Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভালোবাসা দিবসের আড়ালে হারিয়ে গেছে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস

রাশেদুজ্জামান রাশেদ
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৭:২৫

আজি দখিন-দুয়ার খোলা/ এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো…’ এভাবেই বসন্তকে আহ্বান করেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই বসন্ত এসে গেছে। আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে। কিন্তু বসন্ত প্রথম দিনেই বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের জন্য এক কলঙ্কময় দিন। ১৪ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসাবে সারা বিশ্বে পরিচিত হলেও, আমাদের দেশের ইতিহাসে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি। কিন্তু খুব আশ্চর্যের বিষয় ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে রাজপথ কিন্তু তা কেউ মনে রাখে না। অথচ উড়ে এসে জুড়ে বসা বিশ্ব ভালোবাসা নিয়ে মাতিয়ে আছে ছাত্র সমাজ। ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ঝরেছিল শিক্ষার্থীদের রক্ত। কেন রক্ত দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা? এমন প্রশ্ন কী আমাদের শিক্ষার্থীদের ভিতর জাগ্রত হয়? উত্তর খুব স্পষ্ট শিক্ষার্থীর রক্তে রঞ্জিত ইতিহাস রাষ্ট্র কখনও বুঝাতে দিতে চায় না। তাহলে শিক্ষার্থীরা জানবে কীভাবে? কথার প্রসঙ্গে যদি বলা হয় তাহলে ধরে নেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির কোনো শিক্ষার্থীকে যদি প্রশ্ন করা হয় বাবা বলো তো বিশ্ব ভালোবাসা দিবস কবে। সেই শিশু শিক্ষার্থী অকপটে তার সঠিক উত্তর বলে দিতে পারবে। কিন্তু যখন বলা হবে শিক্ষা দিবস কবে? তখন সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না। এমনকি কলেজ পড়ুয়া দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও বলতে পারে না। স্বাধীন দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা কোন পথে। শিক্ষা যে কোনো পণ্য নয়, শিক্ষা শিক্ষার্থীদের অধিকার এ কথা রাষ্ট্র বারবার ভুলে রাখতে চায়। ফলে একই ধারার বিজ্ঞানভিত্তিক গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতির দাবিতে রাজপথে শিক্ষার্থীদের গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস আজ চাপা পড়ে আছে।

বিজ্ঞাপন

১৪ ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব ভালোবাসা পালন না করে কেন ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করব? ভালোবাসা আদান-প্রদান করতে তো কোনো দিনক্ষণের প্রয়োজন পড়ে না কারণ প্রিয়জনের প্রতি মানুষের ভালোবাসা থাকে অবিরাম। ফলে ভালোবাসা কোন দিবস, মাস, বছর কিংবা কালে আবদ্ধ নয়। সবসময়ই থাকে প্রিয়জনের জন্য এক রাশ ভালোবাসা। এটি সার্বজনীন। ভালোবাসা দিবসে প্রচার করে পুঁজিবাদী গোষ্ঠী সাধারণ জনগণের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর বাণিজ্যিক কৌশলের প্রধান হাতিয়ার বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। তাই সচেতন হতে হবে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস না বলে ভাবতে হবে আমাদের শিক্ষার অধিকারের কথা। শিক্ষা আমাদের অধিকার সেই অধিকার টুকু রাষ্ট্র দিতে পারে কী তা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে।

বিজ্ঞাপন

তৎকালীন পাকিস্তান আমলে যদি ইতিহাস দেখি তাহলে দেখতে পাব ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল শিক্ষাকে সর্বজনীন অধিকার। সেই সময়ে সামরিক শাসন আইয়ুবের খানের শিক্ষাসচিব ড. এস এম শরিফ অর্থাৎ শরিফ কমিশন রিপোর্ট কয়েকটি সুপারিশ করেছিল তা হল শিক্ষার ব্যয় বৃদ্ধি এবং উচ্চশিক্ষা সংকোচনের জন্য উদ্দেশ্যমূলক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যেমন: ডিগ্রি কোর্স দুই বছর থেকে তিন বছর করা, কলেজ পর্যায়ে বছর শেষে পরীক্ষা ও তার ফলাফলের ভিত্তিতে পরবর্তী বর্ষে উন্নীত হওয়ার শর্ত, অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সে ভর্তির ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী পরীক্ষার ফলাফলের শর্ত। এগুলোকে ছাত্ররা সাধারণ পরিবারের সন্তানদের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ বন্ধ করার ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে। ফলে শরীফ কমিশনের ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষার অধিকার আদায়ের জন্য ঢাকার রাজপথে তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকগোষ্টির পুলিশের গুলিতে জীবন উৎস্বর্গ করেছিল মোস্তফা ওয়াজিল্লাহ, বাবুল প্রমুখ ছাত্র নেতারা।

সামরিক শাসক আইয়ুব খানের শাসনামলে শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতি অনুসরণ করে হাটতে চেয়েছে স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খানের মজিদ কমিশনের শিক্ষানীতি। তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে যে পাকিস্তানের শিক্ষানীতি রক্ত দিয়ে বাতিল করছে সেই শিক্ষানীতি বাংলাদেশে চালু করা কী উচিত? তৎকালীন সামরিক শাসক স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান ১৯৮২ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর একটি নতুন শিক্ষানীতির প্রস্তাব করেন। সেখানে প্রথম শ্রেণী থেকেই আরবি ও দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য মাপকাঠি করা হয় মেধা অথবা পঞ্চাশ শতাংশ ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতা। ফলে সেই ধর্মভিত্তিক ও বাণিজ্যিকীকরণ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ১৭ সেপ্টেম্বর আন্দোলনের বিষয়ে একমত হয় ছাত্র সংগঠনগুলো। তারপর শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন, কালক্রমে যেটি গণআন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। ছাত্রসমাজের দাবি ছিল একটি অবৈতনিক বৈষম্যহীন শিক্ষানীতি। কিন্তু ড. মজিদ খান যে নীতি ঘোষণা করেন, সেখানে বাণিজ্যিকীকরণ আর ধর্মীয় প্রতিফলন ঘটেছে বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন। তাই শুরু থেকেই ওই নীতির বিরোধিতা করতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে স্মারকলিপি দিতে শিক্ষার্থীরা মিছিল করে সচিবালয়ের দিকে যাবার সময় পুলিশ টিয়ার গ্যাস, জলকামান, অবশেষে নির্বিচারে গুলি চালায়। ফলে লুটিয়ে পড়েন শহিদ দিপালী সাহা, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ূব, কাঞ্চনসহ নাম না জানা অসংখ্য শহিদ। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তোপের মুখে বাধ্য হয়েছিল বাতিল করতে কুখ্যাত মজিদ কমিশনের শিক্ষানীতি। সেই কারণেই ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বৈরাচার ছাত্র প্রতিরোধ দিবস শুধু বাম প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ছাড়া কোনো ছাত্র সংগঠন বা রাষ্ট্র এই দিবস পালন করেন না। তাই ভালোবাসার ফুল তাদের চরণে দেই যারা শিক্ষার রক্ষার আন্দোলন করতে গিয়ে রাজপথে জীবন দিল। ভালোবাসার প্রাণ ওই শহীদদেরা। সেই ভালোবাসার কল্যাণেই এই মাটির ইতিহাস কখনোই ভুলবার নয়। স্বাধীন জাতি হিসাবে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন এবং মজিদ কমিশনের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একই ধারায় বিজ্ঞান ভিত্তিক গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতির লক্ষ্য কতটা অর্জিত হলো, শিক্ষাব্যবস্থায় কী কী দুর্বলতা ও অসংগতি রয়ে গেছে, তা রাষ্ট্রকে বিশ্লেষণ করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। তা না হলে শহীদের রক্তের ঋণ অশ্রদ্ধা করা হবে। ছাত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে রাজপথে থাকতো শিক্ষার্থীরা যার উজ্জ্বল উদাহরণ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলন, ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটা বিরোধী ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রসমাজ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু যখন যেই সরকার ক্ষমতায় আসে সেই দলের সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের নেতারা যখন হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিতে জড়িয়ে পড়েন; তখনই সবাই ছাত্র রাজনীতির নামে ভয় পায়। আর কেউ কেউ ছাত্র রাজনীতি বন্ধের শোরগোল তুলেন। কিন্তু যুবলীগ নেতারা যে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িত, কেউ কি একবারও যুব রাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছেন? আবার ধরেন পুলিশ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও সাংবাদিক সহ বিভিন্ন পেশার মানুষের দুর্নীতি খবর পাই তখন কী কোনো পেশা বন্ধের দাবি উঠেছে? উত্তর হচ্ছে বন্ধের কোনো দাবি উঠে নি। কিন্তু ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হবে কেন? যাদের সন্ত্রাসী ছাত্রসংগঠন তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত। ছাত্র রাজনীতিকে বলা হয় নেতৃত্ব তৈরির বাতিঘর। সেই বাতিঘর তৈরীর কাজ রাষ্ট্রকেই করতে হবে। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের আড়ালে যেন পড়ে না থাকে স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র প্রতিরোধ দিবস।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

ভালোবাসা দিবসের আড়ালে হারিয়ে গেছে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস মুক্তমত রাশেদুজ্জামান রাশেদ

বিজ্ঞাপন

মাদকের টাকার জন্য মা'কে খুন
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৭

আরো

সম্পর্কিত খবর