নোনা জলের ধান ‘চারুলতা’: এক বিস্ময়কর আবিস্কার
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৮:৩১
এই চারুলতা সত্যজিত রায়ের কালজয়ী চলচ্চিত্র চারুলতা নয়, এটি একটি ধানের জাত যা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপখাইয়ে নিতে পারে যা উদ্ভাবন করেছেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার চন্ডীপুর গ্রামের কৃষক দিলীপ তরফদার। দেশে জলবাযু পরিবর্তনের ফলে দক্ষিণের জেলাগুলোয় প্রতিনিয়তই বাড়ছে লবণাক্ততা বাড়ছে। পাশাপাশি জলাবদ্ধতাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যাগে হুমকির মুখে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি উৎপাদন। তাই খরা, বন্যা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবনে সরকারি ও বেসরকারিভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়েও দিলীপ ও হরিপদ কাপালীর মত কৃষক বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছে চারুলতা ও হরি ধান আবিস্কারের মাধ্যমে যদিও দুটি ধানই বীজ রাজনীতির স্বীকার।
এখন আসা যাক ‘চারুলতা’ ধানের উদ্ভাবক কৃষক দিলীপ তরফদারের সফলতার গল্প। কুটেপাটনাই ও খেজুরছড়ি ধানের জাত দুটি ভৌগোলিকভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য উপযোগী। এর মধ্যে খেজুরছড়ি ধান দেখতে চিকন এবং ভাত খেতে সুস্বাদু। আবার কুটেপাটনাই জাতটি লবণাক্ততাসহনশীল। ধানের এ জাত দুটি থেকেই সংকরায়নের মাধ্যমে ২০১০ সালে চারুলতা ধান উদ্ভাবন করেন কৃষক দিলীপ তরফদার। আমন মৌসুমের এ জাত কিছু মাত্রায় লবণসহিষ্ণু। এর বড় বিশেষত্ব হচ্ছে জলাবদ্ধ জমিতেও টিকে থাকতে পারে। চারুলতা ধানের গাছ তুলনামূলক শক্ত ও শীষ লম্বা। ফলে জলাবদ্ধ জমিতে বা বাতাসেও টিকে থাকতে পারে। পাশাপাশি স্থানীয় জাত থেকে সংকরায়িত হওয়ায় রোগবালাইও অন্যান্য ধানের চেয়ে কম। সার ও কীটনাশকও কম লাগে। এতে কৃষকের সার্বিক উৎপাদন খরচ অনেকটাই কমে যায়।
দিলীপ তরফদারের সফলতার গল্পে রয়েছে বেসরকারি কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজের (বারসিক) সহায়তায় ২০০৯ সালে তিনি ফিলিপাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের প্রশিক্ষণ নেন। ‘বারসিক থেকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কীভাবে একটি নতুন জাত উদ্ভাবন করা যায় তা শিখেন তিনি। এর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চারুলতা জাত উদ্ভাবন করা হয়। এর পরের বছরই স্থানীয় দুটি জাতের মধ্যে সংকরায়নের মাধ্যমে নতুন এ জাত উদ্ভাবন করেন। চারুলতার জীবৎকাল ১৫০-১৫৫ দিন। প্রতি বিঘা জমিতে ১৮-২১ মণ ধান হয়। এর শীষের গাঁথুনি ঘন এবং চাল সরু।
নিজের উদ্ভাবিত ধানের নামকরণ প্রসঙ্গে কৃষক দিলীপ তরফদার বলেন, ‘আমার বড় মা যিনি আমাকে লালন-পালন করেছেন, তার নামেই ধানটির নাম রেখেছি চারুলতা।’ উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ত জমি ও জলাবদ্ধতার কারণে ফসল হয় কম হয় জানিয়ে এ কৃষক বলেন, ‘বারসিক থেকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কীভাবে একটি নতুন জাত উদ্ভাবন করা যায় তা শিখেছি। এর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চারুলতা জাত উদ্ভাবন করি। এরপর কৃষকের মাঝেও বীজ বিতরণ করেছি। এখন অনেকেই এ ধান চাষ করছেন। অন্যান্য জাত চাষে যে ফলন, চারুলতায় প্রায় একই ফলন হয়। তবে অন্য জাতগুলোর তুলনায় স্থানীয় এ জাত চাষ করলে খরচ অনেক কমে যায়।’
দিলীপের আক্ষেপ করে বলেন ‘কৃষি বিভাগ আমার উদ্ভাবিত এ জাতের স্বীকৃতি দেয় না। আবার জাতটি নিয়ে গবেষণাও হয়নি। সরকারিভাবে স্বীকৃতি পেলে আমার কষ্টের স্বীকৃতি মিলত। চারুলতা ধানে রোগবালাই কম হয়। উপকূলের জন্য বিভিন্ন জাত থাকলেও জলাবদ্ধতা ও কিছুটা লবণসহিষ্ণু ধানটি কৃষকের জন্য উপযোগী হবে। এ বিষয়ে বারসিকের পরিচালক বলেন, ২০০৯ সালে ফিলিপাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বারসিকের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সংকরায়নের মাধ্যমে কীভাবে নতুন জাত উদ্ভাবন করা যায়, তাই ছিল লক্ষ্য। তখন দিলীপ তরফদার স্থানীয় দুটি জাত সংকরায়নের মাধ্যমে চারুলতা ধান উদ্ভাবন করেন। নতুন এ জাত জলাবদ্ধতা ও কিছু মাত্রায় লবণসহিষ্ণু। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো কৃষক নিজেই জাতটি উদ্ভাবন করেছেন। এসব স্থানীয় জাত ভৌগোলিকভাবেই এ অঞ্চলের জন্য উপযোগী। ঘূর্ণিঝড় আইলার পর শ্যামনগর উপজেলার কিছু স্থানে লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতার কারণে উচ্চ ফলনশীন ধানের জাত চাষ সম্ভব হয়নি। তখন কৃষক স্থানীয় লবণসহিষ্ণু জাতের সন্ধান করছিলেন। স্থানীয় জাতগুলো দুর্যাগ মোকাবেলায় বেশি কার্যকর। এ কারণে সেগুলো সংরক্ষণ ও উন্নতকরণে আমাদের জোর দিতে হবে।’ জাত উদ্ভাবনে কৃষক ও বিজ্ঞানীদের একই প্রাটফর্মে কাজ করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞানী ও কৃষকের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দেখা যায়। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা কৃষককে সঙ্গে নিয়েই নতুন জাত উদ্ভাবন করতে পারেন। কৃষকও অনেক বড় বিজ্ঞানী। কারণ তারা যুগ যুগ ধরে ফসল ফলাচ্ছেন। আর সেটি কীভাবে করতে হবে তা তারা ভালো জানেন। এর বাইরে কৃষককে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যেন তারা নতুন জাত উদ্ভাবনে নিজেরাই উদ্যোগী হতে পারেন। তাদের উৎসাহ দিতে হবে। স্বীকৃতি পেলে তারা উৎসাহ পাবেন।’
এই চারুলতা ধানটি এখন আমলতান্ত্রীক জটিলতার স্বীকার । স্থানীয় কৃষি অফিসের দাবি, চারুলতা ধান কৃষকের কাছে জনপ্রিয়তা পায়নি যা কেবল কৃষক দিলীপ তরফদারের গ্রামেই কেবল কয়েকজন করে বলে শুনেছি। তাছাড়া হাইব্রিড বা উফশি জাতের তুলনায় উৎপাদনও কম। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) জলাবদ্ধতা ও লবণসহিষ্ণু বিভিন্ন ধানের জাত রয়েছে। বিনার মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা বিনা থেকে সর্বশেষ বিনা ২৬ জাতের ধান উদ্ভাবন করেছি। এটি জলাবদ্ধতা ও জলমগ্নতাসহিষ্ণু। এছাড়া বিনা ২৩ দ্বৈত লবণ ও বন্যাসহিষ্ণু। বিনা ১১ ও বিনা ১২ বন্যাসহিষ্ণু জাত। বিনা ৮ ও বিনা ১০ লবণসহিষ্ণু। এর মধ্যে বিনা ১০ উচ্চমাত্রায় লবণসহিষ্ণু। এরে বাইরেও ব্রি উদ্ভাবিত বিভিন্ন জাত রয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর জন্য।’
চারুলতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ ধানটির বিষয়ে আমার ধারণা কম। জাতটি দিয়ে যদি আমন মৌসুমে বিঘাপ্রতি ১৮-২০ মণ ধান হয় তাহলে অবশ্যই ভালো। তবে অনেক ক্ষেত্রে এটি লবণসহিষ্ণু কিনা সেটা কৃষক বুঝতে পারেন না। কেননা মাটিতে আদৌ লবণ আছে কিনা কৃষক তা বলতে পারেন না। তাই সহিষ্ণুতার মাত্রা কেমন তা বের করা আগে জরুরি।’ ধানের আদি বা স্থানীয় জাতগুলো সংরক্ষণ জরুরি জানিয়ে বিনার মহাপরিচালক বলেন, ‘স্থানীয় জাতগুলো সংরক্ষেণে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এগুলোর বৈশিষ্ট্য ধরে রেখে স্বল্পমেয়াদে চাষাবাদ করা যায় এমন জাত উদ্ভাবনেও জোর দেয়া হচ্ছে কিন্তু উফশী জাত না থাকলে দেশে এখন অভাব থাকত। আমাদের উফশী বা হাইব্রিড জাতগুলোর কারণেই খাদ্য উৎপাদন অনেক বেড়েছে।’এদিকে চারুলতা জাতের ধানটি কৃষক দিলীপ তরফদারের উদ্ভাবিত কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক । তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাছে প্রায় চার হাজার জাতের ধান সংরক্ষণে রয়েছে। চারুলতা কৃষক দিলীপ তরফদারের নাকি ব্রির সে বিষয়ে কোনো ডকুমেন্টেশন পাওয়া যায়নি।’ আসলে সরকারি পর্যায়ের এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী খুবই দুখ্যজনক । সরকারের উচিত স্থানীয় পর্যায়ের আবিস্কার গুলুকে সম্প্রসারনে উদ্যোগী হওয়া, বীজ রাজনীতির জালে আবদ্ধ করে রেখে নয় । তা হলেই র্স্মাট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন সার্থক হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই
ড. মিহির কুমার রায় নোনা জলের ধান ‘চারুলতা’: এক বিস্ময়কর আবিস্কার মুক্তমত