Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঈদের অর্থনীতিতে কেনাকাটা শুরু: বিক্রেতা ক্রেতার সহঅবস্থান

ড. মিহির কুমার রায়
১৯ মার্চ ২০২৪ ১৩:২৮

ঈদের কেনাকাটা শুরু হয়েছে ঢাকায় যদিও ঈদের সময় আসতে অনেকটা দিন বাকি রয়েছে । মার্কেট-বিপণিবিতান ফ্যাশন হাউজ এবং শোরমল গুলোতে ক্রেতাদের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। রমজান মাসের প্রথম রোজা থেকে বেচাবিক্রি বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে মার্কেটে কেনাকাটা করতে আসা ক্রেতারা জানিয়েছেন, তারা এখন সাধ্যমতো ঈদের শপিং করছেন। চাঁনরাত পর্যন্ত তাদের কেনাকাটা চলবে। বেচাবিক্রি বাড়ায় খুশি সাধারণ ব্যবসায়ীরা। ইতোমধ্যে মার্কেটগুলো ভরে উঠছে নতুন ও বাহারি সব পোশাক আশাকে। ঈদের বাজারে জমজমাট ব্যবসা-বাণিজ্যের আশায় বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তারা। ঈদের দুদিন পরই এবার বাঙালির সার্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ পালিত হবে সারাদেশে। মূলত এই দুই উৎসব ঘিরে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যে এখন সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। ফলে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে থাকা অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার সুযোগ এসেছে ঈদকে ঘিরে। আশা করা হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ বেচাকেনায় গতি ফিরবে অর্থনীতিতে।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, এবারের ঈদ ও পহেলা বৈশাখে সারাদেশে অন্তত ২ লাখ থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হবে। গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এই বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। বিশেষ করে মানুষের আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনমান উন্নত হওয়ায় তাদের ভোগব্যয় ও কেনাকাটা বাড়ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন উৎসব কেন্দ্রিক এই বাণিজ্য দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে। রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের কারণে চাপে থাকা ব্যবসা-বাণিজ্যে আবার গতি ফিরে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-বোনাস, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স এবং ব্যক্তিগত তহবিলের অর্থ ঈদের কেনাকাটায় সাধারণত ব্যবহার করা হয়।

বিজ্ঞাপন

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ ১৭ কোটি মানুষের এক বিশাল বাজার। ঈদকে ঘিরে এই বাজারে দিন দিন আরও বড় হচ্ছে। ইতোমধ্যে এক কোটি প্রবাসী তাদের আত্মীয়-স্বজনকে ভালোভাবে রোজা, ঈদ উদযাপন এবং পহেলা বৈশাখের কেনাকাটার জন্য রেমিটেন্স পাঠাতে শুরু করেছেন। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের পাশাপাশি বিদেশ থেকেও বিপুল পরিমাণ পণ্যসামগ্রী বিশেষ করে পোশাক, ইলেক্ট্রনিক্স, গহনা, প্রসাধনী, ফার্নিচার এবং গাড়ি আমদানি করা হচ্ছে। ঈদের অর্থনীতিতে পোশাক, জুতা, ভোগ্যপণ্য ও ইলেক্ট্রনিক্সের মতো শীর্ষ ১৫ পণ্যের কেনাকাটায় বাণিজ্য হবে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার ওপরে। এর বাইরে আরও অনেক রকম পণ্যের কেনাকাটা ও লেনদেন হবে ঈদকে ঘিরে। যার পরিমাণ হবে প্রায় প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক পরিবেশ আরও উন্নত হয়েছে। অস্থিরতা ও উদ্বেগ কেটে যাওয়ায় নতুন বিনিয়োগ বাড়তে শুরু করেছে। এমনকি ভোক্তা ব্যয়ও বাড়তে শুরু করেছে দেশে। সব মিলিয়ে ঈদে প্রায় ২ থেকে আড়াই লাখ কোটি টাকার ব্যবসায়-বাণিজ্য হবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি, ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতিসহ ব্যবসায়ীদের অন্যান্য সংগঠন। ঈদের অর্থনীতি প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য হলো ঈদকেন্দ্রিক বেচাবিক্রি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবসময় গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আগের কয়েক বছর করোনা মহামারির ধাক্কা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন ঘিরে এক ধরনের অস্থিরতা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যে। এখন করোনা নেই এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও কেটে গেছে। ফলে ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরবে। সাধারণ মানুষ এবার স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেনাকাটায় শামিল হবেন এটাই সাবাবিক । প্রতিবছর নতুন নতুন চাহিদা বাড়ায় বড় হচ্ছে ঈদের অর্থনীতি। ঈদকে সামনে রেখে সেজে উঠেছে রাজধানীসহ দেশের ছোট-বড় সব বিপণিবিতান ও শপিংমলগুলো। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী এখন কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। ফলে বাড়ছে ঈদের অর্থনীতির আকার। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে থাকবে সাড়ে ১২ লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বোনাস। এক কোটি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আরও প্রায় দেড় কোটি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বোনাস। এছাড়া ব্যক্তিগত অর্থ এবং সঞ্চয় থেকে সাধ্যমতো মানুষ ঈদের কেনাকাটায় শামিল হবেন। এ পরিমাণ টাকার সবই ঈদ অর্থনীতিতে যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রবাসীরা ঈদ উৎসব পালনে আপনজনদের কাছে প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠাতে শুরু করেছেন। মূলত প্রবাসীরা নিজেদের আপনজনদের কাছে ঈদ উৎসব পালনে বাড়তি টাকা পাঠাচ্ছেন। রোজার ঈদের পরই শুরু হবে কোরবানি ঈদের প্রস্তুতি। সেই সময়ও প্রবাসীরা বিপুল অঙ্কের রেমিটেন্স পাঠাবেন। এর ফলে ডলার সংকট কেটে বাড়বে রিজার্ভ। দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বাড়াতে হলে এখন ডলারের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ঈদকে ঘিরে সেই ডলার সংকট কাটবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সিনিয়র সহ-সভাপতি বলেন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঈদ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ব্যবসায়ীরা সারাবছর এই সময়ের জন্য মুখিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ফলে ঈদকে ঘিরে ব্যবসায়ীরা নতুন নতুন বিনিয়োগ করছেন। বিশেষ করে পাইকারি মার্কেটের পর এখন খুচরা পর্যায় থেকে ভোক্তারা সাধ্যমতো কেনাকাটা করছেন।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্যমতে, ঈদে সারা দেশের ২৬ লাখ দোকানে কেনাকাটা শুরু হয়েছে। মুদি দোকান থেকে শুছু করে এসব দোকানের মধ্যে কাপড়ের দোকান, শোরুম ও ফ্যাশন হাউজগুলোও রয়েছে। এসব দোকানে বছরের অন্য সময় প্রতিদিন ৩ হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হলেও রোজার মাসে সেটি তিনগুণ বেড়ে হয় ৯ হাজার কোটি টাকা। ওই হিসাবে রোজার এক মাসে এই ২৬ লাখ দোকানে ঈদ পোশাক থেকে শুরু করে ভোগ্যপণ্য বিক্রি হবে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকারও বেশি। ঈদুল ফিতরে সবচেয়ে বেশি টাকা লেনদেন হয় পোশাকের বাজারে। পোশাকের দোকানেই ঈদের কেনাকাটা এবার ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ কোটি কোটি টাকার বেশি। শুধু তাই নয়, ঈদ ঘিরে অর্থনীতির সব খাতেই গতি ফিরে আসে। ঈদের মাসে যেমন সারাদেশের শপিংমল বা মার্কেটগুলো গতিশীল হয়-তেমনি সারাদেশের কুটিরশিল্প, তাঁতশিল্প, দেশীয় বুটিক হাউসগুলোয় বাড়ে কর্মচাঞ্চল্য ও আর্থিক লেনদেন। বিপুল অর্থ ব্যয়ের কারণে অর্থনীতিতে বড় ধরনের গতিশীলতা আসে।
ঈদের সময় ব্যাংকিং খাতে লেনদেন বাড়ে ব্যাপক হারে। ঈদ উপলক্ষ্যে রেকর্ড গতিতে দেশের অর্থনীতিতে জমা হচ্ছে প্রবাসীদের রেমিটেন্স। মানুষের চাহিদা পূরণে ঈদের আগে বাজারে অতিরিক্ত নতুন নোট ছাড়বে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততা ও যানজটের ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দেশের অনলাইন বাজার। রোজার আগে অর্থনীতিতে এক ধরনের প্রভাব থাকে। আর রোজা শুরুর পর থাকে আরেক ধরনের। রোজার আগে অর্থনীতি সচল থাকে ভোগ্যপণ্যকেন্দ্রিক। এ মাসে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। রোজা শুরুর প্রায় ছয় মাস আগে থেকেই মূলত শুরুহয় রোজাকেন্দ্রিক অর্থনীতি।

রমজানের প্রথম সপ্তাহে রাজধানীর মিরপুরের বিপণিবিতানগুলো ঈদের পর্যাপ্ত পোশাকে উঠলেও এখনও বেচা-কেনা সেভাবে শুরু হয়নি। শপিংমলের ছোট-বড় দোকানগুলোতে কিছু কিছু ক্রেতা এলেও তাদের বেশিরভাগই পছন্দের পোশাক দেখতে আসছেন। বিক্রেতারা বলছেন, চলতি বছর সব ধরনের পোশাকের দাম বেড়েছে। ক্রেতা কম হওয়ার এটাও একটা কারণ হতে পারে। তাদের আশা, রমজানের মাঝামাঝি সময় থেকে ঈদ বাজারের কেনাকাটায় বিপণিবিতানগুলো সরগরম হয়ে উঠবে।

এদিন রাজধানীর মিরপুর অবস্থিত শাহ আলী প্লাজায় ‘এস কে ফ্যাশনে’র বিক্রেতা বলেন, রমজানের প্রথম সপ্তাহ শেষ হতে চললেও অন্য বছরের তুলনায় এবার বেচাকেনা সেভাবে নেই। বাজারে সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। মানুষ সবার আগে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনে তারপর আনন্দের অনুষঙ্গ হিসেবে ঈদে পছন্দের পোশাক কিনে। কিন্তু এবার অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়তি। পোশাকের দামও অনেক বেড়েছে। এসব কারণেও এবার হয়ত ঈদের পোশাকের বাজারে ক্রেতা কম। তারপরও আগামী সপ্তাহ থেকে ক্রেতা বাড়বে বলে আশা করছি।’ এবার রাজধানীর বিভিন্ন শপিং সেন্টারে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদ উপলক্ষে নানা ডিজাইনের পোশাক তারা এনেছেন। কিন্তু বেচাকেনা স্বাভাবিক সময়ের মতোই হচ্ছে। ঈদ বাজারের আমেজ এখনো শুরু হয়নি। তাদের আশা রোজার মাঝামাঝি থেকে বেচাকেনা বাড়বে।

লেখক: গবেষক, অর্থনীতিবিদ

সারাবাংলা/এসবিডিই

ঈদের অর্থনীতিতে কেনাকাটা শুরু: বিক্রেতা ক্রেতার সহঅবস্থান ড. মিহির কুমার রায় মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর