মিয়ানমারে তিন পরাশক্তির প্রতিযোগিতা কেন
১ মার্চ ২০২৪ ১৮:০৬
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ভূ-কৌশলগত অবস্থানে থাকা মিয়ানমারে নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।মূলত চীনা সমর্থনে কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী “অপারেশন ১০২৭” শুরুর পর মিয়ানমার ইস্যুটি নতুন করে সামনে আসে।এই অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ অনেক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারায় সামরিক জান্তা। সম্ভবত ১৯৬২ সালের পর দেশটির সামরিক জান্তা এতটা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়নি। এ কারণে নাইপেদোর ভাগ্য নিয়ে নতুন করে হিসাব নিকাশ করা শুরু হয়েছে।নিকটতম প্রতিবেশি দেশ হিসেবে মিয়ানমারে বহু আগে থেকেই এশিয়ার দুই পরাশক্তি চীন ও ভারতের প্রভাব দেখা যায়।অন্যদিকে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।বিশ্লেষকরা মনে করেন আইপিএস ঘোষণার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তেমন আর মাথা ব্যথা নেই।ওয়াশিংটনের মূল নজর এখন ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশ সমূহে।কিন্তু মিয়ানমারকে কেন্দ্র করে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনা আধিপত্য ক্রমশ বাড়তে থাকায় ওয়াশিংটন পুনরায় নড়ে চড়ে বসেছে।
যুক্তরাষ্ট্র সুচির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) কর্তৃক গঠিত জাতীয় ঐক্যর সরকারকে বার্মা অ্যাক্টের আওতায় ‘অস্ত্র সরঞ্জাম’ দিয়ে যাচ্ছে।অন্যদিকে ভারত শুরু থেকেই মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে সমর্থন দিয়ে আসছে।আশ্চর্যের বিষয় হলো, ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লি বহুদিনের মিত্র হলেও নিজ স্বার্থে মিয়ানমারে তারা পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানে।তবে এদিক দিয়ে চীন এক অদ্ভূত অবস্থানে আছে।দেশটি সামরিক জান্তা ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমান্তরালে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
এমতাবস্থায় মিয়ানমারের বিনিয়োগ করা বিদেশি দেশগুলো বিপদে পড়েছে।বিশেষ করে মিয়ানমারের উত্তরের প্রতিবেশি দেশ
ভারত।দেশটির রাখাইন প্রদেশে বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে।বর্তমানে এই প্রদেশে দিল্লির কালাদান প্রকল্প কার্যত হুমকির মুখে।কেননা প্রবল ভারত বিরোধী বলে পরিচিত আরাকান আর্মি ইতিমধ্যে এর মূল গন্তব্যস্থল প্লাটোয়া দখলে নিয়েছে।অথচ এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উত্তর-পূর্ব ভারতকে কলকাতা-সিত্তে-প্লাটোয়ার মাধ্যমে ভারতীয় মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করা সম্ভব হতো।রাখাইনে আরাকান আর্মির শক্তি বৃদ্ধিতে ভারতের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।আবার রাখাইনে চীনের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের দেশটির আধিপত্য বৃদ্ধিতে দিল্লির নতুন করে চ্যালেঞ্জে পড়ার বিষয়টি তো আছেই।
পূর্বেই বলা হয়েছে যে চীন মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এক নজিরবিহীন নীতি গ্রহণ করেছে।দেশটি দীর্ঘদিন সামরিক জান্তাকে একতরফা সমর্থন দিয়ে আসলেও এবার তারা ভোল পাল্টেছে।চীন বিদ্রোহী ও সামরিক জান্তা উভয়কেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। বেইজিং মূলত ভূরাজনৈতিক অবস্থান ধরে রাখার কৌশল হিসেবে বিদ্যমান বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়ে সামরিক বাহিনীর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহে বেশ আলোচনায় তিন গেরিলা গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স।বলে রাখা প্রয়োজন এই জোটে সবচেয়ে প্রভাবশালী গেরিলা গোষ্ঠী আরাকান আর্মি।তীব্র ভারত বিরোধী বলে পরিচিত এই গেরিলা বাহিনী রাখাইনে সবচেয়ে বেশি সক্রিয়।চীনের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভের অন্তর্ভুক্ত এই প্রদেশটি বেশ কয়েকটি কারণে বেইজিংয়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।প্রথমত,রাখাইন প্রদেশের চকপিউ গভীর সমুদ্রবন্দরে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলে চীন সহজেই বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরে অবাধে বিচরণ করতে পারবে। প্রসঙ্গত,বেইজিং ইতোমধ্যে মালদ্বীপে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল হুমকির মুখে পড়বে।দ্বিতীয়ত,দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্ট নানা প্রতিকূলতার কারণে মালাক্কা প্রণালি দিয়ে শি’র সরকার জ্বালানি আমদানিতে বেশ অসুবিধাজনক অবস্থায় আছে।তাছাড়া ঐ পথে আছে অত্যধিক যাতায়ত খরচ ও সময় অপচয়ের মতো ঝামেলা। চকপিউ গভীর সমুদ্র বন্দর বেইজিংকে এসব অসুবিধা থেকে মুক্তি দিয়েছে।তারই ধারাবাহিকতায় চীন রাখাইনের থা শোয়ে গ্যাসক্ষেত্র থেকে দেশটির কুনমিং পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন করেছে এবং এর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের তিনটি প্রদেশে গ্যাস সরবরাহ করছে।তৃতীয়ত,চকপিউকে ঘিরে চীনা শিল্পাঞ্চল হচ্ছে বলেও জানা যাচ্ছে। এর ফলে মূল ভূখণ্ডের বাইরে এসেও এই শিল্পাঞ্চল থেকে চীন সাশ্রয়ে তার রপ্তানি বাণিজ্য পরিচালনা করতে সক্ষম হবে।বেইজিং ইরাবতী নদীতে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তুলেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে রাখাইন প্রদেশকে ঘিরে তৈরি হয়েছে কৌশলগত প্রতিযোগিতা।বলে রাখা ভালো মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী গুলো জাতিগত ভাবে যেমন আলাদা তেমনি স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতার প্রশ্নে তাদের উদ্দেশ্যও এক নয়।এ বিষয় গুলো দেশটির আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। অন্যদিকে মিয়ানমারের প্রতিবেশি হিসেবে বাংলাদেশও বেশ বেকায়দায়।বলতে গেলে দেশটি রোহিঙ্গা ইস্যুর পাশাপাশি সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়েও বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে আছে।বাংলাদেশের সীমান্তের সাথে মিয়ানমারের চীন ও রাখাইন প্রদেশ রয়েছে।নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমারের বিভিন্ন প্রদেশে বিদ্রোহীদের লড়াই চললেও রোহিঙ্গা ইস্যুর কারণে ঢাকার বেশি নজর রাখাইনের দিকে।একটা বিষয় পরিষ্কার যে, নিজ স্বার্থের জন্য হলেও বেইজিং কখনো চাইবে না মিয়ানমারে বিশেষ করে রাখাইন প্রদেশে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করুক।এ অঞ্চলে বাংলাদেশের সাথে বেইজিংয়ের সুসম্পর্ক সুবিদিত। তাই এই সুযোগটি কাজে লাগানো যেতে পারে।আবার নয়াদিল্লির সাথে সামরিক জান্তার ভালো যোগাযোগ থাকায় সেদিকেও ঢাকাকে দৃষ্টি দিতে হবে।সুতরাং মিয়ানমার ইস্যুতে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বাংলাদেশকে সম্ভাব্য বিপদ মোকাবিলায় সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এজেডএস