মানবতাকে স্তম্ভিত করা এক গণহত্যা
২৪ মার্চ ২০২৪ ১৯:৩৯
বিশ্ব ইতিহাসে গণহত্যার যেসব ঘটনা মানবজাতিকে স্তম্ভিত করে দেয় তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বাংলাদেশে কালরাত্রির গণহত্যা। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঠাণ্ডা মাথায় নিরস্ত্র, নিরপরাধ ও ঘুমন্ত সাধারণ বাঙালির ওপর যেভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তা পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার নজির। এতো অল্প সময়ে এতো বেশি সংখ্যক মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ইতিহাসে বিরল। সেইদিন রাতে ঢাকার নিরস্ত্র নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালির ওপর অতর্কিত ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকায় তিরিশ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় ঢাকানগরী। ২০১৭ সাল থেকে এ দিনটি বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্মরণ করা হচ্ছে।
প্রতিবছর ২৫ মার্চ এলেই সেই কালরাতের কথা স্মরণ করে শিউরে উঠতে হয়। একটা দগদগে স্মৃতি তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। যার সঙ্গে কোনও ভয়াবহতারই তুলনা চলে না। একটি জনগোষ্ঠীর স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে ঢাকায় চালানো ওই হত্যাযজ্ঞের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট।’ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানায় ইপিআর সদস্য বাঙালি জওয়ানেরা। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান।
এ অপারেশনের অন্য উদ্দেশ্য ছিল টেলিফোন, টেলিভিশন, রেডিও, টেলিগ্রাফসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ধ্বংস করে দেওয়া। গণহত্যার এই রাতে সেনাবাহিনী অগ্নিসংযোগ করে দৈনিক ইত্তেফাক, পিপলস, গণবাংলা ও সংবাদ- এর কার্যালয়ে। এর বাইরেও আওয়ামী লীগ ও এর ছাত্রসংগঠনসহ সর্বোচ্চ সংখ্যায় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নেতাকর্মীদের হত্যা করা, ঢাকাকে শতভাগ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা। আর এসব উদ্দেশ্য সফল করার জন্য পাকিস্তানিরা সে রাতে মেশিনগানকেই প্রধান অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী একযোগে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় ঢাকার তখনকার পুলিশ (ইপিআর) সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবাসে। তারা গোলা নিক্ষেপ করে মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসে, হামলা চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বস্তি এলাকায়। ঘুমন্ত মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সেনাবাহিনী। ইতিহাসের এই নির্মম নিধনযজ্ঞ রাতেই ছড়িয়ে পরে পুরো শহরে। তবে সেই রাতেই রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে প্রতিরোধ শুরু হয়। ইপিআর সদস্যরাও প্রতিরোধের চেষ্টা করে জীবন দেন।
অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম পর্যায় শুধু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। একই সঙ্গে আক্রমণ চালানো হয়েছিল চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, খুলনা, যশোর, রংপুর, সৈয়দপুর ও সিলেটে। পাকিস্তানের সামরিক এ অভিযান চলছিল একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এরপর ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দেশে। দেশের এমন কোনও স্থান ছিল না, যেখানে পাকিস্তানি সেনারা বাঙালিদের নিধন করে লাশ নদীতে ভাসায়নি বা গণকবর দেয়নি।
২৫ মার্চ সকাল থেকেই ঢাকার পরিস্থিতি ছিল থমথমে। মুজিব- ইয়াহিয়া আলোচনা পণ্ড হয়ে গেছে- এ খবর দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ায় বীর বাঙালি ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে নেতার নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল। ওইদিন সকালেই প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ভবনে একান্ত বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ভুট্টো সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘পরিস্থিতি সঙ্কটজনক।’ ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠকের পরই জেনারেল ইয়াহিয়া গোপনে বৈঠক করেন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সামরিক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেলটিক্কা খান, চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান, মেজর জেনারেল মিঠঠা খান, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীসহ উচ্চপদস্থ সেনা কর্তাদের সঙ্গে। এদিকে বেলা ১১টার দিকে একটি হেলিকপ্টারে করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল জানজুয়া, মেজর জেনারেল মিঠঠা খান, মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ ও মেজর জেনারেল ওমরসহ আরও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা রংপুর, রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম সেনানিবাস সফর করেন। বিকাল থেকেই পাকিস্তানি সেনারা হেলিকপ্টারে টহল দিতে থাকে, সব ধরনের সামরিক সংস্থার সদস্যদের বার্তা দিতে থাকে অবশ্যম্ভাবী এক সামরিক অপারেশনের জন্য প্রস্তুত থাকতে। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কোনও রকম ঘোষণা ছাড়াই গোপনে সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সরাসরি বিমানবন্দরে চলে যান। তিনি নিরাপদে পশ্চিম পাকিস্তানে নামতেই পূর্ব পাকিস্তানে তৎপর হয়ে ওঠে তার বাহিনী।
এদিকে আবার ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের খবর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে যায় বঙ্গবন্ধুর কাছে। রাত ৯টার দিকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে উপস্থিত দলীয় নেতা, কর্মী, সমর্থক, ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সামরিক ব্যবস্থার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে বেশি আগ্রহী। “এ অবস্থায় আমাদের পথ আমাদেরই দেখতে হবে। সবাইকে সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।” দাবানলের মত ঘরে ঘরে খবর পৌঁছে যায় যে ইয়াহিয়া ‘ঢাকা ছেড়ে পাকিস্তান পালিয়ে গেছে।’ বাঙালি বুঝে ফেলে- কিছু একটা ঘটবে। রাতেই পথে নেমে আসে ছাত্র- জনতা এবং গড়ে তোলে অসংখ্য ব্যারিকেড। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা আত্মগোপনে চলে যান।
রাত ১০টার দিকে ঢাকা সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনীর একটি বড় কনভয় যুদ্ধ সাজে শহরের দিকে রওনা হয়। শহরমুখী সেনাবাহিনীর মেকানিক্যাল কলামটি প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় ফার্মগেইটে। সেখানে বড় বড় গাছের গুঁড়ি, অকেজো স্টিম রোলার এবং ভাঙা গাড়ির স্তূপ জমিয়ে রাখা হয়েছিল পথ আটকানোর জন্য। মুক্তিকামী বেপরোয়া প্রতিরোধোন্মুখ জনতার মাঝ থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উঠছিল। গুলি করে এ প্রতিরোধ ভেঙে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ট্যাংকগুলো সামনে এগিয়ে যায়। একইসঙ্গে রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ রেসকোর্স ময়দানের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে সেনাবাহিনীর অন্তত ৮০টি সাঁজোয়া যানকে পূর্ণ যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। রাত ১১টা ২০ মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি অংশ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের চারিদিকে অবস্থান নিতে শুরু করে। এ আক্রমণের সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে সারাদেশের জেলা ও সাব ডিভিশনে বেতার বার্তার মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। রাত সাড়ে ১১টার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল তাজের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাদের কনভয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আক্রমণ শুরু করে। ব্যারাকে অবস্থানরত বাঙালি পুলিশ সদস্যরা সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি করে।
সেই ভয়াল রাতে প্রায় একই সময়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২তম বালুচ রেজিমেন্টের সেনারা পিলখানায় ইপিআর- এর ওপর হামলা করে। ব্যারাকে থাকা বাঙালি সেনারা চরম সীমাবদ্ধতার মধ্যেও প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন। পিলখানা ইপিআর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনস আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাঁখারি বাজারসহ সমগ্র ঢাকাতে শুরু হয় প্রচণ্ড আক্রমণ; বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় রাতের অন্ধকারে গুলি, বোমা আর ট্যাংকের আওয়াজে প্রকম্পিত পুরো শহর। সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা, এবং বস্তিবাসীর ওপর নজিরবিহীন নৃশংসতা চালায়।
রাত ১টার পর পাকিস্তানের সেনারা ট্যাংক আর সাঁজোয়া যান নিয়ে ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। অনেকেই আত্মগোপনে যেতে বললেও বঙ্গবন্ধু যাননি। তিনি বলেছিলেন, “আমাকে না পেলে ওরা ঢাকা জ্বালিয়ে দেবে।”
বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার সম্পর্কে বিবিসির একটি প্রতিবেদনে সৈয়দ বদরুল আহসান রচিত ‘ফ্রম রেবেল টু ফাউন্ডিং ফাদার’ বইকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। লেখকের বর্ণনায়, “কর্নেল জেড এ খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটা দল ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিতে গিয়েছিল। সেখানে পৌঁছাতেই সেনা সদস্যরা গুলি চালাতে শুরু করে। শেখ মুজিবের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বাঙালি পুলিশ সদস্য গুলিতে মারা যান।” বঙ্গবন্ধু দোতলা থেকে চেঁচিয়ে বলে ওঠেন ‘ফায়ারিং বন্ধ কর।’
সাংবাদিক বি জেড খুসরু তার বই ‘মিথস অ্যান্ড ফ্যাক্টস বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার’ – এ লিখেছেন “গুলি বন্ধ হওয়ার পরে কর্নেল খান বাসায় ঢোকেন। দোতলায় যান। মুজিব একটা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। “শেখ মুজিবকে কর্নেল নির্দেশ দেন তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য। তিনি জানতে চেয়েছিলেন পরিবারকে বিদায় জানিয়ে আসতে পারেন কিনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিবারের সবার সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি।” খুসরু আরও লিখেছেন, “কর্নেলকে শেখ মুজিব জিজ্ঞাসা করেন, আসার আগে আমাকে জানানো হল না কেন? কর্নেল উত্তর দিয়েছিলেন, সেনাবাহিনী আপনাকে দেখাতে চেয়েছিল যে আপনাকে গ্রেপ্তারও করা যেতে পারে।” জেড এ খান ‘দা ওয়ে ইট ওয়াজ’ বইতে লিখেছেন, “শেখ সাহেবকে গ্রেপ্তার করার পরে ৫৭ ব্রিগেডের মেজর জাফর ওয়ারলেস মেসেজ পাঠিয়েছিলেন ‘বিগ বার্ড ইন কেইজ, স্মল বার্ডস হ্যাভ ফ্লোন।’ ”
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, “ওই রাতে মুজিবের সঙ্গে থাকা সব পুরুষকে আমরা গ্রেপ্তার করে এনেছিলাম। পরে চাকরবাকরদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। আদমজী স্কুলে সবাইকে ওই রাতে রাখা হয়েছিল। পরের দিন ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।” গ্রেপ্তারের তিন দিন পরে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয় উল্লেখ করে মেজর সালিক লিখেছেন, “পরে আমার বন্ধু মেজর বিলালের কাছে জানতে চেয়েছিলাম গ্রেপ্তার করার সময়েই মুজিবকে খতম করে দিলে না কেন? বিলাল বলেছিল, জেনারেলটিক্কা খান ব্যক্তিগতভাবে ওকে বলেছিলেন যে কোনও উপায়ে শেখ মুজিবকে জীবিত গ্রেপ্তার করতে হবে।”
এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া, না দেওয়া নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ জলঘোলা করার চেষ্টা করে আসছে। যদিও স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় বক্তব্য দেওয়ার এক পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, ২৫ মার্চ রাতে তিনি চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন।
পকিস্তানের তিন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব, ইয়াহিয়া আর ভুট্টোর এইড ডি ক্যাম্প (এডিসি) বা বিশ্বস্ত সহকারী ছিলেন সেনা কর্মকর্তা আরশাদ সামি খান। তার লেখা, ‘থ্রি প্রেসিডেন্টস অ্যান্ড অ্যান এইড: লাইফ, পাওয়ার অ্যান্ড পলিটিকস’ বইয়ে পাকিস্তানের ক্ষমতার অন্দরমহলের অনেক কথাই পাওয়া যায়। অনেক কিছুই কাছ থেকে দেখেছেন লেখক। অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কেও তথ্য পাওয়া যায় তার বইতে। তিনি লিখেছেন, “প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় উপস্থিত সামরিক হাইকমান্ড নিয়ে বৈঠক করে সবুজ সংকেত দিলেন। অপারেশনের জন্য দিন নির্ধারণ করা হলো ২৫ মার্চ। সিদ্ধান্ত হলো, রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিদ্রোহী আওয়ামী লীগের অন্য সিনিয়র নেতাদের অক্ষত অবস্থায় জীবিত ধরতে হবে। ইয়াহিয়া জোরের সঙ্গে কথাটা কয়েকবার বললেন, ‘তাদের অক্ষত ও জীবিত ধরতে হবে এবং শক্তি যত কম ব্যবহার করে।’ আরশাদ সামি তার বইয়ে আরও লেখেন, “২৫ মার্চ ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট শুরু করার আদেশ দিয়ে নিশ্চিন্ত মনেই ইসলামাবাদ ফিরে গিয়েছিলেন ইয়াহিয়া। ভুট্টো তার পদক্ষেপকে সমর্থন দেওয়ায় তার কাঁধ থেকে যেন একটা বোঝা নেমে গেল। তিনি ভাবলেন, পূর্ব পাকিস্তান ছিল একটা কঠিন সমস্যা এবং শিগগিরই সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে। তিনি ভুট্টোর কাছ থেকে একটু দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করলেন।”
আরশাদ সামি সেই উত্তাল সময়ের একটা ঘটনার উল্লেখ করে লেখেন, “এক সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে একটা জন্মদিনের অনুষ্ঠানে ইয়াহিয়া বেশ খোশমেজাজে ছিলেন। তিনি দুটো বড় বেলুন হাতে নিলেন। তারপর একটা করে বেলুনে লাথি মারলেন আর বললেন, ‘হিয়ার গোওজ মুজিব অ্যান্ড হিয়ার গোওজ ভুট্টো।’ তিনি ভাবতেও পারেননি মুজিবের কারণে পূর্ব পাকিস্তানে কী ভয়াবহ আগুন জ্বলবে এবং ভুট্টো তলে তলে কী কারসাজি করবে।”
একাত্তরের পর পরই বাংলাদেশে এসে নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে গণহত্যার তরতাজা সংবাদ সংগ্রহ করেছিলেন মার্কিন সাংবাদিক ও লেখক রবার্ট পেইন। সেসব তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৭২ সালে প্রকাশিত পেইনের ‘ম্যাসাকার’ বইটিতে গণহত্যার চিত্র ফুটে উঠেছে। ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দিতে গিয়ে রবার্ট লিখেছেন, “মাত্র ১৫ মিনিটে হত্যা করা হলো প্রাণোচ্ছল ১০৯ জন ছাত্রকে। ইকবাল হলের ছাদে মরদেহগুলো যেন শকুনের অপেক্ষায় ফেলে রাখা হলো। হিন্দু ছাত্রদের দেহগুলো রাখা হয়েছিল জ্বালানি কাঠের মতো স্তূপ করে। রাতে মরদেহগুলো কবর দেওয়ার জন্য কয়েকজন ছাত্রকে দিয়ে গর্ত খোঁড়ানো হলো। গর্ত খোঁড়া শেষ হলে তাদের গুলি করে সেই গর্তে ফেলে দিল পাকিস্তানি সৈন্যরা।” পেইনের মতে, অভিযানের প্রথম রাতে শুধু ঢাকা শহরেই ৩০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। এরপর গণহত্যা চলতে থাকে শহর পেরিয়ে গ্রামে।
অনেক আগেই অপারেশন সার্চলাইটের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পাকিস্তানি শাসকরা। ‘ম্যাসাকার’ বইটিতে এ বিষয়ে রবার্ট পেইন লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত এক সামরিক বৈঠকে বাঙালিদের খতম করার সিদ্ধান্ত নেন ইয়াহিয়া খান। সেনাবাহিনীর ওই বৈঠকে ইয়াহিয়া খান নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘কিল থ্রি মিলিয়ন অব দেম, অ্যান্ড দ্য রেস্ট উইল ইট আউট অব আওয়ার হ্যান্ডস। (ওদের ৩০ লাখ মেরে ফেল। বাদবাকিরা আমাদের হাত থেকেই খেয়ে বেঁচে থাকবে)।’
ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানও লিখেছেন, “বাঙালির ওপর অপারেশন সার্চলাইট নামের নিধনযজ্ঞের পরিকল্পনা করা হয়েছিল একাত্তরের মার্চের শুরুতে জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাড়ি পাকিস্তানের লারকানায়। গণহত্যার ষড়যন্ত্রে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো, জেনারেল ইয়াহিয়া ও জেনারেল হামিদ। তাদের ধারণা ছিল, হাজার বিশেক মানুষ হত্যা করলেই ভয় পেয়ে যাবে বাঙালিরা। তারা ভয়ে স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের কথা মুখে আনবে না।”
একাত্তরে বাঙালি নিধনযজ্ঞে সামনের সারিতে থাকা পাকিস্তানি জেনারেলটিক্কা খানের সহযোগী ছিল তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল- বদর, আল- শামস ও শান্তি কমিটি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম রাজা, গুল হাসান খান তাদের আত্মজীবনীমূলক বইয়ে অপারেশন সার্চলাইট এর কথা বলেছেন। কারা কারা বাংলাদেশে গণহত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের নামও তারা লিখেছেন। বিশেষত খাদিম রাজার লেখা ‘স্ট্রেঞ্জার ইন ওন কান্ট্রি’ বইটি এক্ষেত্রে খুবই তথ্যবহুল।
তাছাড়া পাকিস্তান সরকার নিজেই মুক্তিযুদ্ধকালীন একাত্তরের ৫ আগস্ট ‘ক্রাইসিস ইন পাকিস্তান’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাতে একপেশে তথ্য পরিবেশন করা হলেও গণহত্যার ভয়াবহতার বিষয়টি বোঝা যায়। স্বাধীনতাযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের পর ১৯৭২ সালে পাকিস্তান সরকার একটি কমিশনও গঠন করেছিল। হামিদুর রহমান কমিশনের সেই প্রতিবেদন কখনও আলোর মুখ দেখেনি। তবে প্রতিবেদনের অনেক তথ্যই এখন জানা যায়। সেখানেও অপারেশন সার্চলাইট নামে গণহত্যার ষড়যন্ত্রের জন্য প্রধানত জুলফিকার আলী ভুট্টো, জেনারেল ইয়াহিয়া, জেনারেল হামিদ ওটিক্কা খানকে দায়ী করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিবেদনে নয় মাসের গণহত্যার কথা উল্লেখ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে যারা যুদ্ধাপরাধে জড়িত, তাদের বিচারের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছিল।
লেখক: উন্নয়নকর্মী
সারাবাংলা/এজেডএস