Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আন্তর্জাতিক রেড বুক ডে: কমিউনিস্ট ইশতেহার প্রকাশের ১৭৬ বছর

সৈয়দ আমিরুজ্জামান
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৭:০৩

২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বৈশ্বিক পর্যায়ে সাংবার্ষিকভাবে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদযাপন করা হয়।

১৮৪৮ সালে ঐ দিনই (অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি) সমগ্র দুনিয়ার আধুনিক সর্বহারা শ্রেণির মহান যোদ্ধা, মহত্তম মনীষী ও শিক্ষক, বিশ্ব মানব মুক্তির পথ প্রদর্শক, সমাজবিপ্লবের আলোকবর্তিকা মহামতি কমরেড কার্ল মার্কস ও ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস রচিত কমিউনিস্ট ইশতেহার প্রথম প্রকাশিত হয়।

বিজ্ঞাপন

ভাষার জন্য রক্তদান পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশে) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তদানীন্তন পাকিস্তান অধিরাজ্যের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবীর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ রোপিত হয়েছিল বহু আগে, অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের উদ্দেশ্যে প্রতি বছরের মতো এবারেও অমর একুশে পালন করার সাথেই পালিত হয় আন্তর্জাতিক রেড বুক ডে।

সারা পৃথিবী জূড়ে দক্ষিনপন্থার তৎপরতা যখন মানুষের চেতনায় আঘাত হানছে – ভুলিয়ে দিতে চাইছে সংগ্রামের ইতিহাস তখন তার বিপ্রতীপে জীবনের জয়গান গাইতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো পাঠ করার। বাংলাদেশ ও ভারতে নানা জায়গায় এই কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। মস্কো, ডাবলিন, জোহানেসবার্গ, লাহোরেও পাঠ হচ্ছে প্রতি বছর। এই উদ্যোগে সবাইকে যুক্ত হবার আহবান জানানো হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

১৭৬ বছর আগে রচিত ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’ শীর্ষক ছোট্ট এই পুস্তিকাটি দুনিয়াকে বদলে দেওয়ার শ্রমিক শ্রেণির মতাদর্শের এক অপ্রতিরোধ্য রাজনৈতিক হাতিয়ার। সারা দুনিয়ার কমিউনিস্ট বা ওয়ার্কার্স পার্টিসমূহের মহত্তম দলিল হিসেবে আজও স্বীকৃত। এমন কোনো জ্ঞানপিপাসু মানুষ পাওয়া যাবে না যিনি ইশতেহারের সঙ্গে বোঝাপড়া না করে অগ্রসর হতে পেরেছেন। কমিউনিস্ট বিপ্লবের উদ্দীপনার পেছনে এই গ্রন্থের ভূমিকা আজও সমপরিমাণে অটুট আছে।

ইশতেহার প্রকাশিত হওয়ার পর পরই সারা দুনিয়ায় চিন্তার জগতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। এখনো পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে আলোকিত করে চলেছে এই ইশতেহার।

লেনিনের ভাষায়, “এই ছোট পুস্তিকাখানি বহু বৃহৎ গ্রন্থের সমতুল্য। সভ্য জগতের সমগ্র সংগঠিত ও সংগ্রামী প্রলেতারিয়েত আজও তার প্রেরণায় উদ্দীপ্ত ও অগ্রসর।”

কমিউনিস্ট ইস্তেহারের প্রথম ভাগের নাম “বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত”। এই ভাগে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ থেকে পুঁজিবাদের জন্মের কাহিনী বলা হয়। মার্ক্স পুঁজিবাদের আকাশচুম্বী উৎপাদন ক্ষমতাকে যথাযথ স্বীকৃতি দেন। তবে পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ তিনি তার রচনায় উদ্ঘাটিত করেছেন। তার মতে অকল্পনীয় হারে পণ্যোৎপাদন বাড়লেও সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর হয়নি। তিনি পুঁজিবাদের অন্তর্বিরোধ এবং আর্থিক সংকটের বিশ্লেষন করেছেন। এই ইস্তেহারে ধনতন্ত্রের অন্ধকার দিক দেখিয়ে পরিবর্তে অন্য কোনো সমাজব্যবস্থার কথা বলা হয়নি। তবে বলা হয়েছে, প্রচলিত সমাজব্যবস্থার গতিশীলতা থেকেই ঘটনাক্রমে ধ্বংসাত্মক শক্তির জন্ম হবে।

কমিউনিস্ট ইস্তেহার-এর ভেতর যে মূলচিন্তা প্রবহমান তা এই যে ইতিহাসের প্রতি যুগে অর্থনৈতিক উৎপাদন এবং যে সমাজ-সংগঠন তা থেকে আবশ্যিকভাবে গড়ে উঠে, তাই থাকে সেই যুগের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিগত ইতিহাসের মূলে। সুতরাং জমির আদিম যৌথ মালিকানার অবসানের পর থেকে সমগ্র ইতিহাস হয়ে এসেছে শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। আধুনিক বুর্জোয়া সম্পত্তির অনিবার্যভাবে আসন্ন অবসানের কথা ঘোষণা করাই ছিল এই বইয়ের লক্ষ্য।

সমাজ বদলের লড়াইকে অগ্রসর করার তাগিদ থেকে ইশতেহার রচিত হয়েছিল। এর রচয়িতা কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের বন্ধুত্ব ছিল বিস্ময়কর ও অতুলনীয়। প্রতিভাদীপ্ত এই দুইজন বিপ্লবীর অসাধারণ বোঝাপড়া, চিন্তা ও অনুশীলনের ঐক্য ইশতেহার রচনার যৌথকাজে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

প্রলেতারিয়েতের প্রথম আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘কমিউনিস্ট লীগের’ তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক কর্মসূচি হিসেবে ১৯৪৮ সালে লন্ডনে পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয়। লেনিনের মতে, আধুনিককালের কমিউনিস্ট পার্টির ভ্রুণ দেখা দিয়েছিল কমিউনিস্ট লীগের মধ্যে। এটি ছিল গোপন সংগঠন। ‘League of The Just’ বা ‘ন্যায়নিষ্ঠদের লীগ’ নামে এ সংগঠনটির জন্ম হয় ১৮৩৬ সালে। ১৮৪৭ সালের জুন মাসে লন্ডন কংগ্রেসে পরিবর্তিত নাম হয় ‘কমিউনিস্ট লীগ’। নামের সাথে সাথে এর চরিত্রও বিপ্লবী ধারায় বদলে ফেলা হয়। ১৮৪৭ সালকেই কমিউনিস্ট লীগের প্রতিষ্ঠাকাল এবং জুন কংগ্রেসকেই প্রথম কংগ্রেস ধরা হয়।

একই বছর ২৯ নভেম্বর থেকে ৮ ডিসেম্বর লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট লীগের দ্বিতীয় কংগ্রেসে ‘Communist Credo’ অর্থাৎ কমিউনিস্ট নীতি ও চিন্তাধারা সম্বলিত একটি ইশতেহার গৃহীত হয়। এরপর এঙ্গেলস খসড়া আকারে প্রণয়ন করেন ‘Communist Confession of Faith’। ব্লাংকিবাদী, প্রুঁধোবাদী, লাসালপন্থি, ভাইতলিং-এর খ্রিষ্টীয় সমাজতন্ত্রসহ বিভিন্ন পেটিবুর্জোয়া সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আপোষ করে এই দলিলটি রচিত হয়। ওই বছরই এঙ্গেলস ২৫টি প্রশ্নোত্তর সম্বলিত এক খসড়া দলিল প্রণয়ন করেন, যা ‘Principles of Communism’ নামে পরিচিত। আপসমূলক এই দলিলটি কংগ্রেসে গৃহীত হয়নি। শ্যাপার ও হেস কর্তৃক রচিত আরো দুটি খসড়া দলিল কমিউনিস্ট লীগের প্যারিস কমিটি কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। শেষ পর্যন্ত কমিউনিস্ট লীগের দ্বিতীয় কংগ্রেসে নতুন ইশতেহার রচনার দায়িত্ব পড়ে মার্কস ও এঙ্গেলস-এর ওপর। কংগ্রেসের আলোচনার সমস্ত নোট সঙ্গে নিয়ে মার্কস ও এঙ্গেলস চলে যান ব্রাসেলসে। সেখানেই রচিত হয় ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’।

কমিউনিস্ট লীগের কর্মসূচি হিসেবে ১৮৪৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি লন্ডনে ইশতেহারটি ২৩ পৃষ্ঠার পুস্তিকাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৮৪৮ সালের মার্চ থেকে জুলাই মাসে জার্মান রাজনৈতিক দেশান্তরিদের গণতান্ত্রিক মুখপত্র ‘Detsche Londoner Zeitung’-এ এটি কিস্তিতে কিস্তিতে প্রকাশিত হয়। প্রথম সংস্করণের ভুল-ভ্রান্তি দূর করে সেই বছরই জার্মান মূল পাঠটি লন্ডনে প্রকাশিত হয়। ৩০ পৃষ্ঠার এই সংস্করণটিকেই মার্কস-এঙ্গেলস পরবর্তীতে ব্যবহার করেন। ফরাসি, পোলিশ, ইতালিয়, ডেনিশ, ফ্রেমিশ ও সুইডিশ-এসব ভাষাতে ইশতেহার তখন অনূদিত হয়। ১৮৫০ সালের প্রথম ইংরেজি সংস্করণে রচয়িতা হিসেবে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস-এর নাম প্রথমবারের মতো উল্লেখ করা হয়। ১৮৮৩ সালের জার্মান সংস্করণের নাম দেয়া হয় ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’। ইশতেহারের মূল বক্তব্য ও নীতির গুরুত্ব আজও অটুট রয়েছে। মার্কস-এঙ্গেলস ইশতেহারের কিছু বক্তব্য পরবর্তীতে যুগোপযোগী করেছেন। মার্কসের মৃত্যুর পর এঙ্গেলস অনেকগুলি সংস্করণ দেখে দিয়েছিলেন।
‘বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত’, ‘প্রলেতারিয় ও কমিউনিস্টরা’, ‘সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট সাহিত্য’ এবং ‘বিদ্যমান বিভিন্ন বিরোধী পার্টির সম্পর্কে কমিউনিস্টদের অবস্থান’-এই চারটি অধ্যায়ের পাশাপাশি ইশতেহারের ভূমিকা অংশ এবং টীকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।

কমিউনিস্টদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে ঘোষণা করা প্রয়োজন বলে ইশতেহারের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ তখন ইউরোপে সকল শক্তির কাছে কমিউনিজম উদীয়মান শক্তি হিসেবে বিবেচিত।

“ইউরোপ ভূত দেখছে-কমিউনিজমের ভূত!”-এই বিদ্রুপাত্মক বক্তব্য দিয়েই শুরু হয়েছে ইশতেহার। আর শেষ হয়েছে এক দৃপ্ত ঘোষণা দিয়ে-

“আপন মতামত ও লক্ষ্য গোপন করতে কমিউনিস্টরা ঘৃণা বোধ করে। খোলাখুলি তারা ঘোষণা করে যে, তাদের লক্ষ্য সিদ্ধ হতে পারে কেবল সমস্ত প্রচলিত সমাজব্যবস্থার সবল উচ্ছেদ মারফত। কমিউনিস্ট বিপ্লবের আতঙ্কে শাসকশ্রেণিরা কাঁপুক, শৃঙ্খল ছাড়া প্রলেতারিয়েতের হারাবার কিছু নেই। জয় করার জন্য আছে গোটা জগৎ। দুনিয়ার মজুর এক হও।”

কমিউনিস্টদের দার্শনিক অবস্থান সুনির্দিষ্ট করার পাশাপাশি, প্রায়োগিক কর্তব্যও নির্দিষ্ট করেছে ইশতেহার। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী ধারায় মানবসমাজের ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করাই হচ্ছে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। মার্কস-এঙ্গেলস দেখালেন-সমাজের ভিত্তি হচ্ছে অর্থনীতি। উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বের পথ ধরে অনিবার্যভাবে আসে সমাজবিপ্লব। শ্রেণিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী সমাজকে উচ্ছেদ করে প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ।

“নিজেদের প্রস্তুত মালের জন্য অবিরাম প্রসারমান এক বাজারের তাগিদ বুর্জোয়াশ্রেণিকে সারা পৃথিবীময় দৌড় করিয়ে বেড়ায়। সর্বত্র তাদের ঢুকতে হয়, সর্বত্র গেড়ে বসতে হয়, যোগসূত্র স্থাপন করতে হয় সর্বত্র।”-এভাবেই ইশতেহারে বুর্জোয়াশ্রেণির স্বরূপ উদ্ঘাটন করা হয়েছে।

বুর্জোয়াশ্রেণির বিপ্লবী ভূমিকা, তার সীমাবদ্ধতা ও পরিণতির কথা তাৎপর্যপূর্ণভাবে তুলে ধরা হয়েছে ইশতেহারে। আধুনিক বুর্জোয়াশ্রেণি হচ্ছে একটা দীর্ঘ বিকাশধারার ফল এবং উৎপাদন ও বিনিময় পদ্ধতির বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পরিণতি। “উৎপাদনে অবিরাম বৈপ্লবিক পরিবর্তন, সমস্ত সামাজিক অবস্থার অনবরত নড়চড়, চিরস্থায়ী অনিশ্চয়তা এবং আলোড়ন”কে বুর্জোয়া যুগের বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে ইশতেহারে। বুর্জোয়া সমাজের উৎপাদন-শক্তি অতীতের সকল যুগের সমগ্র উৎপাদন-শক্তির চেয়ে আকারে ও পরিধিতে বড়। পুঁজিবাদে অনেক ধারার বৈষম্য, শোষণ, নিপীড়ন একাকার হয়ে যায় এবং একটা অন্যটাকে পুষ্টি প্রদান করে থাকে। কোনোটা দৃশ্যমান, কোনোটা অদৃশ্য।

বুর্জোয়াশ্রেণি গ্রামাঞ্চলকে শহরের পদানত ও মুখাপেক্ষী এবং বর্বর বা অর্ধ বর্বর দেশগুলিকে সভ্য দেশের, কৃষিপ্রধান জাতিগুলিকে বুর্জোয়া-প্রধান জাতির, প্রাচ্যকে প্রতীচ্যের উপরে নির্ভরশীল করে তুলেছে। বুর্জোয়ারা সভ্যতার নাম করে বর্বরতম জাতিদেরও বুর্জোয়া উৎপাদন-প্রণালী গ্রহণে বাধ্য করে এবং নিজের ছাঁচে জগৎ গড়ে তোলে। বুর্জোয়াশ্রেণি সকলকেই মজুরিভোগী শ্রমজীবীতে এবং পারিবারিক সম্বন্ধকে নিছক আর্থিক সম্পর্কে পরিণত করে। সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক ও প্রকৃতি-শোভন সম্পর্ক ধ্বংস করে দিয়ে নগ্ন, নির্লজ্জ, পাশবিক শোষণ কায়েম করে।

ইশতেহার দেখিয়েছে যে, বুর্জোয়াশ্রেণির যে প্রগতিশীল ও বিপ্লবী ভূমিকা ছিল, তা স্থায়ী হয় না। আধুনিক বুর্জোয়াসমাজ শ্রেণিবিরোধ দূর করতে পারে না, এক সময় সমাজ বিকাশের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। তখন নতুন বিপ্লবী শ্রেণির আধিপত্য এবং নতুন সমাজ ব্যবস্থার অনিবার্যতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেই নতুন বিপ্লবী শ্রেণি হচ্ছে প্রলেতারিয়েত, আর নতুন সমাজ হচ্ছে সমাজতন্ত্র।

নতুন শ্রেণি, অত্যাচারের নতুন অবস্থা, নতুন ধরনের সংগ্রাম দেখা যায়। বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েত-পরস্পরের সম্মুখীন এই দুই বিশাল শত্রুশিবিরে গোটা সমাজ ভাগ হয়ে পড়ে। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে বুর্জোয়াশ্রেণি যে অস্ত্র সৃষ্টি করে, তা তার নিজের বিরুদ্ধেই উদ্যত হয়। এই অস্ত্রের সঙ্গেই অস্ত্র ধারণকারী তথা কবর খননকারী প্রলেতারিয়েতকে সে সৃষ্টি করে। বুর্জোয়াশ্রেণির পতনের সঙ্গে সঙ্গে প্রলেতারিয়েতের জয়লাভ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

সমাজ বিকাশের এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবেই পুঁজিবাদের বিকাশের কথা ইশতেহারে বলা হয়েছে। পুঁজিবাদের বিকাশ মানে পুঁজিবাদের বিজয় নয়। পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন এবং পুঁজিবাদের মহাবিপর্যয়ের কথা ইশতেহারে উল্লেখ আছে। বুর্জোয়া বিপ্লবকে প্রলেতারিয় বিপ্লবের ভূমিকাপর্ব বলে অভিহিত করে সেই বিপ্লবে শ্রমিকশ্রেণির কর্তব্য নির্ধারণ করা হয়েছে ইশতেহারে।

ইশতেহারে বলা হয়েছে মজুরি-দাসত্বের শেকল থেকে শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির কথা। বুর্জোয়াদের হাত থেকে ক্রমেই সমস্ত পুঁজি কেড়ে নেওয়া, প্রলেতারিয়েতের হাতে উৎপাদনের সমস্ত উপকরণ কেন্দ্রীভূত করার জন্য প্রলেতারিয়েতকে শাসকশ্রেণির পদে উন্নীত করা এবং তার রাজনৈতিক আধিপত্য নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। বুর্জোয়া সমাজে বর্তমানের ওপর আধিপত্য করে অতীত, আর কমিউনিস্ট সমাজে বর্তমান আধিপত্য করে অতীতের ওপর।

মার্কস-এঙ্গেলস দেখালেন যে, ইতিহাসের চালিকাশক্তি হচ্ছে শ্রেণিসংগ্রাম। তাঁরা বলেছেন: “আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলের ইতিহাসই শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস।” ইতিহাস বলতে তখন লিখিত ইতিহাসকে বোঝানো হয়েছিল। কিন্তু মর্গানের আবিষ্কারের ফলে দেখা গেল, আদিম কমিউনিস্ট সমাজে শ্রেণি, শ্রেণিসংগ্রাম বলে কিছু ছিল না। বিষয়টি এঙ্গেলস ১৮৮৮ সালের ইংরেজি সংস্করণে এবং পরবর্তীতে তাঁর ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

প্রলেতারিয়েত হল বর্তমান যুগে সমাজের মূল নিপীড়িত অংশ এবং প্রকৃত বিপ্লবী শ্রেণি। শ্রমিকশ্রেণির মুক্তি ছাড়া শোষণ ও নিপীড়নের হাত থেকে মানবমুক্তি সম্ভব নয়। অন্যসব শ্রেণিকে মুক্ত না করে শ্রমিকশ্রেণি মুক্ত হতে পারে না। শ্রমিকশ্রেণি বুর্জোয়াশ্রেণির কর্তৃত্বের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করবে। তার ফলে সকল শোষণ, নিপীড়ন, শ্রেণিপার্থক্য ও শ্রেণিসংগ্রাম থেকে চিরদিনের মতো মুক্তি আসবে। নিম্ন মধ্যবিত্ত, ছোট হস্তশিল্প কারখানার মালিক, দোকানদার, কারিগর চাষি-এরা বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের অস্তিত্বটাকে বাঁচাবার জন্য।

অত্যাচারী এবং অত্যাচারিতদের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য অবিরাম লড়াই শেষ হয় সমাজের বৈপ্লবিক পুনর্গঠনে। বুর্জোয়াশ্রেণির বিকাশের সাথে সাথে প্রলেতারিয়েতও বিকশিত হয়। বুর্জোয়াশ্রেণির বিরুদ্ধে প্রলেতারিয়েতের সংগ্রাম শুরু হয় জন্মমুহূর্ত থেকে এবং নানা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়। বুর্জোয়া-স্বার্থে প্রলেতারিয়েতের ওপর আইন, নৈতিকতা, ধর্মের মতো বুর্জোয়া পক্ষপাতমূলক ধারণা চাপিয়ে দেয়া হয়।

উৎপাদনের উপকরণের উপর প্রলেতারিয়েতের কোনো মালিকানা নেই। সমাজ থেকে সব ধরনের বৈষম্য বিলুপ্ত করতে হলে ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদ করতে হবে। আধুনিক বুর্জোয়া সম্পত্তির অনিবার্যভাবে আসন্ন অবসানের কথা তুলে ধরেছে ইশতেহার। ইশতেহারের ভাষায়: “কমিউনিস্টদের তত্ত্বকে এক কথায় প্রকাশ করা চলে : ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ।”

মার্কস-এঙ্গেলস ঘোষণা করেন যে, পুঁজিবাদী সমাজের পতন অবশ্যম্ভাবী এবং অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে সমাজতন্ত্র। পুঁজিবাদ তার কবর খননকারী প্রলেতারিয়েতের সৃষ্টি করেছে। বুর্জোয়াশ্রেণির বিরুদ্ধে প্রলেতারিয়েতের সংগ্রাম জয়যুক্ত হবে এবং মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণের অবসান ঘটবে। প্রলেতারিয়েত দখল করবে রাষ্ট্রক্ষমতা এবং কায়েম করবে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব। পৃথিবী এগিয়ে যাবে এক নতুন শ্রেণিহীন সমাজ-কমিউনিস্ট সমাজের দিকে। তার জন্য শ্রমিকশ্রেণির নিজস্ব পার্টি কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে হবে। এই সার কথাই প্রতিফলিত হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে।

ইশতেহারে বলা হয়েছে, কমিউনিস্টরাই হলো শ্রমিকশ্রেণির অগ্রণী বাহিনী। সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরেছে কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্ব, কর্তব্য ও নেতৃত্বপ্রদানের বিষয়। কমিউনিস্টদের আশু কর্তব্য হিসেবে প্রলেতারিয়েতকে সংগঠিত করা, বুর্জোয়া আধিপত্যের উচ্ছেদ, প্রলেতারিয়েত কর্তৃক রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল-এই তিনটি কাজের কথা বলা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে প্রলেতারিয়েতের স্বার্থ থেকে বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র কোনো স্বার্থ কমিউনিস্টদের নেই।

একটি গভীর লক্ষ্যকে সামনে রেখে কমিউনিস্টরা অগ্রসর হয়। বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যে কেবল কিছু দাবি পূরণই তাদের লক্ষ্য নয়। কমিউনিস্টরা প্রচলিত সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিটি বিপ্লবী আন্দোলন সমর্থন করে এবং নানা ধরনের লড়াই, কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকে। কিন্তু কখনোই সমাজের মৌলিক পরিবর্তনের লক্ষ্যের কথা ভোলে না। কমিউনিস্টরা ব্যক্তির ওপর ব্যক্তির শোষণের পাশাপাশি জাতির ওপর জাতির শোষণও বন্ধ করতে চায়। শ্রমিকশ্রেণির পার্টিগুলির সর্বাপেক্ষা অগ্রসর ও দৃঢ়চিত্ত অংশ হিসেবে কমিউনিস্টরা অন্য সবাইকে সামনে নিয়ে যায়। জাতীয় সংগ্রামের ভেতর থেকে প্রলেতারিয়েতের সাধারণ স্বার্থকে কমিউনিস্টরা সামনে টেনে আনে। শ্রমিকশ্রেণির সাময়িক স্বার্থ রক্ষার জন্য কমিউনিস্টরা লড়াই করে থাকে, কিন্তু আন্দোলনের বর্তমানের মধ্যেও তারা আন্দোলনের ভবিষ্যতের প্রতিনিধি, তার রক্ষক।

কমিউনিস্টদের সম্পর্কে নানা অপপ্রচারের যোগ্য জবাব দিয়েছে ইশতেহার। ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদের দাবিকে বুর্জোয়ারা ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে অভিযোগ করে। কিন্তু পুঁজিবাদেই তো দশ জনের মধ্যে নয় জনেরই ব্যক্তিগত সম্পত্তি উচ্ছেদ হয়ে গেছে। বাকি এক জনের হাতে মালিকানা থাকার কারণ হচ্ছে নয় জনের হাতে কিছুই না থাকা। বুর্জোয়া ব্যক্তিত্ব, বুর্জোয়া স্বাতন্ত্র, বুর্জোয়া স্বাধীনতা অধিকাংশ মানুষের বিপরীতে গিয়ে কেবল বুর্জোয়াদের স্বার্থ রক্ষা করে। কমিউনিস্টদের লক্ষ্য হিসেবে এগুলোর উচ্ছেদের কথা বলা হয়েছে ইশতেহারে। স্বদেশ ও জাতীয়তার বিলোপের যে অভিযোগ কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বুর্জোয়াদের, তার জবাবে বলা হয়েছে, “মেহনতি মানুষের কোনো দেশ নেই। তাদের যা নেই তা আমরা তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারি না।”

মার্কস ও এঙ্গেলস ১৮৪৭ সাল থেকেই প্রলেতারিয়েতের নিজস্ব বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছেন। ১৮৬৪ সালে তাঁরা গড়ে তুলেছেন ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’। ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের আন্তর্জাতিক সংগঠন’ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৫০ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয় জার্মানি, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের বিপ্লবীদের এক সভা।

সভায় গৃহীত কার্ল মার্কস রচিত প্রস্তাবে বলা হয়: “মানবসমাজের শেষ রূপ হবে কমিউনিজম। সেই কমিউনিজমে না পৌঁছানো পর্যন্ত বিপ্লবকে চিরস্থায়ী রেখে সুবিধাভোগী সকল শ্রেণিকে উচ্ছেদ করা এবং এই সব শ্রেণিকে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বে দাবিয়ে রাখাই হলো এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য।”

‘দুনিয়ার মজুর এক হও’ এই উদাত্ত আহ্বান জানিয়েই শেষ হয়েছে ইশতেহার। এই আহ্বানের মধ্য দিয়ে প্রলেতারিয় আন্তর্জাতিকতাবাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে ইশতেহার। পরবর্তীতে লেনিন এই স্লোগানকে আরো যুগোপযোগী করে নতুন স্লোগান দেন ‘দুনিয়ার মজুর ও নিপীড়িত জাতিসমূহ এক হও।’

ইশতেহারে বলা হয়েছে-আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্রের শাসকমণ্ডলী বুর্জোয়াশ্রেণির সাধারণ কাজকর্ম ব্যবস্থাপনার একটি কমিটি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই বুর্জোয়া রাষ্ট্রের উচ্ছেদের সাথে সাথে প্রলেতারিয়েতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্যারি কমিউনের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে মার্কস-এঙ্গেলস বলেছেন : “কমিউন বিশেষ করে একটি কথাই প্রমাণ করেছে যে, তৈরি রাষ্ট্রযন্ত্রটার শুধু দখল পেলেই শ্রমিকশ্রেণি তা নিজের কাজে লাগাতে পারে না।” তাই তাঁরা বুর্জোয়াদের সবলে উচ্ছেদ করে প্রলেতারিয়েতের আধিপত্যের ভিত্তি স্থাপনের জন্য ‘শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব’ কায়েমের কথা বলেছেন।

এ সম্পর্কে লেনিন বলেছেন: “এ কথা তো স্পষ্টই যে, শ্রমিকশ্রেণির ‘শাসকশ্রেণিতে রূপান্তর’ ‘শ্রমিকশ্রেণির শাসকশ্রেণি রূপে সংগঠন’ ‘সম্পত্তির ওপর শ্রমিকশ্রেণির স্বৈরাচারী আক্রমণ’ ইত্যাদি-এটাই তো শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব। ‘রাষ্ট্র অর্থাৎ শাসকশ্রেণিরূপে সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণি’-এটাই তো ‘শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব।”

১৮৫২ সালের ৫ মার্চ হেবডমেয়ারের কাছে মার্কস লিখেছেন: “শ্রেণি বা শ্রেণিসংগ্রামের অস্তিত্ব আবিষ্কার করার কৃতিত্ব আমার নয়। আমার বহু আগে বুর্জোয়া ঐতিহাসিকরা শ্রেণিসংগ্রামের ঐতিহাসিক বিকাশ ব্যাখ্যা করেছেন। নতুনের মধ্যে আমি শুধু প্রমাণ করেছি : ১. উৎপাদনের বিকাশের বিশেষ ঐতিহাসিক পর্যায়ের সঙ্গেই কেবল শ্রেণিসমূহের অস্তিত্ব জড়িত। ২. শ্রেণিসমূহের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব। ৩. যে অবস্থায় শ্রেণিসমূহের বিলোপ ঘটবে এবং শ্রেণিহীন সমাজের পত্তন হবে, শ্রমিকশ্রেণির এই একনায়কত্ব হচ্ছে সেই অবস্থায় উত্তরণের পথ মাত্র।”

‘ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ’ গ্রন্থের জার্মান সংস্করণের ভূমিকায় ১৮৯১ সালে এঙ্গেলস লিখেছেন : “সোসাল ডেমোক্র্যাট অর্বাচীনরা শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব কথাটায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠেছে। বেশ ভালো কথা। ভদ্র মহোদয়গণ, এই একনায়কত্ব কেমন তা আপনারা জানতে চান? প্যারি কমিউনের দিকে তাকান, ওটাই ছিল শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব।”

স্যোসালিস্ট বা সমাজতন্ত্রী ইশতেহার না বলে একে কমিউনিস্ট ইশতেহার কেন বলা হয়েছে-এই প্রশ্নের উত্তরে এঙ্গেলস ১৮৮৮ সালের ইংরেজি সংস্করণের ভূমিকায় বলছেন : “১৮৪৭ সালে সমাজতন্ত্র ছিল বুর্জোয়া আন্দোলন আর কমিউনিজম ছিল শ্রমিকশ্রেণির। অন্তত ইউরোপ মহাদেশে সমাজতন্ত্র ছিল ‘ভদ্রস্থ’, আর কমিউনিজম ছিল ঠিক তার বিপরীত। আর প্রথম থেকেই যেহেতু আমাদের ধারণা ছিল যে, ‘শ্রমিকশ্রেণির মুক্তি শ্রমিকশ্রেণিরই নিজস্ব কাজ হতে হবে’, তাই দুই নামের মধ্যে আমরা কোনটি বেছে নেব সে সম্বন্ধে কোনো সংশয় ছিল না। তাছাড়া আজ পর্যন্ত আমরা এ নাম বর্জন করার দিকেও যাইনি।”

ইশতেহার প্রকাশকালে ইউরোপে সমাজতন্ত্রের যেসব প্রচারিত ছিল, সেগুলো ছিল কাল্পনিক, অবৈজ্ঞানিক। ইশতেহারে ইউটোপিয় সমাজতন্ত্র ও পেটিবুর্জোয়া সমাজতন্ত্রের প্রকৃত চেহারা উন্মোচন করে সমাজতন্ত্রকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো হয়। কমিউনিস্ট ইশতেহারে ঘোষিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রই উনিশ শতকের শেষভাগে সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব বলে স্বীকৃত হয়, অন্যসব হারিয়ে যায়।

ফুরিয়ে, ওয়েনের মতো ইউটোপিয় সমাজতন্ত্রীরা বুর্জোয়া সমাজের বৈষয়িক ও নৈতিক দুর্দশার কথা তুলে ধরে তার তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁরা শহর ও গ্রামের পার্থক্য ঘুচাবার কথা বলেছিলেন। সমাজের সাধারণ মুক্তির মাপকাঠি হিসেবে নারীমুক্তির অবস্থাকে ফুরিয়ে প্রথম তুলে ধরেন। ওয়েনের মতে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, ধর্ম ও প্রচলিত বিবাহপ্রথা হচ্ছে সমাজ-সংস্কারের পথে প্রথম বাধা। তাঁর মতে, ব্যক্তিগত সম্পত্তিই মানুষকে দানবে এবং জগৎকে নরককুণ্ডে পরিণত করে। সাঁ সিমো তাঁর লেখায় শ্রেণিসংগ্রামের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, রাজনীতি হচ্ছে উৎপাদনের বিজ্ঞান; রাজনীতিকে সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করবে অর্থনীতি।

১৮৯০ সালের জার্মান সংস্করণের ভূমিকায় এঙ্গেলস পেটি-বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রীদের ‘সামাজিক হাতুড়ে’ বলে অভিহিত করেছেন। এদের যোগসূত্র ছিল পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে। বুর্জোয়া রাজত্বের সমালোচনায় ‘প্রলেতারিয়েত আর বুর্জোয়ার মাঝখানে দোলায়িত’রা পেটি-বুর্জোয়া মানদণ্ডের আশ্রয় নেয়। তারা শ্রমিকশ্রেণির পক্ষে অস্ত্র ধারণ করে স্বাভাবিকভাবে মধ্যবর্তী শ্রেণিদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই। পেটি-বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রী সিসমন্দি পুঁজিবাদের সমালোচনা করেছিলেন পেটি-বুর্জোয়া মানদণ্ডে। পুঁজিবাদী সমাজের ভিত্তিটা টিকিয়ে রেখে উৎপাদনকে সংকুচিত করে সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলেন। আরেক পেটি-বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রী প্রুধোঁ নানা সমিতি গড়ে তুলে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে চেয়েছেন। আর বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রীরা শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র অর্জন করার কথা বলেছিলেন।

পুঁজিবাদকে কঠোর ও তীক্ষ্ণভাবে সমালোচনা করলেও, সমাজকে পুরনো কাঠামোর মধ্যেই আটকে রাখতে সচেষ্ট বলে এইসব ধারণা প্রতিক্রিয়াশীল ও ইউটোপিয়। তাঁদের ভবিষ্যৎ সমাজের ভাবনা ছিল একেবারেই ইউটোপিয় বা কাল্পনিক, যার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ইশতেহারে মার্কস-এঙ্গেলস এঁদের চিন্তার দুর্বলতার কারণ হিসেবে ‘প্রলেতারিয়েতের অপরিণত অবস্থা’, ‘শ্রেণিসংগ্রামের অবিকশিত অবস্থা’ ইত্যাদি বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন।

মার্কস-এঙ্গেলস সমাজতন্ত্রের এসব অবৈজ্ঞানিক ধারণার বিরুদ্ধে অবিরাম মতাদর্শগত লড়াই চালিয়েছেন, পাশাপাশি নিজেদের চিন্তাকে বিকশিত করেছেন। তাঁদের মতে, সমাজতন্ত্র হচ্ছে ঐতিহাসিক বিকাশের আবশ্যিক পরিণতি এবং সমাজের অর্থনৈতিক অগ্রগতিই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।

ইশতেহারে আলোচনার বিস্তার ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত থাকায় এবং এরপর রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারে বদলে যাওয়ায়, ১৮৭২ সালের ইংরেজি সংস্করণের ভূমিকায় এঙ্গেলস সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যের সমালোচনাটিকে অসম্পূর্ণ বলে অভিহিত করেন। বিরোধী পার্টির সঙ্গে কমিউনিস্টদের অবস্থান সম্পর্কিত ইশতেহারের বক্তব্যগুলি সাধারণ মূলনীতির দিক থেকে সঠিক হলেও ব্যবহারিক দিক থেকে অকেজো হয়ে গেছে এবং ইতিহাসের অগ্রগতি উল্লিখিত রাজনৈতিক দলগুলির অধিকাংশকে এই দুনিয়া থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে এঙ্গেলস ঘোষণা করেন যে : “এই ‘ইশতেহার’ এখন ঐতিহাসিক দলিল হয়ে পড়েছে, একে বদলানোর কোনো অধিকার আমাদের আর নেই।”

ইশতেহার প্রকাশের আগে শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির কোনো দিগ্দর্শন বা বিপ্লবী তত্ত্ব ছিল না। শ্রমিকশ্রেণির এই অভাব পূরণ করে কমিউনিস্ট ইশতেহার। শ্রমিকশ্রেণির মুক্তিসংগ্রামের আদর্শ, লক্ষ্য ও পথ মূর্ত হয়ে উঠল ইশতেহারে। ইশতেহার ভবিষ্যৎ সমাজের সম্ভাবনাকে সামনে নিয়ে আসে এবং ইউটোপিয় সমাজতন্ত্র থেকে শ্রমিকশ্রেণিকে মুক্ত করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দিকে ধাবিত করল। ‘আমরা ভাই ভাই’ এই ঝাপসা, অস্পষ্ট স্লোগানের জায়গায় এলো নতুন স্লোগান ‘দুনিয়ার মজুর এক হও!’

ইশতেহার সম্পর্কে লেনিন বলেছেন, “প্রতিভাদীপ্ত স্পষ্টতায় ও চমৎকারিত্বে এ রচনায় মূর্ত হয়েছে নতুন বিশ্বদৃষ্টি, সমাজ-জীবনের এলাকা পর্যন্ত প্রসারিত সুসঙ্গত বস্তুবাদ, বিকাশের সর্বাপেক্ষা সর্বাঙ্গীণ ও সুগভীর মতবাদস্বরূপ দ্বন্দ্ববাদ, শ্রেণিসংগ্রামের এবং নতুন কমিউনিস্ট সমাজের স্রষ্টা প্রলেতারিয়েতের বিশ্ব ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক ভূমিকার তত্ত্ব।”

কেবল রাজনৈতিক গুরুত্বই নয়, ইশতেহারের সাহিত্যিক গুরুত্বও অসীম। নান্দনিক ভাষা, শব্দশৈলী, ছন্দের ব্যবহার এবং গঠনের দিক থেকে এক কথায় অনন্য। এর প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য তাৎপর্যপূর্ণ এবং আপন মহিমায় ভাস্বর। ইশতেহারের ছত্রে ছত্রে সঞ্চারিত হয়েছে বিপ্লবী প্রেরণা।

মার্কসবাদের ওপর উত্তরাধুনিকতাসহ নানামাত্রিক আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানের মাধ্যমেই এসব আক্রমণ মোকাবিলা করতে হবে। শ্রমিক শ্রেণির মতাদর্শের এই রাজনৈতিক কর্তব্য পালনে আমাদের যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। মুক্তচিন্তা ও মন নিয়েই মার্কসবাদী-লেনিনবাদী সাহিত্য পাঠ ও অনুশীলন করতে হবে। তবে উদার দৃষ্টিভঙ্গির নাম করে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মৌলিক চিন্তাকে সুকৌশলে বাতিল করে দেয়ার চক্রান্ত সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।

পুঁজিবাদের অস্তিত্বই কমিউনিস্ট ইশতেহারকে প্রাসঙ্গিক করে রেখেছে। পুঁজিবাদী বিশ্বের অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটাতে অনেক বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ-পণ্ডিতই মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-মাও সেতুংয়ের কাছে সমাধান খুঁজছেন। বিদ্যমান শোষণমূলক পুঁজিবাদী সমাজ বদলে আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই সাম্যের সমাজ অভিমুখী ‘জনগণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার’। কাঙ্ক্ষিত সমাজ প্রতিষ্ঠার বৈপ্লবিক লড়াইয়ে বিপ্লবের এক মহাকাব্যিক দলিল হিসেবে ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’ আমাদের পথ দেখিয়ে যাবে নিরন্তর।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

আন্তর্জাতিক রেড বুক ডে: কমিউনিস্ট ইশতেহার প্রকাশের ১৭৬ বছর মুক্তমত সৈয়দ আমিরুজ্জামান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর