Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালির বুকে চিরভাস্বর

বিপ্লব বড়ুয়া
৭ মার্চ ২০২৪ ১১:৩৫

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বাঙালি জাতির মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ভাষণটি ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ, বাঙালির বুকে চিরভাস্বর, ইতিহাসের অনন্য দলিল। এই একটি ভাষণই পাকিস্তানি শাসকদের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিল। পাকিস্তানি ও তাদের দোসররা কখনো কল্পনাও করতে পারেনি যে, এই ১৮ মিনিটের একটি মাত্র ভাষণই পৃথিবী তোলপাড় করে দিতে পারে। তখন এই ভাষণটি বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য ছিল এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত বর্তমানে এটি এখন বিশ্ব ঐতিহ্যর সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেসকো কর্তৃক ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অফ ওয়ার্ল্ড রেজিস্ট্রার’-এ বিশ্ব ঐতিহ্য সম্পদ হিসেবে গৃহীত হয়। ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ-মূলমন্ত্র। বাঙালি জাতির নিশানা। বঙ্গবন্ধুর কন্ঠে সেদিন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো বাঙালির মনেপ্রাণে আঁচড়ে পড়েছিল- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এর তাৎপর্য মূলক অসাধারণ ভাষণটি। বঙ্গবন্ধুর আপসহীন ভাষণ বাঙালির প্রেরণার উৎস। স্বাধীনতার সাহসী ডাক। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব তথা বাংলাদেশের উজ্জ্বল প্রতীক।

বিজ্ঞাপন

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের পর থেকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের ওপর বৈষম্য আর নীপিড়নের মাত্র বাড়িয়ে দিতে শুরু করে। ১৯৪৮ সালে শুরু হয় ভাষা আন্দোলনের রুপরেখা। আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে আসে ১৯৫২ সালের রক্তঝরা ২১ শে ফেব্রুয়ারি। রক্তক্ষয়ী এই ভাষান্দোলনের মধ্যে দিয়ে বাঙালিরা সুসংগঠিত হতে থাকে। পর্যায়ক্রমে বাঙালিদের হৃদয়ে মুক্তির সংগ্রামের দানা বাঁধতে শুরু করে। এভাবে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অন্দোলন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, ১৯৭১ সালে আসে বাঙালির মুক্তির আন্দোলন স্বাধীনতার সংগ্রাম। এই সবকটি আন্দোলনের নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিলেন জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওর্য়াদী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত প্রমূখ বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বগণ। তাদের সাহসী উচ্ছারণ ও অসীম ত্যাগের ফলে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যায়। বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সাহস ছিল আকাশচুম্বী।

বিজ্ঞাপন

মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার কথা আসলে বাঙালি মাত্রেই নড়েচড়ে বসে উজ্জ্বীবিত হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালে নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তানি মেলিটারী, পুলিশ, রাজাকার, আলবদর বাহিনীরা যেভাবে বর্বর নির্মম নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল তা আগামী হাজার বছরেও বাঙালিরা ভুলবেনা। কারণ তারা চেয়েছিল এই ভূখন্ড থেকে বাঙালির নিশানা মুছে দিতে। হত্যা, ধর্ষন, লুন্ঠন এমন কোনো কাজ বাকি ছিলনা তারা করেনি। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে দেশকে হানাদার মুক্ত করতে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান সমস্ত বাঙালি জাতি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সে সময় যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ খেলায় মেতে ওঠেছিল বিশে^র বুকে এ এক বিরল ঘটনা। ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ ও ২ লক্ষ মা-বোনের সম্মান-সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়ে যে দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল তার রেশ কোনোভাবে মিশিয়ে যেতে পারে না, তাই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার প্রশ্ন ওঠলেই অনেকের মতো আমার হৃদয়েও শিহরণ জাগে।

মার্চ মাস স্বাধীনতার মাস। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ দ্বিধা-বিভক্ত বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গর্জে ওঠা যে ভাষণ তিনি সেদিন রেসকোর্স ময়দানে দিয়েছিলেন সেই থেকে পাকিস্তানি শাসকরা বুঝে গিয়েছিলেন বাঙালিদেরকে তাদের অধিকার থেকে সড়ানো যাবেনা। এরকম সতর্ক আভাস পেয়েই মার্চ মাসের ২৫ তারিখ দিবাগত রাতে প্রথম বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। পূর্ববাংলা জুড়ে নারকীয় তান্ডব শুরু করে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। শহর থেকে গ্রামে সর্বত্র রক্তের হোলি খেলায় মেতে ওঠে। এরকম একটি বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ নয় মাস পাড়ি দিতে হয়েছিল তখনকার মানুষদের। আজ যে মুক্ত স্বাধীন সোনার বাংলাদেশ তার জন্য বাঙালি জাতিকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। যে ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ভূখন্ড বিশে^র মানচিত্রে রক্তস্নাত লাল-সবুজের বিত্ত স্থান গড়ে নিয়েছে আজ স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫৩ বছর পরে এসে জানতে হচ্ছে এটি কেমন স্বাধীনতা। যেখানে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ বৈষম্য আর দূর্নীতিতে নিমজ্জ্বিত সেখানে স্বাধীনতার অর্থ কী দাঁড়ায় আমার কাছে স্পষ্ট নয়। এ জন্য সরকারকে আরো বেশি কঠোর হওয়া ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই।

স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই সংগত কারণে স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত কোন বিষয় নজরে আসলে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে চেষ্টা করি। সম্প্রতি নাজনীন আরা রচিত মুক্তিযুদ্ধের ওপর ‘মা, আমি আমরা আর ১৯৭১’ নামের একটি গ্রন্থ আমার মনোজগতকে পাল্টিয়ে দিয়েছে। গ্রন্থটি পাঠ করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন অনেক ঘটনা পড়ে শিহরিত হয়েছি। ১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন লেখক মাত্র ৮ম শ্রেনির পড়ুয়া ১৩ বছরের এক কিশোরী। লেখকের জন্মস্থান বগুড়ায়। তার পিতা ছিলেন ম্যাজিষ্ট্যাট। ৪ ভাই ৫ বোনের মধ্যে লেখক সর্বকনিষ্ট। বয়স এখন ৬৫ উর্দ্ধো। মুক্তিযুদ্ধের সময় কতো রকমের ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে লেখককে তার বিশদ বর্ণনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলে ধরেছেন এই বয়সে। জীবনের এই দীর্ঘ সময়ের পড়ে এসে তার প্রত্যক্ষ দেখা মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলীকে তিনি যেভাবে তুলে ধরলেন পড়তে পড়তে কখনো কখনো ভয়ে আতংকিত হয়েছি, শিহরিত হয়েছি আবার রোমাঞ্চিত হয়েছি। এ কেমন দিন তখন বাঙালিরা পাড় করেছিল? নারী-যুবতি আর যুবকরা ছিল পাকিস্তানিদের রোষানলের বস্তুু। নারীদের প্রতিছিল লোলুপ দৃষ্টি। মা-বাবা-ভাইয়ের সামনে থেকে উপযুক্ত নারীদের তুলে নিয়ে দিনের পর দিন ধর্ষন আর ব্রাশ ফায়ারে তাদেরকে হত্যা করে নদী-সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে। লেখক তার গ্রন্থে একেকটি বিষয়ের ওপর যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন তা সত্যিই বিস্মিত হয়েছি। গ্রামের পর গ্রাম জ¦ালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়কার করে দিয়েছে। এখানে একটি কথা বলতে চাই। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময়েই আমার জন্ম। অনেকের মুখ থেকে শুনেছি পাকিস্তানি মেলিটারী আর রাজাকারদের হাত থেকে বাঁচতে তখন শহর-বন্দর ছেড়ে মানুষরা মফস্বল-গ্রামের দিকে ছুটে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এরকম হাজারো আশ্রিতাদের নিরাপদ স্থান ছিল আমাদের বাড়িটি। আমার মা-বাবারা তখন নাকি মানুষদের সেবায় অবিরাম রত ছিল। আমার মতো শিশুকে সেদিন দেখভাল করার সুযোগ হয়নি। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে অন্যের কোলে পিঠে করে মানুষ হতে হয়েছে। মা-বাবারা সেদিন আমার মতো অসংখ্য নারী শিশুর আশ্রয় দাতা, খাদ্য ও নিরাপত্তা দিয়ে মানুষের জীবন রক্ষা করেছিল। আমাদের পরিবারটি ছিল যৌথ পরিবার। তখন বাবার সহোদররা ও মায়েরা যে ত্যাগ করেছিল তার প্রতিদানে আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমার বাবা-মা’দের মতো আরো যারা সেদিন এই ধরণের সাহসী কর্মে হাত বাড়িয়েছিল তাদেরকে আমি স্যালুট জানাই।

জাতির জনকের ৭ই মার্চের ভাষণ এবং এই মার্চ মাস থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলন বাঙালির জাতির জন্য এ এক অসমান্য ঘটনা। বিভিন্ন দিবসকে কেন্দ্র করে এক সময় অলি গলিতে যে হারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও দেশাত্ববোধক গান প্রচারিত হতো শুনে গর্ব লাগতো। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরিতে ছুটে যাবার আমাদের মধ্যে কী রকম আকাঙ্খা জাগতো, উঠতি নবপ্রজন্মের সন্তানদের মধ্যে দিন দিন সেরকম উদ্দীপনা বিলীনের পথে। উন্মুক্ত রাস্তাজুড়ে আল্পনা সাজানো হতো, উন্মুক্ত মঞ্চে স্মৃতিচারণ মূলক কথামালা হতো। সেই সাথে দেশাত্ববোধক আর গণসঙ্গীত পরিবেশন করা হতো। উদ্দীপনা মূলক কবিতা পাঠ হতো, ভাষা শহীদ আর মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক পথ নাটক হতো। সে সব এখন অতীত! এখন হয় কদাচিত, ঘরোয়া পরিবেশে, হলের ভেতরে। এর দায়ভার শুধু সরকারের নয় রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোর ওপরও কিছুটা বর্তায়। এখন বেশিরভাগ রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে দেখি বিশেষ দিনে শহীদ মিনারে একটি ফুলের মালা অর্পনের মধ্যে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করতে। নবপ্রজন্মদেরকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সম্পর্কে জ্ঞাত করতে হলে সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠগুলোদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। আর না হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে আমরা মুখে যত কথাই বলিনা কেন বাস্তবে রূপ হবে বিপরীত।

আমাদের দেশে একটি বিশাল জনগোষ্ঠী রাস্তায় জীবিকা নির্বাহ করে তাদের জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোর কী কোন করনীয় নেই? সাংস্কৃতিক উদ্যোগ-আয়োজনের মধ্যে দিয়ে তাদেরকে জাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তারা যদি না দেখে, না শুনে তাহলে বাংলাদেশকে জানবে কিভাবে? অতকিছুর পরও প্রতিবছর চট্টগ্রাম নগরের ডিসি হিলের পাদদেশে উন্মুক্ত রাস্তাজুড়ে ‘সীবলী সংসদ’ নামে চট্টগ্রামের একটি ঐতিহ্যবাহী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারে এই আয়োজনটি সরকারি কোনোরকম পৃষ্ঠপোষকতা ব্যাতিরেখে চালিয়ে আসছে। সাধারণের মনে ইতিহাসকে পৌঁছে দেওয়ার চেস্টা করছে বেশ ক’বছর ধরে। এই অপ্রাপ্তির মধ্যেও সীবলী সংসদ চট্টগ্রামের আয়োজন প্রশংসার দাবি রাখে। স্বাধীনতার দীর্ঘ বছরেও বাংলার ইতিহাস-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার পাঁয়তারায় লিপ্ত রয়েছে বাংলার সংস্কৃতি বিরোধী একটি মহল। একশ্রেণির প্রজন্ম এখন প্রাণের সংস্কৃতির বদলে বিভিন্ন দিবসে চালায় হিন্দি গানের প্যারোডি আর ধর্মীয় উন্মাদনা উগ্রপন্থী মূলক কথার ফুলঝুরি। এই যদি অবস্থা হয় তাহলে আমাদের আগামী প্রজন্ম কিভাবে দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতিকে ধারণ করবে। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বাঙালি জীবনের ত্যাগের ফসল। স্বাধীনতার মর্মার্থ বাঙালির জীবনাচরণে আরো বেশি সজাগতার সহিত সচেতন-জাগ্রত হোক এই প্রত্যাশা।

লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/এসবিডিই

৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালির বুকে চিরভাস্বর বিপ্লব বড়ুয়া মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর