Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বঙ্গবন্ধুকে প্রকৃত অর্থে কতটুকু ধারণ করি

ইমরান ইমন
১৭ মার্চ ২০২৪ ১৬:০৩

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান—একটি অনুপ্রেরণার নাম, একটি ইতিহাস ও আদর্শের নাম, দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের নাম, অসাম্প্রদায়িকতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের নাম, লাল-সবুজের মানচিত্রখচিত একটি স্বাধীন দেশের উদ্ভাবকের নাম। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অগ্রনায়ক, বাঙালি স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ। তার সুমহান নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি লাল-সবুজের মানচিত্রখচিত অপার সম্ভাবনাময় একটা দেশ। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামীজীবন কেটেছে অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে।

বিজ্ঞাপন

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭মার্চ এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শেখ লুৎফর রহমান ও মোসাম্মৎ সাহারা খাতুনের চারকন্যা ও দুইপুত্রের মধ্যে তৃতীয়সন্তান শেখ মুজিব। বাবা-মা ডাকতেন ‘খোকা’ বলে। কে জানতো ছোট্ট খোকা এদেশের জাতির জনকে পরিণত হবে? এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে হয়তো এদেশ হতো না।

বিজ্ঞাপন

গণমানুষের অধিকার আদায়ে বঙ্গবন্ধু সবসময়ই ছিলেন আপসহীন। গণমানুষের অধিকার আদায় করতে গিয়ে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দিয়েছেন কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে। সইতে হয়েছে অমানবিক নির্যাতন। তবুও তিনি দমিয়ে জাননি, তাঁকে দমিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি।

দেশপ্রেমের মহান আদর্শ বুকে চেপে তিনি আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। বঙ্গবন্ধুর মহান নেতৃত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে এদেশের মানুষ দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলার আকাশে নতুন সূর্যের উদয় হয়।
চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমরা পাই স্বাধীন-সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র, লাল-সবুজের বাংলাদেশ। স্বাধীনতা পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন কর্মোদ্যোগের নীলনকশা তৈরি করেন। কিন্তু তিনি সে নীলনকশা বাস্তবায়নের সুযোগ পাননি। উল্টো তাঁকেই আরেক নীলনকশার বেড়াজালে বলি হতে হয়।

সময়টা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বাংলার আকাশে বাতাসে শোকের মাতম। স্বচ্ছ আকাশে চলছিল ধূসর মেঘের লীলাখেলা। ১৫ আগস্ট আমাদের জাতীয় শোকের দিন, আমাদের বেদনার দিন, আমাদের অশ্রুসিক্ত হওয়ার দিন। এই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

ক্ষণিকের মাঝে বেশ ঠাণ্ডা মাথায় বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে যখন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে নিজ বাসভবনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে বুলেটের তুমুল বৃষ্টিতে ঘাতকরা ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল, তখন যে বৃষ্টি ঝরছিল, তা যেন ছিল প্রকৃতিরই অসহায় আর্তনাদ। সেইদিনের রক্তাক্ত ভেজা বাতাসের আহাজারি ছেয়ে গেছে গোটা বাংলার আনাচেকানাচে।

ঘাতকদের উদ্যত অস্ত্রের সামনে ভীতসন্ত্রস্ত বাংলাদেশ হতাশ হয়ে পড়েছিল শোকের ছায়ায়। যুগ থেকে যুগান্তরে জ্বলবে ১৫ আগস্টের এ শোকের আগুন। বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে হত্যা করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি চিরঞ্জীব। কেননা মহামানবের কখনো মৃত্যু হয় না। সৃষ্টির মধ্য দিয়েই তাঁরা মানুষের মাঝে বেঁচে থাকেন।

বঙ্গবন্ধু এমন এক মহামানব যিনি আমাদের মাঝে অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে জন্ম থেকে জন্মান্তরে বেঁচে থাকবেন। তার সুমহান ত্যাগ আমরা কখনোই ভুলতে পারব না। ‘মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিত মেয়েদের বাবার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দেও, আর ঠিকানা দিয়ে দেও ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর’- এমন কথা যে বলতে পারে সে নিঃসন্দেহে মহাপুরুষ।

এমন মহাপুরুষ হয়তো এ বাংলায় আর জন্ম নিবে না। বঙ্গবন্ধু একটি জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং একটি রাষ্ট্রের স্থপতি। সমগ্র জাতিকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় উজ্জীবিত করেছিলেন ঔপনিবেশিক শাসক-শোষক পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনে দেশের সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শোষক আর শোষিতে বিভক্ত সেদিনের বিশ্ববাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন শোষিতের পক্ষে।

পাকিস্তানি শাসন-শোষণ আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার যে ডাক দিয়েছিলেন তা অবিস্মরণীয়। সেদিন তাঁর বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই অমর আহ্বানেই স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিপীড়িত নিষ্পেষিত বাংলার আপামর জনসাধারণ।

সেই বজ্রকণ্ঠের প্রেরণায় বাঙালি হয়ে উঠেছিল লড়াকু এক বীরের জাতি। আবার ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার পর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেও বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠেই জাতি শুনেছিল মহান স্বাধীনতার অমর ঘোষণা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ওই রাতে বঙ্গবন্ধুকে ধানমণ্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।

এরপর মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তাকে বন্দি থাকতে হয় পাকিস্তানের কারাগারে। তার আহ্বানেই চলে মুক্তিযুদ্ধ। বন্দিদশায় মৃত্যুর খবর মাথায় ঝুললেও স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস করেননি অকুতোভয় এ মহান নেতা। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান।

বীরের বেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তার স্বপ্নের স্বাধীন লাল-সবুজের বাংলাদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। দেশে ফিরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখার পাশাপাশি দেশের মানুষকে উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করেন বঙ্গবন্ধু। দেশগড়ার এই সংগ্রামে চলার পথে তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তার দেশের মানুষ কখনও তার ত্যাগ ও অবদানকে ভুলে যাবে না। অকৃতজ্ঞ হবে না।

নবগঠিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু তাই সরকারি বাসভবনের পরিবর্তে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের সাধারণ বাড়িটিতেই বাস করতেন। এ জাতি যে তার প্রতি অকৃতজ্ঞ হবে সেটা তিনি কখনো ভুলেও চিন্তায় আনেননি। তিনি নিঃস্বার্থভাবে এদেশের মানুষকে ভালোবাসতেন, এদেশের মানুষকে বিশ্বাস করতেন।

এ বিশ্বাস, ভালোবাসা আর দেশপ্রেমের প্রতিদান স্বরূপ এ জাতি তাঁকে উপহার দিল ‘বর্বরোচিত হত্যা।’ ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে এ জাতির অকৃতজ্ঞতা ফুটে ওঠে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্র এবং কতিপয় বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন।

বিশ্ব ও মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সেদিন তারা কেবল বঙ্গবন্ধুকেই নয়, তার সঙ্গে বাঙালির হাজার বছরের প্রত্যাশার অর্জন স্বাধীনতার আদর্শগুলোকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। মুছে ফেলতে অপপ্রয়াস চালিয়েছিল বাঙালির বীরত্বগাঁথা ইতিহাসও।

১৯৭৫ পরবর্তী নানা সময়ে বঙ্গবন্ধুকে মনোজগত থেকে সরিয়ে ফেলার নানা চক্রান্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু নির্বাসনের পরিকল্পনা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এমন এক ব্যক্তিত্ব যাকে পাঠ্যপুস্তক, পত্রিকার পাতা বা টেলিভিশনের পর্দা থেকে সরিয়ে দিলেও বাঙালির মানসপট থেকে তাকে কখনোই সরানো যাবে না। বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব, চিরমহান।

১৯৭৫ সালের এই নির্মম ঘটনার পর থেকে প্রতিবছর আগস্ট মাস এলেই আমরা শোকাহত হই। পুরো জাতি শোকের ছায়ায় মাতম হয়ে পড়ি, ভেঙে পড়ি বেদনায়। রক্তাক্ত ১৫ আগস্টের শোককে আমরা বর্তমান প্রজন্ম শক্তিতে পরিণত করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চেতনা এবং দেশপ্রেমের মহান আদর্শ বুকে ধারণ করে আমরা বিনির্মাণ করতে পারি ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ’।

২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস এবং জাতীয় দিবস। এদিনই স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় ঘোষিত হয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তার সম্মোহনী শক্তি বলে এদেশের আপামরজনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে, স্বাধীন করে দেশকে। আমরা পাই আজকের লাল-সবুজের মানচিত্র খচিত অপার সম্ভাবনার একটি দেশ, বাংলাদেশ। ২০২১ সালে আমরা আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিববর্ষ উদযাপন করেছি। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আমরা এখনও অনেক দিক থেকে স্বাধীন নই। প্রবাদ প্রচলিত আছে—’স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন’। স্বাধীনতার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখা দেশের প্রত্যেক নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব। পাশাপাশি নাগরিকদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্বও সরকারের।

প্রকৃতঅর্থে বঙ্গবন্ধুকে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও তার রাজনৈতিক চেতনাকে কয়জনই বা ধারণ করেন। বর্তমানে দেখা যায়, বিভিন্ন প্রকার স্বার্থসিদ্ধির জন্য মুখে বঙ্গবন্ধু বলে বলে বুলি আওড়ানো হলেও, পোশাক-আশাকে তাকে অনুকরণ করা হলেও প্রকৃতঅর্থে বঙ্গবন্ধুকে, তার আদর্শ ও চেতনাকে ধারণ করতে দেখা যায় না। সব লোক দেখানো ও স্বার্থ হাসিলের ভালোবাসা,
যেটা এক ধরনের ভন্ডামো। ফলে রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ঘটছে। এমন মানুষ দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর। আর সে ক্ষতির প্রভাব এখন চারিদিকে দৃশ্যমান।

বঙ্গবন্ধু আমাদের আমাদের প্রেরণার বাতিঘর। অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শে আমাদের আদর্শিত হতে হবে, তাকে প্রকৃতঅর্থে ধারণ করতে হবে। সর্বোপরি, বর্তমান প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

ইমরান ইমন বঙ্গবন্ধুকে প্রকৃতঅর্থে কতটুকু ধারণ করি মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর