কৃষিখাতে বরাদ্ধ অপ্রতুল
১ মার্চ ২০২৪ ১৭:৪৫
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। সেবা ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও খাদ্য উৎপাদনে ধারাবাহিক অগ্রগতি এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থানের অন্যতম উৎস হওয়ার কারণে অর্থনীতিতে এই খাতের ভূমিকা অপরিবর্তিত রয়েছে। ২০২১২২ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১০ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০১৬১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী শ্রমশক্তির ৪০ দশমিক ৬২ শতাংশ এখনো কৃষিতে নিয়োজিত বিধায় কৃষি অর্থনীতি এখনো নিয়োগের বড় ক্ষেত্র। তবে এটিও অনস্বীকার্য যে, কৃষি খাতের এক সময়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধি হার ক্রমে তলানিতে নেমে আসায় খাদ্য শস্যের জন্য আমাদের আমদানিনির্ভরতা বেড়ে যাচ্ছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত বাংলাদেশ’এর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০ লাখ টন। তখন প্রতি বছর গড়ে খাদ্য আমদানি করতে হতো ১৪ থেকে ২২ লাখ টন। সে সময় জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি; বর্তমানে ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। দেশে বছরে চাষের জমি কমছে প্রায় ১ শতাংশ হারে। তবুও বর্তমানে কৃষি খাতে উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। ফলে খাদ্য ঘাটতির হার নেমে এসেছে ১৪ শতাংশেরও নিচে। কৃষির অগ্রগতির ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বার্ষিক খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি প্রতিবেদন ২০১৯ অনুযায়ী, স্বাধীনতাপরবর্তী ৫০ বছরে দেশের প্রধান প্রধান শস্য উৎপাদন তিন থেকে পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইফপ্রি) ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, দেশের দারিদ্র্য নিরসনে কৃষি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। করোনার অতিমারির প্রভাব এবং ইউক্রেনরাশিয়া যুদ্ধে বিশ্ব অর্থনীতি যেখানে টালমাটাল সেখানে বাংলাদেশের মতো এত জনসংখ্যা অধ্যুষিত, দারিদ্র্যপীড়িত দেশটি এখনো টিকে আছে মূলত কৃষির সফলতার কারণেই। করোনা অতিমারির সময় কৃষকরা করোনাকে অগ্রাহ্য করে খাদ্যপণ্য উৎপাদন করেছিলেন। বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটেও কৃষকরা লাভলোকসানের কথা বিবেচনায় না এনে কৃষিকে তথা দেশের অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত রেখে যাচ্ছে।
এই ধরনের একটি বাস্তবতায় কৃষি খাতে চলতি অর্থবছরের বাজেট বরাদ্দ টাকার অঙ্কে বাড়লেও খাতওয়ারি বরাদ্দের নিরিখে এই খাতে বরাদ্দ শতকরা দশমিক ৩৩ ভাগ কমেছে। কৃষি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৫ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের শতকরা ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। দিনের পর দিন বাজেটে বৃহত্তর কৃষি খাতের হিস্যা হ্রাস পাচ্ছে। ২০১১১২ সালে বৃহত্তর কৃষি খাতের হিস্যা ছিল মোট বাজেটের ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে তা ৬ দশমিক ২ শতাংশে হ্রাস পায়। এবার তা নেমে এসেছে ৫ দশমিক ৭ শতাংশে। যে হারে মোট বাজেট বাড়ছে, সে হারে কৃষি খাতের বাজেট বাড়ছে না। এবার মূল বাজেট বেড়েছে ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশ, কৃষি বাজেট বেড়েছে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ।
কৃষিতে করোনাকালে বিশেষ সহায়তা প্যাকেজ ছিল। এবারের বাজেটেও সহায়তা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার আছে। এটাকে ইতিবাচক বলতে হবে। কিন্তু কৃষি খাতে যে ব্যাপক উন্নয়ন ও যান্ত্রিকীকরণ দরকার, সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা দেখছি না। কৃষি খাতের আধুনিকায়নের জন্য যে গবেষণা ও মাঠপর্যায়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিতে যে সহায়তা আশা করা হয়েছিল, সেটি এই বাজেটে নেই। বাজেটে ছাদ কৃষির কথা বলা হয়েছে। যাদের ঘরের ছাদ আছে কেবল তাদের পক্ষে এ অনুশীলন করা সম্ভব হবে, অন্যথায় নয়।
গত অর্থবছরে দেশের কৃষিপণ্যের রফতানি মূল্য ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। এই ধারা অব্যাহত রাখতে এবং দেশের কোটি কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান দিতে কৃষিতে সরকারি সহায়তা অনস্বীকার্য। বিশেষত উৎপাদনের প্রধান উপকরণ যেমন- সার, বীজ, সেচের খরচ বাড়লে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। সে মাফিক উৎপাদিত দ্রব্যের দাম না বাড়লে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে, পণ্যের দাম বাড়লে ভোক্তা বিপদে পড়ে। এই উভয় সংকটের মোকাবিলায় সরকারকে উৎপাদনের উপকরণে ভর্তুকি দিতে হয়। অনেক দাতা সংস্থা ভর্তুকির বিরোধিতা করলেও প্রায় সব উন্নত দেশই কৃষিতে বিপুল ভর্তুকি দিয়ে থাকে। এরই মধ্যে দুই দফায় ইউরিয়া সারের দাম কেজি প্রতি ১১ টাকা বৃদ্ধি করে ২৭ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে ডিএপি, টিএসপি, এমওপি সারের দামও। যদিও পরিবহন খরচ, সার ছাড় করতে খরচ, সরবরাহ ঘাটতি ইত্যাদির ফলে কৃষককে আরও বেশি দাম দিতে হয়। সুতরাং পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারকে ভর্তুকি বাড়াতে হবে। ২০২৩২৪ অর্থবছরে ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে মোট ৬৬ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পক্ষ থেকে ভর্তুকি হ্রাসের চাপ থাকলেও এ বরাদ্দ ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে টাকার বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বৃদ্ধির কথা বলছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এই ভর্তুকির মধ্যে ১৭ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা সারের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার কৃষি কাজে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়িয়ে কৃষিকে আধুনিক ও লাভজনক করতে নিরলস কাজ করছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে নেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার প্রকল্প। পাশাপাশি কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ত্বরান্বিত করতে দক্ষ জনবল তৈরিতে ইতোমধ্যে মাঠপর্যায়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ফলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সুফল পাওয়া যাচ্ছে। গত বছর থেকে বোরোতে ধান কাটার যন্ত্র কম্বাইন হারভেস্টার, রিপার বেশি ব্যবহৃত হওয়ায় দ্রুততার সঙ্গে সফলভাবে ধান ঘরে তোলা সম্ভব হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে অঞ্চল ভেদে ৫০৭০ ভাগ ভর্তুকিতে কৃষকদের কৃষি যন্ত্র দেওয়া হচ্ছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষিতে নতুন অধ্যায় সূচিত হলো। এর মাধ্যমে ফসল উৎপাদনে সময় ও শ্রম খরচ কমবে। বাংলাদেশের কৃষিও শিল্পোন্নত দেশের কৃষির মতো উন্নত ও আধুনিক হবে। কৃষি যন্ত্রের প্রাপ্তি, ক্রয়, ব্যবহার ও মেরামত সহজতর করতে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
যদি বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে দেখা যায় জিডিপিতে এর হার মাত্র ২৩ ভাগ যা গত কয়েক বছর যাবত স্থবির হয়ে আছে। আবার ব্যাংকিং খাতের হিসাবে দেখা যায় যে কৃষি অর্থনীতিতে ব্যক্তি পর্যায়ে যে বিনিয়োগ হয়েছে তা সামষ্টিক অর্থনীতির বিবেচনায় মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ এবং এতে কৃষি খাতের অংশ আরও কম অথচ ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কৃষি বাণিজ্যকরণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। যেখানে পরিবারভিত্তিক চাষাবাদকে পরিহার করে খামারভিত্তিক বৈজ্ঞানিক চাষাবাদকে (গ্রিন হাউস) উৎসাহিত করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়েছে, ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষীগণ অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। বাজার ব্যবস্থাপনায় এই সকল কৃষকদের কোনো প্রবেশাধিকার এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি যার প্রমাণ কৃষিপণ্য বিশেষত: কৃষকের ধানের মূল্য না পাওয়া। ক্রমাগতভাবে কৃষি প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পাওয়া। কৃষি বাজেটের আরও দিক হলো কৃষির প্রক্রিয়া যেহেতু গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই এর গতিশীলতা ও কর্মসংস্থান বাড়াতে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন।
কৃষি, উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও খাদ্য নিরাপত্তা বর্তমান সরকারের একটি অগ্রাধিকার বিষয়। তাই কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানোর পাশাপাশি তাকে প্রকৃতিবান্ধব করে তুলতে হবে। জনগণের স্বাস্থ্য, পুষ্টির সঙ্গে সমন্বয় রেখে কৃষি ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে, পরিকল্পনা করতে হবে সম্ভাব্য খাদ্য বিপর্যয়ের কথা মাথায় রেখে, ক্ষুদ্র এবং পারিবারিক কৃষকদের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে; আগামী অর্থবছরে সরকারি খাতে কর্মসংস্থান এক শতাংশ বাড়ানো যাবে কিনা তা বলা দুষ্কর। কারণ বৈদেশিক বিনিয়োগ নিম্নমুখী, ব্যাংক থেকে সরকারের ঋন গ্রহণ ঊর্ধ্বমুখী, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ নিম্নমুখী বিধায় কর্মসংস্থান হয় না অথচ দেশে প্রায় ৮০ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেসরকারি বিনিয়োগ। প্রতি বছর ২০ লাখ মানুষ কর্মবাজারে প্রবেশ করে এবং শিক্ষিত বেকার যুবকের সংখ্যা বেশি (২৬ লাখ)। যাদের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে, বিশ্বব্যাপী মোট খাদ্য উৎপাদনের ৮০ শতাংশই আসে পারিবারিক কৃষির মাধ্যমে যার বিবেচনায় জাতিসংঘ ইতোমধ্যে (২০১৯-২০২৮) পারিবারিক কৃষি দশক ঘোষণা করেছে এবং একটি বৈশ্বিক কর্মপরিকল্পনাও চূড়ান্ত করেছে। এই কর্মপরিকল্পনার আলোকে জাতীয় পর্যায়ে নীতিমালা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নে সরকার এবং কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই মিলে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার নকশা তৈরি অত্যন্ত জরুরি।
লেখক: কৃষি অর্থনীতিবীদ, গবেষক
সারাবাংলা/এজেডএস