অ্যান্টিবায়োটিক সেবনে সতর্কতা জরুরি
৩ মার্চ ২০২৪ ১৬:৩০
চিকিৎসা বিজ্ঞানের সব থেকে বড় আবিস্কার হিসেবে ধরা হয় অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কার। অ্যান্টিবায়োটিককে বলা হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের আশীর্বাদ। অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কারক স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং বলেছিলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে আজ কোটি কোটি মানুষ বেঁচে যাবে। কিন্ত এক সময় এগুলা আর কাজ করবেনা। তুচ্ছ কারণে কোটি কোটি মানুষ মারা যাবে।
ওনার সেই ভবিষ্যত বাণী সত্যি হতে খুব বেশি সময় নেই। যে হারে পৃথিবীতে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বেড়েছে এতে করে বলা যায়, নিকট ভবিষ্যতে একটি বড় ধরনের সমস্যার মুখে পড়বে মানব জাতি। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অপ্রয়োজনীয় ও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সেবনে কার্যকারিতা হারাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক।
অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের কিছু নিয়ম আছে। অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পন্ন করা আবশ্যক। যদি কোন ব্যক্তি অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজ সম্পন্ন না করেন সেক্ষেত্রে আপনার শরীরে যেটি ঘটবে সেটিকে বলা হয় “অ্যান্টিবায়োটিক রেজিসটেন্স”। মনে করেন, আপনার শরীরে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণজনিত কোন রোগ হলো এবং চিকিৎসক আপনাকে ৭টি অ্যান্টিবায়োটিকের একটি ডোজ দিলো। আপনি ৫টি অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার পর যখন সুস্থতা বোধ করলেন তখন বাকি ২টি আর সেবন করলেন না, ডোজ সম্পন্ন না করার কারণে ব্যাকটেরিয়া গুলো ধ্বংস হয়না বরং বেঁচে যাওয়া ব্যাকটেরিয়াগুলো টিকে থাকার কৌশল শিখে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে ফলে আপমার শরীরে ঘটে ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিসটেন্স’।তখন এই ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে ওই অ্যান্টিবায়োটিক পরে আর কাজ করে না।
দেশের মানুষের একটা বড় অংশ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিসটেন্সে আক্রান্ত। এর ফলে রোগীর আগে যে অ্যান্টিবায়োটিকে রোগ সারতো, এখন আর সেটি কাজ করছে না। না হলে অত্যন্ত উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হচ্ছে। অনেক কে বলতে শুনা যায় একই ঔষধে তার আর রোগ সারছে না। আইসিডিডিআর-বি এবং যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল (এমজিএইচ) পরিচালিত এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, দেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই অ্যান্টিবায়োটিক কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। রোগীর শরীরে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করার অর্থ হলো সুপারবাগ তৈরি হওয়া। প্রতি চারজন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত পুরুষের মধ্যে তিনজনের শরীরেই তিনটি বা তার বেশি অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর দেখা যাচ্ছে। ৭০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অন্তত একটি অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারিয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে বিধিবদ্ধ দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চিকিৎসকদের যথাসম্ভব কম অ্যান্টিবায়োটিক দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় কম, অতিরিক্ত মাত্রায়, মেয়াদোত্তীর্ণ অ্যান্টিবায়োটিক শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করে। বছরে বিশ্বে ৭০ হাজার লোক মারা যায় রেজিস্ট্যান্স বা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুর মাধ্যমে।
গ্রামীণ জনপদের মানুষদের এমনিতেই খুব স্বল্প সংখ্যক মানুষ আছেন যারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থেকে চিকিৎসা নেন। তার উপর বর্তমান পল্লি চিকিৎসক এবং তথাকথিত হাতুড়ে চিকিৎসকদের রোগ নিরাময়ের বিকৃত প্রতিযোগিতার কবলে গ্রামীণ জনপদের রোগীরা। কে কার থেকে বেশি স্বল্প সময়ে রোগ নিরাময় করতে পারে, কে কার থেকে বেশি এন্টিবায়োটিক দিতে পারে এ নিয়ে প্রায় সব এলাকাতেই পল্লি চিকিৎসকদের মাঝে প্রতিযোগিতা দেখা যায়। তাদের রোগ নিরাময়ের একমাত্র হাতিয়ার ‘এন্টিবায়োটিক’। এছাড়া গ্রামীণ জনপদের মানুষের একসাথে ফুল কোর্স কিনার সামর্থ্য থাকেনা ফলে দু’দিন বা চারদিন সেবনে সুস্থ হলে আর বাকি ডোজ সম্পন্ন করেন না অথবা সামর্থ্য না থাকায় প্রয়োজন মনে করেন না। একারণে গ্রামীণ জনপদের রোগীরা বেশিরভাগই এন্টিবায়োটিক রেজিসটেন্সে আক্রান্ত।
ডাক্তারদের অসাবধানতাও অনেকাংশে দায়ী বলা যায়। কারণ ডাক্তারেরা অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার পরামর্শ দেন, তবে খুব কম সংখ্যক ডাক্তার আছেন যারা এন্টিবায়োটিক সেবনের সঠিক নিয়ম জানিয়ে সতর্ক করে থাকেন। এছাড়াও কিছু কতিপয় চিকিৎসক আছেন যারা কোন পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই এন্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন।
ধারণা করা হয়, দেশের ৯০ শতাংশ ওষুধ বিক্রি হয় চিকিসৎকের পরামর্শ ছাড়া। ফলে ওষুধের অপব্যবহার হয় বেশি। অনেক সময় দেখা যায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই তারা নিজেরাই রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দেন। এমনকি দেখা যায় সাধারণ জ্বর সর্দি হলেও তারা অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দেন। কোন পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের ফলে অনেক সময় ভয়াবহা পরিস্থিতি হয় এবং মৃত্যুর ঝুঁকি ও হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ বিক্রিতে বিধি নিষেধ আরোপ করতে হবে নচেৎ এ সমস্যা থেকে উত্তরোণ সম্ভব নয়।
এখনই যদি অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া না হয় না হয়,তাহলে নিকট ভবিষ্যতে সবাইকেই চরম মূল্য দিতে হবে। অতিরিক্ত ব্যবহারে মানবদেহে ক্রমেই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে ওঠায় এর অপব্যবহার রোধ জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে। মনে রাখতে হবে, অ্যান্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার রোধে চিকিৎসকগণকে সচেতন হতে হবে এবং রোগীকে সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি ওষুধ বিক্রেতারা চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনোভাবেই যাতে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করতে না পারেন, সে জন্য ওষুধ প্রশাসনকে ওষুধের বাজারে তীক্ষ্ম নজরদারি করতে হবে এবং লাইসেন্স বিহীন ঔষুধের দোকানগুলোয় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যেকোনো অনুমোদিত দোকান থেকে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রি করা হোক না কেন, সেসব প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বাতিল করতে হবে। একই সাথে কেউ যাতে সরকারি অনুমোদন ছাড়া ওষুধের দোকান খুলতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে এন্টিবায়োটিক যেমন প্রাণ বাঁচাতে পারে তেমনি প্রাণ নাশের কারণ ও হতে পারে।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই