Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সৈয়দ মুজতবা আলী: সাহিত্যকে যিনি ‘সাহিত্যের মতো’ ধারণ করেছিলেন

ইমরান ইমন
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৪:২৪

বহু ভাষাবিদ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ঔপন্যাসিক, রম্যরচয়িতা ও ভ্রমণকাহিনিকার সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রয়াণ দিবস আজ। পাণ্ডিত্য এবং রম্যবোধেপূর্ণ এই বিশিষ্ট লেখকের জন্ম ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে আসামের অন্তর্ভুক্ত সিলেটের করিমগঞ্জে। বাবা খান বাহাদুর সৈয়দ সিকান্দার আলী সাব-রেজিস্ট্রার ছিলেন। তার পৈতৃকভিটা মৌলভীবাজার। ৬৯ বছর বয়সে ১৯৭৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি অনন্তলোকে পাড়ি জমান।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন বিশ্বভারতীর প্রথম দিকের ছাত্র। এখানে তিনি সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, ফার্সি, হিন্দি, গুজরাটি, ফরাসি, জার্মান ও ইতালীয় ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এখান থেকে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বৃত্তি নিয়ে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে গবেষণার জন্য তিনি ডি.ফিল লাভ করেন ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৩৪-১৯৩৫ সময়ে তিনি মিসরে কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।

১৯২৭ থেকে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সৈয়দ মুজতবা আলী কাবুলের শিক্ষা দপ্তরে অধ্যাপনা করেন। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে বরোদা কলেজে ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। এখানে তিনি আট বছর কাটান। এরপর দিল্লির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। পরে ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের বগুড়ার আযীযুল হক কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের খণ্ডকালীন প্রভাষকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পঞ্চাশের দশকে কিছু দিন আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন পাটনা, কটক, কলকাতা এবং দিল্লিতে। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শান্তিনিকেতনে প্রত্যাবর্তন করেন। বিশ্বভারতীর ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের রিডার হিসাবে যোগ দেন।

শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় সেখানকার বিশ্বভারতী নামের হাতে লেখা ম্যাগাজিনে মুজতবা আলী লিখতেন। পরে তিনি ‘সত্যপীর’, ‘ওমর খৈয়াম’, ‘টেকচাঁদ’, ‘প্রিয়দর্শী’ প্রভৃতি ছদ্মনামে বিভিন্ন দেশ, আনন্দবাজার, বসুমতী, সত্যযুগ, মোহাম্মদীতে কলাম লেখেন। তার বহু দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন ভ্রমণকাহিনি। লিখেছেন ছোটগল্প, উপন্যাস, রম্যরচনা। তার সাহিত্যকর্মের মধ্যে ‘দেশে বিদেশে’, ‘জলে-ডাঙ্গায়’, ‘পঞ্চতন্ত্র’, ‘ময়ূরকণ্ঠী’, ‘চাচাকাহিনী’, ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’, ‘ধূপছায়া’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘ভবঘুরে ও অন্যান্য’, ‘বড়বাবু’, ‘রাজা-উজির’, ‘হিটলার’, ‘অবিশ্বাস্য, ‘শবনম’, ‘শহর ইয়ার’, ‘তুলনাহীনা’ অন্যতম।

বাংলা সাহিত্যে রসবোধ তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তার সময়কালে তিনি ছিলেন বেশ জনপ্রিয় লেখক, তার তখন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা। কিন্তু লেখালেখির বিষয়ে তার ছিল বেশ অনীহা। তিনি বলতেন, “হাঁড়িতে ভাত থাকলে সাঁওতাল কাজে যায় না। আর আমার ড্রয়ারে টাকা থাকলে আমি লিখি না!”

সাহিত্যের পরিমণ্ডল ছাড়িয়ে ব্যক্তিজীবনেও বেশ রসিক ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। বেশি বয়সে বিয়ে করার কারণে সবসময়ই আক্ষেপ করতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলতেন, “বেশি বয়সে যে পতিরা বিয়ে করে তারা ভীষণ বউপ্রেমী হয়। আমার অবস্থা হয়েছে তেমনই।”

জীবনের সর্বপ্রান্তে সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন উদার ও সকল প্রকার সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। সবসময়ই ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। তিনি নিজেকে সবসময়ই বিশ্বনাগরিক মনে করতেন। তার জীবনাচরণ ও লেখনীতেও তাই ফুটে উঠতো। সৈয়দ মুজতবা আলী সম্পর্কে তার বড়ভাই সৈয়দ মুর্তাজা আলী লিখেছিলেন, “তার সাহিত্যে বিন্দুমাত্র ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছিল না। কিন্তু তার এই উদারতার জন্য গোড়া স্বধর্মীরা তাকে কোনোদিন ক্ষমা করেননি।”

জীবন সম্পর্কে সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, “জীবনই অভিজ্ঞতা আর অভিজ্ঞতাই জীবন। অভিজ্ঞতাসমষ্টির নাম জীবন, আর জীবনকে খণ্ড খণ্ড করে দেখলে এক-একটি অভিজ্ঞতা। এক-একটি অভিজ্ঞতা যেন এক এক ফোঁটা চোখের জলের রুদ্রাক্ষ। সব কটা গাঁথা হয়ে যে তসবি-মালা হয় তারই নাম জীবন।”

বই ও বইপড়ার গুরুত্ব নিয়ে কবি ওমর খৈয়ামের কবিতার ভাবানুবাদ সৈয়দ মুজতবা আলী এভাবে করেছিলেন-

“রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত- যৌবনা- যদি তেমন বই হয়।” তার এই উক্তি বাংলা সাহিত্যে এক কালজয়ী উক্তি।

১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নরসিং দাস পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হন। সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।

আজ সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রয়াণ দিবস। প্রয়াণ দিবসে জানাই শ্রদ্ধার্ঘ্য।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

ইমরান ইমন মুক্তমত সৈয়দ মুজতবা আলী: সাহিত্যকে যিনি ‘সাহিত্যের মতো’ ধারণ করেছিলেন


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর