অর্থনীতির রুপান্তর: কৃষি থেকে শিল্পমুখী হতে অনেক চ্যালেঞ্জ
২৪ মার্চ ২০২৪ ১৭:৪৭
প্রাক স্বাধীনতার সময় কৃষি খাতই ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছরে কৃষিতে এক নীরব বিপ্লব ঘটেছে যার ফলে দেশের ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যের চাহিদা মেটাচ্ছে এই কৃষিখাত ও কৃষক সমাজ । এখন এই কৃষক প্রজন্মই শিল্পকারখানায় কাজ করে বাংলাদেশকে উন্নতির চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যাচ্ছেন। স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশক ধরে বেসরকারী খাতে শিল্প তিন হাজার থেকে বেড়ে বতমার্নে প্রায় ৮৮ লাখ কারখানায় পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করা হচ্ছে। এককালের বাংলাদেশের অর্থনীতি আগামী ২০৩৫ সালে হতে যাচ্ছে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ যেখানে দেশের কর্মক্ষম সাড়ে ৮ কোটি মানুষের অন্তত ৮০-৮৫ শতাংশেরই জীবিকা জড়িত বেসরকারী শিল্প খাতের সঙ্গে। বিশ্লেষকগণ বলছে, স্বাধীনতার ৫৩ বছরে কৃষিনির্ভর থেকে পুরোপুরি শিল্পনির্ভর দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ১৯৭৩ সালে মোট রফতানির মধ্যে ৫২ শতাংশ পাটজাত পণ্যের দখলে ছিল। এর পাশাপাশি তখন অল্প অল্প করে চা, চিনি, কাগজ এবং চামড়া শিল্প খাতও জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। স্বাথীনতাত্তোর সরকারের জাতীয়করন নীতি ও তার প্রায় এক দশক পর বেসরকারীকরন নীতি দেশের শিল্পখাতের উত্থান-পতনের অনেক ঘটনা ঘটে থাকে যা পরবর্তিতে ধীরে ধীরে অগ্রগতির দিকে মোড় নেয়।
বিশ্বব্যাংকের এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিএনপি) কৃষি খাতের অবদান ছিল ৫৯.৪ শতাংশ। আর শিল্প ও সেবা খাতের অবদান যথাক্রমে মাত্র ৬.৬ শতাংশ ও ৩৪ শতাংশ। স্বাধীনতার পর বিগত ৫৩ বছরে সময়ে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলো পাল্টেছে, ক্রমশ শিল্প ও সেবা খাতের বিকাশ হয়েছে, যা অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো বদলে দিয়েছে। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরের হিসাবে, মোট জিডিপি তিনটি খাতের মধ্যে কৃষি খাতের অবদান তৃতীয় স্থানে, সেবা খাতের অবদান শীর্ষে। গত অর্থবছরে জিডিপিতে সেবা খাতে অবদান ছিল ৫৩.১২ শতাংশ আর কৃষি খাতের অবদান কমে ১২.৩৫ শতাংশে নেমে এসেছে। শিল্প খাত জোগান দিয়েছে ৩৪.৫৪ শতাংশ।
শিল্পায়নের সম্ভাবনার কথা বিবেচনায় সরকার ১শ’টি অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছে যার মূল লক্ষ্য বিনিয়োগকারী আকর্ষণ ও শিল্পায়নের মাধ্যমে ১ কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি । শিল্প-বাণিজ্যসহ সব খাতের ক্রমবর্ধমান বিকাশে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে দেশের অর্থনীতি। বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের ৪৫টি দেশের মধ্যে সম্পাদিত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে যার আওতায় খাতভিত্তিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে রফতানি বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। এছাড়া বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অগ্রাধিকার মূলক ও মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী রফতানি হচ্ছে ১৯০টি দেশে। কৃষিভিত্তিক এবং আমাদানিনির্ভর দেশ হতে বাংলাদেশ ক্রমে পরিবর্তিত হয়ে একটি উৎপাদননির্ভর রফতানিমুখী দেশে পরিণত হয়েছে। শিল্প খাতের দ্রুত প্রবৃদ্ধি সাধিত হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ২০১৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানেই কর্মরত আছেন প্রায় ৬০ লাখ শ্রমিক-কর্মচারী। এর বাইরে কুটির, মাঝারি, বৃহৎ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, শিল্পমালিক, ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজসহ বিভিন্ন শিল্প খাতে মোট আড়াই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। বিবিএসের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সারাদেশে কুটির শিল্পের সংখ্যা ৬৮ লাখ ৪২ হাজার, ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১০ লাখের বেশি, ছোট শিল্প রয়েছে প্রায় ৯ লাখ, মাঝারি শিল্প ৭ হাজার, বৃহৎ শিল্প ৫ হাজার ২৫০টি। সব মিলিয়ে দেশে শিল্পের সংখ্যা প্রায় ৮৮ লাখ। এর পুরোটাই বেসরকারী খাতের হাত ধরে প্রসারিত হয়েছে। এছাড়া শিল্পায়ন বা শিল্প খাতকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচনা করে শিল্পায়নের গতিকে বেগবান করতে ২০১১ সালে ‘শিল্পনীতি-২০১০’ ঘোষণা করা হয়। উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার মূলধারায় নারীদের নিয়ে আসা এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ এ নীতির মূল উদ্দেশ্য। এর ১০ বছর পর বর্তমান অবস্থার এই খাতে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে যা বিবিএস এর বিভিন্ন প্রতিবেগনে উল্লেীখত হয়েছে ।
বিভিন্ন যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআরইউ) ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি থাকবে ৭.৭ শতাংশ। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হবে এই ধারণা সংস্থাটি দিয়ে রেখেছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে। করোনার আঘাত খানিকটা থমকে দিলেও সার্বিক চিত্র বলে দিচ্ছে, বাংলাদেশ সে পথেই হাঁটছে এবং উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশের প্রাথমিক শর্ত পূরন করতে পেরেছে যার চুড়ান্ত রুপ মিলবে ২০২৬ সালে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ বা এফডিআইয়ের ভূমিকার ওপর ভিত্তি করে ৮ম পঞ্চমবার্ষিক পরিকল্পনায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেসরকারী খাতের ভূমিকা আরও বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বেসরকারী বিনিয়োগের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে মোট বিনিয়োগের ৭৫ শতাংশ। মধ্যমেয়াদী সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোর বিষয়ে অধ্যায় ৩-এর আলোচনা অনুযায়ী ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ এফডিআইয়ের বিদ্যমান আন্তঃপ্রবাহ জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ থেকে জিডিপির ৩ শতাংশ বৃদ্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশে বেসরকারী বিনিয়োগ এফডিআইয়ের অংশ এবং বেসরকারী খাতের মাধ্যমে বিদেশী মুদ্রায় সীমিত বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদের ৩ শতাংশ হতে বৃদ্ধি পেয়ে ৭ শতাংশে এসে দাঁড়াবে। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এটি একটি বড় কৌশলগত রূপান্তর যা বেসরকারী বিনিয়োগ ও রফতানি বৃদ্ধিতে মূল ভূমিকা পালন করবে এবং এভাবে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে বেসরকারী বিনিয়োগের নিষ্প্রভ অবস্থার উন্নয়ন সাধন করবে। এফডিআই দ্রুত প্রবৃদ্ধি এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন, জ্ঞান হস্তান্তর ও দক্ষতার উন্নয়ন প্রক্রিয়া শক্তিশালীকরণে বড় ভূমিকা পালন করবে।
স্বাধীনতার আগে পাট ছিল দেশের প্রধান রফতানিমুখী খাতছিল আর বর্তমানে হলো পোশাক খাত। এ খাতে মোট রফতানির প্রায় ৮০ ভাগই নিয়ন্ত্রণ করছে এবং ৬০ লাখ এর বেশী মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্ঠি করছে । আর ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজসহ প্রায় ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান এ খাতের ওপর নির্ভরশীল, যার পুরোটাই বেসরকারী খাতের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর কৃষিভিত্তিক শিল্প, রড, সিমেন্ট, বিভিন্ন ধরনের রং, রাসায়নিক, ওষুধ, জাহাজভাঙ্গা ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পসহ বহু শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে সময়ের ব্যবধানে।
গত এক দশকে রফতানি আয় বেড়েছে কয়েক গুণ এবং সরকারী সংস্থা বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটির (বেজা) তত্ত্বাবধানে সারাদেশে গড়ে উঠছে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল। শুধু চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে ৩০ হাজার একরের বেশি জায়গাজুড়ে গড়ে উঠছে সুপরিকল্পিত বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী। ২০৩০ সালের মধ্যে এটির কাজ শেষ হবে। এক সময়ের কৃষিপ্রধান দেশ হতে যাচ্ছে শিল্পসমৃদ্ধ। অথনীতিবিদগণ বলছেন স্বাধীনতার সময় মানুয়ের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১২৩ ডলার। এখন তা ২ হাজার ৭ শত ৮৬ ডলারের ওপওে রয়েছে। কৃষিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে শিল্পনির্ভরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে সরকারের সহায়তায় বেসরকারী খাতের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয়, শিল্পসমৃদ্ধ দেশ গঠনের মাধ্যমে বাঙালী জাতির সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে বলে আশা করা যায়। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালে জিএনপির আকার ছিল মাত্র ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার বা ৩ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরে স্থিরমূল্যে দেশের জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৮৩ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা যা প্রমাণ করে অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে। শিল্প খাতের অবদান কয়েক গুণ বেড়েছে। শিল্প বিপ্লবের ৮০ বছরে ইংল্যান্ড জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ২০ শতাংশ থেকে ৩৩ শতাংশে উন্নীত করেছিল। সেই হিসাবে বলা যায়, বাংলাদেশেও একটি ছোটখাটো শিল্প বিপ্লব হয়েছে।
বেসরকারী খাতের শিল্পায়নে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। শ্রমিকের কারিগরি জ্ঞানের অভাব, খনিজ ও শক্তি সম্পদের অভাব, বৈদেশিক সাহায্যের অভাব, শিল্প ঋণের অভাব, সুষ্ঠু পরিকল্পনা, শিক্ষার অভাব প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশের শিল্প নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের জন্য শিল্পায়নের বিকল্প নেই। শিল্পায়নের ফলে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হয়। বাংলাদেশে শিল্পায়নের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে বিদ্যুত ও জ্বালানি অন্যতম। বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতকে উৎপাদনের প্রাণশক্তি বলা হয়। তাই এ খাতের উন্নয়ন জরুরী। তাছাড়া কারিগরি জ্ঞানে জনশক্তির জন্য কারিগরি বিদ্যালয়, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও কৃষি কলেজ স্থাপন করা প্রয়োজন।এছাড়া বেসরকারী উদ্যোক্তাদের ঋণের ব্যবস্থা, অবকাঠামোর উন্নয়ন, পরিকল্পিত শিল্পায়ন, বিদেশে বাজার সৃষ্টি, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে বাংলাদেশে শিল্পায়নের পথ প্রশস্ত হবে। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের শিল্প সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। শিল্প ব্যবস্থার উন্নতি হলে দেশের সামগ্রিক অবস্থার উন্নয়ন সাধিত হবে। শিল্প সমস্যা দূরীকরণের মাধ্যমে টেকসই শিল্প ব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। এতে শিল্প কাঠামো স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপ লাভ করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া ১৭ কোটি মানুষের দেশে শিল্পোন্নয়নের, বিশেষ করে এসএমই খাতের উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। কারণ কৃষি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। দেশে খাদ্য শস্যের উৎপাদন বাড়লেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জমির অপরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে কৃষি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। অপরদিকে শিল্প খাতে বিনিয়োগ, উৎপাদন, আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা।
লেখক: গবেষক, অর্থনীতিবিদ
সারাবাংলা/এজেডএস
অর্থনীতির রুপান্তর: কৃষি থেকে শিল্পমুখী হতে অনেক চ্যালেঞ্জ ড. মিহির কুমার রায়