বাড়ছে মূল্যস্ফীতি: গ্রাম শহরের তুলনামূলক পরিস্থিতি
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৬:১৯
মূল্যস্ফীতি এখন দেশের মানুষের কাছে অতি একটি পরিচিত নাম যা ধরেই নেয়া হয়েছে যে এ দেশে বসবাস করতে হলে দ্রব্যমূল্যের অভিঘাত নিয়েই বাচতে হবে। সম্প্রতি ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জানুয়ারি ভোক্তা মূল্য সূচকের (সিপিআই) হালনাগাদ প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে যেখানে মূল্যস্ফীতির গ্রাম শহরের তুলনামূলক পরিস্থিতি উল্লেকিত হয়েছে। আগের দুই মাসে কিছুটা কমলেও জানুয়ারিতে এসে ফের বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। এ মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে। এবারে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রেখেছে খাদ্য বহির্ভূত পণ্য। নভেম্বরে এরকম পণ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা জানুয়ারিতে বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। অন্যদিকে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশে। বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, এবার গ্রামের চেয়ে শহর এলাকায় মূল্যস্ফীতি বেশি হয়েছে। জানুয়ারিতে শহর এলাকায় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশে, আগের মাস ডিসেম্বরে যা ছিল ৯ দশমিক ১৫ শতাংশ। শহরে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ আর খাদ্য বহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এদিকে গ্রামে জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭০ শতাংশে, ডিসেম্বরে যা ছিল ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। গ্রামে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ, যা ডিসেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ। গ্রামে খাদ্য বহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ১৯ শতাংশ, যা ডিসেম্বরে ছিল ৮ দশমিক ৪১ শতাংশ। চলতি অর্থবছর গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্যমাত্রা ছিল সরকারের। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে আমদানি করতে না পারায় সংকট আরও বেড়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য এত দিন মূলত ডলারের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুদের হার বাড়লে মানুষ সাধারণত ব্যাংকে আমানত রাখতে উৎসাহিত হন। গত কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টাও এবার ব্যর্থ হয়েছে। কয়েক মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও বেড়েছে খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি।
ঠিক এর আগের বছর চিত্রটি ছিল উল্টো। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৩ সালের তথ্যের বরাত দিয়ে ৩০ এপ্রিল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক বছরের বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতির হার শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি। মার্চে শহর ও গ্রামে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৬৯ এবং ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হয়েছে দশমিক ৮৩ শতাংশ। আর খাদ্য খাতে যখন শহরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ, তখন গ্রামে এ খাতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ৭১ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত খাতে শহর ও গ্রামে মার্চে মূল্যস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৯০ এবং ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু মার্চে নয়, বরং গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত টানা ১৪ মাস শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষের আয়ের উৎস খুবই সীমিত। তাই মূল্যস্ফীতির উচ্চহার তাদের জীবনে দুঃখ-কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। গ্রামাঞ্চলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কীভাবে সেখানকার মানুষের দুঃখ-কষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে এবং কীভাবে তা কিছুটা লাঘব করা যেতে পারে, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য। মার্চ এবং পূর্ববর্তী ১৬ মাসে মূল্যস্ফীতির হার পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল মার্চে। এ হার ছিল ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। এর আগের মাসে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। এদিকে যখন মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, তখন কমেছে সাধারণ মানুষের আয়। আর এটি ঘটছে গত এক দশক ধরে।
বিবিএসের তথ্যের বরাত দিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) সম্প্রতি দেখিয়েছেন, ২০১০-১১ অর্থবছরে বিবিএসের মজুরি সূচক ছিল ১০০ পয়েন্ট, যা ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮০ দশমিক ৮৩ পয়েন্টে। এর মানে হলো, ২০১০ সালে মানুষের গড় মজুরি যদি ১০ হাজার টাকা হয়, তাহলে ২০২০-২১ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৮ হাজার ৮৩০ টাকা। এক যুগে মজুরি বেড়েছে ৮১ শতাংশের মতো। অন্যদিকে বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৫-০৬ সালে মূল্যস্ফীতি সূচক ছিল ১০০, যা প্রতিবছর বাড়তে বাড়তে ২০১০-১১ অর্থবছরে দাঁড়ায় ১৫৬ পয়েন্টে। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সূচক ২৮৮ পয়েন্টে উন্নীত হয়। মূল্যস্ফীতির ভিত্তি পুনর্বিন্যাস করলে দেখা যায়, ২০১০-১১ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সূচক যদি ১০০ পয়েন্ট হয়, তাহলে ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৪ পয়েন্টে। অর্থাৎ ২০১০-১১ অর্থবছরে যেখানে জিনিসপত্র কিনতে ১০০ টাকা খরচ হতো, সেখানে তা কিনতে এখন কমপক্ষে ১৮৪ টাকা খরচ হয়।
শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি কেন? গবেষকদের বক্তব্য হলো , গ্রামাঞ্চলে নিত্যপণ্যের জোগানে খরচ বেশি। বেশিরভাগ পণ্যই শহর থেকে যাচ্ছে গ্রামে। কৃষিভিত্তিক নিত্যপণ্যের উৎপাদন গ্রামে হলেও মজুত গড়ে উঠছে শহরে। উৎপাদনের পরপরই সেগুলোর বেশিরভাগই কৃষকের হাত থেকে চলে যাচ্ছে মজুতদারদের নিয়ন্ত্রণে। তারা কম দামে কিনে বেশি দামে গ্রামের মানুষের কাছে বিক্রি করছে। এতে পরে নিজের উৎপাদিত পণ্যই বাড়তি দামে কিনছে কৃষক।এসব কারণেই মূল্যস্ফীতির হার গ্রামে অধিক হারে বাড়ছে। এ ছাড়া রেমিট্যান্সের অর্ধেকের বেশি যাচ্ছে গ্রামে। এগুলোর ৫৩ শতাংশই ভোগ বিলাসে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে অনুৎপাদনশীল খাতে টাকার প্রবাহ বাড়ছে। মূলত এ দুটি কারণেই গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হচ্ছে।
মাত্র এক বছরের কিছু সময়ের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতির যে গতিপথ গ্রাম থেকে শহরের দিকে ধাবিত হয়েছে তা পর্যালোচনার বিষয় । দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঘোষিত আওয়ামী লীগের ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে প্রথম অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মন্ত্রিসভার সদস্যরা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নানা বক্তব্য ও পদক্ষেপের কথা বলছেন। অথচ বাস্তবে লক্ষ করা যাচ্ছে, নিত্যপণ্যের বাজারের অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। এ সমস্যার সমাধানে কর্তৃপক্ষ নানা আশ্বাস দিয়েছে; বেশকিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। তারপরও পণ্যের দাম কমছে না। উলটো বাড়ছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, ভোক্তার জন্য সরকারের দেওয়া শুল্ক ছাড়ের সুবিধা চলে যাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীদের পকেটে। সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের সুফল কেন ভোক্তারা পাচ্ছে না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে বেশকিছু পণ্যের দাম কমেছে। গত ২ মাস ধরে ডলারের দামও মোটামুটি স্থিতিশীল, আমদানি বৃদ্ধির জন্য ডলারের জোগান বাড়ানো হয়েছে। বাকিতে পণ্য আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। শিথিল করা হয়েছে এলসি মার্জিন। কমানো হয়েছে শুল্ক। জ্বালানি তেলের দাম কমায় পণ্যের পরিবহণ খরচও কমেছে। পরিতাপের বিষয়, তারপরও নিত্যপণ্যের দাম কমছে না। বর্তমানে এক কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৪৫ টাকায়; গত বছর একই সময়ে এর দর ছিল ১১০-১২০ টাকা। বস্তুত প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রেই মূল্য ক্রমবর্ধমান। প্রশ্ন হলো, পণ্যের দাম এভাবে বাড়তে থাকলে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার উপায় কী?
রমজান শুরুর কয়েক মাস আগে থেকেই নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। বিশেষত রোজায় যেসব পণ্যের চাহিদা বাড়ে, অসাধু চক্র সেগুলো নিয়ে কারসাজি শুরু করেছে যার প্রভাব গ্রাম-শহর উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য । অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেন-রমজানে খাদ্যপণ্যের চাহিদা কেন বাড়বে আর এ নিয়ে তৈরি হবে সংকট! বাস্তবতা হলো, এ সময় বেশ কিছু খাদ্যপণ্যের পরিভোগ বেড়ে যেতে দেখা যায়। চাল পরিভোগও। গমের চাহিদাও বাড়ে। এরই মধ্যে আটা-ময়দার দাম নতুন করে বাড়ছে। দেশে গমের দাম ভালো মিলছে বলে অনেকে ঝুঁকছে এর চাষে। তবে গমের ফলন এখনো অনেক কম। এ খাতে আমদানির প্রবণতা প্রবল। চালেও আমাদের ‘স্বয়ংসম্পূর্ণতা’র ধারণা ভেঙে পড়ছে। আর স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেই তো হয় না; দামটাও বিবেচ্য। এর নেপথ্যে আছে উৎপাদন ব্যয়ের প্রশ্ন। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়াতেও অনেক পণ্যের দাম বাড়ে। সেটা কিন্তু অযৌক্তিক নয়। ভোক্তার পক্ষে তা ‘অ্যাফোর্ড’ করা আবার কঠিন হতে পারে। চালের ক্ষেত্রে এমনটাও ঘটছে কি না, কে জানে। তবে আমদানিনির্ভরতার সূত্রে কিছু মূল্যস্ফীতি আসছে বিদেশ থেকে। চিনিতে যেমন। এক্ষেত্রে আমরা ভোজ্যতেলের মতোই আমদানিনির্ভর। রমজানে এর চাহিদাও বিপুলভাবে বাড়ে মিষ্টিজাতীয় খাবার তৈরি বেড়ে যাওয়ায়। সরকার নিশ্চয়ই চেষ্টা করবে কর-শুল্ক ছাড় দিয়ে হলেও এসবের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে। ভোক্তা অধিকার সংস্থা, টিসিবি, পণ্য বিপণন ব্যবস্থাপনা, চাহিদা সরবরাহ নেটওয়ার্ক এবং সর্বোপরি আমদানি-রপ্তানি ব্যবস্থাপনায় কঠোর নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা আনয়ন পূর্বক এ সমস্যা সমাধানে তৎপর হতে হবে। অধিকন্তু বিভিন্ন বাজার কমিটি দ্রব্যসামগ্রীর গুণাগুণ যাচাই কমিটি, মালামাল সংরক্ষণ ও গুদামজাত ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং সর্বোপরি মহানগর ও পৌর এলাকাস্থিত বাজারগুলোতে তাদের নিজস্ব পরিদর্শন টিমের আন্তরিকতার সঙ্গে তদারকি কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। আর সকলের সমন্বিত কার্যক্রমে এ দূরবস্থার নিরসন সম্ভব হবে।
লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ
সারাবাংলা/এসবিডিই
ড. মিহির কুমার রায় বাড়ছে মূল্যস্ফীতি: গ্রাম শহরের তুলনামূলক পরিস্থিতি মুক্তমত