স্বাধীনতার জন্য ফাঁসির মঞ্চে আত্মদানকারী বিপ্লবী ভগৎ সিং
২৩ মার্চ ২০২৪ ১৫:১৫
“মানুষ তার নিত্যদিনের কার্যক্রমে অভ্যস্ত হয়ে পরিবর্তনের ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। এই ক্লান্তিকর চিন্তাধারা থেকে বেরোতেই বিপ্লবী উদ্দীপনার প্রয়োজন।”
-ভগৎ সিং
ব্রিটিশ বিরোধী ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও জনগণের সামগ্রিক মুক্তির জন্য সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও ফাঁসির মঞ্চে আত্মদানকারী কিংবদন্তি বিপ্লবী ভগৎ সিং লাল সালাম। মহান এই বিপ্লবীর আত্মদানের ৯৩তম শাহাদাৎ বার্ষিকী আজ। তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন।
যার অদম্য ইচ্ছা শক্তি ও দেশ প্রেম ব্রিটিশ সরকারকেও নাড়িয়ে দিয়েছিল- তিনি হলেন অগ্নিযুগের শহীদ বিপ্লবী ভগৎ সিং। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রভাবশালী বিপ্লবী। আমরা তাঁকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে গভীরভাবে স্মরণ করছি।
বিপ্লবী ভগৎ সিংহের জন্ম ১৯০৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর একটি জাট শিখ পরিবারে। তার পরিবার পূর্ব থেকেই ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কৈশোরেই ভগৎ ইউরোপীয় বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে পড়াশোনা করেন এবং নৈরাজ্যবাদ ও কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন। এরপর তিনি একাধিক বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের (এইচআরএ) সঙ্গে যুক্ত হয়ে মেধা, জ্ঞান ও নেতৃত্বদানের অপরিসীম সক্ষমতায় তিনি অচিরেই এই সংগঠনে বিপ্লবী নেতায় পরিণত হন এবং সংগঠনটিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনে এটিকে হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনে (এইচএসআরএ) রূপান্তরিত করেন। তাকে এবং তার সংগঠনকে নৈরাজ্যবাদী আখ্যা দেওয়া হলে তিনি ক্ষুরধার যুক্তিতে তা খন্ডন করেন। জেলে ভারতীয় ও ব্রিটিশ বন্দীদের সমানাধিকারের দাবিতে ৬৪ দিন টানা অনশন চালিয়ে তিনি ব্যাপক সমর্থন আদায় করেন। প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিপ্লবী লালা লাজপত রায়ের হত্যার প্রতিশোধে এক ব্রিটিশ পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট মিস্টার স্যান্ডার্সকে গুলি করে হত্যা করেন ভগৎ। বিচারে মহান এই বিপ্লবীর ফাঁসি হয়। তার এই আত্মবলিদানের দৃষ্টান্ত শুধুমাত্র ভারতবর্ষের যুবসমাজকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধই করেনি শুধু, বুদ্ধির মুক্তি সহ সামগ্রিক পরিবর্তনের জন্য সমাজতন্ত্রের উত্থানেও প্রভূত সহায়তা করেছিল।
ভগৎ সিংহের জন্ম পাঞ্জাবের লায়ালপুর জেলার বাঙ্গার নিকটস্থ খাতকর কালান গ্রামের এক সান্ধু জাট পরিবারে। তার পিতার নাম সর্দার কিসান সিংহ সান্ধু ও মায়ের নাম বিদ্যাবতী। ভগতের নামের অর্থ “ভক্ত”। তিনি যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সেটি ছিল এক দেশপ্রেমিক শিখ পরিবার। এই পরিবারের কোনো কোনো সদস্য ভারতের বিভিন্ন স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অতীতে এই পরিবারের কোনো কোনো সদস্য আবার মহারাজা রঞ্জিত সিংহের সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন। ভগতের ঠাকুরদাদা অর্জুন সিংহ ছিলেন দয়ানন্দ সরস্বতীর হিন্দু সমাজ সংস্কার আন্দোলন আর্যসমাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভগতের উপরেও এই সংগঠনের গভীর প্রভাব লক্ষিত হত। ভগতের বাবা ও দুই কাকা অজিত সিংহ ও স্বরণ সিংহ কর্তার সিং সরভ গ্রেওয়াল ও হরদয়াল নেতৃত্বাধীন গদর পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অজিত সিংহের নামে একটি মামলা দায়ের করা হলে তিনি পারস্যে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। অন্যদিকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম জোরদারে তহবিল সংগ্রহের প্রয়োজনে ১৯২৫ সালের কাকোরি ট্রেন ডাকাতির ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় ১৯২৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর স্বরণ সিংহের ফাঁসি হয়।
ভগতের বয়সী ছেলেরা সাধারণত লাহোরের খালসা হাইস্কুলে পড়াশোনা করতেন। কিন্তু ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের প্রতি এই স্কুলের আনুগত্যের কারণে তার ঠাকুরদাদা তাকে এখানে পাঠাননি। পরিবর্তে ভগতের বাবা তাকে আর্যসমাজি বিদ্যালয় দয়ানন্দ অ্যাংলো-বৈদিক স্কুলে ভর্তি করেন। মাত্র তেরো বছর বয়সে ভগৎ মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। এই সময় তিনি প্রকাশ্যে ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরোধিতা করেন এবং তার সরকারি স্কুলবই ও বিলিতি স্কুল ইউনিফর্ম পুড়িয়ে ফেলেন। চৌরিচৌরার গণ-হিংসার ঘটনায় কয়েকজন পুলিশকর্মীর মৃত্যু হলে গান্ধীজি আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। এতে হতাশ হয়ে ভগৎ যুব বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেন এবং সশস্ত্র বিপ্লবের পন্থায় ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসন উৎখাত করার কথা প্রচার করতে থাকেন।
১৯২৩ সালে ভগৎ সিং পাঞ্জাব হিন্দি সাহিত্য সম্মেলন কর্তৃক আয়োজিত প্রবন্ধ রচনা প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করেছিলেন। এটি পাঞ্জাব হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক সহ অন্যান্য সদস্যদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি পাঞ্জাব লেখক দ্বারা রচিত অনেক কবিতা এবং সাহিত্য পাঠ করেন এবং তার পছন্দের কবি ছিলেন আল্লামা ইকবাল। ভগত সিং মার্ক্সবাদী সাহিত্য, টলস্টয়, বাকুনিন, আপটম সিনক্লেয়ার ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ নজরুল গভীর মনযোগের সাথে পাঠ করেছিলেন।
ভগৎ সিং কিশোর বয়সে লাহোরের ন্যাশনাল কলেজে পড়াশুনা আরম্ভ করেন কিন্তু বাল্য বিবাহ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে যান এবং ‘নওজাওয়ান ভারত সভা’ (ভারত যুব সভা) এর সদস্য হন। এই সংস্থায় ভগৎ সিং এবং তার আর বিপ্লবী সহকর্মীরা যুবকদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ইতিহাসের শিক্ষক ও প্রফেসর বিদ্যালংকরের সাথে পরিচিত হওয়ার মাধ্যমে ভগৎ হিন্দুস্তান রিপাবলিক এসোশিয়েশনের সাথে যুক্ত হন। যেখানে রামপ্রসাদ বিসমিল, চন্দ্রশেখর আজাদ এবং আসফাক উল্লা খানের মত বিশিষ্ট নেতারা ছিলেন। এটা বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে, তিনি কানপুর থেকে কাকরি গিয়েছিলেন ‘কাকরি ট্রেন লুট’ করার জন্য কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তিনি লাহোর ফিরে আসেন। ১৯২৬ সালের অক্টোবর মাসের নবরাত্রিতে লাহোরে বোমা বিস্ফোরিত এবং ভগৎ সিং এই বোমা বিস্ফোরণে জড়িতদের দায়ে গ্রেফতার করা হয় এবং গ্রেফতারের পাঁচ সপ্তাহ পর তাকে ৬০০০০ টাকা জামিন নিয়ে মুক্তি দেওয়া হয়। তিনি অমৃতসর থেকে উর্দু ও পাঞ্জাব পত্রিকায় লিখেন এবং সম্পাদনা করেন। ১৯২৮ সালের অক্টোবর মাসে ‘কৃতি কিষান পার্টি’ একই পতাকাতলে সমগ্র ভারতের বিভিন্ন বিপ্লবী নেতারা একটি সভায় মিলিত হয়েছিল। ভগৎ সিং ওই সভার সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তীতে তার বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে সমিতির নেতা বানানো হয়।
অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবীদেরকে দমনের জন্য পুলিশকে অধিক ক্ষমতা প্রদান করে ভারত প্রতিরক্ষা আইন পাশ করার সমস্ত প্রক্রিয়া চুড়ান্ত করে। ১৯২৯ সালের ৮ এপ্রিল সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে আইনটির অধ্যাদেশ পাশ হবার সিদ্ধান্ত হয়। এই আইনকে রুখে দেওয়ার জন্য ভগৎ সিং এর ‘হিন্দুস্থান সোসালিস্ট রিপাবলিকান এসোসিয়েশন’ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। দলের নেতা ভগৎ সিং এর নেতৃত্বে সিদ্ধান্ত হয় ৮ এপ্রিল সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে এর প্রতিবাদে বোমা নিক্ষেপ করা হবে। উদ্দেশ্যটা রক্তপাত ঘটানো ছিল না; তাঁরা চেয়েছিলেন, ভগৎ সিং এর ভাষায় ‘বধিরের কানের কাছে আওয়াজ তুলতে’। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত বোমা নিক্ষেপ করবেন আর দলের অন্যরা তাঁদেরকে ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নিবেন। ৮ এপ্রিল যথাসময়ে ‘বধিরের কানের কাছে আওয়াজ পৌঁছানোর’ জন্য ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর বোমা নিক্ষেপ করে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ শ্লোগান দেন, যে-আওয়াজ ওইভাবে এর আগে কখনো শোনা যায়নি। পলায়নের চেষ্টা না-করে তাঁরা নির্ভয়ে ইস্তাহার বিলি করতে থাকেন। এসময় পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করে।
এই ইস্তাহার হিন্দুস্তান রিপাবলিকান আর্মির নামে প্রকাশিত হয়েছিল এবং তাতে মার্কসবাদের প্রতি সংগঠনের অঙ্গীকার অভিব্যক্ত হয়েছিল, বলা হয়েছিল নতুন একটি মানবিক সমাজ গড়বার প্রয়োজনে তাঁরা যে কোনো শাস্তি সানন্দে গ্রহণ করবেন। তাঁরা ঘোষণা করেছিলেন যে, তাঁদের পথটা গণআন্দোলনের। মামলায় ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত উভয়েই যাবজ্জীবন দীপান্তর দণ্ডে দণ্ডিত হন। কিন্তু তাঁদের দু’জনকে পুলিশ ইনসপেক্টর সান্ডার্সকে হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। এই মামলায় প্রমাণাভাবে বটুকেশ্বর দত্ত অব্যাহতি পান। কিন্তু ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরুকে খুনের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে জেলে প্রেরণ করা হয়।
জেলে বন্দী থাকাকালে ভগৎ সিং ব্রিটিশ ও ভারতবর্ষের বন্দীদের সমানাধিকারের দাবিতে ৬৩ দিন অনশন করেন। সে সময় ভারতীয় বন্দীদের চেয়ে ব্রিটিশ চোর ও খুনিদের প্রতি অধিকতর ভাল আচরণ করা হত। ৬৩ দিন অনশনের ফলে ব্রিটিশ সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ভগৎ সিং জেলে থাকার সময় ডায়রী লিখতেন। তিনি প্রচুর বই পড়তেন। যে কথাগুলো ভালো লাগত, সেগুলো টুকে রাখতেন নিজের ডায়েরিতে। ১৯৩০-৩১ সালে জেলের মধ্যে ফাঁসির অপেক্ষায় যখন ভগৎ সিং এর দিন কাটছিল সে সময় তিনি ‘why I am An Atheist’ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। ফাঁসির কয়েক মাস পরে ‘The People’ (Lahore, 27 Sept. 1931) নামক পত্রিকায় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়।
১৯৩০ সালের ৭ অক্টোবর। তিন ব্রিটিশ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত এক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরুকে অপরাধী সাব্যস্ত করে এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় প্রদান করে। অবশেষে ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় মহান এই তিন বিপ্লবীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ব্রিটিশ বিরোধী ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও জনগণের সামগ্রিক মুক্তির জন্য সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও ফাঁসির মঞ্চে আত্মদানকারী কিংবদন্তি বিপ্লবী ভগৎ সিংকে আমরা ভুলবোনা কোনদিন।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
মুক্তমত সৈয়দ আমিরুজ্জামান স্বাধীনতার জন্য ফাঁসির মঞ্চে আত্মদানকারী বিপ্লবী ভগৎ সিং