Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভাষাদূষণ আমাদের নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী

রাশেদুজ্জামান রাশেদ
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৬:৪৫

একুশ বাঙালির মননের বাতিঘর। একুশ মানে সংগ্রামী ইতিহাস। পৃথিবীতে একটাই ইতিহাস আছে যারা নিজেদের ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিয়েছিল তারা হলেন বাঙালি জাতি। তাই একুশ মানে সকালের সূর্য। একুশ মানে ধর্ম ব্যবসায়ী দাঁত ভাঙা জবাব দেওয়ার গল্প। একুশ মানে অস্তিত্বের লড়াইয়ের গল্প। যে লড়াই করেছিল বাঙালির বীর সৈনিকরা। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, কেমনে ভুলি তাদের স্মৃতি। বারবার একুশ আসে ভাষা চেতনায় গোটা জাতিকে শাণিত, উদ্ধুদ্ধ করতে। তাই তো একুশের ডাকে ফিরে আসে নবজীবনের গান। আমরা বাঙালি এক কণ্ঠে উঠি ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা।’

বিজ্ঞাপন

দুঃখের বিষয় ভাষার জন্য যারা রক্ত দিল, জীবন দিল কিন্তু এদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ এখনও অক্ষর জ্ঞানহীন। রাজপথে নিজের অধিকারের দাবির স্লোগান দিতে পারে না। তখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে ভাষা আন্দোলন কি শেষ হয়ে গেছে? না শেষ হয়ে যায়নি। কারণ যতদিন একজন মানুষও নিরক্ষর থাকবে ততদিন ভাষা আন্দোলন চলিয়ে যাওয়া উচিত নয়।অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সাংস্কৃতিক আন্দোলন বাঙালির গর্ব একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশে ফেব্রুয়ারি মানে মুক্তি, একুশে ফেব্রুয়ারি মানে চেতনা। একুশে ফেব্রুয়ারি মানে দেশপ্রেম, একুশে ফেব্রুয়ারি মানে রক্তে রঞ্জিত, ভাষা সৈনিকের রাজপথ।

বিজ্ঞাপন

আবারও দুর্ভাগ্যজনক ও লজ্জাজনক বিষয়। আমরা প্রতিনিয়ত কথাবার্তায় ভাষাদূষণ করছি। আমাদের যানবাহনের গাড়ির নম্বর ফলক ইংরেজি লিখি। অভিজাত হোটেল-রেস্তোরাঁ, বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিংবা শিল্প-কারখানার সাইনবোর্ড এখনো ইংরেজিতে লেখা হয়। এমন কি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোতে চলছে ইংরেজি ব্যবহার। ফলে দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করা যায়নি। অথচ ১৯৮৪ সালে এক নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছিল, সব সাইনবোর্ড এবং গাড়ির ফলক বাংলায় হতে হবে। তবে এ সকল আইন কানুন শুধু খাতা কলমে লিপিবদ্ধ কবে হবে তার বাস্তবায়ন?

শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছিলেন-‘ভাষাদূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী’। আমাদের দেশে যেমন নদীদূষণ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঠিক তেমনি ভাষাদূষণ দুটোই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। বাংলা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে কিন্তু বাংলা ভাষার চর্চা সঠিকভাবে করতে পারছি না। বাংলা বানানের ভুল প্রয়োগ কবে বন্ধ হবে?

ঐতিহাসিক ভাষাবিদের মতে, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বংশ থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি। ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানী ড.মুহম্মদ শহীদল্লাহ আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর পূর্বে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। প্রায় আড়াই হাজার বছর খ্রিস্টপূর্বাব্দে মূল ভাষা থেকে যেসব প্রাচীন ভাষার সৃষ্টি হয়, তার মধ্যে অন্যতম হল আর্য ভাষা। ভারতীয় আর্য ভাষা থেকে গৌড়ী প্রাকৃতের পরিণত অবস্থা গৌড়ী অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার জন্ম। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে উপমহাদেশ বিভক্তির পর পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বৈষম্যের সূচনা সংখ্যালঘিষ্ঠের ভাষা উর্দুকে সরকারি দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণার মধ্য দিয়ে।

পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির মাত্র ১৮ দিনের মাথায় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম কে সম্পাদক নির্বাচিত করে “তমদ্দুন মজলিস” গঠন করা হয়। পরবর্তীতে মজলিশের নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালের ১ অক্টোবর প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। মূলত ভাষা আন্দোলনের রূপকার তমদ্দুন মজলিস। ফলে বাঙালি জাতির প্রথম স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ ও উদ্দীপ্ত প্রেরণার নাম নিজের মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। বাঙালি জাতি নির্ভীক ও দুর্বার। সে জন্য বাঙালি জাতি কখনও পরাজয় বরণ করে নেয় নি। বাঙালি জাতির বড় গৌরব ও অহংকার যে তারা পৃথিবীর একমাত্র জাতি হিসাবে ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী কৌশলগত ভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে বাঙালি জাতির মায়ের মুখের ভাষা বাঙলা কেড়ে নিতে চেয়েছিল।

পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করলে বাঙালিরা তাদের ধর্মের নামে শোষণের কৌশল বুঝতে পেরে তীব্র ঘৃণা ভরে তা প্রত্যাখ্যান করে। ঠিক তখনি বাঙালি যে প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক চেতনার জাতি তা প্রমাণ করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকায় প্রকাশ্য জনসভায় ঘােষণা করেন যে,“উর্দুই একমাত্র হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।” বাঙালিরা জিন্নাহর ঘােষণাকে অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারমূলক বলে ঘােষণা করে। পরবর্তীতে খাজা নাজিমউদ্দিন ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি কায়েদে আজমের অনুকরণে ঢাকার এক জনসভায় ঘােষণা করেন যে, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” তার এ ঘােষণায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ফেটে পড়ে।

মাতৃভাষা বাংলা ভাষার আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ঐ দিন সর্বাত্মক হরতাল পালনের মধ্যদিয়ে ছাত্ররা প্রতি দশজনের একটি মিছিল বের করে। স্লোগান দিতে থাকে “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই ভাষা” অপর দিকে আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য পুলিশ বাহিনী মাঠে নামে। পুলিশ ছাত্রদের উপর লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। যখন দেখা যায়, একপর্যায়ে এগুলাে কোনাে কাজ করতে পারছে না তখন পুলিশ মিছিলের উপর গুলি চালায়। ফলে বরকত, সালাম, জব্বার ও রফিকহ নাম না জানা আরােও অনেকেই নিহত হয়। ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সরকারের ভবিষ্যৎ পতনের পথ প্রশস্ত হয়। বাঙালি জাতি বুকের তাজা রক্ত দিয়ে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৯৯ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।

২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৯৩টি দেশে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে প্রথমবার বিশ্বদরবারে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করেন। যা আমাদের আমাদের গৌরব এবং অহংকার। পরিসংখ্যানবিদদের মতে বাঙালি এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। তাই বাংলা ভাষার পরিধিও প্রসারিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় এখন বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি লোক কথা বলে। ২০৫০ সাল নাগাদ কেবল ১৪ থেকে ২৫ বছর বয়সী বাংলাভাষীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৩১ কোটি ৬০ লাখ।বাংলা ভাষার অস্তিত্ব ভাষা আন্দোলনের প্রায় ৬৮ বছর পরে এসে ভাষাবিজ্ঞানী ভিতর প্রশ্ন ওঠেছে যে বাংলা অপব্যবহার চলছে তা একদিকে যেমন অস্তিত্বের সংকট আর অপর দিকে বাঙালি সংস্কৃতিও সসম্মান হুমকির মুখে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের সমীক্ষার অনুযায়ী বাংলাদেশের ৪১টি ভাষা রয়েছে তার মধ্যে ৩৪টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা। কিন্তু সেই বর্ণমালায় শিক্ষার সুযোগ তেমন না থাকায় তার ওপর বাংলা ভাষার চাপের কারণে তাদের নিজস্ব ভাষাগুলো মৌখিকভাবে চর্চা হলেও এর লিখিতরূপ হারাতে বসেছে। জাতিগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত না করা, নিজ সম্প্রদায়ের শিক্ষক নিয়োগ না দেয়া, পর্যাপ্ত পাঠ্যপুস্তক সঠিকভাবে বিলি না করা ইত্যাদি কারণে উদ্যোগটির সফলতা সব পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। ফলে স্বাধীন দেশে এই বৈষম্য হতে পারে না।

তাই ভাষা শহীদে রক্তের ঋণ শোধ করতে হলে আদিবাসীদের ভাষার অধিকার দিতে হবে। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং সমাজের সর্বস্তরে এর সঠিক প্রয়োগ করতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে মাতৃভাষা বাংলার গুরুত্ব এবং ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস তুলে ধরতে হবে।

যাতে তারা মাতৃভাষা বাংলার চর্চা, পরিচর্যা ও ব্যবহারে আগ্রহী হয়। বিকৃতি রোধ করতে প্রাথমিক পর্যায়ে শিশু ভাষা শিক্ষা তার পরিবার থেকে পায়, তাই তার পরিবার ও প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির মুক্তির চেতনা। বাঙালি জাতির অনুপ্রেরণার উৎস ভাষা আন্দোলন। দেশের সর্বস্তরে চালু হোক বাংলা ভাষার প্রচলন। ফলে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা পণ্য নয় মৌলিক অধিকার হিসেবে বাস্তবায়ন করতে হবে। আগামীর বাংলাদেশ হোক শোষণহীন ও অসাম্প্রদায়িক কল্যাণমূলক দেশ।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

ভাষাদূষণ আমাদের নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী মুক্তমত রাশেদুজ্জামান রাশেদ

বিজ্ঞাপন

মাদকের টাকার জন্য মা'কে খুন
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৭

আরো

সম্পর্কিত খবর