Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী কেন এত প্রভাবশালী

মারিয়া হক শৈলী
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৫:৫০

পাকিস্তান, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির মধ্য দিয়ে এ রাষ্ট্রটির জন্ম। জন্মের পর থেকেই এ রাষ্ট্রটি নানানভাবে আন্তর্জাতিক মহলে বেশ সাড়া ফেলেছে এবং জন্ম দিয়েছে নানান প্রশ্নের। উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি লাভের দশকের পর দশক পার হয়ে গেলেও দেশটিতে এখনও গনতন্ত্র তার শক্ত ভীত স্থাপন করতে সক্ষম হয়নি কিংবা সেনাবাহিনীর প্রভাবশালী দাপটে, সে প্রচেষ্টাও বারবার ব্যর্থতায় মুখ থুবড়ে পড়ছে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে এ কথা প্রচলিত যে গনতান্ত্রিক প্রকৃয়ায় দেশটি পরিচালিত হলেও, দেশটির প্রধানমন্ত্রী মুলত দ্বিতীয় ক্ষমতাসীন ব্যক্তি। সামরিক বাহিনী কিংবা সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানই মুলত মূল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। বিশেষ করে দেশটির প্রতিরক্ষা ও পরাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত সকল গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রীর চাইতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপই সর্বাধিক।

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, জার্মান রাষ্ট্র গঠনে মূল ভূমিকায় ছিল প্রুশিয়ান সেনাবাহিনী। নাগরিক জীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এদের হস্তক্ষেপ, রাষ্ট্রপরিচালনায় এদের অতিরঞ্জিত প্রভাব এবং সামরিক খাতে বিপুল পরিমান ব্যয়-এই বাহিনীকে বেশ আলোচিত ও সমালোচিত করেছিল। বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্রটিও যেন আঠারো শতকে গঠিত প্রুশিয়ান বাহিনীর নব্য সংস্করণ দ্বারা পরিচালিত। পাকিস্তানে যখনই কোন বেসামরকি দল ক্ষমতায় এসেছে, ইচ্ছে করেই হোক কিংবা অনিচ্ছায়, সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদেরকে আপোস করতে হয়েছে বারবার। এখন প্রশ্ন হলো, ঠিক কখন, কিভাবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী কিংবা সেনাপ্রধানগণ হস্তক্ষেপ করতে শুরু করলেন? এ প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্ম পরবর্তী কয়েক বছরের ইতিহাসে। পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই এ রাষ্ট্রটির নেতারা গনতন্ত্রকে জনপ্রিয় করে তুলতে যতটা না কাজ করেছেন, তার চেয়ে অধিক কাজ করেছেন নিজেদের কর্তৃত্ববাদী শাসনকে বছরের পর বছর টিকিয়ে রাখতে। পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্মের এক বছর পর কর্তৃত্ববাদী শাসক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র মৃত্যু এবং পরবর্তীতে আততায়ীর গুলিতে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের মৃত্যু দেশটির রাজনৈতিক মেধার তালিকাকে প্রায় শূন্য করে দেয়। তাছাড়া কাশ্মীর নিয়ে ভারতের সাথে দ্বন্দও দেশটির নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সংকটে ফেলে। অন্যদিকে কূটনীতি সংক্রান্ত বিষয়ে দেশটির রাজনৈতিক নেতাদের গৃহীত পদক্ষেপও ছিল অসন্তোষজন। সব মিলিয়ে বলা যায়, রাজনৈতিক দূর্বলতাই মুলত সেনাবাহিনীকে ধীরে ধীরে পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করতে বাধ্য করে। পাকিস্তান এর সংবিধানের ২৪৩ নং অধ্যায়ের ১ নং ধারা অনুযায়ী, ‘ফেডারেল সরকারের উপর সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রন থাকবে’। কিন্তু স্বাধীনতার পর সামরিক বাহিনী এ কথা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়। দেশটির সাতাত্তর বছরের ইতিহাসে সামরিক বাহিনীরই শাসনকাল ছিল প্রায় ৩৪ বছর। যার প্রভাব এখনও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দৃশ্যমান।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব বিস্তারের আরো একটি বড় কারণ হলো অর্থনৈতিক দিক দিয়েও এ বাহিনী বেশ সমৃদ্ধ। সামরিক বাহিনী চাইলেই যখন তখন সরকাররের উপর চাপ প্রয়োগ করে বেসামরিক গনতন্ত্রকে কোনঠাসা করে রাখতে সক্ষম। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাষ্ট্রীয় সম্পদেরও বিপুল পরিমান ভাগ পায় এবং এই ভাগের অংশ দিয়েই বিগত কয়েক বছরে তারা তাদের সামরিক কাঠামোকে শক্তিশালী করেছে প্রায় কয়েকগুণ। ২০১৬ সালের পাকিস্তানের সিনেট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭ সালে নিজেদের সামরিক খাতকে আরো শক্তিশালী করতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলারের একটি বাজেট নেয়। যা সে বছর দেশটির সর্বোচ্চ দ্বিতীয় সরকারি ব্যয় ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। তাছাড়া প্রায় অর্ধশতাধিক বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে অংশীদারিত্ব রয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেকারি, চিনির কারখানা, ব্যাংক ও এয়ারলাইন্স সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২০০৮ সালে সেনাখাতে বিনিয়োগ ছিল প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার।

নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে দ্বিতীয় পক্ষকে হস্তক্ষেপ করতে না দেওয়াও মূলত পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীকে বেশ শক্ত অবস্থানে রেখেছে। ইতিহাসের সেই শুরু থেকেই পাকিস্তান সকল রাজনতৈকি ব্যক্তিবর্গই সামরিক বাহিনীকে পূর্ন স্বাধীনতা দিয়েছে এবং তাদের অভন্ত্যরীন কোন বিষয়ে কখনও হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন বোধ করেননি। তাছাড়া পাকিস্তান সামরিক বাহিনীও নানান কৌশলে পাকিস্তানের বেসামরিক রাজনৈতিক ব্যক্তিদের এটা বুঝাতে সক্ষম হয় যে, পাকিস্তানের নিরাপত্তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হলে তাদের পূর্ন স্বাধীনতা দরকার। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, তারা নিরাপত্তা বাস্তবায়নের নামে একটা সময় শাসন ক্ষমতার উপর বেশ প্রভাবশালী এক নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করে।

পাকিস্তানে এ পর্যন্ত তিনটি সফল সেনা অভুত্থ্যান হয়েছে। সর্বশেষ সেনা অভ্যুথ্থানটি ঘটে ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশারফ এর নেতৃত্বে। পরবর্তীতে যদিও তিনি নিজেকে বেসামরিক রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষনা করেন ২০০১ সালে। ২০০৭ সালে তিনি বিদায় নেয়ার পর দেশটিতে বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও, দেশটির গনতন্ত্র পুরোপুরি সামরিক বলয় থেকে বের হতে পারেনি। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ক্ষমতায় আসীন হলেও দূর্নীতির অভিযোগে ক্ষমতা থেকে সড়ে যেতে বাধ্য হন, পরবর্তীতে জনপ্রিয় ক্রিকেটার ইমরান খান যিনি পরবর্তীতে নিজেকে একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রমান করেন তিনিও তার মেয়াদ পরিপূর্ন করতে পারেননি। আইনিভাবে রাষ্ট্রীয় উপহার বিক্রির দায়ে পাকিস্তানের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেয় দেশটির একটি আদালত। পরবর্তীতে তাকে গ্রেফতারও করা হয়। অনেকেই বলছেন যে এসবের পিছনে সেনাবাহিনীই মুলত কলকাঠি নাড়ছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকগন বলছেন, ‘সামরিক বাহিনী এখন তাদের নিয়ন্ত্রন প্রকৃয়ায় পরিবর্তন এনেছে। তারা এখন পাকিস্তানের প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রন করছে যেটা এক প্রকার সামরিক আইন ছাড়াই সামরিক শাসন’।

এ যখন পরিস্থিতি তখন সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচন কমিশনের দেয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২৪৫ আসনে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফের সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছেন। দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের দল পাকিস্তান মুসলীম লীগ এবং তৃতীয় অবস্থানে বিলাওয়াল ভুট্টোর দল। তবে পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন, বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশ চ্যালেন্জের মুখে পড়তে হবে তাদের্। একদিকে প্রশাসনে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ তো অন্যদিকে দূর্বল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, এমতা অবস্থায় নতুন সরকার গঠিত হলে, সে সরকার ঠিক কতটা সফলভাবে এ সকল পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে, এখন তাই দেখবার বিষয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ

সারাবাংলা/এসবিডিই

পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী কেন এত প্রভাবশালী মারিয়া হক শৈলী মুক্তমত


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর