কৃষি পণ্যের দাম: ঠকছে কৃষক, ভোক্তা প্রতারিত, লভ্যাংশ কার পকেটে?
২৩ মার্চ ২০২৪ ১৮:০৯
রোজা এলেই বেগুনের কদর বাড়ে। এবারও বেড়েছে চাহিদা ও দাম দুটিই। এখন কিছুটা কমে এলেও রাজধানী থেকে শুরু করে মফস্বলের বাজারেও মোটামুটি চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে বেগুন। তারপরও কপাল চাপড়াতে হচ্ছে বেগুন চাষীদের। দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে কৃষক পর্যায়ের পাইকারি মোকামে বেগুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২ থেকে ৭ টাকায়, অথচ শহরে প্রতি কেজি ৫০ টাকার নিচে নেই। বেগুনের মতোই অবস্থা লাউ, মুলা, টমেটোসহ আরও কয়েকটি সবজির। স্থানীয় পর্যায়ে পাইকারিতে দাম একেবারে পড়ে গেছে। যদিও তার প্রতিফলন নেই খুচরা বাজারে। সবজি উৎপাদনকারী অন্যতম কয়েকটি জেলা এবং ঢাকার পাইকারি আড়ত ও খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যাচ্ছে, দাম এক লাফে কয়েক গুণ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে খুচরা ব্যবসায়ীদের হাতে এসে। সব মিলিয়ে পুরো ব্যবস্থায় কৃষক সর্বস্বান্ত হলেও, যথারীতি ভুগছে কিনে খাওয়া মানুষ। জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি বলেন, ‘বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে একদিকে কৃষক ঠকছে, অন্যদিকে ভোক্তাদের পকেট কাটা হচ্ছে।’
রাজধানীর অন্যতম বড় সবজির আড়ত কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখা যায়, কয়েক শ লাউ নিয়ে বিক্রির অপেক্ষায় বসে আছেন এক পাইকারি ব্যবসায়ী যার বক্তব্য হলো, পঞ্চগড় থেকে চার হাজার লাউ এনেছেন বিক্রির জন্য। দুই দিন বিক্রি করার পরও এখনো কয়েক শ লাউ রয়ে গেছে , প্রতিটি লাউ গড়ে ৭ থেকে ১০ টাকা দামে বিক্রি করছেন। কিন্তু তার থেকে ১০ গজ দূরত্বে একই আকারের ও মানের লাউ খুচরায় প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা দামে। কারওয়ান বাজার থেকে ৭-৫ কিলোমিটার দূরে মোহাম্মদপুর টাউন হল কাঁচাবাজার ও বনশ্রী কাঁচাবাজারে দাম যাচ্ছে আরও বেড়ে। ওই দুই বাজারে প্রতিটি লাউ বিক্রি হয়েছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। একইভাবে কারওয়ান বাজারে গতকাল পাইকারিতে প্রতি কেজি বেগুন ১০-১৫ টাকা, টমেটো ১৫-২০, মুলা ১০-১২ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে। মগবাজারের ডাক্তার গলির এক ভ্রাম্যমাণ সবজি বিক্রেতা এসেছিলেন কারওয়ান বাজারে সবজি কিনতে। সেখানে তিনি , পাইকারি কেজিপ্রতি ১৮ টাকা দামে বেগুন কিনেছেন। ভ্যানে করে ডাক্তার গলিতে ৫০ টাকা দামে বিক্রি করবেন। অর্থাৎ প্রতি কেজি বেগুনে তিনি লাভ করবেন ৩২ টাকা। এত বেশি দামে বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে তার দাবি, ‘পরিবহন খরচ, পুলিশের চাঁদা, ভ্যান ভাড়া বাদ দিলে বেশি লাভ থাকে না। কারওয়ান বাজার থেকে বেরিয়ে মোহাম্মদপুরের টাউন হল কাঁচাবাজারে গিয়ে দেখা যায়, টমেটো ৮০ টাকা, বেগুন ৬০ টাকা, মুলা ৪০ টাকা কেজি ও লাউ প্রতিটি ৭০ টাকায় বিক্রি করছেন।
খুচরা ব্যবসায়ীদের বেশি লাভ করার কারণে ভোক্তাদের বাড়তি দামে সবজি কিনতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন কারওয়ান বাজারের দয়াল ভান্ডার আড়তের মালিক বলেন, ‘বেগুন কেজিপ্রতি ৮-১০ টাকায় এবং লাউ ৭-৮ টাকায় বিক্রি করেছি। পাইকারি দাম অনেক কমলেও খুচরা ব্যবসায়ীদের অতি লোভের কারণে খুচরায় কমেনি।’ তবে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মনে করেন, পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে দামের পার্থক্যের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তার দাবি, খুচরা ব্যবসায়ীদের পাইকারি পণ্য কেনার পর দোকান ভাড়া, চাঁদা, শ্রমিকের বেতনসহ অনেক খরচ হয়। এ ছাড়া কাঁচামালের ৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। খুচরা বিক্রি করতে গিয়ে পাইকারিতে কেনা পণ্যের ওজন মেলে না। খুচরা ব্যবসায়ীর তো বেশি লাভ না করলে পোষাবে না। মানবিকভাবেই বিষয়গুলো দেখতে হবে। এখন কম দামে সবজি বেচে লোকসানে কৃষক ।
খুচরা আর পাইকারিতে যে দামে সবজি বিক্রি হচ্ছে, স্থানীয় পর্যায়ে কৃষকেরা তাও পাচ্ছেন না। বগুড়া ও লালমনিরহাট প্রথম রমজানে পাইকারি দামে বেগুন কেজিপ্রতি ৫০ টাকা বিক্রি হলেও ৬-৭ রমজান থেকে দরপতন। খেত থেকে বেগুন সংগ্রহ করতে শ্রমিকের খরচই উঠছে না চাষিদের। লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার কুমড়িরহাট এলাকার এক কৃষক জানান, তিন মণ (১২০ কেজি) বেগুন পাইকারি বিক্রি করে পেয়েছেন ২৪০ টাকা। যশোরের পাইকারি সবজির মোকাম সদর উপজেলার বারীনগরে গতকাল প্রতি কেজি বেগুন ৫ থেকে ৬ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
ঝিনাইদহের পাইকারি ও খুচরা সবজি বাজারে দেখা যায়, পাইকারিতে লাউ প্রতিটি ১০ টাকা বিক্রি হলেও তা স্থানীয় খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা। বেগুন পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ টাকা। সেই একই বেগুন স্থানীয় খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি। পাইকারি বাজারে সবজি বিক্রি করতে আসা কৃষক জানান, ‘ব্যাপারী, ফড়িয়া, খুচরা বিক্রেতাদের জন্য আমরা সবজির ন্যায্যমূল্য পাচ্ছি না।’ ক্যাব সভাপতি বলেন, ‘দামের এমন তারতম্য খারাপ পরিস্থিতির পূর্বাভাস। কৃষক যদি ন্যায্য দাম না পান, তাঁরা উৎপাদন কমিয়ে দেবেন। তখন সংকট আরও ঘনীভূত হবে।’
এটাই মাঠ পর্যায়ের কৃষিপণ্যের বিপণনের বাস্তব চিত্র । এখন গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত নতুন সরকারের ভূমিকা কী তা নিয়ে জনগনের প্রশ্ন থাকাটাই প্রাসঙ্গিক বলে প্রতীয়মান হয় । এরই মধ্যে সরকার বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে যার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ২৯ পণ্যের দাম নির্ধারণ করলেও তাদের দৈনিক তালিকায় থাকে ৫৩ পণ্যের যৌক্তিক মূল্য। ১৫ মার্চের ২৯ পণ্যের সরকার নির্ধারিত তালিকার ২ নম্বরে মাষকলাই ডালের যৌক্তিক খুচরা দাম উল্লেখ করা হয় কেজি প্রতি ১৬৬ টাকা ৫০ পয়সা। অথচ কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তালিকায় ১২ মার্চ এই মাষকলাইয়ের দাম যৌক্তিক খুচরা মূল্য ছিল প্রতি কেজি ১৩৭ টাকা ৩০ পয়সা। ১২ মার্চের তালিকায় ছোলার খুচরা দর ছিল ৯২ টাকা ৬১ পয়সা; ১৫ মার্চ যা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৯৮ টাকা ৩০ পয়সা। অর্থাৎ এক দিনের ব্যবধানে সরকারই দাম বাড়িয়ে দিয়েছে প্রতি কেজি মাষকলাইয়ে প্রায় ৩০ টাকা এবং ছোলায় ৭ টাকা। একইভাবে ওই এক দিনের ব্যবধানে উন্নত মসুর ডালের দাম কেজিপ্রতি ৫ টাকা কমালেও ২ টাকা বাড়ানো হয়েছে মোটা মসুর ডালের দাম। ডিম, মাছ ও মুরগির দাম বাড়ানো-কমানো না হলেও কেজিপ্রতি গরুর মাংসের দাম বাড়ানো হয়েছে ৮ টাকা, রসুনে বাড়ানো হয়েছে কেজিপ্রতি ৫ টাকা, আদায় বেড়েছে ৮ টাকা, শিমে বাড়ানো হয়েছে ৮ টাকা, টমেটোতে বাড়ানো হয়েছে ৪ টাকা। ব্যবসায়ীরা বেঁধে দেওযা দামে ২৯ পণ্য সরকারকেই বিক্রি করার আহ্বান জানিয়েছেন। এক বছর আগে কৃষকের বাজারে অত্যাধুনিক এই ভবন উদ্বোধন হলেও পুরোদমে চালু হয়নি। সপ্তাহে শুক্রবার সকালে কয়েক ঘণ্টার জন্য কিছু বিক্রেতা এখানে সবজি বিক্রি করেন বলে জানা গেছে। তবে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে বিএডিসির উদ্যান উন্নয়ন প্রদর্শনী ও বিক্রয়কেন্দ্র (আরবান সেলস সেন্টার) চালু আছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ২৯ পণ্য নির্ধারিত দামের বেশিতেই বিক্রি হচ্ছে। এখানে ছোলা ১১০, চিনি ১৫০, দেশি পেঁয়াজ ৯০, মসুর ডাল (উন্নত) ১৪০, প্রতি পিস ডিম ১২ টাকা দরে বেচাকেনা চলছে; যা বাইরের বাজারের চেয়েও বেশি।
এদিকে অভিযোগ উঠেছে, কারও সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই হঠাৎ মনগড়া মূল্য তালিকা বানিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বলেন, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে যে মূল্য নির্ধারণ করে, সেটি বাস্তবসম্মত নয়। নতুন করে ফিডের দাম ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। কোনোভাবেই এ দাম কার্যকর করা সম্ভব হবে না। এসব পণ্যের দাম নির্ধারণের আগে তাদের সংগঠনের কাউকেই ডাকা হয়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব বলেন, দাম নির্ধারণের আগে আমাদের কাউকেই ডাকা হয়নি। টেবিলে বসে এটি বানানো হয়েছে। ফলে উৎপাদন খরচের চেয়ে খুচরা মূল্য কম নির্ধারণ করা হয়েছে। রাজধানীর মগবাজারে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি বলেন, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও টিসিবির মূল্য তালিকা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বাজারে ভয়াবহ পণ্য সংকট দেখা দিতে পারে। দাম বেঁধে দেওয়ার প্রজ্ঞাপনকে ‘অবিবেচনাপ্রসূত’ আখ্যা দিয়ে তা বাতিলের দাবি জানান । তাঁর ভাষ্য, ‘আমাদের দাবি, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় খুচরা পর্যায়ে নির্ধারিত দামে বিক্রির ব্যবস্থা করবে।’ পণ্যমূল্যে ৮২ পয়সা, ৩৩ পয়সা নির্ধারণকে ‘অযৌক্তিক ও অবাস্তব’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, কেউ যদি আমার কাছ থেকে এক কেজি বেগুন কেনে, তাকে আমি এক পয়সা ফেরত দেব কীভাবে? ফেরত না দিলে আমার বিরুদ্ধে মামলা হবে।
কৃষি বিপণন আইন, ২০১৮-এর ৪(ঝ) ধারায় বলা হয়েছে, সংস্থাটি কৃষিপণ্যের সর্বনিম্ন ও যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ এবং বাস্তবায়ন করতে পারবে। এ আইন বাস্তবায়নে বাধা দূর করতে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদন্ড বা এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া পণ্যের বাজার তদারকি করতে সরকারের তিনটি মন্ত্রণালয় ও ১১টি সংস্থা আছে। তারা রোজার সময় বা যখন দাম খুব বেড়ে যায়, তখন যে যার মতো উদ্যোগ নেয়। তবে তাতে খুব একটা ফল আসে না। আবার কখনও কখনও এক প্রতিষ্ঠান আরেক প্রতিষ্ঠানের ওপর দায় চাপাতে ব্যস্ত থাকে।
এই ধরনের একটি বেড়াজালে পড়ে কৃষক ও ভোক্তা বিপাকে রয়েছে যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান জরুরী বিশেষত: উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত কৃষকের স্বার্থে।
লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ
সারাবাংলা/এজেডএস
কৃষি পণ্যের দাম: ঠকছে কৃষক ভোক্তা প্রতারিত লভ্যাংশ কার পকেটে? ড. মিহির কুমার রায়