Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাংলাদেশ এবং ভারতের নন-ব্যাংকিং আর্থিক খাতের পার্থক্য

মো. সাইফুল আলম তালুকদার
৪ মার্চ ২০২৪ ১৫:৫২

আমাদের দেশের নন -ব্যাংকিং আর্থিক খাত (ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা এনবিএফআই) অনেক বছর ধরেই তারল্য সংকটে‌ ভুগছে। তারা তারল্য পরিচালনার জন্য মূলত বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণের উপর নির্ভর করে চলে।‌ কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের আমানতের হার ৯.৯৩%-এ সীমাবদ্ধ করেছে অথচ অন্যদিকে অনেক ব্যাংক এখন আমানতের উপর বন্ডের মাধ্যমে ১২-১৩% মুনাফা দিচ্ছে।

তার উপর, সম্প্রতি একটি নতুন আইন অনুযায়ী নন-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো জনপ্রতি ৫০ লাখ টাকা জমার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করেছে, যদিও এনবিএফআই খাতের ৭৩% আমানত ৫০ লাখ টাকার বেশি। এমনকি আগের আমানত যা ৫০ লাখ টাকার বেশি সেটাও মেয়াদ পূর্তির পরে মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ থাকবে না। তবে‌ এই সীমা ১ কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে যদি ব্যক্তিটি যৌথ অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে। নতুন আইনে বাংলাদেশ ব্যাংককে তার বিবেচনার ভিত্তিতে আমানতের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণের ক্ষমতা দিয়েছে এবং সেই মোতাবেক তারা সর্বোচ্চ জমা সীমা ভবিষ্যতে বাড়াতে পারবে।

বিজ্ঞাপন

আমাদের এনবিএফআইগুলোকে তাই এখন ছোট ছোট আমানত সংগ্রহ করতে হবে। কিন্তু নতুন শাখা ও আরও কর্মী নিয়োগ করতে তাদের যথেষ্ট আর্থিক শক্তি নেই। তবে তার পরিবর্তে ভারতের মতো ফিনটেকের মাধ্যমে আমানত এবং ঋণ সংগ্রহের জন্য আমাদের এখনো কোনো বৃহৎ প্ল্যাটফর্ম বা ইকো-সিস্টেম তৈরি করা হয়নি।

অন্যদিকে অ-ব্যাংকিং আর্থিক ক্ষেত্র প্রসারের জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই) এ বছর আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, দ্রুত ডিজিটাইজেশন, ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে দ্রুত সেবা প্রদান এবং উদীয়মান ঝুঁকি মূল্যায়নে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ভারতীয় নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আর্থিক অন্তর্ভুক্তি আরও গভীর করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে কারণ তারা কম ক্রেডিট রেটিংসহ নিম্ন আয়ের ঋণগ্রহীতাদের চাহিদা পূরণ করছে। এনবিএফসিগুলো প্রচলিত ব্যাংকের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে, যেহেতু ব্যাংক‌ উচ্চ ক্রেডিট-রেটেড ঋণগ্রহীতাদের ঋণ দিয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, গত এক দশকে, প্রযুক্তি, স্মার্টফোন অ্যাক্সেস, উন্নত ডিজিটাল স্বাক্ষরতা এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এনবিএফসিআই খুচরা ঋণ  ২২৩.২% শতাংশ বৃদ্ধি করেছে।

বিজ্ঞাপন

ফিনটেক এনবিএফসি-এর খুচরা ঋণের বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। সম্প্রতি ‘মাহিন্দ্রা অ্যান্ড মাহিন্দ্রা ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসেস’ এসএমই খাতে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির জন্য ফিনটেক কোম্পানি লেন্ডিংকার্টের সঙ্গে সহ-ঋণ প্রদান ব্যবস্থার অধীনে তিন বছর মেয়াদী অংশীদারিত্ব চুক্তি সম্পন্ন করেছে। ফিনটেক কোম্পানির সঙ্গে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অংশীদারি চুক্তি কার্যক্রম গ্রহণ করায় এই সেক্টরে ঋণ বিতরণ প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসএমই খাতে মার্চ-২০২২ ও মার্চ-২০২৩ সালে যেখানে ব্যাংকের ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছিল মাত্র ১২.৭% এবং ১২.৪% হারে, সেখানে একই সময়ে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছিল যথাক্রমে ২১.২% ও ৪২.৪% হারে। এছাড়াও ফিনটেকের সঙ্গে যৌথভাবে ঋণ প্রদান করার ক্ষেত্রে ভারতীয় নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো First Loss Default Guarantee সুবিধা ভোগ করছে। অর্থাৎ ফিনটেকের মাধ্যমে আনিত গ্রাহকদের ঋণ প্রদান করার ক্ষেত্রে সর্বমোট ঋণ প্রদানের ৫% ফিনটেক কোম্পানিগুলো প্রদান করতে বাধ্য থাকছে, যদি সেই ঋণ মন্দ-ঋণে পরিণত হয়।

ভারতীয় এনবিএফসি-গুলোতে ৪৩% ঋণ (গোল্ড লোনসহ) খুচরা ঋণের অধীনে রয়েছে, যেখানে মজার তথ্য হলো যে এনবিএফসি-এর গৃহঋণের অংশ দিন দিন কমে যাচ্ছে। যেহেতু পাবলিক, প্রাইভেট এবং বিদেশি ব্যাংকগুলো এই ক্ষেত্রে তাদের ঋণের সরবরাহ বাড়াচ্ছে, তাই, এনবিএফসি গৃহঋণ ব্যবসা টায়ার-১ শহর থেকে টায়ার-৩ শহরে (কেননা টায়ার-১ শহরে ব্যাংকের প্রাধান্য বেশি) স্থানান্তরিত করেছে। কিন্তু, আমরা আমাদের খুচরা ঋণ পোর্টফোলিও বাড়াতে পারিনি যতক্ষণ না আমাদের দেশে শহরগুলো সম্প্রসারিত হচ্ছে। ‘গ্রিন বন্ড’ এক্ষেত্রে আমাদের শহর সম্প্রসারণে অর্থের যোগান দিতে পারে। আমরা জানি, ঢাকা শহরে একটি গাড়ি ঘণ্টায় মাত্র ৪-৫ কিলোমিটার বেগে চলতে পারে, তাহলে আমরা গাড়ির ঋণ কোথায় বিক্রি করব? অথচ একজন সুস্থ সবল মানুষ ঘন্টায় একই পরিমাণ দূরত্ব হেঁটে অতিক্রম করতে পারে।

ঘণ্টায় ৯,৬৬৬টি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) রয়েছে যারা বিভিন্ন বিভাগের আওতায় শ্রেণিবদ্ধ। এনবিএফআইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৯,৬৪০টি নন-ব্যাংকিং ফাইন্যান্স কোম্পানি (এনবিএফসি) হিসাবে গঠিত এবং ৯৫টি রয়েছে গৃহঋণ প্রদানকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে আমানত গ্রহণ করতে পারবে এবং করতে পারবে না এমন উভয় ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এনবিএফসি-এর আমানত বিমা দ্বারা সুরক্ষা করা হয় না বিধায় ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০০২ সাল থেকে ৭৮৪টি আমানত গ্রহণকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৪৯টিতে নামিয়ে এনেছে। আইএল অ্যান্ড এফসি (IL&FC) নামক আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার কারণে, ২০১৮-১৯ সময়কালে ভারতের এনবিএফসি অঙ্গনে চাপ ছিল। যার কারণে তারা ব্যাংক থেকে ধার নিতে পারছিল না এবং মিউচুয়াল ফান্ডগুলোও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ এড়িয়ে চলছিল। ফলে পরবর্তীকালে প্রায় ১৯০০ এনবিএফসি তাদের নিবন্ধন বাতিল করতে বাধ্য হয়।

যাইহোক, আশ্চর্যজনক তথ্য হলো ‘এইচডিএফসি ফাইন্যান্স’ ‘এইচডিএফসি ব্যাংক’এর জন্ম দিয়েছিল, যা বাংলাদেশে কল্পনা করা যায় না। এই দুটি প্রধান প্রতিষ্ঠানের একীভূত হওয়ার আগে (১৭ অক্টোবর, ২০২১ পর্যন্ত) এইচডিএফসি ফাইন্যান্স এবং এইচডিএফসি ব্যাংক উভয়ের মূল্য ছিল যথাক্রমে ৬৮ বিলিয়ন এবং ১২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি এনবিএফসি-কে তারল্য প্রদান করে না এবং বাংলাদেশের মতোই তারল্যের যোগান ব্যাংকের মাধ্যমে প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে। তবে ব্যাংক ঋণের উপর নির্ভরতা কমাতে ভারতের প্রায় সব এনবিএফসিগুলো খুচরা নন-কনভার্টিবল ডিবেঞ্চার (এনসিডি) বা বন্ডের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করবার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছর এনবিএফসিগুলোকে ব্যাংক ঋণের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা এবং সেই সঙ্গে ব্যাংকগুলোকেও এনবিএফসিদের প্রতি ঋণের ঝুঁকি কমাতে সতর্কতা জারি করেছিল, কারণ এনবিএফসিতে ব্যাংক ঋণ ৩০% বৃদ্ধি পেয়েছিল। খুচরা এনসিডি বা বন্ডের সম্প্রসারণ খুচরো বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি ভালো বিনিয়োগ ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করবে। গত কয়েক মাসে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তহবিল সংগ্রহের জন্য বন্ড বাজারে ব্যস্ত সময় পার করছে। ইনক্রিড ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস, ইন্ডিয়াবুলস হাউজিং ফাইন্যান্স, আদিত্য বিড়লা ফাইন্যান্স, মুথুট ফিনকর্প এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। বলা বাহুল্য, বহু বছর আগে থেকেই ভারতীয় এনবিএফসি ডিবেঞ্চার (দীর্ঘমেয়াদী ঋণ) এবং কমার্শিয়াল পেপার (স্বল্পমেয়াদী ঋণ) থেকে প্রায় ২৫% তহবিল সংগ্রহ করে যাচ্ছে।

ভারতে এনবিএফসি সেক্টর তার আবির্ভাবের পর থেকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছে, যেখানে হাউজিং ফাইন্যান্স, মাইক্রো-ফাইন্যান্স এবং কনজিউমার ফাইন্যান্স এর প্রসারে অবদান রেখেছে। আরবিআইর মতে, ২৪ জানুয়ারি-২০২৪ পর্যন্ত এসএমই, গোল্ড লোন, গৃহঋণ এবং গাড়ির ঋণে এনবিএফসি-এর অবদান ছিল ১৯%, ২৫%, ৩৪% এবং ৫০%। এসএমই ঋণ ২০১৮ সালে মাত্র ৯% ছিল এবং গৃহঋণ ২০১৮ সালের ৩৯% থেকে হ্রাস পেয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ভারতে এনবিএফসি-এর ক্রেডিট-জিডিপি অনুপাত ৮.৬% থেকে ১১.৫%-এ বেড়েছে, যেখানে একই সময়ে ব্যাংকগুলোর অনুপাত ৫৯.১% থেকে ৫১.২%-এ নেমে এসেছে। অন্যদিকে, এনবিএফআই-তে আমাদের মন্দ-ঋণ নভেম্বর-২০২৩ পর্যন্ত মোট বিতরণ করা ঋণের ৩০%-এ পৌঁছেছে, যেখানে সেপ্টেম্বর-২০২৩ পর্যন্ত ভারতীয় এনবিএফসিগুলোতে ছিল মাত্র ৫%-এর নিচে।

ভারতের ন্যাশনাল অ্যাসেট রিকনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সম্পদ পুনর্গঠনকারী কোম্পানি – এনএআরসি) ২০২১ সাল থেকে ব্যাংকিং খাতের মন্দ-ঋণ কিনে নেওয়া শুরু করেছে। যদিও তাদের লক্ষ্য ছিল ৫০ হাজার কোটি রুপির (ভারতে মন্দ-ঋণজনিত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ কোটি রুপিতে) মন্দ-ঋণ কিনে নেয়া, কিন্তু তারা কিনেছে মাত্র ১০ হাজার ৩৮৭ কোটি রুপি। অর্থাৎ , এনএআরসি তাদের লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২১% পূরণ করেছে। অথচ আমাদের দেশের ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মন্দ-ঋণ কমানোর এই ধরনের কোনো প্রক্রিয়া এখন পর্যন্ত শুরু হয়নি। গত বছর ভারতে নন-ব্যাংকিং আর্থিক কোম্পানির মধ্যে সম্পদ পুনর্গঠনকারী কোম্পানি ছিল ২৯টি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানদের মধ্যে আমার প্রিয় একজন ব্যক্তি হচ্ছেন ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাক্তন প্রধান রঘুরাম রাজন। তিনি তার দায়িত্বকালীন সময়ে দুটি প্রধান কাজ সম্পন্ন করেছিলেন। একটি ছিল ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন এবং অন্যটি হয়তো অনেকেই জানেন না, ইসলামিক ফাইন্যান্সের ওপরে। পেমেন্ট গেটওয়ের উদারীকরণেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ফলশ্রুতিতে ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মাত্র তিন বছর মেয়াদে এই অর্থনীতিবিদ ইউপিআই-এর মতো যুগান্তকারী পদক্ষেপ চালু করতে পেরেছিলেন।

যদি ভারতীয় ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন প্রায় ছয়-সাত বছর আগে ইউপিআই (যা এখন বিশ্বব্যাপী ৫০টি দেশ অনুসরণ করতে চলেছে) চালু করতে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করতে পারে, যাতে সহজে এবং দ্রুত টাকা ট্রান্সফার করা যায় সেটা দেশে বা বিদেশে যেখানেই হোক, তাহলে আমাদের ব্যাংকার্স বা এনবিএফআই অ্যাসোসিয়েশন কেন তা করছে না? কিভাবে করবে, আমাদের দেশে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দুই-তিনটি ছাড়া বাকি সবগুলোই চরমভাবে ধুঁকছে। আর এই মুহূর্তে ১২টি প্রতিষ্ঠান চলছে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছাড়া। অনেক প্রতিষ্ঠানেই গত চার-পাঁচ বছর যাবৎ প্রধান নির্বাহী ছাড়া চলছে খরচ কমানোর অজুহাতে।

লেখক: ব্যাংকার, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসি

সারাবাংলা/আইই

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর