Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বতন্ত্র সাংসদরাই হোক বঙ্গবন্ধুর আদর্শপুষ্ট শক্তিশালী বিরোধী দল

কাজী মাসুদুর রহমান
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৮:০৮

সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বহুল আলোচিত ও কাঙ্ক্ষিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ তার কর্মযাত্রা সূচনা করেছে। এবারের সংসদ আওয়ামি লীগের ২২৪টি, জাতীয় পার্টির ১১ টি, ওয়ার্কার্স পার্টির ১টি, জাসদের ১টি, কল্যান পার্টির ১টি, স্বতন্ত্রের ৬২টি এবং সংরক্ষিত নারী ৫০টি আসন নিয়ে তার অভিযাত্রা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে আপাততঃ ২৫ জন মন্ত্রী ও ১১ জন প্রতিমন্ত্রী চুড়ান্ত করে মন্ত্রী পরিষদের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৫৬ (২) ধারা বলে এই নিয়োগ দান করেছেন। এরই মধ্যে জাতীয় পার্টিকে সংসদীয় বিরোধীদল হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তবে বিজিত স্বতন্ত্ররা অফিসিয়ালি নির্দলীয় হওয়া সত্ত্বেও সরকারদলীয় তথা আওয়ামী উৎসমূল (তিনজন বাদে) হওয়ার ফলে তাদেরকে কৌশলগত কারণে সংসদীয় বিরোধীদলের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তবে এরা প্রত্যেকে স্বাতন্ত্রিক ভাবে বিরোধী সাংসদের ভূমিকা পালন করতে পারবে।

বিজ্ঞাপন

বলাবাহুল্য, সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী সাংসদ বা বিরোধীদল কিংবা বিরোধী জোট খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কার্যত এরা ছায়া সকারের ভূমিকা পালন করে। বিরোধীদল ছাড়া সংসদ যেমন অর্থবহ হয়না তেমনি গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্য দিয়ে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষারও প্রতিফলন ও বাস্তবায়ন ঘটেনা। রাজনীতিতে বিরোধীদল সংসদ ও রাজপথ উভয় স্থলেই সরব থাকতে পারে।

উল্লেখ্য, নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ তথ্য মতে (২০২৩ সাল পর্যন্ত) দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৩৯ টি। সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ৯৩ টি দল নিবন্ধনের জন্য কমিশন বরাবর আবেদন করেছিল। তার মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বি এন এম) ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বি এস পি) – এই দুটি দল নিবন্ধন পায়। প্রসঙ্গতঃ, নিবন্ধন আইন ২০২০ অনুযায়ী কোনো রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র জাতীয় সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হলে তারা অযোগ্য বিবেচিত হবে। উল্লেখ্য, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কে ‘জাতির পিতা’ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ১৯৭১ সালের- ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও মুজিব নগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানে সন্নিবেশ করা হয়।

বলা বাহুল্য, বাঙালি জাতিসত্তাকে পরম সাধনে ও যতনে লালন করে বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্র সৃস্টিতে বঙ্গবন্ধুর সুমহান আত্মত্যাগের কালজয়ী তথা অবিনাশী ইতিহাসই তাকে ‘জাতির পিতা’ র আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। ইতিহাসের এই পরম সত্যধারা অস্বীকার করে কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী শুধু সাংবিধানিক প্রবিধানে নয়, নৈতিক বিধানেও বৈধতার অধিকার রাখে কিনা তা এখন সময়ের জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা। অথচ বিএনপি-জামায়াতসহ একাধিক দল বা গোষ্ঠী তাদের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় এই পরম সত্যকে স্বীকার করেনা। এমনকি সংবিধানে উল্লেখিত বাকি তিনটি ঐতিহাসিক দলিলকেও তারা অবিলিলায় অস্বীকার করে চলেছে। অথচ এগুলো আমাদের বীরোচিত মুক্তিযুদ্ধ ও মহান স্বাধীনতার মৌলিক ও অবিচ্ছেদ্য দালিলিক ভিত্তি। শুধু তাই-ই নয়! এরা ছয় দফা, মুজিবনগর সরকার, চার জাতীয় নেতা’র মতো রাস্ট্রীয় মৌলিক ইস্যু গুলোও অস্বীকার করে, বিকৃতি ঘটায়ে কথিত ভিন্ন মতের রাজনীতির নামে কার্যত রাস্ট্রবিরোধী মতের অপচর্চা ‘৭৫ পরবর্তী হতে চালিয়ে আসছে। বিস্মিত বিষয় হলো, এমন ভিত্তিহীন বিতর্কিত মতাদর্শ ধারন করেই বি এন পি এবং তার দোসর- যুদ্ধাপরাধী জামায়াত সরকার ও বিরোধী উভয় স্থলে আসীন হয়েছে। বলাবাহুল্য, বঙ্গবন্ধু কে সপরিবারে হত্যার পর সংবিধানে বাঙালি জাতি রাস্ট্রের মৌলিক চেতনা বিলুপ্তির পাশাপাশি ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে পূর্ববাংলার আবহমান ধ্রুপদী রাজনীতির সৃজনশীল গতিপথ পরিবর্তন করে জাতীয়তা পরিপন্থী অনাদর্শিক পথে দেশকে নিপতিত করানো হয়।

বিজ্ঞাপন

গণতন্ত্র ও ভিন্নমত চর্চার নামে জাতীয় চেতনা বিপন্থী এমন বিকৃত ও তথাকথিত রাজনীতি চর্চার দৃষ্টান্ত বিশ্বে দ্বিতীয়টি নাই। এ দিক থেকে জাতি হিসাবে আমরা দূর্ভাগা। এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া স্বরুপ রাজনীতি এখন আর স্বদেশ প্রেমের ওপর ভর করেনা। রাজনীতি এখন অনেকটাই সাম্প্রদায়িকতা, পেশীনীতি ও দূর্নীতি’র কোপানলে জর্জরিত যা জিয়ার ভয়ংকর দর্শন’ আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর দ্য পলিটিসিয়ান্স’ এর সফল বাস্তবায়ন বলে মনে হয়। উল্লেখ্য- একটি বৈষম্যহীন, শোষণহীন মানবিক সমাজ গঠনই ছিল বঙ্গবন্ধুর আজীবনের ব্রত।

একটি সর্বজনীন সাম্যের সমাজ গঠনে তিনি আজীবন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। লড়াই করেছেন পেশীনীতি ও দূর্নীতির বিরুদ্ধেও। রাজনীতি কে তিনি পেশা নয় বরং পরম সেবার ধর্ম হিসাবে লালন-পালন করতেন। সাধারণ জনগণই ছিল তাঁর রাজনীতির মৌলসত্তা। সময়ের আবর্তে তাঁর অতিসাধনার আওয়ামিলীগ তাঁর সৃজনশীল রাজনৈতিক দর্শন থেকে এখন অনেক দূরে। বর্তমান রাজনীতিতে তাঁর মহান আদর্শাবলী এখন অনেকটাই কেবল মুখরোচক বাক্যে পরিণত হয়েছে। তা কেবল অনুস্মরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে ; অনুকরণ ও পালন -এর ধারের কাছে নেই। রাজনীতি এখন অনেকটাই অর্থ ও পেশীশক্তির বুর্জোয়া পণ্যে পরিণত। জনতান্ত্রিক নয় বরং ধনতান্ত্রিক ও আমলাতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব এখন রাজনীতিকে ক্রমশঃ গ্রাস করে ফেলেছে। ম্লান হয়েছে রাজনীতির পরিশীলন চর্চা।

উল্লেখ্য, ‘৭৫ পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ যখনই ক্ষমতাসীন হয়েছে তখনই মুলতঃ বি এন পি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে। তখন কেউই দেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শুন্যতা পূরণে আওয়ামীলীগকে নুন্যতম তাগিদ দেয়নি। কেননা, তারা কেউই বঙ্গবন্ধুর সর্বজনহিতৈষী রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী নয়। পক্ষান্তরে, আওয়ামীলীগ যখন বিরোধী দলে থেকেছে তখন তারা রাস্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সুমহান আদর্শ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে জাতির মগজ ও মনন থেকে চিরতরে নস্যাৎ করার গভীর ষড়যন্ত্রের অপরাজনীতি করেছে। এমনকি তাবৎ আওয়ামীলীগকে চিরতরে নিঃশেষ করার লোমহর্ষক ষড়যন্ত্রেও মত্ত থেকেছে যা ২১ আগস্টের মতো নৃশংস গ্রেনেড হামলা ও শেখ হাসিনাকে ২১ বার হত্যা চেস্টা সহ অসংখ্য ভয়ংকর-ঘৃণ্য উদাহরণে জর্জরিত। বিশেষ করে বি এন পি -জামায়াত বিরোধী দলের মুখোশে সরকার বিরোধিতার নামে কার্যত দেশবিরোধীতায় আভ্যন্তরীন ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুভাবে সংশ্লিষ্ট থেকেছে যা কখনোই গণতান্ত্রিক চর্চা হতে পারেনা। বলাবাহুল্য, বঙ্গবন্ধু ও তার আদর্শিক দর্শন কোনো নির্দিষ্ট রাজনেতিক দল বা গোষ্ঠীর একান্ত সম্পদ নয়। তিনি ও তার আদর্শ দল, মত, গোষ্ঠী নির্বিশেষে অবশ্যই পূজনীয় ও অনুকরণীয়। সন্দেহাতীত ভাবে, ঐতিহাসিক সূত্রে একামাত্র তিনিই আমাদের জাতীয় রাজনীতির মডেল, আইকন, আইডল। তার আদর্শকে অস্বীকার করে এদেশের কোনো রাজনীতিই পরিপুষ্ট হতে পারেনা।

‘বঙ্গবন্ধু’ থেকে ‘বিশ্ববন্ধু’ স্বীকৃতির মাধ্যমে তার সৃষ্টিশীল রাজনৈতিক দর্শন এখন জাতীয় সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও পরম কৃতিত্বের ইতিহাস গড়েছে ; অর্থাৎ পৃথিবীর যে কোনো অধিকার বঞ্চিত ভগ্নদশা জাতি বা গোষ্ঠী’র মুক্তির আলোক বর্তিকা হিসাবে তিনি অনন্তকাল অনুকরণীয় হয়ে থাকবেন। প্রসঙ্গত, এই প্রথম জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শপুষ্ট এক ঝাঁক স্বতন্ত্র সাংসদ আওয়ামিলীগ সরকারের বিরোধীগোস্ঠী হিসাবে সংসদে অবতীর্ণ হয়ে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দেশ পরিচালনায় এই সরকার কতটা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করবে তা গাইডিং করার এই প্রথম সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যদিও জাতীয় পার্টি অফিসিয়ালি প্রধান বিরোধীদল হিসাবে এই সংসদে স্বীকৃতি পেয়েছে তবুও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে নীতিগতভাবে তারা দায়িত্বশীল হবে না। কেননা, বিএনপি’র মতো জাতীয় পার্টিও সামরিক ব্যারাক হতে জন্ম নেওয়া একটি অগণতান্ত্রিক দল যারা হীন স্বার্থ চরিতার্থে ধর্মকে কূটকৌশলে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িকতার লালসালু লাগিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করে জাতীয় রাজনীতিকে কলুষিত করেছে; এমনকি ‘৭২ এর মহান সংবিধানকে জিয়ার মতো বিক্ষত করে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বীজ বপনের মাধ্যমে বাঙালি জাতির চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক ঐক্যের শুভবন্ধনে ফাটল ধরিয়েছে এবং প্রবল আঘাত হেনেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতেও। বলা যায়, জিয়া সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তি স্থাপন করেন আর এরশাদ সেই ভিত্তির ওপর ‘রাস্ট্রধর্ম ইসলাম'(?) এর নামে সাম্প্রদায়িকতা নির্মাণ করেন।

দীর্ঘ সময়ে এদের সৃষ্ট বিজাতীয় প্রভাবে প্রজন্মের এক বিরাট অংশ এখন জাতিসত্তা বোধে সন্দিগ্ধ ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত!ফলে, যুগান্তরে পশ্চাদপদ হয়েছে আমাদের জাতীয় অগ্রযাত্রা। আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবীর প্রতিটি দেশ ও জাতি যখন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিযোগিতার কক্ষে ধাবমান তখন আমাদেরকে আজো জাতিসত্তা, ইতিহাস, ঐতিহ্যের মতো মৌলিক ইস্যুগুলোকে বিকৃতির আগ্রাসন থেকে বাঁচানোর জন্য মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক লড়াই করতে হয়; উদ্বিগ্ন থাকতে হয় এসকল পরম সংবেদনশীল ইস্যুগুলোর বিরুদ্ধে অপরাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের আশংকায়! তার উপর দূর্নীতি, অর্থপাচার, বাজার সিন্ডিকেট, কৃত্রিম মূল্যস্ফিতী প্রভৃতি বিচিত্র নৈতিক অবক্ষয়ের বিভৎসতা সামাজিক ও নাগরিক জীবনকে নিদারুণ বিষন্ন করে তুলেছে! বিপন্ন হচ্ছে সুশান!স্বতন্ত্র সাংসদরা বঙ্গবন্ধুর অবিনাশী আলোয় দ্যুতিময় হয়ে ছায়া সরকারের ভূমিকায় দেশ ও জাতিকে একটি সুন্দর উপভোগ্য আগামী’র পথ দেখাবে এই শুভ প্রত্যাশায় আমরা।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

কাজী মাসুদুর রহমান মুক্তমত স্বতন্ত্র সাংসদরাই হোক বঙ্গবন্ধুর আদর্শপুষ্ট শক্তিশালী বিরোধী দল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর