Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা প্রয়োজন শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি

আলমগীর হোসেন
২১ মার্চ ২০২৪ ২০:৪৫

গুণগত ও মানসম্পন্ন শিক্ষাই একটি সুশিক্ষিত জাতি গঠনের মূল ভিত্তি। আর এই সুশিক্ষা নিশ্চিত করার কান্ডারী হচ্ছেন একজন দক্ষ শিক্ষক। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দায়সারাভাবে প্রদানই একজন শিক্ষকের মূল লক্ষ্য না হয়ে সেই শিক্ষাকে সঠিকভাবে প্রদান করা একজন আদর্শ শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। জ্ঞান বিতরণ এমনভাবে করা উচিত যাতে প্রত্যেক শিক্ষার্থী সঠিকভাবে বিষয়টিকে বুঝতে পারেন, ধারণ করতে পারেন ও প্রয়োগ করতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা ক্লাস নেন সীমিত পরিসরে।

বিজ্ঞাপন

মার্কিন শিক্ষা বিভাগের মতে, ৩ ক্রেডিটের কোর্সে একজন শিক্ষককের ১৫ সপ্তাহে ৩ ঘণ্টা করে সর্বমোট ১৫*৩=৪২ ঘণ্টা ও ৪ ক্রেডিট কোর্সের জন্য ১৫ সপ্তাহে ৪ ঘণ্টা করে সর্বমোট ১৫*৪= ৬০ ঘণ্টা ক্লাস নেওয়ার কথা থাকলেও শিক্ষকরা কোর্স প্রতি ১৫-২০ ঘণ্টা ক্লাস নিয়ে থাকেন। কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কিছু বিভাগে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক ঘাটতি থাকলেও বেশ কিছু বিভাগে রয়েছে শিক্ষকদের অনিচ্ছা ও দায়িত্বহীন মনোভাব। অনেক সময় দেখা যায়, নির্ধারিত এই ক্লাসগুলোতেও শিক্ষকদের শিখন পদ্ধতি শিক্ষার্থীদেরকে আকৃষ্ট করে না। অনেকে শিক্ষার্থীদের পড়ান গদবাধা নিয়মেই। পাঠদান প্রক্রিয়ায় থাকে না কোনো কোনো অভিনব পদ্ধতি। সেমিস্টার পরীক্ষা না আসা পর্যন্ত প্রকাশ করা হয় না পরীক্ষার সিলেবাস। প্রকাশ করা হয় না ইন্টারনাল মার্কস। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও ক্লাসের বাইরে শিক্ষার্থীদের দেন না তেমন সময়। স্বীয় বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং না করে বাইরে কাউন্সিলিং ও ব্যবসার মাধ্যমে মত্ত থাকেন অর্থ উপার্জনে। নম্বর কমে যাওয়ার শঙ্কায় শিক্ষকদের নিয়ে মন্তব্যও করতে পারেন না শিক্ষার্থীরাও। অনেক সময় শিক্ষক কর্তৃক কুপ্রস্তাবের বিপরীতে মুখ খুলতে সাহস পান না নারী শিক্ষার্থীরা। ফলে অনিচ্ছা থাকা সত্তে¡ও তাল মেলাতে হয় অনৈতিক কার্যক্রমে। সম্প্রতি দেশসেরা বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক কর্তৃক নারী শিক্ষার্থীকে কুপ্রস্তাব এবং কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় নানা রকম হেনস্থার ঘটনা বেড়েই চলেছে।

বিজ্ঞাপন

এজন্য প্রয়োজন শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি। একজন শিক্ষককের জানা দরকার শিক্ষকতায় তার ঘাটতি কোথায়? কিভাবে শিখন পদ্ধতি আরও শিক্ষার্থী উপযোগী করা যায়? কোর্সের উপকরণ কিভাবে সাজালে শিক্ষার্থীদের জন্য সহজবোধ্য হয়? যে পদ্ধতিতে শিক্ষক জ্ঞান বিতরণ করছেন সেটি শিক্ষার্থীদের কাছে কতটুকু সহজবোধ্য? কতটুকু ফলপ্রসু? এসব প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষককের প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিয়মিত মন্তব্য গ্রহণ। শিক্ষার্থীদের মন্তব্যে নিজেকে মূল্যায়ন করে জ্ঞান বিতরণ পদ্ধতিতে নতুনত্ব নিয়ে আসা। কর্তৃপক্ষের উচিত একজন শিক্ষক পর্যাপ্ত ক্লাস নিচ্ছেন কিনা সেটি নজরদারি করা। শিক্ষক মূল্যায়ন ফরমের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট কোর্সে কোনো শিক্ষকের ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের মন্তব্য নেওয়া। এসকল শিক্ষক মূল্যায়ন ফরমে থাকবে না কোনো শিক্ষার্থীর নাম, রোল বা অন্য কোনো পরিচয়। পরে উক্ত কোর্স শিক্ষকের সাথে একান্তে বসে শিক্ষার্থীদের মন্তব্য অনুযায়ী কোন কোন জায়গায় উন্নয়ন করা যায় সেগুলো পরামর্শ দেবেন। যৌন নিপীড়ন বা মার্কস টেনপারিং এর কোনো অভিযোগ পেলে শিক্ষককে সতর্ক করবেন। বছর শেষে নির্দিষ্ট সময় অন্তত ১বার করা যেতে পারে শিক্ষক মূল্যায়ন। শিক্ষার্থীরা নাম, রোল, পরিচয়হীনভাবে মূল্যায়ন করবেন শিক্ষককে। এতে করে নিশ্চিত হতে পারে মানসম্মত শিক্ষা। শিক্ষকরা সুযোগ পাবেন নিজেদেরকে আরও শিক্ষার্থী উপযোগী করে তুলতে। তবে কোনোভাবেই এই শিক্ষক মূল্যায়নকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না।

শিক্ষক মূল্যায়নে যেসকল পদ্ধতি ব্যবহৃত করা যেতে পারে

শিক্ষকের পাঠদানের কার্যকারিতা বিভিন্ন উপায়ে পরিমাপ করা যেতে পারে। উল্লেখ্যযোগ্য ৩টি টুল হলো:

১. স্টুডেন্ট অ্যাচিভমেন্ট গ্রোথ: ‘স্টুডেন্ট অ্যাচিভমেন্ট গ্রোথ’ হলো সময়ের সাথে সাথে শিক্ষার্থীর একাডেমিক অগ্রগতির উপর শিক্ষকের প্রভাব পরিমাপ করে। এটি শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পারফরম্যান্সের উন্নতিতে শিক্ষকের নির্দেশনামূলক পদ্ধতি কতটুকু কার্যকর সেটি নির্ধারণে সহায়তা করে।

২. স্টুডেন্টস পারসেপশনস অফ দ্য টিচার ইফেক্টিভনেস অ্যান্ড ক্লাসরুম ইন্সট্রাকশনাল ক্লাইমেট: এই পদ্ধতিতে শিক্ষকের কার্যকারিতা এবং শ্রেণিকক্ষে শেখার পরিবেশ সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা কী মনে করছেন সেই তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এই পদ্ধতিতে নাম, রোল,পরিচয় গোপণ রেখে শিক্ষার্থীরা কিছু প্রশ্নের ভিত্তিতে প্রতিক্রিয়া প্রদান করে থাকে। যেমন: নির্দিষ্ট কোর্সে কোনো শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে কেমন পাঠদান করেন? ক্লাসের রুটিন অনুযায়ী সময়মত ক্লাস শুরু করেন কিনা? নির্দিষ্ট সময়ে কোর্স শেষ করেন কিনা? জ্ঞানভিত্তিক লেকচার দেন কিনা? কোর্সের বিষয়বস্তু কেমন? ক্লাসগুলো আকর্ষণীয় এবং প্রাণবন্ত করতে পারছেন কিনা? শ্রেণিকক্ষে আরামদায়ক অ্যাকাডেমিক পরিবেশ তৈরি করতে পারছেন
কিনা? কোর্স ম্যাটেরিয়ালস সরবরাহ করছেন কিনা? পরীক্ষা-অ্যাসাইনমেন্ট ঠিকমত নিচ্ছেন কিনা? এবং সেগুলোর ঠিকমত মূল্যায়ন হচ্ছে কিনা? সামগ্রিকভাবে শিখন প্রক্রিয়া কার্যকর ছিল কিনা? এই প্রতিক্রিয়া শিক্ষকদের শিক্ষাদানের পদ্ধতি এবং শ্রেণীকক্ষের কার্যকলাপের কৌশলগুলি কীভাবে শিক্ষার্থীরা উপলব্ধি করছে সে সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।

৩. পিয়ার রিভিউ: এক্ষেত্রে শিক্ষকগণ সহকর্মীদের একে অপরের শিক্ষার কৌশলগুলি পর্যবেক্ষণ করবে এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিভাগের উদ্দেশের সাথে মিল রেখে পাঠদানের কৌশলগুলোর উন্নতিতে আলোচনা করার ক্ষেত্র তৈরি করবে। এক্ষেত্রে পিয়ার রিভিউ একদিকে শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতার সংস্কৃতি তৈরি করবে, অন্যদিকে শিক্ষকেরা একে অপরের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা বিনিময়ের মাধ্যমে পাঠদানের পরিবেশকে ক্রমাগত উন্নত করতে পারবেন।

শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতির কিছু বিশেষ উপকারিতা

শিক্ষক মূল্যায়নের ফলে জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পাশাপাশি শিক্ষকদের মধ্যেও ক্রমাগত নতুন কিছু শেখার সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। শিক্ষকগণ শিক্ষাদান পদ্ধতিতে উৎকর্ষ ও উদ্ভাবনের জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করতে উৎসাহিত হবেন। শিক্ষকগণ নিজের সর্বোচ্চ সক্ষমতা দিয়ে শেখাতে পারবেন এবং ছাত্ররা তাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা দিয়ে শিখতে পারবেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ইন্টারঅ্যাকশন বৃদ্ধি পাবে। শিক্ষকগণ পাঠদান ও শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগে সচেতন হবেন। শিক্ষার্থীরা শিখন প্রক্রিয়ায় নিজেদের মতামত প্রদানের মাধ্যমে ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে পারবেন। শিক্ষার্থীদের শেখার সম্ভাবনাকেই বাড়িয়ে তুলবে। শিক্ষার গুণগত মান আরও উন্নত হবে। এছাড়া জবাবদিহিতার পরিবেশ তৈরি হওয়ায় যৌন নিপীড়নসহ শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন রকম হেনস্থা কমে যাবে।

শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতিতে চ্যালেঞ্জ

শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে বেশকিছু চ্যালেঞ্ছ মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে শিক্ষকদের একটি পক্ষের ভেটো ও অনীহা। এছাড়াও অনেক সময় শিক্ষক মূল্যায়নকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হতে পারে। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের ক্ষেত্রে শিক্ষক মূল্যায়নকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার সম্ভাবনা থাকতে পারে। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পর্যালোচনা করার সময় শিক্ষকরা কখনও কখনও ভুল বুঝতে পারেন। শিক্ষকদের অনেকেই শিক্ষক মূল্যায়নকে নিজের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির একটি টুল হিসাবে না দেখে বরং ব্যক্তিগতভাবে নিতে পারেন।

শিক্ষক মূল্যায়নের দৃষ্টান্ত

সম্প্রতি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্ছিনিয়ারিং বিভাগে চালু করা হয়েছে এই শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি। যেটিকে বলা হয়েছে “স্টুডেন্টস পারসেপশনস অফ দ্য টিচার ইফেক্টিভনেস অ্যান্ড ক্লাসরুম ইন্সট্রাকশনাল ক্লাইমেট”। বিভাগটিতে শিক্ষার গুগগত মান নিশ্চিতে বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ড. মো. সুজন আলী (শেখ সুজন আলী) গ্রহণ করেছেন এই উদ্যোগ। শিক্ষকরা যাতে শিক্ষার্থীদের মন্তব্য অনুযায়ী নিজেদেরকে গুছিয়ে শিক্ষার্থীদের মতো করেই জ্ঞান পরিবেশ করতে পারেন সেজন্য এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। তার গৃহীত এই শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট কোর্সে কোনো শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে কেমন পাঠদান করেন? ক্লাসের রুটিন অনুযায়ী সময়মত ক্লাস শুরু করেন কিনা? নির্দিষ্ট সময়ে কোর্স শেষ করেন কিনা? জ্ঞানভিত্তিক লেকচার দেন কিনা? কোর্সের বিষয়বস্তু কেমন? ক্লাসগুলো আকর্ষণীয় এবং প্রাণবন্ত করতে পারছেন কিনা? শ্রেণিকক্ষে আরামদায়ক অ্যাকাডেমিক পরিবেশ তৈরি করতে পারছেন কিনা? কোর্স ম্যাটেরিয়ালস সরবরাহ করছেন কিনা? পরীক্ষা-অ্যাসাইনমেন্ট ঠিকমত নিচ্ছেন কিনা? এবং সেগুলোর ঠিকমত মূল্যায়ন হচ্ছে কিনা? সামগ্রিকভাবে শিখন প্রক্রিয়া কার্যকর ছিল কিনা?-এমন মোট ১০টি বিষয়ে লিকার্ট স্কেলে শিক্ষার্থীদের মতামত জানতে চাওয়া হবে। শেষের প্রশ্নের ভিত্তিতে লিখিতভাবে মন্তব্য ও পরামর্শ দেওয়ার সুযোগও আছে। এই মূল্যায়ন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর কোন ব্যক্তিগত তথ্য উল্লেখ থাকবে না। সকল তথ্য গোপন রেখে একজন শিক্ষার্থী একটি নির্দিষ্ট কোর্সের জন্য সেই শিক্ষককে মূল্যায়ন করতে পারবে।

শিক্ষার্থীদের এই মূল্যায়নকে আমলে নিয়ে সেই শিক্ষকের শিক্ষা প্রদানের পদ্ধতিকে অনেক ভালো (এ), ভালো (বি), সন্তোষজনক (সি) কিংবা উন্নতির প্রয়োজন (ডি) এই চারটি ভাগে মূল্যায়ন করা হবে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়াও ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশসেরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি চলমান রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে শিক্ষকদের পাঠদানের মূল্যায়ন পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও। যা জুন (২০২৪) থেকে চালুর কথা ভাবছে কর্তৃপক্ষ।

শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতিকে কিভাবে দেখছেন শিক্ষার্থীরা?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইন্সটিটিউট (ফলিত পরিসংখ্যান) এর ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মোঃ বাধন ইসলাম বলেন, “একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তার সাবজেক্টিভ ফিল্ডে কতটা উৎসাহী হবে তা অনেকটাই শিক্ষকের পাঠদান এবং শিক্ষক-সুলভ আচরণের উপর নির্ভর করে। এই সিস্টেম চালু হলে শিক্ষকদের ফাঁকিবাঁজির কোনো সুযোগ থাকবে না এবং তারা শিক্ষার্থীবান্ধব হয়ে উঠবে। যার ফলস্বরূপ শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের অনুকূল পরিবেশ ফিরে আসবে। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় তুলনামূলকভাবে বেশি উৎসাহী হয়ে উঠবে এবং যথাযথ স্কিল অর্জন করে চাকরির বাজারে এগিয়ে থাকবে।”

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের রিয়া মোদক বলেন, “শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। এ পেশায় যারা আসার সুযোগ পান তারা সর্বোচ্চ মেধার স্বাক্ষর রেখেই প্রবেশ করেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। তবে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এমন অনেক শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে পাঠদান করে থাকেন যার গুনগত মান নিয়ে তৃপ্ত হতে পারেনা শিক্ষার্থীরা। এর অনেক কারণ থাকতে পারে। যেমন: পরিবর্তিত বা সমসাময়িক সিলেবাসের সাথে উক্ত শিক্ষকের খাপ খাওয়াতে না পারা, অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যথাযথ প্রস্তুতির অভাব, শিক্ষক রাজনীতিতে অতিরিক্ত নিমজ্জিত থাকা, জ্ঞান সৃষ্টি ও মৌলিক গবেষণায় মনোনিবেশের অভাব, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক শিক্ষার পরিবেশ ইত্যাদি কারণ থাকতে পারে। যার ফলে একটি মানসম্মত লেকচার দিতে ব্যর্থ হন একজন শিক্ষক। এক্ষেত্রে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক মূল্যায়নের ভার শিক্ষার্থীর ওপর থাকলে সেসব শিক্ষক যেমন গুণগত পাঠদানে সক্ষম হবেন, তেমনই নিজ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হবেন। আগে শিক্ষকদের মূল্যায়ন কথাটির সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। তবে ইদানীং এর ব্যবহার বাড়ছে। এর মাধ্যমে বুঝা যায় কিছু শিক্ষক শিক্ষকতা বাদ দিয়ে অন্যান্য কাজে মনোযোগ বেশি দিয়ে শিক্ষার্থীদের কাক্সিক্ষত পাঠদানে ব্যর্থ হচ্ছেন। তবে শিক্ষক মূল্যায়নের একক ভার শিক্ষার্থীর ওপর থাকলে কোন শিক্ষকের সাথে অপরাজনীতি বা মিথ্যা হয়রানিরও শিকার হবারও সম্ভবনা উড়িয়ে দেওয়া যায়না।”

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেদ্ওয়ান আহমদ বলেন, “অনেক সময় স্বজনপ্রীতি, দলীয় বা অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের ঘটনা দেখা যায়। যে কারণে, একজন শিক্ষার্থী তার উপযুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষাগ্রহণ থেকে অনেকাংশেই বঞ্চিত হচ্ছে। দেশের বড় চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিলেন। কিন্তু সে স্বায়ত্তশাসনের অসদ্ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে অনেক শিক্ষককে। আর সে প্রভাবটা এসে পড়ছে শিক্ষার্থীদের উপর। যে শিক্ষার্থী একসময় দেশসেরা হওয়ার স্বপ্ন দেখতো, শিক্ষকের অদক্ষতা বা দায়িত্বহীনতায় হয়তো সে অকালেই ঝরে পড়ছে। তবে, এটা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে একটি উপায়ে। আর সেটি হলো- শিক্ষার্থীদের দ্বারা শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি। এটি হলে, নাম প্রকাশ না করে একজন শিক্ষার্থী অনায়াসেই তার সেই শিক্ষককে ভালো-মন্দ মূল্যায়ন করতে
পারবে। আর শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে প্রশাসন সে শিক্ষকের পক্ষে-বিপক্ষে ব্যবস্থা নিবে। আর এভাবেই হয়ে উঠবে একটি আদর্শ পাঠদান প্রক্রিয়া। তবে, সেটা যেন কোন এক দুই জন শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন না হয়। পুরো ক্লাসের একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন হয়।”

নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার এন্ড ইঞ্ছিনিয়ারিং বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নুসরাতুল ইসলাম মীম বলেন, “শিক্ষক মূল্যায়নের জন্য এতদিন কোনো প্ল্যাটফর্ম ছিল না। কোন টিচার কেমন পড়াচ্ছেন, তার কোন দিকটা ভালো লাগছে, কোনটা খারাপ লাগছে, এই বিষয়গুলো আমাদের প্রকাশ্যে বলার সুযোগ ছিল না। এই পদ্ধতির কারণে শিক্ষকের দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহিতা বাড়বে। মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষকদের দোষ খোঁজা নয়, বরং তাদের পাঠদান প্রক্রিয়ার উন্নতি হবে। আমাদের বিভাগে শিক্ষক মূল্যায়ন চালু করায় বিভাগীয় প্রধান শেখ সুজন আলী স্যারকে ধন্যবাদ জানাই।”

শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতিকে কিভাবে দেখছেন শিক্ষাবিদগণ?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, “এই কার্যক্রম শিক্ষার মানকে আরো সমৃদ্ধ করবে। এর মাধ্যমে শিক্ষকরা আরও দায়িত্বশীল হবেন। যারা ক্লাসের ব্যাপারে আন্তরিক নন, ক্লাস কম নেন, তারা সচেতন হবেন এবং আরও বেশি প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাসে যাবেন। আশা করি আমাদের প্রত্যেক শিক্ষক এটিকে ইতিবাচক হিসেবে নেবেন এবং এর মাধ্যমে ভালো ফল আসবে। আমি মনে করি, শিক্ষার উন্নয়নের জন্য শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি চালু করা উচিত।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, “শিক্ষকদের পাঠদান মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু হলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের মধ্যেই সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ তৈরি হবে। এই মূল্যায়ন পদ্ধতি সমস্ত বিশ্বেই আছে। এটি এখন শিক্ষকতার একটি অংশ হয়ে গেছে। একজন শিক্ষক কার কাছে দায়বদ্ধ? দায়বদ্ধতা এবং তার নিজস্ব উন্নয়নের জন্যই মূল্যায়ন পদ্ধতিটা প্রয়োজন।একজন শিক্ষক যদি বিশেষ কারণে নিয়োগ পান, তিনি সেই বিষয়টা জানেন কিনা? সেই বিষয়টা পড়াতে পারছেন কিনা? এটি যদি মূল্যায়িত না হয়, তাহলে তো তিনি বছরের পর বছর উচ্চতায় উঠতে পারবেন না। তার কাজেরও তেমন উন্নতি হবে না।” শিক্ষকের পাঠদান মূল্যায়ন কেমন হওয়া উচিত এমন প্রশ্নে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, “মূল্যায়নটা দুই রকম হতে পারে। একটা মূল্যায়ন আমরা পারব না, সেটা হচ্ছে পিয়ার ইভালুয়েশন। সহকর্মীরা একজন আরেকজনকে মূল্যায়ন করবে, সেটা আমাদের দেশে সম্ভব নয়। কেননা আমাদের রাজনীতি এত বিভাজিত, সেখানে অবশ্যই রাজনীতি চলে আসবে। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতিটা হতে হবে বস্তুনিষ্ঠ। তাদেরকেও বুঝাতে হবে, আমরা মূল্যায়নটা ঠিকমত করেছি। সেজন্য ছাত্র-ছাত্রীদেরও ট্রেনিং দিতে হবে প্রথমে। আমি মনে করি এটা আমাদের সামনে যাওয়ার একটা উপায়। শিক্ষক মূল্যায়নে বাধা আসবে, তারপরও এটি চালু করা উচিত। কিšদ এই মূল্যায়নের মাধ্যমে কাউকে যেন অযাচিতভাবে শাস্তি দেওয়া না হয়।”

নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, “এটি বাংলাদেশের জন্য অনেকটা চ্যালেঞ্ছিং। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষের উপর যে বিশ্ববিদ্যালয় সেটি শিক্ষক মূল্যায়ন শুরু করার চেষ্টা করছে। আমি মনে করি পাশ্চাত্যের এই রীতি খারাপ নয়। শিক্ষকদেরও আসলে মূল্যায়িত হওয়া দরকার। শিক্ষকদের জানা দরকার তাদের পারফরম্যান্স, ডেপথ অফ নলেজ, স্মার্টনেসকে শিক্ষার্থীরা কিভাবে দেখছেন। শিক্ষকরা এই চ্যালেঞ্ছের মুখোমুখি হলে তাদের মধ্যে গুগগত পরিবর্তন আসবে। আমরা এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। অদূর ভবিষ্যতে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়য়ে আমরা প্রশাসনিক উদ্যোগে ছোট পরিসরে হলেও এটি শুরু করবো।”

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্ছুরী কমিশনের (ইউজিসি) সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, “শিক্ষক মূল্যায়ন একটি চমৎকার বিষয়। আমরা জিডিপিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও আমাদের শিক্ষার গুনগত মান এখনো নিশ্চিত হয়নি। আমাদের দেশে প্রায় ৪৮ লক্ষ উচ্চশিক্ষিত মানুষ থাকলেও শিক্ষার মানের অবস্থা সত্যিকার অর্থে ভালো না। শিক্ষার গুনগত মান নিশ্চিতে শিক্ষক মূল্যায়ন অত্যন্ত জরুরি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়, একবার কোনোভাবে শিক্ষক হয়ে গেলে পরবর্তীতে তাঁকে আর মূল্যায়ন করা হয় না। প্রফেসর হওয়ার পরেও শিক্ষক ইভালুয়েশনের সুযোগ থাকে। বাংলাদেশের অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এই শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি আছে। ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশসেরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত শিক্ষক মূল্যায়ন করা হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও এটি চালু করা দরকার। এতে করে শিক্ষকদের দায়িত্ববোধ বাড়বে। শিক্ষক মূল্যায়ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক স্বায়ত্তশাসনের অংশ। ইউজিসি শিক্ষক মূল্যায়নকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। আমি মনে করছি, সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক মূল্যায়ন চালু করা দরকার।”

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা

সারাবাংলা/এজেডএস

আলমগীর হোসেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা প্রয়োজন শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর