চট্টগ্রাম: যত্র তত্র শহরের বাজার নাকি বাজারের শহর
১৯ মার্চ ২০২৪ ১৪:৩০
কোথাও সকাল সকাল, কোথাও বা ছুটির দিনে, ভ্যানে সবজি বিক্রেতার ডাকেই ঘুম ভাঙ্গে অনেকের। অনেক বিক্রেতা আবার কাস্টমারকে টোটাল সেবা দেওয়ার জন্য সবজির পাশাপাশি মাছ-মাংস-ডিম এসবও রাখা শুরু করেছে। শুধু বিক্রিই নয়, বিল্ডিংয়রে সামনে কাটাকুটির কাজও সারেন অনেকে। বর্জ্যগুলো কোথাও কোথাও পাশে স্তুপ করে রেখে যায়।
হয় কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে, নয়তো প্রতি শুক্রবার নিয়ম করে সুনিদ্দিষ্ট বাজারে গিয়ে জিনিসপত্র কেনার সংস্কৃতি এখন খুব একটা নেই। একটা সময় নগরীর মানুষজন শহরের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে একদম সকাল সকাল মাছ কিনতে যেতো ফিসারীঘাট। অনেকে সাশ্রয়ী দামে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাছ নিত ওখান থেকে, অনেকে ঘরের নিয়মিত রান্নার জন্য নিত। এখন তাও অনেকের করতে হয়না।
বাসা থেকে বের হতেই অলিতে গলিতে বাজার, রাস্তা ঘাটে বাজার, পাড়া মহল্লায় বাজার, ফুটপাতে বাজার, পার্কের পাশে বাজার, এখানে ওখানে সবখানেই বাজার, যেন বাজারের শহর!
যদিও নিদ্দিষ্ট সময়ের জন্য, নগরীতে কিছু কিছু বাজার আবার এমন, সকালে মানুষজন ব্যায়াম বা প্রাতঃভ্রমণ করতে যাবে, ফিরতে তাদের সুবিধার্তে বসে যায় বাজার, যাতে সবই পাওয়া যায়, কোথাও আবার চড়া দামে। নির্ধারিত সময়ের পর কোথাও আবার তাদের বাশিঁ বাজিয়ে বাজিয়ে তুলে দিতে হয় জোর করেই।
সকালে সন্তানদের স্কুলে পৌছেঁ দিয়ে অভিভাবকদের সুবিধার্থে সবজি, মাছ, মাংস এসব নিয়ে বসে পড়ে বিক্রেতারা। সকালে এমন জটলা নিত্যদিনের।
আদালত কেন্দ্রিক নানান পসরা সাজিয়ে বিক্রেতাদের বেচা বিক্রি চলে দিনব্যাপী। আদালতে নানান কাজে আসা যাওয়া করা মানুষজন যেমন এসবের ক্রেতা, আবার দিন শেষে অনেক আইনজীবী ঘরে ফেরার আগে এখান থেকে সদাই কিনে ফিরেন।
শুধু নিউ মার্কেট কেন্দ্রিক রেয়াজুদ্দিন বাজার ছাড়া সারা শহরের নির্ধারিত প্রসিদ্ধ বাজার গুলোতে শহরবাসীর যাতায়াত যে খুব একটা নেই সেটা অনুমান করা যায়।
যেখানে সেখানে গড়ে উঠা বাজার গুলোতে যে শুধু ক্রেতা বিক্রেতার স্বার্থ নির্ভর, তা নয়। এগুলো বসতে দেওয়াতে সব চেয়ে বিপদজনক ভুমিকা রাখে এলাকাভিত্তিক অদৃশ্য মাফিয়াদের হোমরা চোমরা’রা।
ঘরের কাছের বেশ কিছু বছর ধরে হঠাৎ গজিয়ে উঠা বাজারটিতে অবৈধ ভাসমান দোকানীদের থেকে প্রায় দিন হ্যাংলা লিক লিকে মাদকাসক্ত টাইপের লোকটার চাঁদাবাজি দেখলে বুঝা যায়, কোন বটগাছের ছায়া ছাড়া লোকটা এতটা বেপোরোয়া হতে পারে না। তাই সব দেখে সাধারণ জনগণ কেউ আর বিপ্লবী হতে চায় না।
বন্দর নগরীর সৌন্দর্য বা ঐতিহ্যে সুনির্দিষ্ট পুরানো বাজারগুলোও একটা অংশ, সে ঐতিহ্যও বিলুপ্তির পথে।
দেশের অন্যতম পাইকারী বাজার খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, বক্সিরহাট, রেয়াজুদ্দিন বাজার, কাজির দেউরী বাজার, চকবাজার, বহদ্দারহাট কাঁচা বাজার, কামাল বাজার, বিবিরহাট, ফতেয়াবাদ, চৌধুরী হাট, দেওয়ানহাট, চউক কর্ণফুলী মার্কেট, হালিশহর কাঁচা বাজার, সরাইপাড়া, সিইপিজেড মোড়, কাটগড় বাজার, পতেঙ্গা বাজার- এই নির্ধারিত হাট বাজার গুলোতে নগরীর মানুষ একটা সময় যে যার কাজের ফাঁকে সুবিধাজনক সময়ে বাজার সদাই করতো৷ তখন শহরও তুলনামূলক অনেক পরিচ্ছন্ন ছিল, ‘হাতের নাগালেই সব’ এমন নেতিবাচক মানসিকতার বিস্তারও খুব একটা ঘটেনি তখন। আর এখন দৃশ্যপট একেবারে পুরোটাই উল্টো।
কোন কোন জায়গায় বড় বড় অ্যাপার্টমেন্টে বসবাসরত’রা তো পারে না নিজেদের যার যার বিল্ডিংয়ের সামনেই একেকটা বাজার বসিয়ে দেয়।
হাতের নাগালে বাজার, নাগরিক সুবিধায় যতটা না সহজলভ্যতা, তার চেয়ে বরং অনভ্যস্ততা-অলসতা, অকর্মণ্যতা, শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হওয়া ছাড়া কিছুই না, বছরের পর বছর যা বেড়েই চলেছে।
বিগত ২০ বছরে নিজের চোখে যা দেখেছি, নগরীর আভ্যন্তরীন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় যে উন্নয়ন হয়েছে, যেভাবে সড়ক সম্প্রসারণ হয়েছে দ্বিগুণ তিন গুণ, গুরুত্বপূর্ণ ২/৩টা পয়েন্ট ছাড়া, প্রায় সড়কের সম্প্রসারিত অংশের পুরোটাই অবৈধ পার্কিং, বাজার, হকারের দখলে আর নেপথ্যের কুশীলব’রা ফেঁপে ফুলে বড় হয়।
অবৈধ দখল বা উচ্ছেদের নামে কিছুদিন পর পর যা দেখি, হাস্যকর মনে হয়। কারণ সপ্তাহ পাড় হতে না হতেই সেই পুরানো চিত্র।
নাগরিক হিসেবে আমরা নিজেরাই চরম উদাসীন। শুধু নিজের সুবিধাটাই প্রত্যাশা করি, ভূমিকা রাখার বেলায় একেবারে শূণ্য। শহর পরিচ্ছন্নতায় সিটি কর্পোরেশন প্রতিনিয়ত সাধ্যমত ভূমিকা রাখলেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা নিজেরাই চরম অসচেতন।
শহর দিনে দিনে ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায়, মাত্রাতিরিক্ত যানবাহনে, ধূলোবালিতে দূষণের মাত্রাও বেড়ে চলেছে খুব।
আমি বা আমরা এতটাই ননীর পুতুল হয়ে যাচ্ছি দিন দিন, বাজার তো বাজার, প্রাত্যহিক নানান টিপটপ সুবিধা নিতে নিতে কয়েকদিন বাদে হয়তো ঘরে ঘরে গিয়ে শৌচকর্ম ও তিনবেলা আহার করিয়ে দেওয়ার মানুষ সাপ্লাইয়ের এজেন্সি তৈরি হয়ে যাবে, নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে সেবা দিতে।
যতদিন আমরা ভাড়াটিয়া মানসিকতা থেকে বের হয়ে, এই শহরকে নিজের মনে করে ভাবতে পারবো না, ততদিন হয়তো ক্রমঃ অধঃগতির এই সিস্টেম থেকে মুক্তি মিলবে না। আর মনের খোরাকের জন্য দেশের পরিচ্ছন্ন শহরের রোল মডেল রাজশাহী গিয়ে ঘুরবো, ছবি তুলবো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাব্যিক ভাষার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে আফসোসের ঢেকুর তুলবো।
লেখক: সংস্কৃতিকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই
অজয় মিত্র চট্টগ্রাম- যত্র তত্র শহরের বাজার নাকি বাজারের শহর মুক্তমত