রূপালী ইলিশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৫:৫৮
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রূপালী ইলিশের অবদান অনস্বীকার্য এবং পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মোট মাছ উৎপাদনের ১২ ভাগ আসে ইলিশ মাছ থেকে যার মূল্য প্রায় ৮ হাজার ১২৫ কোটি টাকা, জিডিপিতে ইলিশ মাছের অবদান ১৫ শতাংশ এবং বিশ্বের মোট ইলিশ উৎপাদনের ৭৫ শতাংশ আহরিত হয় বাংলাদেশ থেকেই । প্রতিবছর ইলিশ মাছ রপ্তানি করে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। যদি প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা ও জাটকা নিধন বন্ধ থাকে, তাহলে ২১ থেকে ২৪ হাজার কোটি নতুন পরিপক্ব ইলিশ পাওয়া যাবে। এতে বছরে ৭ হাজার কোটি টাকা মূল্যের ইলিশের বাজার সৃষ্টি সম্ভব হবে বাংলাদেশে। এই প্রাকৃতিক সম্পদ রূপালী ইলিশের আহরণ, পরিবহন, বাজারজাতকরণ ও রপ্তানিসহ এ শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত আছে দেশের ২০ লাখ থেকে ২৫ লাখ মানুষ। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত অর্থবছরে দেশে ৫ লাখ টনেরও বেশি ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে, যা আগামীতে আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৯-১০ শতাংশ হারে বাড়ছে ইলিশের উৎপাদন। গত নয় বছরের ব্যবধানে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। আগামী মৌসুমে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে ৬ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে; যার বাজার মূল্য ১৮ হাজার কোটি টাকা। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্থায়ীভাবে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশের ভৌগোলিক ইলিশ। ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এই মাছ, যা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের এক সুদূরপ্রসারি সাংস্কৃতিক অর্জন। প্যাটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তরের সূত্রমতে, জিওগ্রাফিক্যাল ইনডেক্স বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে ইলিশ মাছের নাম নিবন্ধন ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৯৫ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) বিশ্ব মেধাস্বত্ব কর্তৃপক্ষের (ডব্লিউআইপিআরও) সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করে। তদানুসারে ইলিশ এখন বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য। সাম্প্রতিক কালে ৬৮৩০৫৬৮ টন ইলিশ রপ্তানি করে ৪২৮৭.৬৪ কোটি টাকার সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। সরকারের মৎস্য অধিদপ্তর নানমুখী পদক্ষেপের ফলেই ইলিশের এই উল্লেখযোগ্য উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। তবে চ্যালেঞ্জ রয়েছে যেমন কারেন্ট ও বেহুন্দি জাল দিয়ে মাছ ধরা, যদিও সরকার জাটকা ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
গবেষকগন ও সম্প্রসারন ব্যক্তিবর্গ বলছেন ইলিশের সহনশীল উৎপাদন বজায় রাখার লক্ষ্যে ডিমওয়ালা মা ইলিশ রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই লক্ষ্যে গত ৪ থেকে ২৫ অক্টোবর, ২০২৩ (১৯ আশ্বিন থেকে ৯ কার্তিক, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ) পর্যন্ত মোট ২২ দিন দেশের অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার জলসীমায় মা ইলিশ ধরা নিষেধ করেছিল মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। দেশে ইলিশের অভয়াশ্রম রয়েছে ছয়টি জেলায়,যেমন , ভোলা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর ও শরীয়তপুর যার মোট আয়তন ৪৩২ কিলোমিটার। এই অভয়াশ্রম হলো- বরিশাল বাংলাদেশে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্রের চারটি পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে,যেমন মীরসরাই, চট্টগ্রামের মায়ানি, তজুমুদ্দিন ও ভোলার পশ্চিমে সৈয়দ আওলিয়া, কুতুবদিয়া ও কক্সবাজারের উত্তর কুতুবদিয়া এবং পটুয়াখালীর কলাপাড়া ও লতাচাপালী যা প্রায় ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার উপকূলীয় এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এ চারটি পয়েন্ট ইলিশের এসব অভয়াশ্রম ছাড়াও সব নদ-নদীতে এ নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। ২০২১ সালে প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানের এলাকা নির্ধারণ করা হয়েছে দেশের ৩৮টি জেলা ও ১৭৪টি উপজেলাকে। নিষেধাজ্ঞা আইন অমান্যকারীকে কমপক্ষে ১ বছর থেকে সর্বোচ্চ ২ বছর সশ্রম কারাদন্ড অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দনেডি দন্ডিত করা যাবে।
সম্প্রতি ইলিশ সংরক্ষণের অনেক উপায় বেরিয়েছে ,তাই সবাই ইলিশ চান মৌসুমেই। রসনাবিলাসী বাঙালির কথা, কাব্যে, ইতিহাসে আছে ইলিশের উপস্থিতি। অষ্টাদশ শতকের বিভিন্ন রচনাতেও ইলিশের বিবরণ পাওয়া গেছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে মা ইলিশ ডিম ছাড়ে। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এই বৃষ্টির নাম দিয়েছেন ইলশেগুঁড়ি। প্রাণ-প্রকৃতির কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়। বৃষ্টির সঙ্গেও তাই ইলিশের আছে মাখামাখি। কবি বুদ্ধদেব বসুর ইলিশ কবিতাটি ইলিশপ্রেমিক বাঙালীর প্রিয়। সৈয়দ মুজতবা আলীর ইলিশবন্দনা আমাদের জানা। । শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক ও পৌষ মাসের শুক্লা চতুর্দশী, পূর্ণিমা এবং পূর্ণিমার পরদিন, অমাবস্যা ও অষ্টমীর দিনগুলোতে বছরে কমপক্ষে ৫২ থেকে ৭২ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল। সরস্বতী ও লক্ষ্মী পূজায় জোড়া ইলিশকে ধরা হয় শুভ লক্ষণ। দশমীতে তাই উৎসব জমে জোড়া ইলিশেই। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ইলিশ ধরা জেলেদেরই জীবন আখ্যান। জীবনঘনিষ্ঠ লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এই উপন্যাস লেখার জন্য দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন পদ্মার বুকে।ইলিশের ব্যতিক্রমী জীবনচক্রের সঙ্গেও তুলনা চলে না আর কোনো মাছের। নোনা পানির এই মাছ ডিম পাড়তে নদীর উজান বেয়ে উঠে যায় মিঠা পানিতে। ডিম ছাড়া হয়ে গেলে ফের ভাটিতে ভাসে সাগরের পথে। ডিম ফুটে মাছ হওয়া জাটকাও ছোটে সাগরপানে। জীবনচক্র পূর্ণ করতে ডিম ছাড়ার সময় হলে ফের উঠে আসে নদীর অগভীর পানিতে। ঘণ্টায় ৭১ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে দক্ষ সাঁতারু ইলিশ। ডিম ছাড়ার জন্য এরা এক হাজার ২০০ কিলোমিটার সাঁতরাতেও রাজি। তবে গভীরতা ৪০ ফুট হলে সাঁতরাতে সুবিধা হয় এদের। উজান বাওয়ার সময় কিছু খায় না এরা। ডিম ছাড়ে সাঁতরাতে সাঁতরাতে। একেকটি মাছ ডিম ছাড়তে পারে ২০ লাখ পর্যন্ত। এই সমুদ্রশাবক মাছ জালে ধরা পড়ার পর ডাঙায় তুললে আর বাঁচে না। ইলিশ মাছ প্রজননের ক্ষেত্রে চন্দ্রনির্ভর আবর্তন অনুসরণ করে। প্রতি বছর আশ্বিন মাসের প্রথম উদিত চাঁদের পূর্ণিমার আগের চার দিন, পরের ১৭ দিন এবং পূর্ণিমার দিনসহ মোট ২২ দিন এ নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে।
সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যেখানে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৯ হাজার টন, সেখানে ২২১১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে ৫ লাখ ৫০ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে; যা দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ যার চলতি বাজারমূল্য প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। তথ্য বলছে ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যেখানে ভারতে ২০০২ থেকে ২০১৮ সালে ইলিশের জোগান যেখানে ৫৬ শতাংশ কমেছে, সেখানে বাংলাদেশে ১৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার জাটকা আহরণ নিষিদ্ধ করেছে এবং এর সময়সীমা ও মাছের দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। মৎস্য সংরক্ষণ আইন-১৯৫০ অনুযায়ী ১ নভেম্বর থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ১০ ইঞ্চির ছোট জাটকা ধরা নিষিদ্ধ থাকে। জাটকা আহরণ নিষিদ্ধ সময়ে জেলেদের ভিজিএফ খাদ্য সহায়তা ফেব্্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্তমোট ৪ মাস প্রদান করা হয়। ইলিশ সম্পদ উন্নয়নে প্রতি অর্থবছরে সরকার বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২ কোটি টাকা। বর্তমান অর্থবছরে সরকার বরাদ্দ দিয়েছে ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট বলছে, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত যা বর্তমানে ১৭৪টি উপজেলার প্রবাহিত নদীতে, পদ্মার শাখানদী মহানন্দা থেকে শুরু করে মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেদির হাওরেও ইলিশ মাছ পাওয়া যাচ্ছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, একটি ইলিশ একসঙ্গে কমপক্ষে ৩ লাখ ও সর্বোচ্চ ২১ লাখ ডিম ছাড়ে, এসব ডিমের ৭০-৮০ শতাংশ ফুটে রেণু ইলিশ হয় যার সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত টিকে থাকে, যা পরবর্তী সময়ে ইলিশে রূপান্তরিত হয়। ইলিশ দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশে রপ্তানি ছাড়াও ইলিশের নডুলস, স্যুপ ও পাউডার তৈরির প্রযুক্তি আবিষ্কারের ফলে ইতোমধ্যে তা বাজারজাতকরণ শুরু হয়েছে।
সরকার ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের আওতায় ২৪৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে বলে গত বছর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন হয়েছে। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, প্রকল্পের অনুমোদনের সময় ইলিশের উৎপাদন বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে খাঁচায় অন্যান্য মাছ চাষের জন্য প্রশিক্ষণের তাগিদ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ইলিশ আহরণে নিয়োজিত ৩০ হাজার জেলে পরিবারের জন্য সৃষ্টি করা হবে বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ। জেলেদের ১০ হাজার বৈধ জাল বিতরণ ও প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা হবে। । প্রকল্পের আওতায় ইলিশের ছয়টি অভয়াশ্রমে সুরক্ষা দেয়া হবে। নিম্ন মেঘনা নদী, তেঁতুলিয়া নদী, আন্ধারমানিক নদী, নিম্ন পদ্মা নদীতে নির্দিষ্ট সময়ে মা ইলিশ আহরণ বন্ধ করা হবে। ইলিশ অভয়াশ্রম সংলগ্ন ১৫৪টি ইউনিয়নের জেলেদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে ১ হাজার ২৩২টি সভা, ৬০টি নানা ধরনের কর্মশালা, অভিযান পরিচালনার জন্য ১৯টি বোট কেনাসহ মা ইলিশ সংরক্ষণে ১৩ হাজার ৪০০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত ও জেলে পরিবারে বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য ১৮ হাজার জেলেকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। পদ্মার ইলিশ সম্পর্কে মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের ইলিশ বিষয়ক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিসুর রহমান বলেন, ইলিশ সারা বছর সাগরে থাকলেও শুধু ডিম ছাড়ার জন্য নদীতে আসে। নদীর ইলিশ একটু বেটেখাটো, তবে সাগরের ইলিশ হবে সরু ও লম্বা; পদ্মা নদীর ইলিশ একটু বেশি উজ্জ্বল, গায়ের রং চকচকে ও বেশি রূপালী হয়। অন্যদিকে সাগরের ইলিশ তুলনামূলক কম উজ্জ্বল; পদ্মা মেঘনা অববাহিকার ইলিশ মাছের আকার হবে পটলের মতো, অর্থাৎ মাথা আর লেজ সরু আর পেটটা মোটা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে লেজের একটু উপর থেকে মাছটা গোল হতে শুরু করে; ইলিশের আসল পার্থক্য বোঝা যাবে খাওয়ার সময়। পদ্মার ইলিশের যে স্বাদ আর গন্ধ তার সঙ্গে অন্য কোন নদীর বা সাগারের মাছের তুলনাই চলে না।
লেখক: সাবেক ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ, সিটি ইউনিভার্সিটি
সারাবাংলা/এসবিডিই
ড. মিহির কুমার রায় মুক্তমত রূপালী ইলিশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে