বাজার অর্থনীতি, সমবায় আন্দোলন ও গ্রামীণ অর্থনীতির রুপান্তর
২২ মার্চ ২০২৪ ২০:২৫
বিগত ৫৩ তম জাতীয় সমবায় দিবস উদযাপন ও জাতীয় সমবায় পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী পণ্যের অপচয় রোধ করে সহজে বাজারজাতকরন নিশ্চিত করতে সমবায়ের গুরত্বের কথা উল্লেখ্য করে বলেন আমাদের সীমিত জমিতে যা উৎপাদিত হয় তা অনেকক্ষেত্রে মূল্যের যাথাযথ সুযোগের অভাবে কৃষকরা প্রতিনিয়তই বঞ্চিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় গ্রামীণ সমবায়কে যথাযথ ভাবে কাজে লাগাতে পাড়লে উৎপাদনের মূল্য কৃষকের অনুুুকুলে যাবে। আমরা কৃষি পণ্যে উৎপাদনে বিশ্বে একটি সম্মান জনক স্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছি যেমন সবজি উৎপাদনে তৃতীয় স্থান, চাল উৎপাদনে চতুথর্ স্থান, আলু উৎপাদনে অষ্টম স্থান, সাধু পানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয় স্থান , ফল উৎপাদনে দশক স্থান, ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ স্থান ও বিশ্বের মোট ইলিশের উৎপাদনের ৮৩ শতাংশ হয় বাংলাদেশে। এই সকল সাফ্যলের পেছনে যে সকল সহায়ক শক্তি রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো সেচ এলাকা বৃদ্ধি ( ৭০ লাখ হেক্টর ) ,কৃষি উদ্যোক্তা ঋন ( ৩৩,৪৩২ জন কৃষক ), কৃষি সহায়ক কার্ড ( ২.১০ কোটি কৃষক ), সেচ পাম্প ( ১২৫০ সৌর চালিত সেচ পাম্প স্থাপন ), উৎপাদনমুখী প্রশিক্ষণ ( ৪১,৫০০ কৃষক,২৮৮৬ উদ্যোক্তা, ৭০০ জন এনজিতও কর্মী , ৩৮০ ব্যাংকার ও ২৮৪ সরকারি কর্মকর্তা ,কৃষি তথ্য কেন্দ্র ২৫৪ টি ও কৃষি খাতে শেষ আট বছরে বিনিয়োগ হয়েছে ৫৭৭৬ কোটি টাকা (উৎসঃ প্রথম আলো প্রতিষ্ঠাবাষিকী সংখ্যা )
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন দেশের উন্নয়নে যুব শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মাটি, জল, বাযূ ও পরিবেশের সমন্বয়ে সমবায় ভিত্তিক উদ্যোগের কোন বিকল্প নেই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রামঞ্চলের বাধ্যতামুলক উৎপাদনমুখী সমবায়ের কথা উল্লেখ্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন সমবায় হচ্ছে তারা যে সকল পণ্যে উৎপাদন করছে সে গুলো তারা শিল্প কারখানার কাঁচা মাল হিসাবে ব্যবহার করে যদি প্রক্রিয়জাত করন করা যায় তা হলে গ্রাম বাংলা আর অবহেলিত থাকবে না। বিদ্যমান সমবায় আইনকে যোগপযোগী করে সমবায় ব্যাংককে র্কায্যকর করতে হবে এবং বর্তমান যুগে ডিজিটাল বাংলাদেশে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলে সমবায়ের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে হবে।বঙ্গবন্ধু মনে করতেন সমবায় হলো একটি জনকল্যান মুলক প্রতিষ্ঠান যার মধ্যে রয়েছে গনতন্ত্র, উৎপাদন, সুশাসন ,আন্দোলন, চেতনা ও আদর্শ এবং ১৯৭২ সালের ৩০ শে জুন বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন কতর্কৃ আয়োজিত সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষন তার জলন্ত প্রমাণ। ১৯৭২ সালে ২৬ শে মার্চ জাতীয়করনের নীতি ঘোষনা উপলক্ষ্যে কর্মসুচিতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন যে পাঁচ বছরের প্লানে দেশের ৬৫ হাজার গ্রামে বাধ্যতা মুলক সমাবায় প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তিনি উন্নয়নে দর্শনে প্রাধান্য দিয়েছিলেন সমবায়কে। সেই সমবায় ভাবনাকে পাথেয় করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বহুবিধ সমবায বান্ধব কার্য্যক্রম এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয়ে সবাইকে এগিয়ে আসার আমন্ত্রন জানিয়েছেনে। কিন্তুু সেই স্বপ্ন বা আশা বাস্তবায়নের সহযোগী কারা হবে- সরকার না জনগন ? যদি জনগন হয় তবে তারাই সমবায়ের পতাকাটিকে বহে নিয়ে যাবে তাদের অভিষ্ট লক্ষ্যে যেখানে সরকার হবে সহযোগী। আর সরকার যদি সুচনা করে তবে তার প্রতিষ্টানিক কাঠামোতে তা বেড়ে উঠবে জনগনের সগযোগিতায়।
বাংলাদেশর সমবায়ের ইতিহাসের দুটিরই উপস্থিতি পাওয়া যায় বিভিন্ন অবয়বে- বৃটিশ কিংবা পাকিস্থান আমালে । এর অভিজ্ঞতার ফসল গুলো আমাদের গবেষনার খোরাক যোগাবে এবং বাড়তি নতুন প্রকল্প তৈরিতে সহায়তা করবে যেমন দুস্থর কিংবা তিন স্থর সমবায কাঠামোর আদলে সার্বিক গ্রামেন্নয় কর্মসুচি, পল্লী দারিদ্র বিমোচন কর্মসুচি, একটি বাড়ী একটি খামাড় প্রকল্প ,পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক ইত্যাদি। কিন্তু বিশেষায়িত ব্যাংক হিসাবে সমবায় ব্যাংক লিঃ এর কিছু হবে কিনা? কথায় বলে (ড়ষফ রং মড়ষফ) যদি তাই হয় তবে প্রধানমন্ত্রীর কন্ঠে আবার সমবায় আইনের সংস্কারের প্রসঙ্গটি উচ্চারিত হলো এবং এর আগেও এই আইনের বিভিন্ন ধারায় সংস্কার হয়েছে কিন্তুু বাস্তবায়নেই যত সমস্যা দেখা দেয় যা সরকারের প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোই বাধা হয়ে দাড়ায়। দেশে প্রচলিত সনাতন পদ্ধতির সমবায় ( সমবায় অধিদপ্তর ) ও কুমিল্লা পদ্ধতির সমবায় এই দুইটি কেবল দাপ্তরিক নথিতেই সচল আছে তা বলা যাবে না যদিও সরকারী দফতর হিসাবে কর্মকর্তা কর্মচারীরা তাদের চাকুরীর সকল সুবিধা পাচ্ছে । কিন্তু সমবায় সমিতির মাধ্যমে কৃষির রুপান্তরের যে সুচনা হয়েছিল বিশেষত সঞ্চয়ে বিপননে ঋন প্রাদনে প্রশিক্ষনে সামাজিত পুজির বিকাশে তা আর তেমনটি নেই। এখন সেই জায়গা গুলো দখল করে নিয়েছে অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যাদের বলা হয় (ঘমড়ং) অথচ অর্থনৈতিক, সামাজিক কিংবা ব্যবাসয়ীক সংগঠন হিসাবে স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়নে সমবায়ের বিকল্প নেই। চায়নার কমিউন সিস্টেম, মেক্সিকা ইডোস ইসরাইলীর কিভোজ বাশিয়ার স্টেট কিংবা কালেকটির ফার্ম ভারতের সমবায় খামার জাপানোর কৃষি পণ্যে বিপনন সমবায় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হিসাবে যথেষ্ট অবদান রাখছে। কিন্তুু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সরকারি পরিকল্পনা দলিলে ( ৬ষ্ট ও ৭ম পঞ্চবাষির্কি পরিকল্পনা ) এর উপস্থিতি তেমন দৃশ্যমান নয় আর মাঠ পর্যায়ে কথা বাদই দিলাম। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়ের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনকে পলিসি সাপোট দেয়ার জন্য ষাটের দশকে তদানীন্তন সরকার পাসিস্থান গ্রাম উন্নয়ন একাডেমি বার্ড মানে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্টা করেছিল যার প্রায়গিক গবেষনা ফসল কুমিল্লা মডেল ( দুস্থও বিশিষ্ট সমবায় পল্লী পূত কর্মসুচি থানা সেচ কর্মসুচি থানা প্রশিক্ষণ উন্নয়ন কেন্দ্র ) তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্থানের সরকারের আনুকলে থানা পর্যায়ে তাদের পরিকাঠামো বিস্তার করে সারা পৃথীবিতে দৃষ্টি আকর্ষন করেছিল এবং এর পরিবর্তিতে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ পল্øী উন্নয়নের জন্য এটাই ছিল সরকারী পর্যায়ে একমাত্র কার্য্যক্রম । সময়ের আবর্তে পল্লী পূর্ত কর্মসুচি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ( এলজিইডি) দুস্থর বিশিষ্ঠ সমবায় বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড রিআরডিবি থানা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্র টিটিডিসি এবং থানা সেচ কর্মসুচি টিআইপি সরকারি পতিষ্ঠান হিসাবে আত্ম প্রকাশ করে। এগুলোর মধ্যে বিআরডিবি দুস্থর বিশিষ্ট সমবায় বাস্তবায়নে নিয়োজিত ছিল এবং এখনও আছে। প্রতিটি থানায় ( বর্তমানে উপজেলায় ) থানা সেন্টাল কো অপারেটির এসোসিয়েশন ( টিসিসিত্র) যা গ্রাম সমবায় সমিতির ( কেএসএস) থানা পর্যায়ে ফেডারেশন সমবায় সংগঠনের কাজ করে যাচ্ছিল এবং সমিতির চেয়ারম্যান মডেল ফার্মার ও ব্যবস্থাপক গন প্রতি মাসেবই আসত থানা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য।
সেই সমবায়ের আয়োজন সে সময়ে কৃষি উন্নয়নে একটি গতিশীল ভুমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল বিশেষ করে উফসী ধান সম্পসারনে। কিন্তুু আশির দশকে যখন বাজার অর্থনীতির ধিরে ধিরে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে তখন থেকেই কাজর করার সামাজিক আচরন গুলো বাধা গ্রস্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে এককেন্দ্রীকতা (বঃযহড়পবহঃৎরংস) সমবায়িদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় । নব্বইয়ের দশকের প্রথমবার্ধে নিবাচিত নতুন গনতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় বসেই একটি ভ্রান্তি সিদ্ধান্ত নিয়োজিত বিশেষত পাচ হাজার টাকা পযন্ত কৃষি ঋনের সুদ মওকুফ যার আওতায় সমবায়িরা না আসায় আন্দোলনে মুখে সমবায় সমিতিগুলো তাদের নিয়মিত ঋনের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ করে দেয়। এর ফলশ্রæতিতে সমবায়িদের প্রদেয় সোনালী ব্যাংকের নয়শত কোটি টাকা আটকে যায় যর গ্রহনযোগ্য সমাধান না হওয়ার দু স্থর বিশিষ্ট সমবায় কাঠামো ভেঙ্গে পড়ে। কৃষকরা নিয়মিত থানা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্র আসা বন্দ করে দেয় এবং চোখের সামনে একটি জীবন্ত কর্মসুচির পতন ঘটে শুরু একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারনে। । সমসাময়িক সরকারগুলো ও তাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা ( ৬ষ্ট ও ৭ম) সমবায়কে আর সেই ভাবে আনতে দেখা যায় না এবং পিআরএসপি (poverty reduction strategy paper) এর দলিল থেকে সমবায়কে বাদ দেয়া হয়েছে সর্ম্পূন ভাবে। এই ধরনের একটি পরিস্থিতিতে সমবায় সংগঠকে আবার পুন:জাগরণের করার ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বিশেষত। কৃষি পণ্যে বিপনের ক্ষেত্রে সমবায়কে ব্যবহার করে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষত জাপানে এর সফল দৃষ্টন্ত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সফল উদ্যোগক্তার প্রয়োজন যারা অঞ্চল ভিত্তি কৃষি পণ্যের উৎপাদনের নীবিরতা নিরিখে বিপনন সমিতি গড়ে তুলবে উৎপাদকদের সহযোগীতায়। এখানে উল্লেখ্য যে কৃষি পণ্যেও বিপননে মধ্যস্বত্য ভোগীরা দলিল ফরিয়া ব্যাপারী এক ধরনের (exploitative) ভুমিকা পালন করে যা কৃষকের স্বার্থে যায় না। সেইরক্ষেত্রে সমবায় সংগঠনের ভ’মিকা সমবায়ের জোড়ালো হতে হবে। আমাদের দেশের উদ্যোগক্তারা কৃষকদের দৃষ্টি সমবায়ের প্রতি ফেরাতে পারলে তা অনেকাংশে সম্ভব হবে যদিও কাজটি যথেষ্ট কষ্ট সাধ্য। দেশে প্রতিবছর ব্যবসায় প্রসাশনে অগনিত ছাত্রছাত্রী স্মাতক ডিগ্রি নিয়ে বেরচ্ছে এবং তারাই হতে পারে আগমী দিনের সমবায় আন্দোলনের সৌনিক ও কর্ণধার । বর্তমানে খামার বাড়ীতে অবস্থিত কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সমবায় অধিদপ্তরের সাথে একিভূত হয়ে কৃষি পণ্যের সমবায় বিপণন পদ্বোতি সারা দেশে চালু করতে পারে। বাংলাদেশের কৃষক লীগ, কৃষক ইউনিয়ন ও কৃষক আন্দোলনে এ ব্যাপারে কৃষকদের সংঘটিত করে বিপণন ব্যবস্থাকে জোরদার করতে পাড়ে।। তাহলেই সোনার ফসলের মূল্য কৃষকের মুখে হাঁসি ফোটাবে এবং প্রধান মন্ত্রীর আশা পূরন হবে এই বাংলায়।
লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক
সারাবাংলা/এজেডএস
গ্রামীণ অর্থনীতির রুপান্তর ড. মিহির কুমার রায় বাজার অর্থনীতি সমবায় আন্দোলন