বাংলাদেশ খাদ্যে আমদানিনির্ভরতা কমাবে কিভাবে?
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৯:৫৪
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) গত ২৩ ডিসেম্বর ঘোষণা করেছে, বিশ্বে খাদ্য আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে চীন ও ফিলিপাইনের পর বাংলাদেশের অবস্থান। কিন্তু কেন এত আমদানি বিশেষত: খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ভাল থাকার পরও । উদাহরণ স্বরুপ বলা যায় বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে ৩য়, সবজি উৎপাদনে ৩য়, আম উৎপাদনে ৭ম, আলু উৎপাদনে ষষ্ঠ, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম, চা উৎপাদনে ৪র্থ, পাট উৎপাদনে ২য়, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে ৩য় এবং ইলিশ উৎপাদনে ১ম স্থানে অবস্থান করে বিশ্ব পরিমন্ডলে সমাদৃত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের ফলে বর্তমানে বিশ্বে দানাদার শস্য উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। ২০২২ সালে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন। কৃষি, কৃষক ও কৃষিবিদদের নিরলস প্রচেষ্টায় ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কৃষিবান্ধব নীতির কারণে আমরা আজ কৃষিতে সমৃদ্ধ। কৃষির এই অভাবনীয় সাফল্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ১১১টি জাত, পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ধান, পাঠ, গম, তেলবীজ, সবজি ও মসলা জাতীয় শস্যের ১৯টি উচ্চ ফলনশীল এবং উন্নত গুণসম্পন্ন ১১৪টি জাত, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ২১০টির অধিক ফসলের ৭০০টি প্রযুক্তি, তুলা উন্নয়ন বোর্ড ২১টি জাত, বিজেআরআই ৬৪টি জাত, বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক ইক্ষুর ৪৮টি ও সুগারবিট তাল ও স্টিভিয়ার জাত উদ্ভাবন ও উন্মুক্ত করা হয়েছে। জিএমও প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিটি বেগুনের ৪টি জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে এবং বিটি তুলার জাত উদ্ভাবনের কাজ চলমান রয়েছে। দেশী ও তোষা পাটের জীবনরহস্য আবিষ্কারসহ পাঁচশতাধিক ফসলের ক্ষতিকর ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করা হয়েছে। পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের ৫৪টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও উন্মুক্ত করা হয়েছে।
সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের এহেন খাদ্য সাহায্যনির্ভরতা মারাত্মক পর্যায়ে ছিল। ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিলাম প্রথমবারের মতো । এরপর ২০০৯ সালে মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দুই বছরের মধ্যে দেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছিল ২০১১ সালে। এরপর গত ১২ বছরের মধ্যে ২ বছর ছাড়া ১০ বছর দেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে চলেছে কিংবা উদ্বৃত্ত ধান উৎপাদনে সক্ষম হচ্ছে।কিন্তু দুধ,পেয়াজ,মসলা,বিভিন্ন ধরনের ডাল,তৈল বীজ,খেজুর,বিভিন্ন ফল, শাকসবজি, হাঁস-মুরগির, মাংস ইত্যাদিতে বাংলাদেশ কি স্বনির্ভর হয়েছে কি ? সকল সাফল্যগুলোকে খাটো না করেও স্বীকার করতে হবে যে খাদ্য আমদানিতে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ আমদানিকারক হওয়া বাংলাদেশের জন্য একান্তই স্বাভাবিক কি ?
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জানাচ্ছে, বাংলাদেশে মোট ৯ কোটি ৩৩ লাখ টন কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদিত হচ্ছে আর ১ কোটি ২৫ লাখ টন খাদ্য আমদানি করছে।ভোজ্যতেলের চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত খাদ্যের মোট চাহিদার ৯ দশমিক ৩ শতাংশ আমদানি করা হতো, ২০২২ সালে খাদ্য আমদানি চাহিদার ১১ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছে গেছে। জনগণের মাথাপিছু জিএনআই বাড়ার কারণে বাজার থেকে খাদ্য কেনার সক্ষমতা এই তিন বছরে বেড়েছে, তেমনি দেশের খাদ্য আমদানির আর্থিক সক্ষমতাও বেড়েছে। গম, ভোজ্যতেল ও গুঁড়া দুধ আমদানির জন্য সর্বোচ্চ ব্যয় হয়,। মসলাপাতি, ডাল ও ফল আমদানি বাংলাদেশে সাধারন চিত্র, গম উৎপাদন বেশি বাড়ানোর সুযোগ নেই বিধায় ৫৫ থেকে ৬০ লাখ টন গম আমদানি করতে হচ্ছে প্রতি বছর । এক সময় সরিষা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পুর্ণ হলেও বর্তমানে এই ধারা রক্ষা করা যায়নি উচ্চফলনশীল বোরো ধান চাষের কারণে।
বাংলাদেশে আমদানিনির্ভর হওয়ার প্রশ্নে সতর্কও হতে হবে। বিশেষত জরুরি খাদ্যপণ্য আমদানিতে বিশ্ববাজারের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে দেবে ঝুঁকি। যেমন, চালের ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর হওয়া যাবে না। তারপরও কিছু চাল আমরা আমদানি হচ্ছে, গম তো সিংহভাগ আমদানিই করতে হয়, ভোজ্যতেল ও চিনির প্রায় পুরোটা আমদানি নির্ভর। এ দুটি পণ্য আবার আনে মাত্র কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে সিন্ডিকেশনের প্রবণতা থাকা স্বাভাবিক। তাই সার্বিক বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে অনুভব করতে হবে । এই অবস্থা থেকে পরিত্রান পেতে হলে দেশজ উৎপাদন বাড়াতে হবে । জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতি রেখে আগামী দিনে আবহাওয়া-সহনশীল জাতের গম চাষে জোর দিতে হবে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে শীতের দীর্ঘতা ও তীব্রতা বেশি হওয়ায় ওই অঞ্চলে গম আবাদে জোর দিতে হবে।. জরুরি ভিত্তিতে একটি জরিপের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে আগামী মার্চ ও এপ্রিলে কী পরিমাণ চাল আমদানি প্রয়োজন হতে পারে এবং তদনুযায়ী চাল আমদানির পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। গম আমদানিতেও অনুরূপ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কৃষি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
লেখক : গবেষক ও অর্থনীতিবিদ
সারাবাংলা/এজেডএস