তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হচ্ছে বাংলা ভাষাকে
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৬:০৪
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তানের ছিল দুইটি অংশ: পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের অধিক দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়।
১৯৪৭ সালের ১৭ মে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান এবং একই বছর জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে গ্রহণের পক্ষে মত দেন। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর প্রতিবাদ করেন এবং বাংলার পক্ষে বক্তব্য দেন।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচীতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। ওই অধিবেশনে কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষা ব্যবহারের পক্ষে একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। একই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের তাঁর সংশোধনী প্রস্তাবে ২৯ নং বিধির ১ নং উপ-বিধিতে উর্দু ও ইংরেজির পর ‘বাংলা’ শব্দটি যুক্ত করার দাবি জানান।
তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেন, পাকিস্তানের ৫টি প্রদেশের ৬ কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাংলা ভাষাভাষী। সুতরাং বিষয়টিকে প্রাদেশিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাংলাকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে দেখা উচিত। তাই তিনি গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অন্তর্ভূক্তির দাবি করেন। তৎকালীন পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলীম লীগ সদস্যরা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন। ১১ মার্চ পাকিস্তান গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষা উর্দু বিল পাশ হয়ে যায়।
এর প্রেক্ষিতেই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে গড়ে ওঠে তমদ্দুন মজলিস ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৪৮ সালের ১০ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ধর্মঘট ডাকার সিদ্ধান্ত হয়।
১১ মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবী দিবস’ উপলক্ষে পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ওই দিন ভোরবেলা শত শত ছাত্র ইডেন বিল্ডিং, জিপিও ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করেন। পুরো ঢাকা শহর পোস্টারে ভরে যায়। ছাত্রদের আন্দোলনে পুলিশ লাঠিপেটা করে। নানা জায়গায় অনেক ছাত্র আহত হন। সর্বজনাব শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদসহ সত্তর-পঁচাত্তরজন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়।
১৯৪৮ সালের ১৯শে মার্চ ঢাকায় আসেন পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ২১শে মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘোষণা দেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’।
২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গিয়েও তিনি একই বক্তব্য রাখেন। যখন তিনি উর্দুর ব্যাপারে তার অবস্থানের কথা পুনরুল্লেখ করেন, উপস্থিত ছাত্ররা সমস্বরে ‘না, না’ বলে চিৎকার করে ওঠে। তাৎক্ষণিকভাবে এ ঘোষণার প্রতিবাদে তারা বলে, উর্দু নয় বাংলা হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যেও গভীর ক্ষোভের জন্ম হয়।
বাঙালিরা বারবার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি জানান কিন্তু পাকিস্তান সরকার তা ক্রমাগত প্রত্যাখ্যান করতে থাকে। ১৯৫১ সালে ও ১৯৫২ সালের শুরুতে ভাষা নিয়ে দেশব্যাপী হাজারো আন্দোলন সংগঠিত হয়। সর্বশেষ ১৯৫২ সালের ২৭ শে জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন পুনরায় ঘোষণা করেন “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু”। বাঙালি আর চুপ থাকতে পারল না। সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি যে বাংলা ভাষা মায়ের ,যে ভাষায় কথা বলা যায় প্রাণভরে,যে ভাষাতে গান হয়,কবিতা লেখা হয়,যে ভাষায় মায়ের মমতা,যে ভাষায় বাবার শাসন,যে ভাষায় বোনের আবদার, প্রেমিকাকে প্রেম নিবেদন করে সে ভাষা পাল্টে যাবে, সে ভাষা ব্যবহার করা যাবে না, সে ভাষায় মা’কে মা ডাকা যাবে না, বাবাকে বাবা বলা যাবে না তা কী করে হয়? বাঙালিরা পথে নামলো মায়ের ভাষার জন্য,প্রাণের ভাষার জন্য, বাংলা ভাষার জন্য।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট এবং ২১ শেষ ফেব্রুয়ারি হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয় । তাদের এ আন্দোলনকে প্রতিহত করতে ২০ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার সারাদেশে আন্দোলন, মিছিল, সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করেন। ভাষার জন্য আন্দোলনে আসে নতুন মোড়।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি (৮ই ফাল্গুন ১৩৫৮) ১৪৪ ধারা আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে।
শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১শে ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২২শে ও ২৩শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং শোভাযাত্রাসহ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। ২২শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর , রিক্সাচালক আউয়াল এবং অলিউল্লাহ নামক এক কিশোর। ২৩শে ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এ নির্লজ্জ, পাশবিক, পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগের সদস্যরা সংসদীয় দল থেকে সেদিনই পদত্যাগ করেন।
ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহিদ মিনার, যা ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। ২৬শে ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন।
ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রবর্তিত হয়। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করে।
১৯৯৮ সালে কানাডায় বসবাসরত দুই বাঙ্গালী রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে।
১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘ। ঘোষণার পর ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদার সাথে পালিত হচ্ছে।
২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের নাম এবং এই জাতির ভাষার উপর প্রবল ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছরে এসে সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে, অতি-আধুনিকতায়, তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে ক্রমাগত কমেছে সঠিক উচ্চারণে বাংলা ভাষার ব্যবহার।বেড়েছে বিদেশি শব্দের ব্যবহার।
নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত, মুর্খ থেকে সমাজের উচ্চশিক্ষিত সবাই চায় কথার মাঝে দু-একটা ইংরেজি বলতে। অথচ তাদের মধ্যে শুদ্ধ করে বাংলা বলার কোন আগ্রহ দেখা যায় না।
বাংলা আর ইংরেজির সংমিশ্রণে আজকাল প্রতিনিয়ত বাংলিশ ভাষার প্রচলন বাড়ছে। ফলে বাংলা ভাষা হারাচ্ছে তার নিজস্বতা। দেশের সিংহভাগ মানুষের কাছে এখন বিদেশি ভাষায় কথা বলতে পারাটই অধুনিকতা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলা ভাষার অপব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলেছে সকালে ঘুম থেকে উঠে গুড মর্নিং থেকে শুরু তারপর হাই, হ্যালো গ্যায়েস, আপ, মে, আয়া, গ্যায়া আর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে গুড নাইট গুলোর সাথে বাংলিশ এর অবাধ বিচরন তো রয়েছেই।
টিকটক,ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে বিভিন্ন বিদেশি ভাষায় নিজেদের তুলে ধরার প্রবণতা বেড়েছে ব্যাপক ভাবে। নিজেদের জনপ্রিয় করার এই তালিকায় তরুণ, তরুণী, মধ্যবয়সী এমনকি বৃদ্ধরাও বাদ যাচ্ছেন না। সামাজিক এসব যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয় হওয়ার জন্য বিদেশি ভাষার ব্যবহারের পাশাপাশি তুচ্ছতাচ্ছিল্যও করা হচ্ছে বাংলা ভাষাকে।
দেশে রেডিও ও টেলিভিশনের সংখ্যা এখন অনেক। রেডিও, টেলিভিশনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে ভাষার অপব্যবহার হয়। লক্ষ্য করে দেখা যায় দেশের রেডিও তে যারা সঞ্চালনা করেন তারা বাংলার সাথে বিভিন্ন বিদেশি ভাষা ও শব্দের ব্যাপক ব্যবহার করে থাকেন। বাংলা ইংরেজি এমনকি হিন্দি-উর্দুর মিশ্রণ এবং বিকৃত উচ্চারণে কথা বলে যান অনবরত। হ্যালো গ্যায়িস, হ্যালো লিসেনার্স, হ্যালো ভিউয়ার্স, সম্বোধনের ফলে বাংলা ভাষা হারাচ্ছে তার নিজের অস্তিত্ব। বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডারে যথেষ্ট পরিমাণে শব্দ থাকা সত্ত্বেও বিদেশী শব্দের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে বাংলা ভাষার সৌন্দর্য নষ্ট করা হচ্ছে বারবার। অন্য দিকে বাংলা সংস্কৃতির উপর অন্যতম আগ্রাসন চলাচ্ছে হিন্দি, উর্দু, কোরিয়ান ও ইংরেজি ভাষার নাটক চলচিত্র।
দেশের বিভিন্ন শহরের সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, নামফলক, বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ধরনের শিল্প ও ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান গুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে বিদেশি ভাষার কতটা প্রভাব অধিকাংশ সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, প্রতিষ্ঠানের নাম ইংরেজী ভাষায় লেখা। তাছাড়া যে দুই একটি বাংলা ভাষায় লিখিত সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড পাওয়া যায় সেগুলো অসংখ্য ভুল লক্ষ করা যায়। অথচ ২০১৪ সালের ১৭ ফ্রেবুয়ারি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এক আদেশে দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বরপ্লেট, সরকারি দপ্তরের নামফলক এবং গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যাবহার বন্ধ করতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বলেন। কিন্তু দশ বছর পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এই আদেশের পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এর দায়ভার সরকারের একার নয় দায় আমাদের সকলের। কারন আজও পর্যন্ত আমরা সর্ব সাধারণের মধ্যে আমাদের ভাষার সৌন্দর্য, মাধুর্য পৌঁছিয়ে দিতে পারিনি।বোঝাতে পারিনি আমাদের প্রিয় ভাষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য।
রাজধানীতে থেকে শুরু করে মফস্বলের অলিতে গলিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সব পরিবারের পছন্দের শীর্ষে এখন ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা। ছেলে মেয়েদের ইংরেজিতে মাধ্যমে পড়াশোনা করানো অভিভাবকদের কাছে গর্বের বিষয়। ইংরেজি ও আরবি মাধ্যম শিক্ষার জাতাঁকলে বাংলা মাধ্যমের অবস্থা এখন নড়বড়ে।
তবে আশার আলো দেখাচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম, যেখানে প্রমিত বাংলা উচ্চারণ, আবৃত্তি, নাটক ইত্যাদিকে পাঠ্যক্রমের আওতায় এনে বাংলা ভাষার সংরক্ষণ ও বাংলা সংস্কৃতির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু হতাশা আছে এখানেও বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাই বাংলা বর্ণমালার প্রমিত উচ্চারণ সম্পর্কে সচেতন নন এবং আঞ্চলিকতাদুষ্ট। অন্যদিকে যারাও বা সচেতন, তাদের সংখ্যাও খুবই কম। তাই বাংলা ভাষার প্রমিত উচ্চারণ ও ভাষা সংরক্ষণের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সকল শিক্ষককে যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করাটা অতীব জরুরি।
আশার জাগানিয়া এই তালিকায় আরো আছে প্রমিত বাংলা উচ্চারণের প্রসারে, আবৃত্তি শিল্পের প্রসারে সারা দেশে নিয়মিত কাজ করে যাওয়া নিবেদিত প্রাণ পাঁচ শতাধিক আবৃত্তি সংগঠন। যারা কেবল প্রমিত বাংলা উচ্চারণ নয়, কাজ করে যাচ্ছে আবৃত্তি শিল্পের প্রসারেও। এছাড়াও বিভিন্ন নাট্য সংগঠন, নাট্য দলেও চলে শুদ্ধভাবে বাংলা বলার চর্চা। শিল্পকলা একাডেমির জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ের কেন্দ্রগুলোতেও চলছে আবৃত্তি ও নাটকের প্রশিক্ষণ।
সরকার নিশ্চয়ই নতুন এই শিক্ষাক্রম প্রচলনের সাথে সাথে শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের কাজটিও যথাযথ গুরুত্বের সাথে করবেন। একইসাথে ইতোপূর্বে নিয়োগকৃত সঙ্গীত প্রশিক্ষকের ন্যায় যে সকল সংগঠন, প্রতিষ্ঠান বা মানুষেরা দীর্ঘকাল নিষ্ঠার সাথে প্রমিত বাংলা উচ্চারণ, আবৃত্তি সহ বাংলা সংস্কৃতির নিবিড় চর্চা করছেন তাদের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ বিষয়ে পাঠদান করা। সরকারের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও উচিৎ সন্তানকে প্রথাগত কোচিং, টিউশনির বাইরে নিয়ে সঠিক প্রতিষ্ঠান ও মানুষের কাছে সন্তানের প্রমিত বা শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ চর্চায় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির রক্ষণের এ মহাযজ্ঞে অংশীজন হওয়া।
লেখক: সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই