আমার চিন্তায় আমার মাতৃভাষা
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৬:২৮
পৃথিবীর প্রত্যেকটি ব্যক্তির এবং প্রত্যেকটি দেশের নিজস্ব মাতৃভাষা রয়েছে। মানুষ জন্মের পর মায়ের মুখে শুনে যে ভাষায় কথা বলতে শিখে ও লিখতে শিখে তাই তার মাতৃভাষা। আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা হচ্ছে বাংলা যা আমাদের মাতৃভাষা। আর এই মাতৃভাষা ৫২’র ভাষা আন্দোলনে কতিপয় ছাত্রনেতাসহ বীর বাঙালির রক্তের বিনিময়ে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাকে এদেশের মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে তৎকালীন সরকার।
আর আমার চিন্তায় আমার মাতৃভাষা বলতে আমি বলবো আদর্শলিপির আদর্শে পথ চলা শুরু করে আজ আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে আমার সুখ দুঃখের নিত্যসঙ্গী হচ্ছে আমার মাতৃভাষা “বাংলা ভাষা”। যে ভাষায় আমাকে আমার বাবা-মা শাসন করেন, শিক্ষক পাঠদান করেন এবং যে ভাষায় আমরা আমাদের আবেগ অনুভূতি বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ভাগ করে নেই সেটাই আমার কাছে আমার মাতৃভাষা। একজন নিরক্ষর লোকের আবেগ-অনুভূতি, চাহিদা, প্রত্যাশা জ্ঞাপন করার যে মাধ্যম সেটি আমার মাতৃভাষা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দুর্বলতা যার মাধ্যমে পূরণ করা যায় সেটি আমার মাতৃভাষা।
আবার কখনো কখনো দেখা যায় একজন ব্যক্তি কোন লোকালয়ে তার নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছে তখন অনেক ক্ষেত্রেই এই আঞ্চলিক ভাষাকে নিয়ে হাসি তামাশা বা ব্যঙ্গ করা হয়। কিন্তু আমার কাছে এই আঞ্চলিক ভাষাটাই আমার কাছে আমার মাতৃভাষা। আর কোন ব্যক্তি তার নিজস্ব বাংলা ভাষায় আনন্দে কথা বলতে পারছে এটাই মাতৃভাষা।
আবার যে কোন আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানে সব সময় দেখা যায় বাংলার থেকে ইংরেজি ভাষাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় এমনকি উচ্চ শিক্ষার পরীক্ষার খাতায়ও ইংরেজি ভাষাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। আর এই গুরুত্বহীন ভাষাটিই হচ্ছে আমার কাছে আমার মাতৃভাষা। আমার মনে হয় ৫২’র ভাষা আন্দোলনে যদি আমরা সঠিকভাবে উদ্বুদ্ধ হতাম তাহলে বিশ্বের অন্য সকল ভাষা থেকে দেশের সকল ক্ষেত্রে এই বাংলা ভাষাকেই অধিক গুরুত্ব দিতাম। বাংলায় কথা বলতে পারাকে নিজেদের গর্ব মনে করতাম।
যে ভাষায় আমি খুব সহজেই চিন্তা করতে পারি এবং সাফল্য লাভ করতে পারি সেটিই আমার মাতৃভাষ। এক্ষেত্রে শরৎচন্দ্র যথার্থই বলেছিলেন, ‘ইংরেজি বা ফরাসি ভাষায় চিন্তা করা যায় না, ইংরেজি লিখতে পারো; কিন্তু মাতৃভাষাকে বড় করে না তুললে চিন্তা চিরদিন ছোট হয়ে থাকবে’।
আমার জীবন এবং সমাজের সঙ্গে আমার মাতৃভাষার সম্পর্ক গভীর, নিরন্তর। আমার চিন্তাভাবনাগুলো মাতৃভাষার সরোবরেই প্রতিনিয়ত সাঁতার কাটে। আমার মাতৃভাষা আমার চিন্তার ভাষা, স্বপ্নের ভাষা। স্বপ্নে কথা বলতে হলে আমি মাতৃভাষায় বলি। আমি যদি কল্পনা করি মানুষের কোনও ভাষা নেই, তাহলে আমার অনুভবে আসে আমার জীবনেও অনেক-কিছুর কোনও অস্তিত্ব নেই। ভাষাহীন মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারলেও তার পক্ষে অনেক বিচিত্র কাজই করা সম্ভব নয়। ভাষাহীন মানুষ এত সহজে বোঝাতে পারে না ‘সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই।’ এখানে আমি যা বোঝাতে চাইছি তা ঠিক এভাবে ভাষা ছাড়া সম্ভব ছিল না। ভাষা ছাড়া মানুষের পক্ষে আরও অনেক-কিছুর মতো সংগীত, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি রচনাও সম্ভব ছিল না; সম্ভব ছিল না বাংলাদেশসহ অন্য কোনও রাষ্ট্রের জন্য সংবিধান রচনা করা।
এখানে কিছু কথা বলতে চাচ্ছি—আদৌ আমরা আমাদের ভাষা কতখানি চর্চা করি কিংবা ভালোবাসি। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর উর্দু অক্ষরে বাংলা লেখার যে প্রস্তাব আমরা দৃঢ়চিত্তে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম আজ ঠিক তার বিপরীতে আন্তরিক সহকারে ইংরেজি বর্ণ দিয়ে বাংলা লেখা গ্রহণ করেছি। উচ্চ শিক্ষায় বাংলা অনুবাদের বই খুবই নগণ্য, বাধ্য হয়ে ইংরেজিতে পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের। ইংরেজিমাধ্যমে নেই তেমন বাংলা চর্চা। মার্কেট, নামি-দামি রেস্টুরেন্টে থেকে ছোট ছোট দোকানে পর্যন্ত নামগুলো ইংরেজি লেখা হয়। ভাষার মাস এলে কোনো কোনো জায়গায় অভিযান চলে। ভাষার মাস চলে গেলে আবার সেই আগের মতোই! সুন্দর উচ্চারণে ইংরেজি বলতে পারলে এখন সেটা একটা মান হিসেবে ধরা হয় কিন্তু শুদ্ধ বাংলা বলতে পারলে কেন নয়?
ইংরেজি সঠিক উচ্চারণ নিয়ে যতটুকু পাঠদান অনলাইন কিংবা অফলাইনে দেখা যায়, বাংলার ক্ষেত্রে তার আংশিক লক্ষণীয় মাত্র। রাষ্ট্র থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে বাংলার চেয়ে ইংরেজির আধিপত্য বেশি। ইংরেজি জানা বা শেখা ও চর্চা করা দোষের কিছু না। কিন্তু বাংলাকে অবহেলা করে যেন না হয়। আসুন ভাষার মাসে প্রতিজ্ঞা করি বাংলাকে ভালোবাসি ও চর্চা করি বছর জুড়ে; তা হোক ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে। তখনই আমাদের ভাষা শহিদের রক্ত ও প্রাণ বিসর্জন সফল ও সার্থক হবে।
সবশেষে আমি বলব মাতৃভাষাকে সকালের কাছে উন্নত মম শির হিসেবে তুলে ধরতে হবে আর এটাই আমাদের একুশের চেতনা।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই