মহান একুশে ফেব্রুয়ারি
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৮:৫১
মহান একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাঙালি জাতির এক শোকাবহ দিন। ১৯৫২ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির দামাল ছেলেরা বাংলা ভাষার দাবিতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলা ভাষার মান-মর্যাদা রক্ষা করেছে। বাঙালিরা প্রমাণ করেছে যে তারা ভীরু নয়।
তাদের মায়ের মুখের ভাষা বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে যে কোনো মূল্য দিতে প্রস্তুত। একুশের চেতনা থেকে পরবর্তীতে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি, পেয়েছি স্বাধীন দেশ, একটি লাল সবুজ পতাকা। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলেও এদেশের আপামর জনগোষ্ঠীর লাভ হয়নি। বর্তমান বাংলাদেশের অংশটি পূর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানীরা রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করে শাসনের পরিবর্তে শোষণ শুরু করে। তাদের শাসন ও শোষণের অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে গেলেই তারা বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নির্বিচারে এদেশের বাঙালিদের গুলি করে হত্যা করে। এভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এ এদেশের অগণিত মানুষ বিভিন্ন সময়ে নিহত হয়েছে। বাঙালিরাও এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার পর বাঙালিদের মাতৃভাষা বাংলার ওপর আঘাত হানা ছিলো অন্যতম।
পাকিস্তান জাতির জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকাতে এসে ঘোষণা দেয় যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র বক্তব্যের বিরুদ্ধে বাঙালিরা প্রতিবাদ- আন্দোলনে নেমে পড়ে এবং যেকোনো ধরনের সভা, সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ঢাকার রাজপথে ১৪৪ ধারা জারি করে৷ সেদিন বাঙালিরা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে ঢাকার বিভিন্ন রাজপথে বাংলা ভাষার দাবিতে মিছিল করেছিলো। পুলিশ মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে প্রথমে লাঠিচার্জ ও পরবর্তিতে গুলি করে। পুলিশের গুলিতে বরকত,সালাম, রফিক, শফিক জব্বারসহ আরও অনেক নাম না জানা ব্যক্তি শহীদ হয়েছিলেন। বাংলা ভাষা তাঁদের এত প্রিয় ছিলো যে তাঁরা জীবন দিয়ে বাংলা ভাষার মান-মর্যাদা রক্ষা করেছে। প্রতি বছর বাঙালিরা এই দিনটাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। তাদের অবদানের কথা বাঙালি জাতি কোনোদিন ভুলতে পারেনা। ভাষা শহীদদের রক্তে বাংলার মাটি রঞ্জিত হয়েছে। তাদের রক্ত বৃথা যায়নি। ভাষা শহীদদের জন্য আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারছি, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করার সুযোগ পাচ্ছি। সেদিন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। অবশেষে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে বাংলা ভাষাকে মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো নজির নেই যে, মাতৃভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। মাতৃভাষার জন্য বাঙালি জাতিরা প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে তা বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে।
মহান একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু বাঙালিরাই পালন করেন না। বিশ্বের সমস্ত মানুষ দিনটাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। এদেশের গন্ডীর বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছে এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে রূপলাভ করেছে। যে কোনো মানুষের কাছে তার মাতৃভাষা সবচেয়ে প্রিয় কিন্তু বিশ্বের সকল ভাষাভাষীর মাতৃভাষাকে সম্মান জানানোর দিন। আমরা বিশ্বের সকল মানুষের মাতৃভাষাকে সম্মান জানাবো, শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখবো।
আমরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে আমাদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করেছি। তাই আমরা মাতৃভাষাকে সর্বস্তরে চালু করবো, বাংলা ভাষার মান-মর্যাদা রক্ষা করে চলবো। বাংলা ভাষার উপর যদি কেহ আঘাত হানে তা হলে রক্ষা করার চেষ্টা করবো। আমরা যদি সর্বস্তরে মাতৃভাষা চালু করতে পারি তাহলে যারা মাতৃভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন, তাদের পবিত্র আত্মা শান্তি পাবে। এজন্য সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে, সবার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে হবে তাহলে আমরা সফল হতে পারবো।
আমরা এখনও সর্বস্তরে মাতৃভাষা চালু করতে পারিনি। বাংলাদেশের অনেক অফিস-আদালতে ইংরেজি ভাষার প্রচলন রয়ে গেছে। ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা লাভ করে গর্ববোধ করার মানসিকতা দেখা যায় বাঙালিদের মাঝে। যা আমাদের কারোরই কাম্য নয়।
ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনারে প্রতি বছর ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। সবার কন্ঠে ধ্বনিত হয় —” আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি!” সত্যি তাই, যতদিন পৃথিবীতে মানবজাতি বেঁচে থাকবে ততদিন মানবজাতির হৃদয়ে ভাষা শহীদদের নাম অক্ষয় হয়ে থাকবে। আমরা নব প্রজন্মের কাছে ভাষা শহীদদের অবদান তুলে ধরবো এবং সেইসাথে পৃথিবীর সব ভাষাভাষীদের মাতৃভাষাকে সম্মান জানাবো। বাংলাদেশের প্রতিটি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ব বিদ্যালয় চত্বরে শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে, যা কালের সাক্ষী হিসাবে রয়ে যাবে যুগ যুগ ধরে…..
লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
সারাবাংলা/এসবিডিই