নারীর ক্ষমতায়নে শহিদ জিয়া ও বেগম জিয়ার অবদান
৮ মার্চ ২০২৪ ১৯:২৯
বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বিশেষ অবদান রয়েছে। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের বাস্তববাদী রাষ্ট্রপতি বা রাষ্ট্রনয়ক। তার দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশে সার্বিক অগ্রগতি হয়েছিল। আধুনিক স্বনির্ভর বাংলাদেশের রূপকার জিয়াউর রহমান তার সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নারী সমাজকে মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন অনুভব করেন।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৬, ২৭, ২৮, ২৯ অনুচ্ছেদে নারী-পুরুষের সমঅধিকার ঘোষণা করা হয়েছে। জনজীবনের সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমভাবে অংশগ্রহণের কথাও আমাদের সংবিধানে বলা আছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ছিল ভিন্ন। স্বাধীনতার পর জাতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারীদের সম্পৃক্ততা উল্লেখ করার মতো ছিল না।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণে জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। কিন্তু সেই নারী সমাজ শিক্ষা-দীক্ষায়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পুরুষদের তুলনায় অনেক পশ্চাতে পড়ে রয়েছে। পূর্বে তাদের চেতনাবোধ জাগিয়ে তোলার জন্য কোনো সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা সরকারের তরফ থেকে গ্রহণ করা হয় নাই। ঘর-রান্নার কাজ ছাড়া আর কোনো গঠনমুখী কাজে অংশ নেওয়ার সুযোগ তাদের ছিল না। এই কথা স্বীকার করতেই হবে যে, যদি কোনো জাতির অর্ধেক অংশ পেছনে পড়ে থাকে, তবে সেই জাতির সর্বাঙ্গীণ উন্নতি আশা করা যায় না।’
জিয়াউর রহমানের ১৯ দফার ১১ নম্বর দফায় নারীদের যথাযোগ্য মর্যাদা নিশ্চিত করে এবং সমাজে তাদের যোগ্য স্থানে প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। নারীর কল্যাণ ও তাদের অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের অধীনে একটি নারীবিষয়ক দফতর প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে ১৯৭৮ সালে জিয়া সরকার ‘মহিলাবিষয়ক’ একটি স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। নারীরা যাতে যথাযোগ্য মর্যাদা, ধর্মীয়, শাসনতান্ত্রিক ও আইনগত অধিকার এবং আর্থিক ও সামাজিক সুবিধাগুলো ভোগ করতে পারেন, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তারা যাতে চাকরি করতে পারেন এবং সর্বোপরি সমাজ ও জাতি গঠনে অবদান রাখতে পারেন এ বিষয়গুলো দেখভাল করার লক্ষ্যে মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করে এ মন্ত্রণালয়ে একজন নারীকে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম নারী বেগম খালেদা জিয়া মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে বর্ধিত করে ‘মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে’ রূপান্তরিত করেন। নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধ, নারী পাচার রোধ, নারীর নিরাপত্তা এবং সর্বক্ষেত্রে সমঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই হলো মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মূল লক্ষ্য। ১৯৭৮-৮০ সালের জিয়া সরকারের গৃহীত দ্বিবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারী উন্নয়নবিষয়ক বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। জাতীয় মহিলা সংস্থা ও নারী উন্নয়ন অ্যাকাডেমির তত্ত্বাবধানে নারীদের সেলাই, বুনন, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু পালন এবং মৌচাষ ইত্যাদি নানামুখী প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের কর্ম উপযোগী করে তোলা হয়। বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশন নারীদের জন্য বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে নারীদের কল্যাণে আইডিএ ও বিশ্বব্যাংক বেশ কিছু প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। শহিদ জিয়া নারী শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। শিক্ষিত নারীদের কর্মজীবী নারীতে রূপান্তরিত করার জন্য সরকারি-বেসরকারি খাতে চাকরির শূন্য পদে নারীদের জন্য শতকরা ১০ শতাংশ পদ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীতে প্রাথমিক শিক্ষা ও দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত নারীদের লেখা-পড়া অবৈতনিক করেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া’র নেতৃত্বে সরকার এবং বিশেষ প্রাধিকার প্রদান করা হয়। মাধ্যমিক স্কুলে নারীদের জন্য শতকরা ৫০ ভাগ, সরকারি কলেজের প্রভাষক পদে এক-তৃতীয়াংশ, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে টাইপিস্ট ও করণিক পদের শতকরা ৫০ ভাগ, টেলিফোন অপারেটর ও রিসেপশনিস্টের সব পদ এবং থানা পরিবার পরিকল্পনা অফিসারের ২০ শতাংশ পদ নারীদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। মেডিক্যাল কলেজসমূহের ২০ শতাংশ আসন নারী শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ক্রীড়া অঙ্গনে প্রথম মহিলা ফুটবল প্রতিযোগিতা শুরু করেন।
বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীতে আজ যে নারী সদস্যের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায় এর উদ্যোগটি প্রথম নিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। তিনিই প্রথম সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা উপেক্ষা করে নারীদের পুলিশ বাহিনী যোগদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। গ্রামীণ জনপদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শহিদ জিয়া গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী বা ভিডিপি প্রতিষ্ঠা করেন। এতেও তিনি নারী সদস্য অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রায় ৭৬% আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। তৈরি পোশাক শিল্পকে রফতানিমুখী শিল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উদ্ভাবনী চিন্তার ফসল থেকে। এই পোশাক তৈরির খাতে নারী শ্রমিকের অবদানই আজ সবচেয়ে বেশি। এ খাতে কর্মরত প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিকের শতকরা ৯০ ভাগই নারী। নারীদের এ বিশাল কর্মসংস্থান সৃষ্টি শহিদ জিয়ার দূরদৃষ্টির ফল বলা যেতে পারে।
বাল্যবিয়ে বন্ধ, যৌতুক নিরোধ ও নারী নির্যাতন বন্ধে জিয়াউর রহমান কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। এ কাজে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য ও গ্রাম সরকারকে সম্পৃক্ত করা হয়েছিল। ১৯৮০ সালে জাতীয় সংসদে বিবাহে যৌতুক নিরোধ আইন পাস করা হয়। জিয়ার এসব উদ্যোগের ফলে তখন নারীর প্রতি সহিংসতা অনেক কমে গিয়েছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধি বাংলাদেশের এক নম্বর জাতীয় সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করে ১৯৭৬ সালে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। একটি সামাজিক আন্দোলন হিসেবে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে মাঠপর্যায়ে প্রায় ৫৫ হাজার পূর্ণকালীন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। এদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন নারী।
নারীর ক্ষমতায়নের অংশ হিসেবে শহিদ জিয়া তাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করেন। রাজনীতিতে মহিলারা যাতে অধিকহারে সংস্পৃত হতে পারেন, নিজের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপিতে সে ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৭৮ সালের ২০ অক্টোবর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির প্রথম সভায় বক্তৃতায় তিনি কেন্দ্র, জেলা এবং আরো নিচের পর্যায়ের কমিটিতে নারী সদস্য অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছিলেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন ‘বাংলাদেশের প্রত্যেকটি নারী একদিন না একদিন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সদস্য হবেন।’ শহীদ জিয়া স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থায় নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের বিকাশ, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ব্যাপক অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা এবং তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সরকারের যোগাযোগ তৈরির জন্য তিনি গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
১১ সদস্যের গ্রাম সরকারে ২টি সদস্য পদ নারীদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। এছাড়া প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে ২টি এবং ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনে পাঁচটি সদস্য পদ নারীদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। সংরক্ষিত পদের বাইরেও নারীরা সাধারণ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৬৫(৩) অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদে ১০ বছরের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষণ করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র ৬ নম্বর সংশোধন আদেশ, ১৯৭৮ দ্বারা ১০ বছরের স্থলে ১৫ বছর এবং নারীদের সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ১৫ থেকে বাড়িয়ে ৩০ জন করেন। এর বাইরে সংবিধানের ৬৫(২) অনুযায়ী সাধারণ আসনেও নারীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন। মন্ত্রিপরিষদেও জিয়া নারী সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করেছিলেন। ১৯৭০-৭৫ সালের সরকারে নারী মন্ত্রীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২ জন। ১৯৭৬-৮০ সালে জিয়া সরকারের সময় এ সংখ্যা ৬ জনে উন্নীত হয়।
বেগম খালেদা জিয়া সরকার মহীয়সী নারীদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে সন্মানিত করার জন্য ১৯৯৫ সালে প্রথম “বেগম রোকেয়া পদক” প্রদান শুরু করেন। সংসদে সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৩০ থেকে ৫০-এ উন্নতি করেন। তার সময়েই মাতৃ মৃত্যুর হার কমে এসেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে বর্তমানে শহিদ জিয়ার এসব অবদানকে অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা যায়। প্রবণতা দেখা যায় নারীর ক্ষমতায়ন ও মুক্তির প্রশ্নে খালেদা জিয়ার সরকারের অবদানও। কিন্তু ইতিহাস থেকে কারো অবদান জোর করে মুছে দেওয়া যায় না।
লেখক: সাংস্কৃতিক কর্মী ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
সারাবাংলা/এজেডএস