পাঠ্যবই ঘিরে ষড়যন্ত্রের জাল
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৫:৫০
ষড়যন্ত্র যেন এদেশের রাষ্ট্রীয় অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। এর বিষাক্ততা যেন রন্ধ্রে-রন্ধ্রে গ্রথিত।এটি যেন এখন জাতীয় সমস্যার প্রতিরূপ ধারণ করেছে। বলাবাহুল্য, আমাদের বীরোচিত মহান স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্রের সুপ্তবীজের অংকুরোদগম সূচিত হতে থাকে। কখনো-কখনো তা রাজনৈতিক সংকটকে ছাপিয়ে রাষ্ট্রীয় সংকটের রুপ পরিগ্রহ করেছিল। উল্লেখ্য, একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পরিগঠন কল্পে বঙ্গবন্ধু যখন যারপরেনাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তার শাসনামলকে বিতর্কিত করার হীন চক্রান্তে পশ্চাদে সৃষ্ট বিচিত্র ঘৃণ্য ঘটনাপ্রবাহ সে সকল বিশেষায়িত ষড়যন্ত্রেরই তিক্তময় সাক্ষ্য বহন করে। এর মধ্যে কৃত্রিম ভাবে সৃষ্ট ‘৭৪ এর কু পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষ ছিল ঘৃণ্যতম ষড়যন্ত্র। মুলতঃ দেশকে দেশী-বিদেশী যৌথ ষড়যন্ত্রের কোপানলে ফেলে বঙ্গবন্ধুর অগ্রগামী শাসনামলকে জনগণের মাঝে চরম বিতর্কিত করে ‘৭৫ এর বর্বরতম প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করা হয়েছিল।
এদেশের গণমানুষের মেধা-মনন থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা চিরতরে মুছে দেয়ার ষড়যন্ত্রে ‘৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ প্রায় একুশ বছর ব্যাপী জাতীয় সংবিধানের মৌলিক চেতনায় আঘাতের মধ্যদিয়ে পাঠ্যপুস্তকে জাতীয় ইতিহাসের বিকৃতি ও ঐতিহ্যের বিলুপ্তি ঘটানো হয়। সময়ের আবর্তে ষড়যন্ত্রের স্বরূপ তার বৈশিষ্ট্য পাল্টে আরো শাণিত ও পরিব্যপ্ত হয়েছে। আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে তথ্য-যোগাযোগের অবাধ প্রবাহের প্রভাবে ষড়যন্ত্র এখন দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে। বর্তমানে গুজব ও বিকৃতি সংমিশ্রিত হয়ে তা সাইবার ভিত্তিক তথ্য সন্ত্রাসে রুপ নিয়েছে; অর্থাৎ, অপচর্চা এখন দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক ভাবেও চর্চিত হচ্ছে। দুশ্চিন্তিত বিষয় হলো, ষড়যন্ত্র বর্তমানে বুদ্ধিবৃত্তিক কূটকৌশলে অলংকৃত হয়ে তা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে উন্নীত হয়েছে যা সমসাময়িক কালের বহু অপ্রিয়কর ঘটনাপ্রবাহের দ্বারা প্রতীয়মান হয়েছে এবং হচ্ছে; দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংঘটিত পূর্বাপর ঘটনাবলী তার জ্বাজ্বল্য উদাহরণ।
বিষয়গুলো সচেতন মহলকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। মনে হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি যখনই সরকারে থাকে তখনই ষড়যন্ত্রের অক্টোপাস তার ভয়ংকর অষ্টবাহু মেলে তাকে চেপে ধরতে চায়! সাম্প্রতিককালে নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার সিন্ডিকেট ও পাঠ্যক্রম (কারিকুলাম) সংশ্লিষ্ট বিতর্কিত বিষয়াবলী সেই দুরভিসন্ধিমূলক ষড়যন্ত্রেরই ইঙ্গিত দেয়। ইস্যু দুটি বর্তমানে জনমনে নাভিশ্বাস তুলে ছেড়েছে। বিচলিত করে তুলেছে সরকারকেও।
বর্তমান সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের ক্ষমতাকালে বহুবিধ সাফল্যের মধ্যে ন্যাশনাল কারিকুলামের আওতায় পাঠ্যবই ব্যবস্থাপনা ছিল বেশ ঈর্ষনীয়। বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের মাঝে নতুন পাঠ্য বই বিতরণ ছিল দারুণ জননন্দিত উদ্যোগ।কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে একের পর এক বিতর্কিত বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি সেই কৃতিত্ব তথা নন্দিত সাফল্যকে ম্লান করে ফেলছে। উল্লেখ্য, গত বছর ৬ষ্ঠ শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন’ বইতে ‘খুঁজে দেখি মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস ‘ শিরোনামের অধ্যায়ে চার্লস ডারউইন এর মানব সৃষ্টির বিবর্তন তত্ত্ব-বাদ নিয়ে দেশ ব্যাপি ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে পরিণত করে নোংরা রাজনীতিতে মেতেছিল। বিষয়টিকে তারা বিকৃতভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালিয়েছিল। শুধু তাই-ই নয়, বইটিতে ‘ছেলে বেলার মুজিব’ শিরোনামের অনুচ্ছেদে বঙ্গবন্ধুর বাবার নামের শুরুতে ‘শেখ’ শব্দটি বাদ দিয়ে শুধু ‘লুৎফর রহমান’ লেখা হয়েছিল। তার পেশার তথ্যে ‘সরকারি সেরেস্তাদার’ এর পরিবর্তে ‘কেরানি’ লিখে বিকৃত করা হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘বিবর্তন বাদ’ এর মতো এমন হাই-কনসেপ্ট এতো নিম্ন শ্রেণির জন্য পাঠ্য উপযোগী ছিলনা। এছাড়াও ৭ম শ্রেণির বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের অনুচ্ছেদে ন্যাশনাল জিগ্রাফিক এডুকেশনাল সাইট হতে হুবহু অনুকরণ করে বাংলা অনুবাদ করা হয় যা চৌর্যবৃত্তির সামিল। বইটির সম্পাদনার দায়িত্বে নিয়োজিত জনপ্রিয় লেখক ও অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং অধ্যাপক হাসিনা খান অকপটে তাদের দায় স্বীকার করেছিলেন। বইটি রচনাসহ আনুষঙ্গিক কাজে নিয়োজিত কর্তাদের প্রতি তারা দু’জন বেশ বিশ্বাসী ও নির্ভরশীল ছিলেন বিধায় চুড়ান্তকরনের প্রাক্কালে নীরিক্ষনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি। পরবর্তীতে বিতর্কিত বিষয়াবলী বাতিল পূর্বক নতুন সংস্করণের মাধ্যমে বইগুলো পরিমার্জন করা হয়। বিষয়াবলী ঘিরে তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রী ডা: দীপু মনি দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন। জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনারও ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তা হিম ঘরে চলে যায়। তদন্তের কার্যক্রম ও ফলাফল আজো আলোর মুখ দেখেনি।
এখানেই শেষ নয়; ৭ম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামজিক বিজ্ঞান অনুশীলন’ বইতে ‘সরকার পরিচালনায় নারী ‘ শিরোনামের অধ্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী ও শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি’র নাম ও ছবি ব্যবহার করা হয়। দেশে আরো প্রখ্যাত নারী নেতা থাকা সত্ত্বেও পাঠ্যপুস্তকের পাতায় খোদ শিক্ষামন্ত্রীকে উপস্থাপন করাটা তখন বেশ সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। পরে জানা যায় তার অগোচরেই তার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। মুলতঃ তাকে খাটো করতেই এমন কূটকৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল। পাঠ্যবইয়ে এভাবে বিচিত্র অসংগতির মধ্য দিয়ে এন সি টি বি ২০২৩ সাল পার করেছিল।
ধারনা করা হয়েছিল ইত্যপূর্বের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী পাঠ্যক্রম নির্ভুল ও সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে ওঠবে। কিন্তু একই পরিস্থিতি পুনরায় সংঘটিত হলো। এবার ২০২৪ সালে প্রণিত ৭ম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ের ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা ‘ অধ্যায়ে ‘শরীফা’ ও ‘শরীফার গল্প’ অনুচ্ছেদে আমাদের সমাজের ‘থার্ড জেন্ডার’ বা ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ বা ‘ হিজড়া’ গোষ্ঠীর মানবিক ও সামাজিক আবেদন উপস্থাপন করতে যেয়ে ধর্মান্ধগোষ্ঠী কর্তৃক সেখানে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ বা ‘লিঙ্গান্তর’ শিক্ষার অভিযোগ ওঠে। পরবর্তীতে তাতে সমকামিতার মনগড়া ঘৃণ্যতম বিকৃতির প্রলেপ লাগিয়ে জঘন্য গুজবের মাধ্যমে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়। মুলতঃ গল্পটির কোথাও ট্রান্সজেন্ডার ও সমকামিতার উল্লেখ না থাকলেও গল্পটির শরীফা চরিত্রের দুইটি লাইনে প্রকাশিত মনস্তাত্ত্বিক অভিব্যক্তির অস্পষ্টতা (না হিজড়া, না স্বাভাবিক) ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্রের পালে প্রবল বাতাস যুগিয়েছে। সরল-সাধারণ মানুষ তাদের এই প্রোপাগাণ্ডার কোপানলে পরে বেশ সমালোচনা মুখর হয়ে ওঠে।
আসলে আমাদের সমাজে অবহেলিত হিজড়া গোষ্ঠী সম্পর্কে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের মাঝে একটি ইতিবাচক ‘মনস্তত্ব’ সৃষ্টি করার লক্ষ্যেই এই গল্পের অবতারণা। তবে গল্পটির মূল উদ্দেশ্য ঠিক রেখে এর শব্দ চয়ন আরো সহজ-শোভন ভাবে উপস্থাপন করে শিক্ষার্থী উপযোগী হতে পারতো বৈকি। কিন্তু এখানে সেই সতর্কতা অবলম্বন করা হয়নি। অর্থাৎ, বিষয়টি গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ধর্ম কেন্দ্রীক একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার লক্ষ্যে পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসাবে অত্যন্ত সূক্ষ্ম-কূট ভাবে গল্পটিকে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিষয়টি পরে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়।
এখানেই শেষ নয়! ৬ষ্ঠ শ্রেণির কিছু ইসলাম শিক্ষা বইয়ের ১২- ২৭ পৃষ্ঠা পর্যন্ত দেব-দেবীর ছবি ও বিবরণ মুদ্রিত হয়েছে। ৯ম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ের ‘মিলে মিশে নিরাপদ বসবাস’ অধ্যায়ের ‘নগর বসতি’ অনুচ্ছেদে প্রচ্ছদ মানচিত্রে ‘ফিলিস্তিন’ নাম বাদ দিয়ে ‘ইসরায়েল ‘ এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়গুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ সমালোচনার ঝড় তুলছে। এ দুটি ঘটনায় সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্র কে উস্কে দেওয়া হয়েছে বলে সচেতন মহল মনে করে।
এছাড়াও ৯ম শ্রেণির ‘বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের ‘বাস্তুতন্ত্র’ অধ্যায়ের ১২.৭ অনুচ্ছেদের লেখাগুলি ভারতের কোচিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘বাইজুস’ এর ওয়েবসাইট থেকে বাংলায় হুবহু নকল করা হয়েছে। বিষ্মিত জিজ্ঞাসা হলো, পুস্তক প্রণয়নে ও প্রকাশনে অনেকগুলো বিশ্বস্ত ও বিশেষজ্ঞ ধাপ পেরিয়ে আসার পরেও কিভাবে এতো অসংগতি ঘটলো? পর্যবেক্ষণে দেখা যায় এগুলো কোনো মুদ্রণ বিষয়ক ত্রুটি নয়। এগুলো পরিকল্পিত সংযোজন! বলাবাহুল্য, ২০২৩ সালের বই গুলোতে বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছিল জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ইস্যু সৃষ্টির লক্ষ্যে; খোদ সরকারি মহল থেকে এই অভিযোগ উঠেছিল। নির্বাচন বিরোধী দলগুলোও বিষয়টি নিয়ে রাজনীতির পানি বেশ ঘোলা করেছিল। বিগত দিনের মতো এবারও বিতর্কিত বিষয়াবলী সংশোধন করে পরিমার্জন করা হবে মর্মে শিক্ষা মন্ত্রী সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে ‘শরীফ-শরীফা’ বিতর্ক অবসানে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠিত হলেও শ্রেণিভেদে পাঠ্যপুস্তকের সামগ্রিক অসংগতির কারণ ও তার দায়ভার নিরুপনে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি।
বছরের শুরুতেই এন সি টি বি থেকে দেশব্যাপি বই সরবরাহ করা হলেও অনেক প্রতিষ্ঠানে সময়মতো পৌঁছায়নি মর্মে অভিযোগ আছে। ‘শরীফ-শরীফা’ গল্পের বিতর্কের সুযোগ নিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বই বিতরণে অনীহা সৃষ্টি করতে পারে বলে এন সি টি বি কর্তৃপক্ষ সন্দেহ প্রকাশ করেছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকরাও এ সকল ষড়যন্ত্রের অনুষঙ্গী কিনা তা খতিয়ে দেখে যথাযথ পদক্ষেপ নওয়া উচিৎ বলে সচেতন মহল মনে করে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, উল্লেখিত সামগ্রিক অসংগতিগুলো বিশেষ পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র! যদি তাই হয় তবে তা সুচারু রুপে খতিয়ে দেখে জড়িত-দোষীদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির আওতায় আনা জরুরি। শুধু রাজনৈতিক স্বার্থে নয়, জাতীয় স্বার্থেও তা করা উচিৎ। অন্যথায় বারংবার একই ঘটনাবলীর পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। ফলে, ক্ষতিগ্রস্থ হবে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নশীল মননশীলতা যার নেতিবাচক প্রভাব সমগ্র জাতির ওপরই বর্তাবে।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই