শ্রমিকশ্রেণির প্রথম রাষ্ট্র প্যারি কমিউনের ১৫৩ বছর ও মানবাধিকার
১৮ মার্চ ২০২৪ ১৮:০৬
পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রমিকশ্রেণির প্রথম রাষ্ট্র প্যারি কমিউনের ১৫৩তম বার্ষিকী আজ। ১৮৭১ সালের ১৮ মার্চ ফ্রান্সের বুর্জোয়া শ্রেণি প্রুশিয়ান আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির সাহায্য নিয়ে লড়াই করার বদলে যখন আত্মসমর্পণ করে বসলো, তখন প্যারির শ্রমিকরা বিদ্রোহ করে ক্ষমতা দখল করে নিল। তারা বুর্জোয়া পার্লামেন্টের বদলে স্থাপন করল কমিউন– যার প্রশাসনিক ও আইন তৈরির দু’রকম ক্ষমতাই ছিল। এর সদস্যরা নির্বাচিত হত সার্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে, এবং যে-কোনো মুহূর্তে তাদেরকে প্রত্যাহার করে নেওয়া যেত। স্থায়ী সৈন্যবাহিনী তুলে দিয়ে তার বদলে জনতাকে সশস্ত্র করা হল। পুলিশরা পুরোপুরি জনতার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে এলো। ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যান্য সরকারি কর্মচারীরা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হত, তারা মাইনে পেত শ্রমিকদের মজুরির হারে। ইতিহাসে এই প্রথম সর্বহারাশ্রেণি বুর্জোয়াদের উৎখাত করে নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। আর এই কমিউনার্ডরা যদিও মার্কসবাদী ছিল না তবুও তাদের হাতে এই নতুন রাষ্ট্র সর্বহারা একনায়কত্বেরই রূপ পেল– মার্কস ও এঙ্গেলস যেমনটা ভেবেছিলেন।
এঙ্গেলস লিখেছিলেন- আপনারা জানতে চান, সর্বহারা একনায়কত্ব কেমন দেখতে? প্যারি কমিউনের দিকে তাকান। এটাই হচ্ছে সর্বহারা একনায়কত্ব।
কমিউন মাত্র কয়েক সপ্তাহ টিকে ছিল। শ্রমিকশ্রেণির কোনো পার্টি ছিল না, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন তখনও ছিল নিতান্তই শৈশবে, আর অভিজ্ঞতার অভাবে নেতারাও কয়েকটি মারাত্মক ভুল করেছিলেন। শত্রুদের প্রতি তারা খুবই কোমল ছিলেন, শ্রমিক কৃষক মৈত্রীও তারা গড়ে তুলতে পারেননি। সবচেয়ে বড় কথা, শহর-অবরোধকারী শত্রু সৈন্যদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের জন্য তাদের এত বেশি ব্যস্ত থাকতে হত যে, সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্যের জন্য তারা আদৌ সময়ই পাননি। … (লেনিন)
মে মাসের শেষে কমিউনের পতন ঘটলো এবং নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে প্যারির শ্রমিকরা সেই বুর্জোয়াদেরই রাইফেলবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হল, যারা মাত্র আশি বছর আগে সাম্য, স্বাধীনতা ও মৈত্রীর ধ্বনি দিয়ে সামন্তবাদী রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটিয়েছিল।
কিন্তু তবুও, ঐতিহাসিকভাবে দেখতে গেলে, প্যারি কমিউন ব্যর্থ হয়নি।… এটা যে শুধু প্রথম সর্বহারা একনায়কত্ব ছিল তাই নয়, উপরন্তু এর সাংগঠনিক একক কমিউন ছিল রাশিয়ার শ্রমিক-প্রতিনিধিদের সোভিয়েতগুলোর– যা সেখানে ১৯০৫ সালে, এবং আবার ১৯১৭ সালে গড়ে উঠেছিল– আদি রূপ। লেনিন লিখেছিলেন : পুঁজিবাদের অধীনে, এমনকি সবচেয়ে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রগুলিতেও, আমলাতান্ত্রিক ও বিচারবিভাগীয় বুর্জোয়া যন্ত্রটিকে বজায় রাখতে হয়, বাস্তবত শ্রমিকশ্রেণি ও সমগ্র মেহনতী মানুষের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবেই। একমাত্র রাষ্ট্রের সোভিয়েত সংগঠনই এই সেকেলে অর্থাৎ বুর্জোয়া যন্ত্রটিকে অবিলম্বে ও চিরদিনের জন্য চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে পারে। এ পথে প্রথম যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল প্যারি কমিউন। আর দ্বিতীয় পদক্ষেপ সোভিয়েত শাসনের।
১৮৭১ সালের অভিজ্ঞতা থেকে আহরিত শিক্ষাকেই লেনিন মূর্ত করে তুলেছিলেন তার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং তারই নেতৃত্বে পরিচালিত বিপ্লবী পার্টির কাজের মধ্য দিয়ে।
মানব সভ্যতার ইতিহাস শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস, যা সমাজ অভ্যন্তরের সংঘাতের প্রতিফলন। অভ্যন্তরে বিপরীতের এই সংঘাতের মীমাংসার মধ্য দিয়েই সমাজ এগিয়ে চলে, পুরনো সমাজ ভেঙে গিয়ে একটি নতুন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। কার্ল মার্কস প্রথম দিকের বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদদের অসঙ্গতিকে একপাশে রেখে, অর্থনীতি ও এর বৈশিষ্ট্যগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করে ও নিরন্তর অনুসন্ধান চালিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে দেখালেন যে, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে যে দ্বন্দ্ব বিদ্যমান তা অমীমাংসেয়। যে কারণে সমতা-ন্যায্যতা ও মানবাধিকারের সর্বোচ্চ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় মার্কস ও এঙ্গেলস-এর মতে, সর্বহারা শ্রেণি অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণি ক্রমশ সংগঠিত হয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বুর্জোয়া শ্রেণির কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করবে এবং প্রতিষ্ঠিত হবে। সর্বহারার একনায়কত্বে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এইসবের ফলশ্রুতি হিসেবে শ্রেণিভেদ, শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও শ্রেণিশােষণের অবসান ঘটে। এইভাবে সাম্যবাদী সমাজের সৃষ্টি হয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজে, উৎপাদনের উপকরণের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা লুপ্ত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় সামাজিক মালিকানা। এইভাবে শ্রেণিসংগ্রামের অবসান ঘটবে এবং মানুষের দ্বারা মানুষের শােষণের পরিসমাপ্তি ঘটবে। পরিশেষে, বিপ্লবের মাধ্যমে এসব দ্বন্দ্বের মীমাংসা করা গেলে জনগণের সমতা-ন্যায্যতা ও মানবাধিকারের সর্বোচ্চ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।
শ্রেণি কাকে বলে? মার্কসের শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্বটি
নিচে আলোচনা করা হলো-
শ্রেণির সংজ্ঞা: এমিল বার্নস-এর মতে, একই প্রণালীতে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে, সমাজের এইরকম এক-একটি অংশ হল এক-একটি শ্রেণি। লেনিনের মতে, সমাজে শ্রেণি হল সেই সামাজিক গােষ্ঠীসমূহ যাদের মধ্যে কোনাে এক গােষ্ঠী অর্থনীতির ক্ষেত্রে নিজ অবস্থানের জোরে অন্য কোনাে গোষ্ঠীর শ্রমকে আত্মসাৎ করে। লেনিনের এই সংজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়一
(ক) শ্রেণি হল ঐতিহাসিক দিক থেকে বিচার্য এমন একটি বর্গ যা উৎপাদন ব্যবস্থার ক্রমবিকাশের একটি ফল।
(খ) শ্রেণি এমন একটি বর্গ যার অবস্থান নির্ধারিত হয় উৎপাদন ব্যবস্থার উপকরণগুলির সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।
(গ) সমাজ ব্যবস্থায় শ্রেণী চরিত্র নির্দেশিত হয় সমাজস্থ সম্পদ হস্তগত করার পদ্ধতি ও পরিমাণের উপর ভিত্তি করে।
শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব:
ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্ত্ব অনুযায়ী বৈর উৎপাদন সম্পর্ক উৎপাদন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণকারী সংখ্যালঘুদের সঙ্গে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের বিরােধের সৃষ্টি করে। আদিম সাম্যবাদী সমাজে ভাঙনের পর থেকে ইতিহাসের এই ধারণাটিকে অনুসরণ করা হয়। মার্কস একেই বলেছেন শ্রেণিসংগ্রাম। অর্থাৎ সমাজ বিকাশের এক-একটি পর্যায়ে উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে সংগতি সাধিত হয়, সমাজের সেই স্তরে শ্রেণিসংগ্রামের অবসান ঘটিয়ে। শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে এক-একটি সমাজ ব্যবস্থার উত্থান ও পতনই হল সমাজ বিকাশের অন্যতম চালিকা শক্তি।
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে মার্কস ও এঙ্গেলস রচিত কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’-তে প্রথম বাক্যটিই হল আজ পর্যন্ত ইতিহাসে যত সংগ্রাম দেখা গেছে তা সবই শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস (The history of all hitherto of existing society is the history of class struggles.)
মূলত, মার্কস ও এঙ্গেলস ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দৃষ্টিতে প্রমাণ করেছেন যে, আদিম সাম্যবাদী সমাজ ব্যতীত আজ পর্যন্ত যত সমাজ উদ্ভূত হয়েছে তাদের সকলের ইতিহাস হল শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। একসময় সমাজজীবনে শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল না, উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশের একটি বিশেষ স্তরে পরস্পরবিরােধী শ্রেণির আবির্ভাব ঘটেছিল। ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির সামাজিক অবস্থান এবং স্বার্থ ভিন্ন হওয়ার জন্যই শ্রেণিগুলির মধ্যে বিরােধ শুরু হয়। কোনাে শ্রেণির স্বার্থ হল পরের শ্রম আত্মসাৎ করা বা শােষণ করা, আর কোনাে শ্রেণির উদ্দেশ্য হল শােষণ থেকে অব্যাহতি পাওয়া। ড্রেপার (Draper) বলেছেন, শ্রেণির উন্মেষের পিছনে মূল কারণটি হল উদ্বৃত্ত উৎপাদন এবং সেই উদ্বৃত্ত সম্পদকে করায়ত্ত করে তার উপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই শ্রেণিব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
শ্রেণিসংগ্রামের ধাপসমূহ:
মার্কস সমাজের ক্রমবিবর্তনে ৫টি পর্যায়ের কথা উল্লেখ করেছেন, যথা আদি সাম্যবাদী সমাজ, দাস সমাজ, সামন্ততান্ত্রিক সমাজ, ধনতান্ত্রিক সমাজ এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ।
[১] আদি সাম্যবাদী সমাজে শ্রেণিসংগ্রাম: আদি সাম্যবাদী সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে কিছু ছিল না, ফলে সম্পত্তির ভিত্তিতে সমাজও শ্রেণিবিভক্ত হত না। সেই সমাজে মানুষ বাঁচার তাগিদে গােষ্ঠীবদ্ধভাবে খাদ্য সংগ্রহে নিয়ােজিত থাকত। বলাবাহুল্য, উৎপন্ন দ্রব্য সকলেই সমানভাবে ভােগ করতে পারত বলেই শ্রেণিভেদ বা শ্রেণিদ্বন্দ সেইসময় পলিরক্ষিত হত না।
[২]দাস সমাজে শ্রেণিসংগ্রাম: দাস সমাজ দাসমালিক ও দাস এই দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। দাস সমাজের ইতিহাস হল এই দুটি শ্রেণির মধ্যে বিরতিহীন শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। দাসদের শ্রম শােষণ করে মুষ্টিমেয় দাস-মালিক সম্পদশালী হয়ে উঠল। দাস সমাজে প্রথমে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা গড়ে ওঠে এবং পরবর্তীকালে দাস-মালিক ও দাস শ্রেণির মধ্যে বৈরিতামূলক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দাস সমাজব্যবস্থায় তাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে দাস-বিদ্রোহের সূচনা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রােমে স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে দাসদের সংগ্রাম ইতিহাসের পাতায় আজও উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
[৩]সামন্ত সমাজে শ্রেণিসংগ্রাম: পরবর্তী পর্যায়ের সামন্ত সমাজ শােষক সামন্তপ্রভু এবং শােষিত ভূমিদাস এই দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত হয়। এখানে উৎপাদনের উপাদানসমূহের মালিক সামন্তপ্রভু ভূমিদাসদের অবাধে শােষণ করেছে। তাই এখানে এই দুটি শ্রেণির মধ্যে শ্রেণিসংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী। এই কারণে সামন্ত যুগের ইতিহাস হল অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস।
[৪] পুঁজিবাদী সমাজে শ্রেণিসংগ্রাম: বর্তমানকালের ধনতান্ত্রিক সমাজ শিল্পপতি বা বুর্জোয়া এবং শ্রমিক শ্রেণি বা সর্বহারা এই দুটি পরস্পর বিরােধী শ্রেণিতে বিভক্ত। এই পর্বে উৎপাদনের উপাদানের মালিক মুষ্টিমেয়। সংখ্যালঘু মুষ্টিমেয় শিল্পপতি শ্রেণি নিজেদের শ্রেণিস্বার্থের জন্য সংখ্যার শ্রমিক শ্রেণিকে শােষণ করে। শ্রমিক শ্রেণির দ্বারা সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করাই হল ধনতান্ত্রিক সমাজে মালিক শ্রেণির প্রকৃতি। বুর্জোয়াদের শােষণ যতই বল্গাহীন হয় মেহনতি শােষণমুক্তির সংগ্রাম ততই তীব্রতর হয়। ধীরে ধীরে সংগঠিত সর্বহারা শ্রেণি রাষ্ট্রশক্তি দখল করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে শামিল হয়। এর পরিণতিতে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়।
[৫]সমাজতান্ত্রিক সমাজে শ্রেণিসংগ্রাম: মার্কস ও এঙ্গেলস-এর মতে, সর্বহারা শ্রেণি অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণি ক্রমশ সংগঠিত হয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বুর্জোয়া শ্রেণির কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করবে এবং প্রতিষ্ঠিত হবে। সর্বহারার একনায়কত্বে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এইসবের ফলশ্রুতি হিসেবে শ্রেণিভেদ, শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও শ্রেণিশােষণের অবসান ঘটে। এইভাবে সাম্যবাদী সমাজের সৃষ্টি হয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজে, উৎপাদনের উপকরণের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা লুপ্ত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় সামাজিক মালিকানা। এইভাবে শ্রেণিসংগ্রামের অবসান ঘটবে এবং মানুষের দ্বারা মানুষের শােষণের পরিসমাপ্তি ঘটবে।
শ্রেণিসংগ্রামের বিভিন্ন রূপ:
পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিক তথা সর্বহারা শ্রেণি অনেক বেশি শ্রেণিসচেতন হওয়ায় শ্রেণিসংগ্রাম তীব্র আকার ধারণ করে। তারা তিন ভাবে শ্রেণিসংগ্রাম চালাতে থাকে।
[১] অর্থনৈতিক সংগ্রাম: পুঁজিবাদী তথা বুর্জোয়া (শােষক শ্রেণি) শ্রেণির কাছ থেকে দ্রুত অর্থনৈতিক সুযােগসুবিধা আদায় করাই হল অর্থনৈতিক সংগ্রামের মুখ্য উদ্দেশ্য। এই অর্থনৈতিক সংগ্রাম চালাতে গিয়ে শ্রমিক তথা শােষিত শ্রেণি ধর্মঘট, মিছিলে শামিল হয় এবং প্রতিবাদ সভা, সংঘ গঠন করে।
[২] রাজনৈতিক সংগ্রাম: রাজনৈতিক সংগ্রাম হল এমন এক সংগ্রাম যার মাধ্যমে শ্রমিক তথা শােষিত শ্রেণি বুর্জোয়া তথা পুঁজিপতি শ্রেণির হাত থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে তাদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
[৩] মতাদর্শগত সংগ্রাম: মতাদর্শগত সংগ্রাম হল বুর্জোয়া বা পুঁজিপতি শ্রেণি চিন্তা ভাবনা বা ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধে এবং সমাজতান্ত্রিক তথা শ্রমিক শ্রেণির আদর্শের পক্ষে সংগ্রাম। পুঁজিবাদী সমাজের অব্যবস্থার বিরুদ্ধে শ্রমিক অসন্তোষই যথেষ্ট নয়, সেইসঙ্গে শ্রমিকদের শ্রেণি সচেতনও হয়ে উঠতে হবে। মার্কস বলেছেন, চূড়ান্ত শ্রেণি সচেতনতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য শ্রমিক শ্রেণিকে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালাতে হবে। তবে এখানে মার্কসবাদে দীক্ষিত একটি রাজনৈতিক দলের প্রয়ােজন। শ্রেণিসংগ্রামের ফলে চূড়ান্তভাবে শােষণহীন সমাজের প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে মার্কসবাদীরা মনে করেন।
শ্রেণিসংগ্রামের সমালােচনা:
মার্কসীয় মতবাদের শ্রেণি ও শ্রেণিসংগ্রাম সংক্রান্ত তত্ত্ব বিভিন্ন দিক থেকে সমালােচনার সম্মুখীন হয়েছে।
(১)মার্কসীয় দর্শনে রাষ্ট্রকে কেবলই শ্রেণি শােষণের যন্ত্র হিসেবে দেখানাে হয়েছে। এই শোষণ ব্যবস্হার বিলুপ্ত সাধন করতে পারে কেবলমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্হাতেই।
(২)মার্কস সর্বকালীন সমাজ ব্যবস্থায় পরস্পর বিরোধী দুটি শ্রেণির অস্তিত্বের কথা বলেছেন। বাস্তবে বিত্তবান ও বিত্তহীন বা শােষক ও শােষিত শ্রেণির মধ্যে যা সমাজে বিভিন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণিও স্বতঃস্ফূর্তভাবে জড়িত।
(৩)মার্কসীয় মতবাদে কেবল অর্থনৈতিক স্বার্থের ভিত্তিতে শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে কিন্তু অর্থনৈতিক স্বার্থ ছাড়াও রাজনৈতিক কারণে সমাজে সংঘাতের সৃষ্টি হয়ে থাকে।
মানবাধিকারের প্রাচীন দলিল ‘সাইরাস সিলিন্ডার’:
মানবাধিকারের প্রাচীন দলিল দেখতে অনেকটা পিপার মতো, মাটির তৈরি এই সিলিন্ডার দুই হাজার ৬০০ বছরের পুরোনো। পারস্যের (বর্তমান ইরান অঞ্চল) তৎকালীন সম্রাট সাইরাসের নামে নামকরণ: সাইরাস সিলিন্ডার। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এটিই বিশ্বের ‘প্রথম মানবাধিকার সনদ’।খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩৯ সালে ব্যাবিলন দখল করার পর সাইরাসের নির্দেশে সিলিন্ডারটি তৈরি করা হয়েছিল। এতে খোদাই করে লেখা আছে পারস্য সাম্রাজ্যজুড়ে ধর্মীয় স্বাধীনতা, সহিষ্ণুতা ও মানবাধিকার বাস্তবায়নের কথা।যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অবস্থিত ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে সিলিন্ডারটি সম্প্রতি কিছুদিনের জন্য ধার নেয় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির বিভিন্ন শহরে নিদর্শনটি প্রদর্শিত হয়। ফলে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় পারস্যের অবদানের কথা নতুন করে আলোচনায় আসে।ব্রিটিশ মিউজিয়ামের পরিচালক নিল ম্যাকগ্রেগর বলেন, সাইরাস ও দারিউস প্রতিষ্ঠিত পারস্য সাম্রাজ্যের বিস্তার ছিল বলকান অঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত। জাতিগত বৈচিত্র্য এবং বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতার আদর্শ ওই রাষ্ট্রেই প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একটি তথ্য অনেককেই বিস্মিত করতে পারে, আর তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানপ্রণেতারা সাইরাসের সেই আদর্শে প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেই বিবেচনায় আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রের পথচলায় ইরানের অবদান স্বীকার করতে হয়। অথচ দুটি দেশের বর্তমান সম্পর্ক কতই না বৈরী!ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে সংগৃহীত ১৬টি নিদর্শন প্রদর্শিত হয় ‘সাইরাস সিলিন্ডার অ্যান্ড অ্যানসিয়েন্ট পারসিয়া: অ্যা নিউ বিগিনিং’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে। আর সাইরাস সিলিন্ডারই এ প্রদর্শনীর মূল আকর্ষণ। পিপা আকৃতির সিলিন্ডারটি ব্যাবিলনের ভিত্তিস্তম্ভে ব্যবহার করা হয়েছিল। ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক ও কূটনীতিক হরমুজদ র্যাসামের নেতৃত্বে মেসোপটেমিয়া (বর্তমান ইরাক) থেকে সিলিন্ডারটি ১৮৭৯ সালে উদ্ধার করা হয়।সাইরাস সিলিন্ডারে বর্ণিত রয়েছে সম্রাট সাইরাসের ব্যাবিলন আক্রমণের ইতিহাস। তিনি ব্যাবিলনের দেবতা মারদুকের আমন্ত্রণে প্রথম সেখানে গিয়েছিলেন। আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর তিনি মুক্তি দিয়েছিলেন ব্যাবিলনীয়দের হাতে নির্যাতিত দাস জাতিগোষ্ঠীকে। এ ছাড়া তাদের প্রার্থনালয়ে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল সাইরাসের নির্দেশেই। মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ইহুদিরাও ছিল। তাদের নিজ নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন সাইরাস। এসব অসাধারণ পদক্ষেপ বা অবদানের জন্য একজন ‘উদার ও আলোকিত সম্রাটের’ সুনাম অর্জন করেন সাইরাস।
সাইরাসের জীবনীর ওপর ভিত্তি করে গ্রিক চিন্তাবিদ জেনোফন লিখেছেন সাইরোপিডিয়া। বইটি (গ্রিক ও লাতিন ভাষায়) ইউরোপে ১৭৬৭ সালে প্রকাশিত হয়। একটি কপি স্থান পেয়েছে ওয়াশিংটন ডিসির বিশেষ প্রত্নপ্রদর্শনীতে। আরেকটি কপি ছিল সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের সংগ্রহে, যা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে সংরক্ষিত রয়েছে।
সক্রেটিসের সমসাময়িক চিন্তাবিদ জোনোফন লিখেছেন সাইরাস কীভাবে সহিষ্ণুতার ওপর ভিত্তি করে একটি বৈচিত্র্যময় সমাজ শাসন করতেন। ইউরোপ-আমেরিকায় রাজনৈতিক চিন্তাবিদদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের যুগে সাইরোপিডিয়া বা সাইরাসের উদারপন্থী ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৭৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের খসড়াপ্রণেতারাও বইটির মাধ্যমে বিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত সংগ্রহশালা ফ্রিয়ার অ্যান্ড স্যাকলার গ্যালারিসের পরিচালক জুলিয়ান র্যাবি বলেন, মানবিকতার প্রতি ইরানের অনন্য অবদানের বিষয়টি মার্কিনদের সামনে তুলে ধরার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ একটি দেশকে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালনার কথা অষ্টাদশ শতকের রাষ্ট্রনায়কেরা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রকাশের প্রায় ১০০ বছর পর সাইরাস সিলিন্ডারটি ভূগর্ভ থেকে উদ্ধার করা হয়। ওই ঘোষণার খসড়াপ্রণেতা টমাস জেফারসন ও তাঁর সহযোগীরা নির্ভর করেছিলেন জেনোফনের সাইরোপিডিয়ার ওপর। জেফারসন পরবর্তী সময় যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি সাইরাসের আদর্শ নিবিড়ভাবে পড়েছিলেন এবং পরিবারের অন্য সদস্যদেরও পড়তে বলেছিলেন। ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক সংগ্রহশালা ফ্রিয়ার অ্যান্ড স্যাকলারের পরিচালক (কিউরেটর) মাসুমেহ ফরহাদ বলেন, জেফারসন তাঁর নাতিকে একটি চিঠিতে লিখেছেন, গ্রিক ভাষা শেখা শুরু করার পর প্রথমেই সাইরোপিডিয়া পড়া উচিত।
কালের বিবর্তনে সাইরাস সিলিন্ডারটিতে একাধিক ভাঙন দেখা দিয়েছে, তবে এর ঐতিহাসিক বা প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব এতটুকু ম্লান হয়নি।
বাস্তিল দুর্গের পতন ও ফরাসী বিপ্লব:
২৩৪ বছর পূর্বে ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্স রাজ্যের প্যারিসের কুখ্যাত বাস্তিলে বিক্ষোভ হয়। ফ্রান্সের সম্রাট ষোড়শ লুই তৃতীয় শ্রেণীর বুর্জোয়াদের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও তিনি পুরোনো রাজতন্ত্রের প্রতীক হয়ে থাকতে চেয়েছিলেন। শুধুমাত্র সেই কারণে ফ্রান্সের প্রধান অর্থমন্ত্রী নেকারকে সরিয়ে দিয়ে সেই পদে প্যারিস ও ভার্সাই এর সেনা মোতায়েন করেন। এরপর ফ্রান্সের উত্তপ্ত জনতা ১৭৮৯ সালের ১৪ই জুলাই বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করে ও দখল করে নেয়।
এই বাস্তিল দুর্গের পতনের মধ্য দিয়ে ফরাসী বিপ্লব সংঘটিত হয়। এই বিপ্লব ছিল তদানীন্তন ফ্রান্সের শত শত বছর ধরে নির্যাতিত ও বঞ্চিত “থার্ড স্টেট” বা সাধারণ মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এই বিপ্লবের আগে সমগ্র ফ্রান্সের ৯৫ শতাংশ সম্পত্তির মালিক ছিল মাত্র ৫ ভাগ মানুষ। অথচ সেই ৫ ভাগ মানুষই কোনো আয়কর দিত না এবং এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করত তাদেরকে এই বাস্তিল দুর্গে বন্দী করে নির্যাতন করা হতো। বাস্তিল দুর্গ ছিল স্বৈরাচারী সরকারের নির্যাতন ও জুলুমের প্রতীক। একবার কোনো বন্দী সেখানে প্রবেশ করলে জীবন নিয়ে আর ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকত না । কারাগারের ভিতরেই মেরে ফেলা হতো অসংখ্য বন্দীদের। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই বাস্তিল দুর্গের আশেপাশের বিক্ষুব্ধ মানুষ বাস্তিল দুর্গ অভিমুখে রওনা হয়। দুর্গের সৈন্যরাও ভিতর থেকে কামান দাগাতে থাকে। প্রায় দুইশো বিপ্লবী হতাহত হয়। এরপর চারিদিক থেকে উত্তেজিত বিক্ষুব্ধ জনতা বাস্তিল দুর্গ ধ্বংস করে। জয় হয় সাম্য, মৈত্রী এবং স্বাধীনতার। এই ঘটনাটিই ফ্রান্সের জাতীয় উৎসব বলে পালন করা হয়।
বাস্তিল দুর্গের পতনের পর ফ্রান্সের রাজতন্ত্র খানিকটা শিথিল হয়ে পড়ে। আতঙ্কিত রাজা ফ্রান্সের জাতীয় পতাকাকে মেনে নেয়। জনগণের নির্ধারিত মেয়রকে প্যারিস পৌরসভার প্রধান করা হয়। স্বৈরতন্ত্রের প্রতীক বাস্তিল দুর্গের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্র ক্ষমতা হারায়। ফ্রান্সে রাজতন্ত্র পতনের শুরু হলে, গণতন্ত্র শক্তিশালী হতে শুরু করে। জনগণের আক্রমণে ফ্রান্সের বাস্তিল দুর্গের পতন হলে সম্রাটরা বুঝতে পারে, তাদের সময় বেশিদিন থাকবে না। এরপর থেকে গণতন্ত্র জোর বাঁধতে শুরু করে ও ফ্রান্সে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়।
ফরাসী বিপ্লব ইউরোপ এবং নতুন বিশ্বের উপর একটি বড় প্রভাব ফেলেছিল। মানব ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তনের নির্ণায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। এটি সামন্তবাদের অবসান ঘটায় এবং পৃথকভাবে সংজ্ঞায়িত ব্যক্তিগত মুক্তির ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের অগ্রগতির পথ প্রশস্ত করেছিল।
ফরাসী বিপ্লব (১৭৮৯–১৭৯৯) ফরাসি, ইউরোপ এবং পশ্চিমা সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই বিপ্লবের সময় ফ্রান্সে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে প্রজাতান্ত্রিক আদর্শের অগ্রযাত্রা শুরু হয় এবং একই সাথে দেশের রোমান ক্যাথলিক চার্চ সকল গোঁড়ামী ত্যাগ করে নিজেকে পুনর্গঠন করতে বাধ্য হয়। ফরাসী বিপ্লবকে পশ্চিমা গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি জটিল সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় যার মাধ্যমে পশ্চিমা সভ্যতা নিরঙ্কুশ রাজনীতি এবং অভিজাততন্ত্র থেকে নাগরিকত্বের যুগে পদার্পণ করে।
ফরাসী বিপ্লবের মূলনীতি ছিল “স্বাধীনতা, সমতা, ভ্রাতৃত্ব, অথবা মৃত্যু”। এই শ্লোগানটিই বিপ্লবের চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছিলো যার মাধ্যমে সামরিক এবং অহিংস উভয়বিধ পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বে মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই শ্লোগানটি তখন সকল কর্মীর প্রাণের কথায় পরিণত হয়েছিলো।
কমিউনিস্ট ইশতেহার
জনগণের সমতা-ন্যায্যতা ও মানবাধিকারের সর্বোচ্চ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ১৭৫ বছর আগে রচিত ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’ শীর্ষক ছোট্ট এই পুস্তিকাটি দুনিয়াকে বদলে দেওয়ার শ্রমিক শ্রেণির মতাদর্শের এক অপ্রতিরোধ্য রাজনৈতিক হাতিয়ার। সারা দুনিয়ার কমিউনিস্ট বা ওয়ার্কার্স পার্টিসমূহের মহত্তম দলিল হিসেবে আজও স্বীকৃত। এমন কোনো জ্ঞানপিপাসু মানুষ পাওয়া যাবে না যিনি ইশতেহারের সঙ্গে বোঝাপড়া না করে অগ্রসর হতে পেরেছেন। কমিউনিস্ট বিপ্লবের উদ্দীপনার পেছনে এই গ্রন্থের ভূমিকা আজও সমপরিমাণে অটুট আছে।
ইশতেহার প্রকাশিত হওয়ার পর পরই সারা দুনিয়ায় চিন্তার জগতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। এখনো পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে আলোকিত করে চলেছে এই ইশতেহার।
লেনিনের ভাষায়, “এই ছোট পুস্তিকাখানি বহু বৃহৎ গ্রন্থের সমতুল্য। সভ্য জগতের সমগ্র সংগঠিত ও সংগ্রামী প্রলেতারিয়েত আজও তার প্রেরণায় উদ্দীপ্ত ও অগ্রসর।”
কমিউনিস্ট ইস্তেহারের প্রথম ভাগের নাম “বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত”। এই ভাগে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ থেকে পুঁজিবাদের জন্মের কাহিনী বলা হয়। মার্ক্স পুঁজিবাদের আকাশচুম্বী উৎপাদন ক্ষমতাকে যথাযথ স্বীকৃতি দেন। তবে পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ তিনি তার রচনায় উদ্ঘাটিত করেছেন। তার মতে অকল্পনীয় হারে পণ্যোৎপাদন বাড়লেও সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর হয়নি। তিনি পুঁজিবাদের অন্তর্বিরোধ এবং আর্থিক সংকটের বিশ্লেষন করেছেন। এই ইস্তেহারে ধনতন্ত্রের অন্ধকার দিক দেখিয়ে পরিবর্তে অন্য কোনো সমাজব্যবস্থার কথা বলা হয়নি। তবে বলা হয়েছে, প্রচলিত সমাজব্যবস্থার গতিশীলতা থেকেই ঘটনাক্রমে ধ্বংসাত্মক শক্তির জন্ম হবে।
কমিউনিস্ট ইস্তেহার-এর ভেতর যে মূলচিন্তা প্রবহমান তা এই যে ইতিহাসের প্রতি যুগে অর্থনৈতিক উৎপাদন এবং যে সমাজ-সংগঠন তা থেকে আবশ্যিকভাবে গড়ে উঠে, তাই থাকে সেই যুগের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিগত ইতিহাসের মূলে। সুতরাং জমির আদিম যৌথ মালিকানার অবসানের পর থেকে সমগ্র ইতিহাস হয়ে এসেছে শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। আধুনিক বুর্জোয়া সম্পত্তির অনিবার্যভাবে আসন্ন অবসানের কথা ঘোষণা করাই ছিল এই বইয়ের লক্ষ্য।
সমাজ বদলের লড়াইকে অগ্রসর করার তাগিদ থেকে ইশতেহার রচিত হয়েছিল। এর রচয়িতা কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের বন্ধুত্ব ছিল বিস্ময়কর ও অতুলনীয়। প্রতিভাদীপ্ত এই দুইজন বিপ্লবীর অসাধারণ বোঝাপড়া, চিন্তা ও অনুশীলনের ঐক্য ইশতেহার রচনার যৌথকাজে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
প্রলেতারিয়েতের প্রথম আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘কমিউনিস্ট লীগের’ তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক কর্মসূচি হিসেবে ১৯৪৮ সালে লন্ডনে পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয়। লেনিনের মতে, আধুনিককালের কমিউনিস্ট পার্টির ভ্রুণ দেখা দিয়েছিল কমিউনিস্ট লীগের মধ্যে। এটি ছিল গোপন সংগঠন। ‘League of The Just’ বা ‘ন্যায়নিষ্ঠদের লীগ’ নামে এ সংগঠনটির জন্ম হয় ১৮৩৬ সালে। ১৮৪৭ সালের জুন মাসে লন্ডন কংগ্রেসে পরিবর্তিত নাম হয় ‘কমিউনিস্ট লীগ’। নামের সাথে সাথে এর চরিত্রও বিপ্লবী ধারায় বদলে ফেলা হয়। ১৮৪৭ সালকেই কমিউনিস্ট লীগের প্রতিষ্ঠাকাল এবং জুন কংগ্রেসকেই প্রথম কংগ্রেস ধরা হয়।
একই বছর ২৯ নভেম্বর থেকে ৮ ডিসেম্বর লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট লীগের দ্বিতীয় কংগ্রেসে ‘Communist Credo’ অর্থাৎ কমিউনিস্ট নীতি ও চিন্তাধারা সম্বলিত একটি ইশতেহার গৃহীত হয়। এরপর এঙ্গেলস খসড়া আকারে প্রণয়ন করেন ‘Communist Confession of Faith’। ব্লাংকিবাদী, প্রুঁধোবাদী, লাসালপন্থি, ভাইতলিং-এর খ্রিষ্টীয় সমাজতন্ত্রসহ বিভিন্ন পেটিবুর্জোয়া সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আপোষ করে এই দলিলটি রচিত হয়। ওই বছরই এঙ্গেলস ২৫টি প্রশ্নোত্তর সম্বলিত এক খসড়া দলিল প্রণয়ন করেন, যা ‘Principles of Communism’ নামে পরিচিত। আপসমূলক এই দলিলটি কংগ্রেসে গৃহীত হয়নি। শ্যাপার ও হেস কর্তৃক রচিত আরো দুটি খসড়া দলিল কমিউনিস্ট লীগের প্যারিস কমিটি কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। শেষ পর্যন্ত কমিউনিস্ট লীগের দ্বিতীয় কংগ্রেসে নতুন ইশতেহার রচনার দায়িত্ব পড়ে মার্কস ও এঙ্গেলস-এর ওপর। কংগ্রেসের আলোচনার সমস্ত নোট সঙ্গে নিয়ে মার্কস ও এঙ্গেলস চলে যান ব্রাসেলসে। সেখানেই রচিত হয় ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’।
কমিউনিস্ট লীগের কর্মসূচি হিসেবে ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লন্ডনে ইশতেহারটি ২৩ পৃষ্ঠার পুস্তিকাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৮৪৮ সালের মার্চ থেকে জুলাই মাসে জার্মান রাজনৈতিক দেশান্তরিদের গণতান্ত্রিক মুখপত্র ‘Detsche Londoner Zeitung’-এ এটি কিস্তিতে কিস্তিতে প্রকাশিত হয়। প্রথম সংস্করণের ভুল-ভ্রান্তি দূর করে সেই বছরই জার্মান মূল পাঠটি লন্ডনে প্রকাশিত হয়। ৩০ পৃষ্ঠার এই সংস্করণটিকেই মার্কস-এঙ্গেলস পরবর্তীতে ব্যবহার করেন। ফরাসি, পোলিশ, ইতালিয়, ডেনিশ, ফ্রেমিশ ও সুইডিশ-এসব ভাষাতে ইশতেহার তখন অনূদিত হয়। ১৮৫০ সালের প্রথম ইংরেজি সংস্করণে রচয়িতা হিসেবে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস-এর নাম প্রথমবারের মতো উল্লেখ করা হয়। ১৮৮৩ সালের জার্মান সংস্করণের নাম দেয়া হয় ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’। ইশতেহারের মূল বক্তব্য ও নীতির গুরুত্ব আজও অটুট রয়েছে। মার্কস-এঙ্গেলস ইশতেহারের কিছু বক্তব্য পরবর্তীতে যুগোপযোগী করেছেন। মার্কসের মৃত্যুর পর এঙ্গেলস অনেকগুলি সংস্করণ দেখে দিয়েছিলেন।
‘বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত’, ‘প্রলেতারিয় ও কমিউনিস্টরা’, ‘সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট সাহিত্য’ এবং ‘বিদ্যমান বিভিন্ন বিরোধী পার্টির সম্পর্কে কমিউনিস্টদের অবস্থান’-এই চারটি অধ্যায়ের পাশাপাশি ইশতেহারের ভূমিকা অংশ এবং টীকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
কমিউনিস্টদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে ঘোষণা করা প্রয়োজন বলে ইশতেহারের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ তখন ইউরোপে সকল শক্তির কাছে কমিউনিজম উদীয়মান শক্তি হিসেবে বিবেচিত।
“ইউরোপ ভূত দেখছে-কমিউনিজমের ভূত!”-এই বিদ্রুপাত্মক বক্তব্য দিয়েই শুরু হয়েছে ইশতেহার। আর শেষ হয়েছে এক দৃপ্ত ঘোষণা দিয়ে-
“আপন মতামত ও লক্ষ্য গোপন করতে কমিউনিস্টরা ঘৃণা বোধ করে। খোলাখুলি তারা ঘোষণা করে যে, তাদের লক্ষ্য সিদ্ধ হতে পারে কেবল সমস্ত প্রচলিত সমাজব্যবস্থার সবল উচ্ছেদ মারফত। কমিউনিস্ট বিপ্লবের আতঙ্কে শাসকশ্রেণিরা কাঁপুক, শৃঙ্খল ছাড়া প্রলেতারিয়েতের হারাবার কিছু নেই। জয় করার জন্য আছে গোটা জগৎ। দুনিয়ার মজুর এক হও।”
কমিউনিস্টদের দার্শনিক অবস্থান সুনির্দিষ্ট করার পাশাপাশি, প্রায়োগিক কর্তব্যও নির্দিষ্ট করেছে ইশতেহার। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী ধারায় মানবসমাজের ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করাই হচ্ছে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। মার্কস-এঙ্গেলস দেখালেন-সমাজের ভিত্তি হচ্ছে অর্থনীতি। উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বের পথ ধরে অনিবার্যভাবে আসে সমাজবিপ্লব।
শ্রেণিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী সমাজকে উচ্ছেদ করে প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ।
“নিজেদের প্রস্তুত মালের জন্য অবিরাম প্রসারমান এক বাজারের তাগিদ বুর্জোয়াশ্রেণিকে সারা পৃথিবীময় দৌড় করিয়ে বেড়ায়। সর্বত্র তাদের ঢুকতে হয়, সর্বত্র গেড়ে বসতে হয়, যোগসূত্র স্থাপন করতে হয় সর্বত্র।”-এভাবেই ইশতেহারে বুর্জোয়াশ্রেণির স্বরূপ উদ্ঘাটন করা হয়েছে।
বুর্জোয়াশ্রেণির বিপ্লবী ভূমিকা, তার সীমাবদ্ধতা ও পরিণতির কথা তাৎপর্যপূর্ণভাবে তুলে ধরা হয়েছে ইশতেহারে। আধুনিক বুর্জোয়াশ্রেণি হচ্ছে একটা দীর্ঘ বিকাশধারার ফল এবং উৎপাদন ও বিনিময় পদ্ধতির বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পরিণতি। “উৎপাদনে অবিরাম বৈপ্লবিক পরিবর্তন, সমস্ত সামাজিক অবস্থার অনবরত নড়চড়, চিরস্থায়ী অনিশ্চয়তা এবং আলোড়ন”কে বুর্জোয়া যুগের বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে ইশতেহারে। বুর্জোয়া সমাজের উৎপাদন-শক্তি অতীতের সকল যুগের সমগ্র উৎপাদন-শক্তির চেয়ে আকারে ও পরিধিতে বড়। পুঁজিবাদে অনেক ধারার বৈষম্য, শোষণ, নিপীড়ন একাকার হয়ে যায় এবং একটা অন্যটাকে পুষ্টি প্রদান করে থাকে। কোনোটা দৃশ্যমান, কোনোটা অদৃশ্য।
বুর্জোয়াশ্রেণি গ্রামাঞ্চলকে শহরের পদানত ও মুখাপেক্ষী এবং বর্বর বা অর্ধ বর্বর দেশগুলিকে সভ্য দেশের, কৃষিপ্রধান জাতিগুলিকে বুর্জোয়া-প্রধান জাতির, প্রাচ্যকে প্রতীচ্যের উপরে নির্ভরশীল করে তুলেছে। বুর্জোয়ারা সভ্যতার নাম করে বর্বরতম জাতিদেরও বুর্জোয়া উৎপাদন-প্রণালী গ্রহণে বাধ্য করে এবং নিজের ছাঁচে জগৎ গড়ে তোলে। বুর্জোয়াশ্রেণি সকলকেই মজুরিভোগী শ্রমজীবীতে এবং পারিবারিক সম্বন্ধকে নিছক আর্থিক সম্পর্কে পরিণত করে। সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক ও প্রকৃতি-শোভন সম্পর্ক ধ্বংস করে দিয়ে নগ্ন, নির্লজ্জ, পাশবিক শোষণ কায়েম করে।
ইশতেহার দেখিয়েছে যে, বুর্জোয়াশ্রেণির যে প্রগতিশীল ও বিপ্লবী ভূমিকা ছিল, তা স্থায়ী হয় না। আধুনিক বুর্জোয়াসমাজ শ্রেণিবিরোধ দূর করতে পারে না, এক সময় সমাজ বিকাশের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। তখন নতুন বিপ্লবী শ্রেণির আধিপত্য এবং নতুন সমাজ ব্যবস্থার অনিবার্যতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেই নতুন বিপ্লবী শ্রেণি হচ্ছে প্রলেতারিয়েত, আর নতুন সমাজ হচ্ছে সমাজতন্ত্র।
নতুন শ্রেণি, অত্যাচারের নতুন অবস্থা, নতুন ধরনের সংগ্রাম দেখা যায়। বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েত-পরস্পরের সম্মুখীন এই দুই বিশাল শত্রুশিবিরে গোটা সমাজ ভাগ হয়ে পড়ে। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে বুর্জোয়াশ্রেণি যে অস্ত্র সৃষ্টি করে, তা তার নিজের বিরুদ্ধেই উদ্যত হয়। এই অস্ত্রের সঙ্গেই অস্ত্র ধারণকারী তথা কবর খননকারী প্রলেতারিয়েতকে সে সৃষ্টি করে। বুর্জোয়াশ্রেণির পতনের সঙ্গে সঙ্গে প্রলেতারিয়েতের জয়লাভ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
সমাজ বিকাশের এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবেই পুঁজিবাদের বিকাশের কথা ইশতেহারে বলা হয়েছে। পুঁজিবাদের বিকাশ মানে পুঁজিবাদের বিজয় নয়। পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন এবং পুঁজিবাদের মহাবিপর্যয়ের কথা ইশতেহারে উল্লেখ আছে। বুর্জোয়া বিপ্লবকে প্রলেতারিয় বিপ্লবের ভূমিকাপর্ব বলে অভিহিত করে সেই বিপ্লবে শ্রমিকশ্রেণির কর্তব্য নির্ধারণ করা হয়েছে ইশতেহারে।
ইশতেহারে বলা হয়েছে মজুরি-দাসত্বের শেকল থেকে শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির কথা। বুর্জোয়াদের হাত থেকে ক্রমেই সমস্ত পুঁজি কেড়ে নেওয়া, প্রলেতারিয়েতের হাতে উৎপাদনের সমস্ত উপকরণ কেন্দ্রীভূত করার জন্য প্রলেতারিয়েতকে শাসকশ্রেণির পদে উন্নীত করা এবং তার রাজনৈতিক আধিপত্য নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। বুর্জোয়া সমাজে বর্তমানের ওপর আধিপত্য করে অতীত, আর কমিউনিস্ট সমাজে বর্তমান আধিপত্য করে অতীতের ওপর।
মার্কস-এঙ্গেলস দেখালেন যে, ইতিহাসের চালিকাশক্তি হচ্ছে শ্রেণিসংগ্রাম। তাঁরা বলেছেন : “আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলের ইতিহাসই শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস।” ইতিহাস বলতে তখন লিখিত ইতিহাসকে বোঝানো হয়েছিল। কিন্তু মর্গানের আবিষ্কারের ফলে দেখা গেল, আদিম কমিউনিস্ট সমাজে শ্রেণি, শ্রেণিসংগ্রাম বলে কিছু ছিল না। বিষয়টি এঙ্গেলস ১৮৮৮ সালের ইংরেজি সংস্করণে এবং পরবর্তীতে তাঁর ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
প্রলেতারিয়েত হল বর্তমান যুগে সমাজের মূল নিপীড়িত অংশ এবং প্রকৃত বিপ্লবী শ্রেণি। শ্রমিকশ্রেণির মুক্তি ছাড়া শোষণ ও নিপীড়নের হাত থেকে মানবমুক্তি সম্ভব নয়। অন্যসব শ্রেণিকে মুক্ত না করে শ্রমিকশ্রেণি মুক্ত হতে পারে না। শ্রমিকশ্রেণি বুর্জোয়াশ্রেণির কর্তৃত্বের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করবে। তার ফলে সকল শোষণ, নিপীড়ন, শ্রেণিপার্থক্য ও শ্রেণিসংগ্রাম থেকে চিরদিনের মতো মুক্তি আসবে। নিম্ন মধ্যবিত্ত, ছোট হস্তশিল্প কারখানার মালিক, দোকানদার, কারিগর চাষি-এরা বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের অস্তিত্বটাকে বাঁচাবার জন্য।
অত্যাচারী এবং অত্যাচারিতদের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য অবিরাম লড়াই শেষ হয় সমাজের বৈপ্লবিক পুনর্গঠনে। বুর্জোয়াশ্রেণির বিকাশের সাথে সাথে প্রলেতারিয়েতও বিকশিত হয়। বুর্জোয়াশ্রেণির বিরুদ্ধে প্রলেতারিয়েতের সংগ্রাম শুরু হয় জন্মমুহূর্ত থেকে এবং নানা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়। বুর্জোয়া-স্বার্থে প্রলেতারিয়েতের ওপর আইন, নৈতিকতা, ধর্মের মতো বুর্জোয়া পক্ষপাতমূলক ধারণা চাপিয়ে দেয়া হয়।
উৎপাদনের উপকরণের উপর প্রলেতারিয়েতের কোনো মালিকানা নেই। সমাজ থেকে সব ধরনের বৈষম্য বিলুপ্ত করতে হলে ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদ করতে হবে। আধুনিক বুর্জোয়া সম্পত্তির অনিবার্যভাবে আসন্ন অবসানের কথা তুলে ধরেছে ইশতেহার। ইশতেহারের ভাষায় : “কমিউনিস্টদের তত্ত্বকে এক কথায় প্রকাশ করা চলে : ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ।”
মার্কস-এঙ্গেলস ঘোষণা করেন যে, পুঁজিবাদী সমাজের পতন অবশ্যম্ভাবী এবং অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে সমাজতন্ত্র। পুঁজিবাদ তার কবর খননকারী প্রলেতারিয়েতের সৃষ্টি করেছে। বুর্জোয়াশ্রেণির বিরুদ্ধে প্রলেতারিয়েতের সংগ্রাম জয়যুক্ত হবে এবং মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণের অবসান ঘটবে। প্রলেতারিয়েত দখল করবে রাষ্ট্রক্ষমতা এবং কায়েম করবে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব। পৃথিবী এগিয়ে যাবে এক নতুন শ্রেণিহীন সমাজ-কমিউনিস্ট সমাজের দিকে। তার জন্য শ্রমিকশ্রেণির নিজস্ব পার্টি কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে হবে। এই সার কথাই প্রতিফলিত হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে।
ইশতেহারে বলা হয়েছে, কমিউনিস্টরাই হলো শ্রমিকশ্রেণির অগ্রণী বাহিনী। সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরেছে কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্ব, কর্তব্য ও নেতৃত্বপ্রদানের বিষয়। কমিউনিস্টদের আশু কর্তব্য হিসেবে প্রলেতারিয়েতকে সংগঠিত করা, বুর্জোয়া আধিপত্যের উচ্ছেদ, প্রলেতারিয়েত কর্তৃক রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল-এই তিনটি কাজের কথা বলা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে প্রলেতারিয়েতের স্বার্থ থেকে বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র কোনো স্বার্থ কমিউনিস্টদের নেই।
একটি গভীর লক্ষ্যকে সামনে রেখে কমিউনিস্টরা অগ্রসর হয়। বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যে কেবল কিছু দাবি পূরণই তাদের লক্ষ্য নয়। কমিউনিস্টরা প্রচলিত সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিটি বিপ্লবী আন্দোলন সমর্থন করে এবং নানা ধরনের লড়াই, কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকে। কিন্তু কখনোই সমাজের মৌলিক পরিবর্তনের লক্ষ্যের কথা ভোলে না। কমিউনিস্টরা ব্যক্তির ওপর ব্যক্তির শোষণের পাশাপাশি জাতির ওপর জাতির শোষণও বন্ধ করতে চায়। শ্রমিকশ্রেণির পার্টিগুলির সর্বাপেক্ষা অগ্রসর ও দৃঢ়চিত্ত অংশ হিসেবে কমিউনিস্টরা অন্য সবাইকে সামনে নিয়ে যায়। জাতীয় সংগ্রামের ভেতর থেকে প্রলেতারিয়েতের সাধারণ স্বার্থকে কমিউনিস্টরা সামনে টেনে আনে। শ্রমিকশ্রেণির সাময়িক স্বার্থ রক্ষার জন্য কমিউনিস্টরা লড়াই করে থাকে, কিন্তু আন্দোলনের বর্তমানের মধ্যেও তারা আন্দোলনের ভবিষ্যতের প্রতিনিধি, তার রক্ষক।
কমিউনিস্টদের সম্পর্কে নানা অপপ্রচারের যোগ্য জবাব দিয়েছে ইশতেহার। ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদের দাবিকে বুর্জোয়ারা ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে অভিযোগ করে। কিন্তু পুঁজিবাদেই তো দশ জনের মধ্যে নয় জনেরই ব্যক্তিগত সম্পত্তি উচ্ছেদ হয়ে গেছে। বাকি এক জনের হাতে মালিকানা থাকার কারণ হচ্ছে নয় জনের হাতে কিছুই না থাকা। বুর্জোয়া ব্যক্তিত্ব, বুর্জোয়া স্বাতন্ত্র, বুর্জোয়া স্বাধীনতা অধিকাংশ মানুষের বিপরীতে গিয়ে কেবল বুর্জোয়াদের স্বার্থ রক্ষা করে। কমিউনিস্টদের লক্ষ্য হিসেবে এগুলোর উচ্ছেদের কথা বলা হয়েছে ইশতেহারে। স্বদেশ ও জাতীয়তার বিলোপের যে অভিযোগ কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বুর্জোয়াদের, তার জবাবে বলা হয়েছে, “মেহনতি মানুষের কোনো দেশ নেই। তাদের যা নেই তা আমরা তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারি না।”
মার্কস ও এঙ্গেলস ১৮৪৭ সাল থেকেই প্রলেতারিয়েতের নিজস্ব বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছেন। ১৮৬৪ সালে তাঁরা গড়ে তুলেছেন ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’। ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের আন্তর্জাতিক সংগঠন’ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৫০ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয় জার্মানি, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের বিপ্লবীদের এক সভা।
সভায় গৃহীত কার্ল মার্কস রচিত প্রস্তাবে বলা হয় : “মানবসমাজের শেষ রূপ হবে কমিউনিজম। সেই কমিউনিজমে না পৌঁছানো পর্যন্ত বিপ্লবকে চিরস্থায়ী রেখে সুবিধাভোগী সকল শ্রেণিকে উচ্ছেদ করা এবং এই সব শ্রেণিকে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বে দাবিয়ে রাখাই হলো এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য।”
‘দুনিয়ার মজুর এক হও’ এই উদাত্ত আহ্বান জানিয়েই শেষ হয়েছে ইশতেহার। এই আহ্বানের মধ্য দিয়ে প্রলেতারিয় আন্তর্জাতিকতাবাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে ইশতেহার। পরবর্তীতে লেনিন এই স্লোগানকে আরো যুগোপযোগী করে নতুন স্লোগান দেন ‘দুনিয়ার মজুর ও নিপীড়িত জাতিসমূহ এক হও।’
ইশতেহারে বলা হয়েছে-আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্রের শাসকমণ্ডলী বুর্জোয়াশ্রেণির সাধারণ কাজকর্ম ব্যবস্থাপনার একটি কমিটি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই বুর্জোয়া রাষ্ট্রের উচ্ছেদের সাথে সাথে প্রলেতারিয়েতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্যারি কমিউনের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে মার্কস-এঙ্গেলস বলেছেন : “কমিউন বিশেষ করে একটি কথাই প্রমাণ করেছে যে, তৈরি রাষ্ট্রযন্ত্রটার শুধু দখল পেলেই শ্রমিকশ্রেণি তা নিজের কাজে লাগাতে পারে না।” তাই তাঁরা বুর্জোয়াদের সবলে উচ্ছেদ করে প্রলেতারিয়েতের আধিপত্যের ভিত্তি স্থাপনের জন্য ‘শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব’ কায়েমের কথা বলেছেন।
এ সম্পর্কে লেনিন বলেছেন : “এ কথা তো স্পষ্টই যে, শ্রমিকশ্রেণির ‘শাসকশ্রেণিতে রূপান্তর’ ‘শ্রমিকশ্রেণির শাসকশ্রেণি রূপে সংগঠন’ ‘সম্পত্তির ওপর শ্রমিকশ্রেণির স্বৈরাচারী আক্রমণ’ ইত্যাদি-এটাই তো শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব। ‘রাষ্ট্র অর্থাৎ শাসকশ্রেণিরূপে সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণি’-এটাই তো ‘শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব।”
১৮৫২ সালের ৫ মার্চ হেবডমেয়ারের কাছে মার্কস লিখেছেন : “শ্রেণি বা শ্রেণিসংগ্রামের অস্তিত্ব আবিষ্কার করার কৃতিত্ব আমার নয়। আমার বহু আগে বুর্জোয়া ঐতিহাসিকরা শ্রেণিসংগ্রামের ঐতিহাসিক বিকাশ ব্যাখ্যা করেছেন। নতুনের মধ্যে আমি শুধু প্রমাণ করেছি : ১. উৎপাদনের বিকাশের বিশেষ ঐতিহাসিক পর্যায়ের সঙ্গেই কেবল শ্রেণিসমূহের অস্তিত্ব জড়িত। ২. শ্রেণিসমূহের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব। ৩. যে অবস্থায় শ্রেণিসমূহের বিলোপ ঘটবে এবং শ্রেণিহীন সমাজের পত্তন হবে, শ্রমিকশ্রেণির এই একনায়কত্ব হচ্ছে সেই অবস্থায় উত্তরণের পথ মাত্র।”
‘ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ’ গ্রন্থের জার্মান সংস্করণের ভূমিকায় ১৮৯১ সালে এঙ্গেলস লিখেছেন : “সোসাল ডেমোক্র্যাট অর্বাচীনরা শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব কথাটায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠেছে। বেশ ভালো কথা। ভদ্র মহোদয়গণ, এই একনায়কত্ব কেমন তা আপনারা জানতে চান? প্যারি কমিউনের দিকে তাকান, ওটাই ছিল শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব।”
স্যোসালিস্ট বা সমাজতন্ত্রী ইশতেহার না বলে একে কমিউনিস্ট ইশতেহার কেন বলা হয়েছে-এই প্রশ্নের উত্তরে এঙ্গেলস ১৮৮৮ সালের ইংরেজি সংস্করণের ভূমিকায় বলছেন : “১৮৪৭ সালে সমাজতন্ত্র ছিল বুর্জোয়া আন্দোলন আর কমিউনিজম ছিল শ্রমিকশ্রেণির। অন্তত ইউরোপ মহাদেশে সমাজতন্ত্র ছিল ‘ভদ্রস্থ’, আর কমিউনিজম ছিল ঠিক তার বিপরীত। আর প্রথম থেকেই যেহেতু আমাদের ধারণা ছিল যে, ‘শ্রমিকশ্রেণির মুক্তি শ্রমিকশ্রেণিরই নিজস্ব কাজ হতে হবে’, তাই দুই নামের মধ্যে আমরা কোনটি বেছে নেব সে সম্বন্ধে কোনো সংশয় ছিল না। তাছাড়া আজ পর্যন্ত আমরা এ নাম বর্জন করার দিকেও যাইনি।”
ইশতেহার প্রকাশকালে ইউরোপে সমাজতন্ত্রের যেসব প্রচারিত ছিল, সেগুলো ছিল কাল্পনিক, অবৈজ্ঞানিক। ইশতেহারে ইউটোপিয় সমাজতন্ত্র ও পেটিবুর্জোয়া সমাজতন্ত্রের প্রকৃত চেহারা উন্মোচন করে সমাজতন্ত্রকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো হয়। কমিউনিস্ট ইশতেহারে ঘোষিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রই উনিশ শতকের শেষভাগে সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব বলে স্বীকৃত হয়, অন্যসব হারিয়ে যায়।
ফুরিয়ে, ওয়েনের মতো ইউটোপিয় সমাজতন্ত্রীরা বুর্জোয়া সমাজের বৈষয়িক ও নৈতিক দুর্দশার কথা তুলে ধরে তার তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁরা শহর ও গ্রামের পার্থক্য ঘুচাবার কথা বলেছিলেন। সমাজের সাধারণ মুক্তির মাপকাঠি হিসেবে নারীমুক্তির অবস্থাকে ফুরিয়ে প্রথম তুলে ধরেন। ওয়েনের মতে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, ধর্ম ও প্রচলিত বিবাহপ্রথা হচ্ছে সমাজ-সংস্কারের পথে প্রথম বাধা। তাঁর মতে, ব্যক্তিগত সম্পত্তিই মানুষকে দানবে এবং জগৎকে নরককুণ্ডে পরিণত করে। সাঁ সিমো তাঁর লেখায় শ্রেণিসংগ্রামের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, রাজনীতি হচ্ছে উৎপাদনের বিজ্ঞান; রাজনীতিকে সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করবে অর্থনীতি।
১৮৯০ সালের জার্মান সংস্করণের ভূমিকায় এঙ্গেলস পেটি-বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রীদের ‘সামাজিক হাতুড়ে’ বলে অভিহিত করেছেন। এদের যোগসূত্র ছিল পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে। বুর্জোয়া রাজত্বের সমালোচনায় ‘প্রলেতারিয়েত আর বুর্জোয়ার মাঝখানে দোলায়িত’রা পেটি-বুর্জোয়া মানদণ্ডের আশ্রয় নেয়। তারা শ্রমিকশ্রেণির পক্ষে অস্ত্র ধারণ করে স্বাভাবিকভাবে মধ্যবর্তী শ্রেণিদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই। পেটি-বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রী সিসমন্দি পুঁজিবাদের সমালোচনা করেছিলেন পেটি-বুর্জোয়া মানদণ্ডে। পুঁজিবাদী সমাজের ভিত্তিটা টিকিয়ে রেখে উৎপাদনকে সংকুচিত করে সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলেন। আরেক পেটি-বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রী প্রুধোঁ নানা সমিতি গড়ে তুলে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে চেয়েছেন। আর বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রীরা শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র অর্জন করার কথা বলেছিলেন।
পুঁজিবাদকে কঠোর ও তীক্ষ্ণভাবে সমালোচনা করলেও, সমাজকে পুরনো কাঠামোর মধ্যেই আটকে রাখতে সচেষ্ট বলে এইসব ধারণা প্রতিক্রিয়াশীল ও ইউটোপিয়। তাঁদের ভবিষ্যৎ সমাজের ভাবনা ছিল একেবারেই ইউটোপিয় বা কাল্পনিক, যার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ইশতেহারে মার্কস-এঙ্গেলস এঁদের চিন্তার দুর্বলতার কারণ হিসেবে ‘প্রলেতারিয়েতের অপরিণত অবস্থা’, ‘শ্রেণিসংগ্রামের অবিকশিত অবস্থা’ ইত্যাদি বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন।
মার্কস-এঙ্গেলস সমাজতন্ত্রের এসব অবৈজ্ঞানিক ধারণার বিরুদ্ধে অবিরাম মতাদর্শগত লড়াই চালিয়েছেন, পাশাপাশি নিজেদের চিন্তাকে বিকশিত করেছেন। তাঁদের মতে, সমাজতন্ত্র হচ্ছে ঐতিহাসিক বিকাশের আবশ্যিক পরিণতি এবং সমাজের অর্থনৈতিক অগ্রগতিই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
ইশতেহারে আলোচনার বিস্তার ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত থাকায় এবং এরপর রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারে বদলে যাওয়ায়, ১৮৭২ সালের ইংরেজি সংস্করণের ভূমিকায় এঙ্গেলস সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যের সমালোচনাটিকে অসম্পূর্ণ বলে অভিহিত করেন। বিরোধী পার্টির সঙ্গে কমিউনিস্টদের অবস্থান সম্পর্কিত ইশতেহারের বক্তব্যগুলি সাধারণ মূলনীতির দিক থেকে সঠিক হলেও ব্যবহারিক দিক থেকে অকেজো হয়ে গেছে এবং ইতিহাসের অগ্রগতি উল্লিখিত রাজনৈতিক দলগুলির অধিকাংশকে এই দুনিয়া থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে এঙ্গেলস ঘোষণা করেন যে : “এই ‘ইশতেহার’ এখন ঐতিহাসিক দলিল হয়ে পড়েছে, একে বদলানোর কোনো অধিকার আমাদের আর নেই।”
ইশতেহার প্রকাশের আগে শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির কোনো দিগ্দর্শন বা বিপ্লবী তত্ত্ব ছিল না। শ্রমিকশ্রেণির এই অভাব পূরণ করে কমিউনিস্ট ইশতেহার। শ্রমিকশ্রেণির মুক্তিসংগ্রামের আদর্শ, লক্ষ্য ও পথ মূর্ত হয়ে উঠল ইশতেহারে। ইশতেহার ভবিষ্যৎ সমাজের সম্ভাবনাকে সামনে নিয়ে আসে এবং ইউটোপিয় সমাজতন্ত্র থেকে শ্রমিকশ্রেণিকে মুক্ত করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দিকে ধাবিত করল। ‘আমরা ভাই ভাই’ এই ঝাপসা, অস্পষ্ট স্লোগানের জায়গায় এলো নতুন স্লোগান ‘দুনিয়ার মজুর এক হও!’
ইশতেহার সম্পর্কে লেনিন বলেছেন, “প্রতিভাদীপ্ত স্পষ্টতায় ও চমৎকারিত্বে এ রচনায় মূর্ত হয়েছে নতুন বিশ্বদৃষ্টি, সমাজ-জীবনের এলাকা পর্যন্ত প্রসারিত সুসঙ্গত বস্তুবাদ, বিকাশের সর্বাপেক্ষা সর্বাঙ্গীণ ও সুগভীর মতবাদস্বরূপ দ্বন্দ্ববাদ, শ্রেণিসংগ্রামের এবং নতুন কমিউনিস্ট সমাজের স্রষ্টা প্রলেতারিয়েতের বিশ্ব ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক ভূমিকার তত্ত্ব।”
কেবল রাজনৈতিক গুরুত্বই নয়, ইশতেহারের সাহিত্যিক গুরুত্বও অসীম। নান্দনিক ভাষা, শব্দশৈলী, ছন্দের ব্যবহার এবং গঠনের দিক থেকে এক কথায় অনন্য। এর প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য তাৎপর্যপূর্ণ এবং আপন মহিমায় ভাস্বর। ইশতেহারের ছত্রে ছত্রে সঞ্চারিত হয়েছে বিপ্লবী প্রেরণা।
মার্কসবাদের ওপর উত্তরাধুনিকতাসহ নানামাত্রিক আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানের মাধ্যমেই এসব আক্রমণ মোকাবিলা করতে হবে। শ্রমিক শ্রেণির মতাদর্শের এই রাজনৈতিক কর্তব্য পালনে আমাদের যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। মুক্তচিন্তা ও মন নিয়েই মার্কসবাদী-লেনিনবাদী সাহিত্য পাঠ ও অনুশীলন করতে হবে। তবে উদার দৃষ্টিভঙ্গির নাম করে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মৌলিক চিন্তাকে সুকৌশলে বাতিল করে দেয়ার চক্রান্ত সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।
পুঁজিবাদের অস্তিত্বই কমিউনিস্ট ইশতেহারকে প্রাসঙ্গিক করে রেখেছে। পুঁজিবাদী বিশ্বের অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটাতে অনেক বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ-পণ্ডিতই মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-মাও সেতুংয়ের কাছে সমাধান খুঁজছেন। বিদ্যমান শোষণমূলক পুঁজিবাদী সমাজ বদলে আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই সাম্যের সমাজ অভিমুখী ‘জনগণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার’। কাঙ্ক্ষিত সমাজ প্রতিষ্ঠার বৈপ্লবিক লড়াইয়ে বিপ্লবের এক মহাকাব্যিক দলিল হিসেবে ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’ আমাদের পথ দেখিয়ে যাবে নিরন্তর।
সমতা-ন্যায্যতা ও মানবাধিকারের সর্বোচ্চ ব্যবস্থার জন্য মহান অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব:
১০৬ বছর পূর্বে ১৯১৭ সালে জনগণের সমতা-ন্যায্যতা ও মানবাধিকারের সর্বোচ্চ ব্যবস্থার জন্য মহান অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। রুশ বিপ্লব ১৯১৭ সালে সংগঠিত দুইটি বিপ্লবের মিলিত নাম। এই বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় জার শাসনের অবসান হয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান হয়।
১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংগঠিত প্রথম বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ার সম্রাজ্য ভেঙে পরে এবং শেষ সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাসকে উৎখাত করে একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে অন্তর্বতীকালীন সরকারকে উৎখাত করে বলশেভিক (কমিউনিস্ট) সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লব (গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী মার্চ মাস) এর কেন্দ্রবিন্দু ছিল তৎকালিন রাজধানী পেট্রোগ্রাদ (বর্তমানে সেইন্ট পিটার্সবার্গ) ও তার আশেপাশের অঞ্চল। বিশৃঙ্খলার মধ্যে, দ্যুমা ইম্পেরিয়াল সংসদ সদস্যরা একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করে দেশের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন বলে অনুমিত হয়। সেনা নেতৃত্ব অনুধাবন করেন যে, সম্রাটের উৎখাতের ফলে যে জনদ্রোহ দেখা দিয়েছে তা নিয়ন্ত্রণ করার উপায় তাদের হাতে নেই। সোভিয়েতরা (শ্রমিক কাউন্সিল), প্রথমদিকে অন্তরবর্তীকালীন সরকারকে সমর্থন দিলেও একটি বিশেষ ক্ষমতা বলে তারা সরকারকে প্রভাবিত করতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর (১৯১৪-১৮) সামরিক বিপর্যরের প্রেক্ষাপটে ফ্রেব্রুয়ারি বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল। এ সময় সেনাবাহিনী বিদ্রোহম্মুখ অবস্থায় ছিল।
তৎকালীন রাশিয়ায় একটি দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা চলতে থাকে যেখানে অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের হাতে ছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আর সোভিয়েতদের হাতে ছিল জাতীয় পর্যায়ে সমাজের শ্রমিক শ্রেনী ও বামপন্থীদের আনুগত্যের ফলে প্রাপ্ত ক্ষমতা। এই বিশৃঙ্খল পরিবেশে ঘন ঘন বিদ্রোহ, প্রতিবাদ ও ধর্মঘট সংগঠিত হতে থাকে। অন্তরর্বর্তীকালীন সরকার যখন জার্মানির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত, তখন বলশেভিক ও অন্যান্য সমাজাতন্ত্রিক জোটগুলো সংঘাত বন্ধের জন্য প্রচারণা চালায়। বলশেভিকরা শ্রমিক মিলিশিয়াদের রেড গার্ডস, পরবর্তিতে রেড আর্মিতে রূপান্তরিত করে এবং তাদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে।
১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের (গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জী অনুসারে নভেম্বর) মধ্য দিয়ে বিপ্লবের মহানায়ক কমরেড ভ ই লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি ও শ্রমিক সোভিয়েতরা পেট্রোগ্রাদের অন্তরবর্তীকালীন সরকারকে উৎখাত করে রাশিয়ান সোভিয়েত ফেডারেশন সোস্যালিস্টিক রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করে। সেই সাথে রাজধানী মস্কোতে স্থানান্তর করা হয়। বলশেভিকরা সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রনালয়ের প্রধানের দায়িত্ব নেয় এবং গ্রামাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ভিন্নমত দমন করা জন্য তারা সর্বত্র চেকা প্রতিষ্ঠা করে। মার্চ ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার অংশগ্রহণ সমাপ্ত করার জন্য বলশেভিক নেতারা ট্রিটি অব ব্রিস্ট-লিটভস্ক স্বাক্ষর করে।
বলশেভিক (রেড) ও সমাজত্রন্ত্রবিরোধীদের (হোয়াইট) ও অন্যান্য অ-বলশেভিক সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। এই যুদ্ধ বেশ কয়েকবছর ধরে চলে এবং বলশেভিকরা তাদের বিরোধীদের পরাজিত করে। বলশেভিদের এই জয় ১৯২২ সালে ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোসালিস্ট রিপাবলিক (ইউএসএসআর) প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে।
মানবাধিকারের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ –
Journal of United Nation এ বলা হয়েছে যে, “The establishment of human rights provided the foundation upon which rests the political structure of human freedom. The achievement of human freedom generates the will as the capacity for economic and social progress, the attainment of economic and social progress provides the basic for true peace”.
জাতিসঙ্ঘের প্রাক্তন মহাসচিব উথান্ট এর বক্তব্য হতে বোঝা যায় যে মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে প্রকৃত কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যেই মানবাধিকারের উদ্ভব। মানবাধিকার কথাটির ব্যবহার আজ থেকে প্রায় দু’শো থেকে তিনশো বছর আগে থেকে ব্যবহার করা হচ্ছে। যদিও এর প্রকৃত ধারনা খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ২০০০ অব্দ হতে বিরাজ ছিল।
১৯৪৮ সালের ১০ই ডিসেম্বর-এ Universal declaration of Human Rights এর মাধ্যমে মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করা হয় যা মানবাধিকারের ইতিহাসে এক বিশেষ মাইলফলক। প্রকৃতপক্ষে আজ থেকে প্রায় ১৪শ বছর পূর্বে আল্লাহ প্রদত্ত দীন ইসলাম অর্থাৎ মুহাম্মদ (সাঃ) কর্তৃক তা প্রণীত হয়েছিল। আজকের এই বিশ্বে মানবাধিকারের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সার্বজনীন।
মানবাধিকার কি, তার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে নীচে আলোচনা করা হল:
মানবাধিকার কি
মানবাধিকার বা “Human Rights” কথাটি দুটি শব্দ তথা human ও rights নিয়ে গঠিত হয়েছে। এখানে অধিকার বলতে এমন সত্তা বা দাবিকে বুঝায় যা মানুষ কর্তৃক সংক্ষরিত। এ অধিকারের ব্যাপারে GilChrist বলেন, “Rights arise from the fact that man is a social being”.
FRW Times তার “Human Rights and Duties” Article এ বলেছেন, “Right is moral power of claim to receive something which is due through justice”.
আমরা এই অধিকারের সংজ্ঞা থেকে মানবাধিকারের সংজ্ঞা পাই।
আমরা মানবাধিকারের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলতে পারি যে, যেসকল মানুষ হিসেবে সকলের জন্য প্রযোজ্য তা হল মানবাধিকার।
ড. শফিক আহমেদ বলেছেন, “মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা, ক্ষমতার বিকাশ এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবন-যাপনের জন্য একান্তভাবে প্রয়োজনীয় অধিকার হচ্ছে মানবাধিকার”।
গাজী শামসুর রহমান বলেছেন, “সকল দেশের, সকল কালের,সকল মানুষের ন্যূনতম যে অধিকারসমূহ সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত, একেই বলা হয় মানবাধিকার”। (মানবাধিকার ভাষ্যঃ গাজী শামসুর রহমান, পৃষ্ঠা:৩৩)
Gaiues Ezjiofor বলেছেন, “মানবাধিকার হল সেসব অধিকারের আধুনিক নাম যাকে ঐতিহ্যগতভাবে অধিকার বলা হয় এবং নৈতিক অধিকার যা প্রত্যেক ব্যক্তি প্রতিটি স্থানে ও সার্বক্ষণিকভাবে এই কারণে পেয়ে থাকে, সে অনান্য সকল সৃষ্টির তুলনায় অধিক বোধশক্তি সম্পন্ন এবং নৈতিক গুণাবলীর অধিকারী। ন্যায়বিচার ছাড়া এসব অধিকার হতে মানুষকে দূরে রাখা যাবে না”।(Protection of Human Rights)
মোস্তাফা জামান ভুট্টো বলেন, “মানবাধিকার হল সেই অধিকার যা মানুষের সুস্থ্য, সুন্দর ও শান্তিময় জীবন-যাপনের নিশ্চয়তা দেয়”।
The New Encyclopedia Britannica তে বলা হয়েছে যে, “Rights thought to belong to individual under the natural law as a consequence of his being Human”.
তাহলে আমরা উপরের প্রামাণ্য সংজ্ঞাসমূহ হতে এ কথা নির্ধিধায় বলতে পারি যে, মানুষের যে সকল অধিকার সর্বজনীনভাবে স্বীকৃতিস্বরুপ আর যা যেকোন মানুষের জন্য খর্ব করা হলে পরে তা হবে চরম অন্যায়, সেই অধিকারসমূহ হল মানবাধিকার।
মানবাধিকারের কতিপয় দিকসমূহ
১. মানবাধিকার মানুষের মর্যাদার স্বীকৃতি দেয় এবং আইনগত ও প্রশাসনিক কার্যক্রমের জন্য পথ প্রদর্শনের নীতিমালা দেয়।
২. মানুষের জুলুম-অত্যাচার ও শক্তি প্রয়োগের হাত থেকে রক্ষা করে নিরাপত্তা দেয়।
৩. মানবাধিকারের ফলে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব দেয় যা সকল ব্যক্তি ও শাসকগোষ্ঠীর মোকাবিলায় অধিকার বাস্তবায়নের গ্যারান্টি দেয় যা হল বিচার বিভাগ।
মানবাধিকারের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
মানবাধিকারের ধারনা শুরু হয়েছিল খ্রিষ্টীয়পূর্ব ১৫০০ অব্দ হতে। পারতপক্ষে মানবাধিকারের প্রধান ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ মহানবী (সাঃ) কর্তৃক “মদীনা সনদ” ঘোষণার মধ্য দিয়ে। এরপর ১২১৫ সালে ইংল্যান্ডে যে ম্যাগনে কার্টা সাক্ষরিত হয় যাকে মানবাধিকারের প্রথম সনদ বলা হয়। এই মানবাধিকারের উৎপত্তি এর ব্যাপারে কিছু উল্লেখযোগ্য দিক নীচে তুলে ধরা হল:
ইংল্যান্ডে মানবাধিকারের বিকাশ
ম্যাগনে কার্টা
এই পৃথিবীতে মানবাধিকারের উৎপত্তির ব্যাপারে যে দলীলটির কথা বলা হয় তা হল ম্যাগনে কার্টা এর দলীল। তৎকালীন রাজা জনের অত্যাচার বন্ধ করতে স্টেফানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল রাজার সাথে ম্যাগনে কার্টা দলীলটির সাক্ষর করেন যেখানে ৬৩টি ধারা উল্লেখ ছিল। প্রকৃতপক্ষে এই চুক্তিটি সাক্ষরিত হয় ব্যারনদের (তথা জমির মালিকদের নিম্নভূক্ত খেতাব) সাথে রাজার যারদ্বারা ব্যারনদের অধিকারের দায়িত্ব রাজাকে নিতে হয়েছিল।
বিল অফ রাইটস প্রদান
১৬২৮ সালে পার্লামেন্ট কর্তৃক “বিল অব রাইটস” প্রদান করা হয় যা ছিল মানবাধিকারের সর্বপ্রথম সাংবিধানিক দলীল। এ দলীলে মাত্র ৪টি ধারা ছিল যার দ্বারা অহেতুক করারোপ, কাউকে জেলে আটকানো, রাজার কমিশন জারী করার ব্যাপারে সীমাবদ্বতা আনা হয়। যদিও এ দলীলটির বাস্তবে প্রয়োগ ঘটে নাই। এ ধারাটি বাস্তবায়ন না করার দরুন রাজা চার্লসকে ১৬৪৯ সালে প্রাণ দিতে হয়েছিল।
পিটিশন অফ রাইটস প্রদান
১৬৮৯ সালে ইংলিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক পিটিশন অব রাইটস প্রণীত হয় যারদরুন রাজশক্তি জনশক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। এ ধারা কার্যকর হওয়ার পর পর রাজার ক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস্ব পায়। এ প্রসংগে ও.হুদ ফিলিপ বলেন, “বিল অব রাইটস হল মানবাধিকারের সর্বপ্রথম ভিত্তি”। পরবর্তীতে ১৭০১ সালে এক্ট অব সেটেলমেন্ট প্রণয়ন করা হয় যার দ্বরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
আমেরিকাতে মানবাধিকারের বিকাশ
ইংল্যান্ডের পর মানবাধিকার বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে যুক্তরাষ্ট্র। ঔপনিবেশিক শাসনের কব্ল থেকে রক্ষা করার জন্য ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার মহানায়ক জর্জ ওয়াশিংটন পেনসেলভেনিয়ার ফিলাফিলডেল হতে Declaration of Independence এর ঘোষণা দেন। যেখানে বলা হয়,
“All men are created equal with inalienable rights to life, liberty and the pursuit of happiness”.
এ অধিকারগুলোকে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ ঘোষণায় জনগণের এমন ক্ষমতা ও অধিকারের কথা বলা হয়।
ফ্রান্সে মানবাধিকার
যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকারকে অনুসরণ করে ফ্রান্সে ১৭৮৯ সালে বিপ্লব সংঘটিত হয়।বিপ্লবে তৎকালীন রাজা ষোড়শ লুই ও তার স্ত্রী রাণী মেরিসহ অনেক রাজপ্রসাদের কর্মচারীদের গিলেটিনে হত্যা করা হয়। এরপর বিপ্লবীদের দ্বারা দেশ পরিচালিত হতে থাকে এবং তারা একটি সংবিধান প্রণয়ন করে। তারা মানুষের মৌলিক মানবাধিকারের ব্যাপারে তারা “Declaration of the rights of man and Citizens” নামে একটি দলীল প্রণয়ন করে।এখানে মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, ধর্মীয় অধিকারের স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকারের স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করা হয়। এখানের বলা হয়, “Men are born and remain free and equal in rights”. এখানকার ধারনাসমূহ কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে মানবাধিকারে বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জাতিসংঘ কর্তৃক মানবাধিকার ঘোষণা
১৯১৪ হতে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত প্রথম বিশ্ব যুদ্ব চলতে থাকে যেখানে প্রায় দেড় কোটি মানুষ নিহত হয়। এরপর ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ব সংঘটিত হয় যেখানে প্রায় ছয় কোটি লোক নিহত হয়। এতে হিটলারের নাৎসি বাহিনী কর্তৃক প্রায় ষাট লক্ষ ইয়াহূদী প্রাণ বিসর্জন দেয়।তখন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সারা বিশ্বের মানুষ নতুন করে চিন্তা-ভাবনা শুরু করল। ২য় বিশ্ব যুদ্ব চলাকালীন সময় থেকে মিত্রশক্তি মানবাধিকারের কথা চিন্তা-ভাবনা শুরু করে। ১৯৪১ সালের ১৪ই আগষ্ট আটলান্টিক চার্টার ও ১৯৪২ সালের জানুয়ারিতে জাতিসংঘের গৃহীত ঘোষণায় এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়। ১৯৪৫ সালে সান-ফ্রান্সিসকোতে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হলেও সেখানে মানবাধিকারের ব্যাপারে কোন সুস্পষ্ট নীতি-মালা ছিল না যদিও একটি মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়েছিল। ১৯৪৬ সালের জানুয়ারি মাসে সাধারণ পরিষদের প্রথম অধিবেশনে আন্তর্জাতিক অধিকারসমূহের বিল প্রণয়ন করার পরিকল্পণা গ্রহণ করা হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি হতে এর কাজ শুরু হয়।অতঃপর ১৯৪৮ সালের ১০ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের ৩৮টি দেশের সম্মতিতে সর্বপ্রথম মানবাধিকার সনদ প্রণয়ন করা হয়। এ ঘোষণায় ১৯টি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার এবং ৬ টি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের কথা স্বীকৃত। পরবর্তীতে অনেক দেশ ঔপনিবেশিক শাসনের কবল হতে রক্ষা পায় ১৯৬৬ সালের ১৬ই ডিসেম্বর সে দেশগুলোর সম্মতিক্রমে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা দেয়া হয় এর ফলশ্রুতিতে ১৯৭৬ সালে জাতিসংঘের ৩৫তম সদস্যের অনুমোদন নিতে বাধ্য করা হয়।পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালের ১৫ই ডিসেম্বর ৫৯টি দেশের সম্মতিতে মানুষের রাজনৈতিক অধিকার,মৃত্যুদণ্ডাদেশ বেশ কয়েকটি সনদ যুক্ত করে। এভাবে করে বিভিন্ন সময় মানবাধিকারের ক্রমবিকাশ হতে থাকে এবং তা বর্তমানরুপ ধারন করেছে।
মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোঘণাপত্র
মুখবন্ধ
যেহেতু মানব পরিবারের সকল সদস্যের সমান ও অবিচ্ছেদ্য অধিকারসমূহ এবং সহজাত মর্যাদার স্বীকৃতিই হচ্ছে বিশ্বে শান্তি, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তি;
যেহেতু মানব অধিকারের প্রতি অবজ্ঞা এবং ঘৃণার ফলে মানুবের বিবেক লাঞ্ছিত বোধ করে এমন সব বর্বরোচিত ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং যেহেতু এমন একটি পৃথিবীর উদ্ভবকে সাধারণ মানুষের সর্বোচ্চ কাংবা রূপে ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে সকল মানুষ ধর্ম এবং বাক স্বাধীনতা ভোগ করবে এবং অভাব ও শংকামুক্ত জীবন যাপন করবে;
যেহেতু মানুব যাতে অত্যাচার ও উত্পীড়নের মুখে সর্বশেষ উপায় হিসেবে বিদ্রোহ করতে বাধ্য না হয় সেজন্য আইনের শাসন দ্বারা মানবাধিকার সংরক্ষণ করা অতি প্রয়োজনীয়;
যেহেতু জাতিসমূহের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়াস গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক;
যেহেতু সদস্য জাতিসমূহ জাতিসংঘের সনদে মৌলিক মানবাধিকার, মানব দেহের মর্যাদা ও মূল্য এবং নারী পুরুষের সমান অধিকারের প্রতি তাঁদের বিশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং বৃহত্তর স্বাধীনতার পরিমণ্ডলে সামাজিক উন্নতি এবং জীবনযাত্রার উন্নততর মান অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছেন;
যেহেতু সদস্য রাষ্ট্রসমূহ জাতিসংঘের সহযোগিতায় মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা সমূহের প্রতি সার্বজনীন সম্মান বৃদ্ধি এবং এদের যথাযথ পালন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্য অর্জনে অঙ্গীকারবদ্ধ;
যেহেতু এ স্বাধীনতা এবং অধিকারসমূহের একটি সাধারণ উপলব্ধি এ অঙ্গীকারের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ
এজন্য এখন
সাধারণ পরিষদ
এই
মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র
জারী করছে
এ ঘোবণা সকল জাতি এবং রাষ্ট্রের সাফল্যের সাধারণ মানদও হিসেবে সেই লক্ষ্যে নিবেদিত হবে, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি এবং সমাজের প্রতিটি অঙ্গ এ ঘোষণাকে সবসময় মনে রেখে পাঠদান ও শিক্ষার মাধ্যমে এই স্বাধীনতা ও অধিকার সমূহের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করতে সচেষ্ট হবে এবং সকল সদস্য রাষ্ট্র ও তাদের অধীনস্থ ভূখণ্ডের জাতিসমূহ উত্তরোত্তর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রয়াসের মাধ্যমে এই অধিকার এবং স্বাধীনতাসমূহের সার্বজনীন ও কার্যকর স্বীকৃতি আদায় এবং যথাযথ পালন নিশ্চিত করবে।
ধারা ১
সমস্ত মানুষ স্বাধীনভাবে সমান মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তাঁদের বিবেক এবং বুদ্ধি আছে ; সুতরাং সকলেরই একে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্বসুলভ মনোভাব নিয়ে আচরণ করা উচিত্।
ধারা ২
এ ঘোষণায় উন্নেণিত স্বাধীনতা এবং অধিকারসমূহে গোত্র, ধর্ম, বর্ণ, শিক্ষা, ভাষা, রাজনৈতিক বা অন্যবিধ মতামত, জাতীয় বা সামাজিক উত্পত্তি, জন্ম, সম্পত্তি বা অন্য কোন মর্যাদা নিবিশেষে প্রত্যেকেরই সমান অধিকার থাকবে।
কোন দেশ বা ভূখণ্ডের রাজনৈতিক, সীমানাগত বা আন্তর্জ্জাতিক মর্যাদার ভিত্তিতে তার কোন অধিবাসীর প্রতি কোনরূপ বৈষম্য করা হবেনা; সে দেশ বা ভূখণ্ড স্বাধীনই হোক, হোক অছিভূক্ত, অস্বায়ত্বশাসিত কিংবা সার্বভৌসত্বের অন্য কোন সীমাবদ্ধতায় বিরাজমান।
ধারা ৩
জীবন, স্বাধীনতা এবং দৈহিক নিরাপত্তায় প্রত্যেকের অধিকার আছে।
ধারা ৪
কাউকে অধীনতা বা দাসত্বে আবদ্ধ করা যাবে না। সকল প্রকার ক্রীতদাস প্রথা এবং দাসব্যবসা নিষিদ্ধ করা হবে।
ধারা ৫
কাউকে নির্যাতন করা যাবে না; কিংবা কারো প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ করা যাবে না অথবা কাউকে এহেন শাস্তি দেওয়া যাবে না।
ধারা ৬
আইনের সামনে প্রত্যেকেরই ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভের অধিকার আছে।
ধারা ৭
আইনের চোখে সবাই সমান এবং ব্যক্তিনির্বিশেবে সকলেই আইনের আশ্রয় সমানভাবে ভোগ করবে। এই ঘোষণা লঙ্ঘন করে এমন কোন বৈষম্য বা বৈষম্য সূষ্টির প্ররোচনার মুখে সমান ভাবে আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই আছে।
ধারা ৮
শাসনতন্ত্রে বা আইনে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে উপযুক্ত জাতীয় বিচার আদালতের কাছ থেকে কার্যকর প্রতিকার লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
ধারা ৯
কাউকেই বেয়ালখুশীমত গ্রেপ্তার বা অন্তরীণ করা কিংবা নির্বাসন দেওয়া যাবে না।
ধারা ১০
নিজের অধিকার ও দায়িত্ব নির্ধারণ এবং নিজের বিরুদ্ধে আনীত ফৌজদারী অভিযোগ নিরূপণের জন্য প্রত্যেকেরই পূর্ণ সমতার ভিত্তিতে একটি স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ বিচার-আদালতে প্রকাশ্য শুনানি লাভের অধিকার রয়েছে।
ধারা ১১
১. দত্তযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের নিশ্চিত অধিকারসম্বলিত একটি প্রকাশ্য আদালতে আইনানুসারে দোবী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ গণ্য হওয়ার অধিকার থাকবে।
২. কাউকেই এমন কোন কাজ বা ক্রটির জন্য দণ্ডযোগ্য অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না, যে কাজ বা ক্রটি সংঘটনের সময় জাতীয় বা আন্তর্জাতিক আইনে দণ্ডনীর অপরাধ ছিলনা। দণ্ডযোগ্য অপরাধ সংঘটনের সময় যে শাস্তি প্রযোজ্য ছিল, তার চেয়ে গুরুতর শাস্তিও দেওয়া চলবে না।
ধারা ১২
কারো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কিংবা তাঁর গৃহ, পরিবার ও চিঠিপত্রের ব্যাপারে খেয়ালখুশীমত হস্তক্ষেপ কিংবা তাঁর সুনাম ও সম্মানের উপর আঘাত করা চলবে না। এ ধরনের হস্তক্ষেপ বা আঘাতের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
ধারা ১৩
১. নিজ রাষ্ট্রের চৌহদ্দির মধ্যে স্বাধীনভাবে চলাফেরা এবং বসবাস করার অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
২. প্রত্যেকেরই নিজ দেশ সহ যে কোন দেশ পরিত্যাগ এবং স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের অধিকার রয়েছে।
ধারা ১৪
১. নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভিন্নদেশে আশ্রয় প্রার্থনা করবার এবং সে দেশের আশ্রয়ে থাকবার অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
২. অরাজনৈতিক অপরাধ এবং জাতিসংঘের উদ্দেশ্য এবং মূলনীতির পরিপন্থী কাজ থেকে সত্যিকারভাবে উদ্ভূত অভিযোগের ক্ষেত্রে এ অধিকার প্রার্থনা নাও করা যেতে পারে।
ধারা ১৫
১. প্রত্যেকেরই একটি জাতীয়তার অধিকার রয়েছে।
২. কাউকেই যথেচ্ছভাবে তাঁর জাতীয়তা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না, কিংবা কারো জাতীয়তা পরিবর্তনের অধিকার অগ্রাহ্য করা যাবে না।
ধারা ১৬
১. ধর্ম, গোত্র ও জাতি নির্বিশেবে সকল পূর্ণ বয়স্ক নরনারীর বিয়ে করা এবং পরিবার প্রতিষ্ঠার অধিকার রয়েছে। বিয়ে, দাম্পত্যজীবন এবং বিবাহবিচ্ছেদে তাঁদের সমান অধিকার থাকবে।
২. বিয়েতে ইচ্ছুক নরনারীর স্বাধীন এবং পূর্ণ সম্মতিতেই কেবল বিয়ে সম্পন্ন হবে।
৩. পরিবার হচ্ছে সমাজের স্বাভাবিক এবং মৌলিক গোষ্ঠী-একক, সুতরাং সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিরাপত্তা লাভের অধিকার পরিবারের রয়েছে।
ধারা ১৭
১. প্রত্যেকেরই একা অথবা অন্যের সঙ্গে মিলিতভাবে সম্পত্তির মালিক হওয়ার অধিকার আছে।
২. কাউকেই যথেচ্ছভাবে তাঁর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা বাবে না।
ধারা ১৮
প্রত্যেকেরই ধর্ম, বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতায় অধিকার রয়েছে। এ অধিকারের সঙ্গে ধর্ম বা বিশ্বাস পরিবর্তনের অধিকার এবং এই সঙ্গে, প্রকাশ্যে বা একান্তে, একা বা অন্যের সঙ্গে মিলিতভাবে, শিক্ষাদান, অনুশীলন, উপাসনা বা আচারব্রত পালনের মাধ্যমে ধর্ম বা বিশ্বাস ব্যক্ত করার অধিকারও অন্তর্ভূক্ত থাকবে।
ধারা ১৯
প্রত্যেকেরই মতামত পোষণ এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতায় অধিকার রয়েছে। অবাধে মতামত পোষণ এবং রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে যে কোন মাধ্যমের মারফত ভাব এবং তথ্য জ্ঞাপন, গ্রহণ ও সন্ধানের স্বাধীনতাও এ অধিকারের অন্তর্ভূক্ত।
ধারা ২০
১. প্রত্যেকেরই শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশগ্রহণ ও সমিতি গঠনের স্বাধীনতায় অধিকার রয়েছে।
২. কাউকে কোন সংঘভূক্ত হতে বাধ্য করা যাবে না।
ধারা ২১
১. প্রত্যক্ষভাবে বা অবাধে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিজ দেশের শাসন পরিচালনায় অংশগ্রহণের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
২. নিজ দেশের সরকারী চাকুরীতে সমান সুযোগ লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
৩. জনগণের ইচ্ছাই হবে সরকারের শাসন ক্ষমতার ভিত্তি; এই ইচ্ছা নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত প্রকৃত নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যক্ত হবে; গোপন ব্যালট কিংবা সমপর্যায়ের কোন অবাধ ভোটদান পদ্ধতিতে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
ধারা ২২
সমাজের সদস্য হিসেবে প্রত্যেকেরই সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার আছে। জাতীয় প্রচেষ্টা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সংগঠন ও সম্পদের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রত্যেকেরই আপন মর্যাদা এবং ব্যক্তিত্বের অবাধ বিকাশের জন্য অপরিহার্য সামাজিক, অথনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারসমূহ আদায়ের অধিকার রয়েছে।
ধারা ২৩
১. প্রত্যেকেরই কাজ করার, স্বাধীনভাবে চাকূরী বেছে নেবার, কাজের ন্যায্য এবং অনুকূল পরিবেশ লাভ করার এবং বেকারত্ব থেকে রক্ষিত হবার অধিকার রয়েছে।
২. কোনরূপ বৈষম্য ছাড়া সমান কাজের জন্য সমান বেতন পাবার অধিকার প্রত্যেকেরই আছে।
৩. কাজ করেন এমন প্রত্যেকেরই নিজের এবং পরিবারের মানবিক মর্যাদার সমতুল্য অস্তিত্বের নিশ্চয়তা দিতে পারে এমন ন্যায্য ও অনুকূল পারিশ্রমিক লাভের অধিকার রয়েছে; প্রয়োজনবোধে একে অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাদি দ্বারা পরিবধিত করা যেতে পারে।
৪. নিজ স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য প্রত্যেকেরই ট্রেড ইউনিয়ন গঠন এবং তাতে যোগদানের অধিকার রয়েছে।
ধারা ২৪
প্রত্যেকেরই বিশ্রাম ও অবসরের অধিকার রয়েছে; নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে বেতনসহ ছুটি এবং পেশাগত কাজের যুক্তিসঙ্গত সীমাও এ অধিকারের অন্তর্ভূক্ত।
ধারা ২৫
১. খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিত্সা ও প্রয়োজনীয় সমাজ কল্যাণমূলক কার্যাদির সুযোগ এবং এ সঙ্গে পীড়া, অক্ষমতা, বৈধব্য, বার্ধক্য অথবা জীবনযাপনে অনিবার্যকারণে সংঘটিত অন্যান্য অপারগতার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং বেকার হলে নিরাপত্তার অধিকার সহ নিজের এবং নিজ পরিবারের স্বাস্থ্য এবং কল্যাণের জন্য পর্যাপ্ত জীবনমানের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
২. মাতৃত্ব এবং শৈশবাবস্থায় প্রতিটি নারী এবং শিশুর বিশেষ যত্ন এবং সাহায্য লাভের অধিকার আছে। বিবাহবন্ধন-বহির্ভূত কিংবা বিবাহবন্ধনজাত সকল শিশু অভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা ভোগ করবে।
ধারা ২৬
১. প্রত্যেকেরই শিক্ষালাভের অধিকার রয়েছে। অন্ততঃপক্ষে প্রাথমিক ও মৌলিক পর্যায়ে শিক্ষা অবৈতনিক হবে। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে। কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সাধারণভাবে লভ্য থাকবে এবং উচ্চতর শিক্ষা মেধার ভিত্তিতে সকলের জন্য সমভাবে উন্মুক্ত থাকবে।
২. ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ এবং মানবিক অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা-সমূহের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে শিক্ষা পরিচালিত হবে। শিক্ষা সকল জাতি, গোত্র এবং ধর্মের মধ্যে সমঝোতা, সহিষ্ণুতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়াস পাবে এবং শান্তিরক্ষার স্বার্থে জাতিসংঘের কার্যাবলীকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
৩. কোন ধরনের শিক্ষা সন্তানকে দেওয়া হবে, তা বেছে নেবার পূর্বাধিকার পিতামাতার থাকবে।
ধারা ২৭
১. প্রত্যেকেরই সমষ্টিগত সাংস্কৃতিক জীবনে অংশগ্রহণ করা, শিল্পকলা উপভোগ করা এবং বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও তার সুফল সমূহে অংশীদার হওয়ার অধিকার রয়েছে।
২. বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পকলা ভিত্তিক কোন কর্মের রচয়িতা হিসেবে নৈতিক ও বৈষয়িক স্বার্থ সংরক্ষণের অধিকার প্রত্যেকেরই থাকবে।
ধারা ২৮
এ ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহের বাস্তবায়ন সম্ভব এমন একটি সামাজিক ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় অংশীদারীত্বের অধিকার প্রত্যেকেরই আছে।
ধারা ২৯
১. প্রত্যেকেরই সে সমাজের প্রতি পালনীয় কর্তব্য রয়েছে, যে সমাজেই কেবল তাঁর আপন ব্যক্তিত্বের স্বাধীন এবং পূর্ণ বিকাশ সম্ভব।
২. আপন স্বাধীনতা এবং অধিকারসমূহ ভোগ করার সময় প্রত্যেকেই কেবলমাত্র ঐ ধরনের সীমাবদ্ধতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন যা অন্যদের অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহ নিশ্চিত করা এবং একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নৈতিকতা, গণশৃংখলা ও সাধারণ কল্যাণের ন্যায়ানুগ প্রয়োজন মেটাবার জন্য আইন দ্বারা নির্নীত হবে।
৩. জাতিসংঘের উদ্দেশ্য ও মূলনীতির পরিপন্থী কোন উপায়ে এ অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহ ভোগ করা যাবে না।
ধারা ৩০
কোন রাষ্ট্র, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি এ ঘোষণাপত্রের কোন কিছুকেই এমনভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবেন না, যার বলে তারা এই ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহ নস্যাত্ করতে পারে এমন কোন কাজে লিপ্ত হতে পারেন কিংবা সে ধরনের কোন কাজ সম্পাদন করতে পারেন।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় যে, মানুষের অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যে মানবাধিকারের কথা বলা হচ্ছে বাস্তবিক অর্থে তা অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমণ্ডিত।মানবাধিকার সনদ প্রদান করার পর তার প্রতি অনেকের আশা-আকাংখা ছিল। কিন্তু এত কিছু করার পর বর্তমান ফিলিস্তিন, ইরাক, আফগানিস্তান, মায়ানমার পরিস্থিতি মানবাধিকার বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে। যদিও এর কিছু সাফল্য রয়েছে। পারতপক্ষে জনগণের সমতা-ন্যায্যতা ও মানবাধিকারের সর্বোচ্চ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ১৭৫ বছর পূর্বে রচিত ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’ শীর্ষক ছোট্ট পুস্তিকাটি ঘোষিত হয়েছিল, তা দুনিয়াকে বদলে দেওয়ার এক ঐতিহাসিক দলিল এবং শ্রমিক শ্রেণির মতাদর্শের এক অপ্রতিরোধ্য রাজনৈতিক হাতিয়ার। যে মানবাধিকার ঘোষণা করা হয়েছিল তা সকলের জন্য অনুসরণীয় এবং তাকে আমরা মানবাধিকারের মূল ভিত্তি হিসেবে গণ্য করে সামনের দিকে আগাতে থাকলে একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে সক্ষম হব।
আমাদের দেশে মানবাধিকারের মূল ভিত্তি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে হলে বিদ্যমান শোষণমূলক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন দরকার। দরকার জনগণের মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুশাসন নিশ্চিত করা। আর সেটি করতে হলে আমাদের বৈষম্যহীন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ এই চার নীতিতে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। তাহলেই জনআকাঙ্খা পূরণ করা সম্ভব হবে।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
মুক্তমত শ্রমিকশ্রেণির প্রথম রাষ্ট্র প্যারি কমিউনের ১৫৩ বছর ও মানবাধিকার সৈয়দ আমিরুজ্জামান