‘১৯৭১ সালে কালো ২৫শে মার্চ ছিল,
অন্ধকারাচ্ছন্ন এক ভয়াল রাত।
অপারেশন সার্চ লাইটের নামে ১৯৭১,
ওরা বাঙালিদের করেছে নিপাত।’
আজ ভয়াল ২৫ মার্চ, জাতীয় গণহত্যা দিবস। জাতীয় গণহত্যা দিবস বা বাঙালি গণহত্যা স্মরণ দিবস বাংলাদেশে পালিত একটি দিবস।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক নির্মম গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে দিবসটি পালন করা হয়। ১৯১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১৯৭১ সালের এইদিন মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পূর্ব পরিকল্পিত অপারেশন সার্চ লাইটের নীলনকশা অনুয়ায়ী আন্দোলনরত বাঙালিদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে এবং বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা মুছে দেওয়ার চেষ্টায় রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে শুরু করে ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরোচিত ও নিকৃষ্টতম গণহত্যা।
একাত্তরের ২৫ মার্চের গণহত্যা শুধু একটি রাতের হত্যাকাণ্ডই ছিল না, এটা ছিল মূলতঃ বিশ্ব সভ্যতার জন্য এক কলঙ্কজনক জঘন্যতম গণহত্যার সূচনাও।
এ সম্পর্কে মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন লিখেছেন, ‘সেই রাতে ৭ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার করা হয় আরও ৩ হাজার লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট। লুট আর ধ্বংস যেন তাদের নেশায় পরিণত হলো। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। গোটা বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।’
পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি রয়েছে খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও। পূর্ব পাকিস্তানের এ সঙ্কট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয়: ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’
শোষণ আর বঞ্চনায় ঘেরা ছিল এই নৃশংসতার নেপথ্য কারণ। ১৯৭০ -এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও বিজয়ী আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানি জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে উল্টো লিপ্ত হয় প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে।
যার ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি সেনারা কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নাম দিয়ে নিরীহ বাঙালি বেসামরিক লোকজনের ওপর নারকীয় এ গণহত্যা শুরু করে।
এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ সকল সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান। সেই সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রফতার করে করাচি নিয়ে গিয়ে কারাবন্দী করে মৃত্যুকূপে ঠেলে দেয়।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার নেতৃত্বে প্রজ্ঞা ও তোখড় বিচক্ষণতায় গ্রেফতারের আগে ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ মধ্যরাতে) বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যেকোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালিরা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। দেখা মিলে আলোকিত দিনের। আর বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।
লেখক: শিক্ষার্থী, গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, কিশোরগঞ্জ