Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিশ্ব নাট্য দিবস: নাটকের ইতিহাস ঐতিহ্যের পটভূমি ও চর্চা

অজয় মিত্র
২৭ মার্চ ২০২৪ ১৫:০০

আজ (২৭ মার্চ) বিশ্ব নাট্য দিবস। আজ নাটকময় ভাবনা থেকে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রাত্যহিক বিনোদনের সিংহভাগ জুড়েই থাকে কোনো না কোনো নাটক, সিরিয়াল, সিনেমা, অভিনয় ইত্যাদি নিয়েই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হালের রিল ভিডিও’র মূল উপজীব্যও কিন্তু অভিনয়! নাটকের উৎপত্তি, ইতিহাস, গোড়াপত্তন আলোচনা থেকেই জানা যায় অনেক কিছু। বিনোদন, সমাজ পরিবর্তন, বিপ্লব, ঐতিহাসিক পট পরিবর্তন- প্রতিটা প্রেক্ষাপটেই সংস্কৃতির অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে নাটক-অভিনয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পুঁথিগত উপমায় ‘নাটক সমাজের দর্পণ’ হলেও কালের আবর্তে কার্যত তা কেমন ভূমিকা রাখছে বর্তমানে?

বৈশ্বিক পরিম-লে আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউট (আইটিই) কর্তৃক ১৯৬১ সালে বিশ্ব নাট্য দিবসের প্রবর্তন হয়। ১৯৬১ সাল থেকে প্রতি বছর ২৭ মার্চকেই বিশ্ব নাট্য দিবস হিসেবে পালন করা হয়। প্রথমে হেলসিঙ্কি এবং তারপর ভিয়েনায় ১৯৬১ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত আইটিই’র নবম আলোচনা সভায় আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউটের ফিনিশ কেন্দ্রের পক্ষে অধ্যক্ষ আর্ভি কিভিমায় বিশ্ব নাট্য দিবস উদযাপনের প্রস্তাব দেন। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কেন্দ্রসমূহে এটাকে সমর্থন দেয়ার পরই দিবসটির বিশ্বব্যাপী প্রচলন শুরু হয়।

ভারতবর্ষের প্রাচীনতম সাহিত্যে বিশেষত ঋগবেদে এমন কিছু কথা রয়েছে যা ইঙ্গিত দেয় থিয়েটার বা নাটকের। ধারণা করা হয় এগুলোই নাটকের আদিরূপ। এসময় নারী পুরুষরা ভাল পোশাক পড়ে নাচ গান করতেন। যা এই নাটকের পূর্বরূপ বলেই ধরা হয়। এছাড়া বৈদিক কাজকর্মেও অনেক নাটকীয় আচরণ চোখে পড়ে। গ্রিসের সংস্পশে আসার পর থেকেই ভারতীয় নাটক/সাহিত্য উদ্বুদ্ধ হতে শুরু করে। তবে ভারতবর্ষে প্রায় সব কিছুরই নিজস্ব রূপ আছে। গ্রিক ঘরানার নাটক নিজ গুণেই ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে একিভূত হয়ে গেছে। সংস্কৃত সাহিত্যের শুদ্রক রচিত ‘মৃচ্ছকটিক’, কালিদাস রচিত ‘অভিজ্ঞান শকুন্ত—লম’, ভবভূতির ‘উত্তর রামচরিত’ সেই নির্দশনই বহন করে চলেছে। মানুষের মন ও চেতনায় এক উচ্চতর আসন দখল করে আছে নাটক বা থিয়েটার। বিশ্বের অনন্য অগ্রণী নাটক্যার হিসেবে সর্বাগ্রে শেকস্পিয়র হলেও নাটক মানে শুধু শেকস্পিয়র নন, কালিদাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাদল সরকার, বিজন ভট্টাচার্য, দীনবন্ধু মিত্রের মতো অনেকের নামই আসে।

উনিশ শতকে যখন বাংলা নাটক তৈরি হচ্ছে সে সময় নাটক ছাপিয়ে গিয়েছে সব উচ্চতা। সে সময় নাটকেই লোকশিক্ষে হত। আধুনিক বাংলা নাটকের সূচনা হয় ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে। সে সময় বিদেশি নাটকের অনুবাদের পাশাপাশি মৌলিক নাটকও রচিত হয়। ১৮২২-এর অনূদিত সংস্কৃত প্রহসন প্রবোধচন্দ্রদয়, শকুন্তলা, রতœাবলীর মতো। তারাচরণ শিকদারের ‘ভদ্রার্জুন’ ও জিসি গুপ্তের ‘কীর্তিবিলাস’ দুটি মৌলিক নাটকের প্রকাশ হয় ১৮৫২-তেই। বিচিত্র বিষয় ভাবনা নিয়ে তৈরি হয় শেকস্পিয়রের অনুসরণে হরচন্দ্র ঘোষের, ‘ভানুমতী চিত্ত বিলাস (১৮৫২), কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘বাবু নাটক’ (১৮৫৪), উমেশচন্দ্র মিত্রের ‘বিধবাবিবাহ নাটক’ (১৮৫৬) রীতিমতো হইচই ফেলেছিল। এ সময়ের অন্যতম নাট্যকার ছিলেন রামনারায়ণ তর্করতœ তিনি তাঁর নাটক ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’-তে যেভাবে সে সময়কার সমাজকে তুলে ধরেছিলেন, তা আগে দেখা যায়নি। এরপর দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ সে সময়কার নীলচাষীদের সমস্যার কথা তুলে ধরে নজির গড়ে। যদিও এই নাটক কিছুটা পরের দিকের।

তবে নাটকের মধ্য দিয়েই উঠে আসতে থাকে তদানিন্তন সমাজের সমস্যার কথা। কখনও কৌতূকের ছলে, আবার কখনও কঠিনরূপে। নাটককে ভেঙে নানা রূপ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ফিউশনও তৈরি করা হচ্ছে। ভারত শুধু নয় গোটা বিশ্বের ইতিহাসে নাটকের একটি আলাদা মর্যাদা রয়েছে। তবে বর্তমান সময়ে বাংলা নাটকের পরিস্থিতি অনেকটাই ভঙ্গুর। নাটকের সঙ্গে মানুষের রুটি রোজগার যোগ হয়েছে। সাহিত্য থেকে বেরিয়ে এসে কড়া বাস্তবের মুখোমুখি নাটককে বারবার দাঁড়াতে হয়েছে। জীবন-জীবিকা শুধু মাত্র নাটকেই আটকেছে অনেক শিল্পীর। টিভি, সিনেমার জগতে কোথাও যেন নাটকের গতিতে টান পড়েছে। আর্থিক সমস্যা তৈরি হয়েছে। তবুও সিনেমা বা সিরিয়াল কখনই থিয়েটারের জায়গা নিতে পারেনি। বলা হয় একজন থিয়েটার অভিনেতা এতটা দক্ষ হন, যে সব মাধ্যমেই তিনি মানানসই। আজ বিশ্ব নাট্য দিবস সব নাট্য শিল্পীদের কাছে বিশেষ আনন্দের। নাটকসহ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় দিনটি পালন করা হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের ভূখণ্ডে নাট্যচর্চা শুরু হয়েছিল ১৯৭২ সালে। অবশ্য তারও আগে থেকেই বাংলাদেশে হাজার বছরের নাট্যচর্চা যেমন লালিত হয়েছিল তেমন পরিবেশিত হয়েছিল আধুনিক বাংলা থিয়েটারের উপযোগী মৌলিক নাটকও। কিন্তু আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের নানা আবর্তে বাংলা থিয়েটারের কোনো সুনির্দিষ্ট ধারাবাহিক রূপরেখা পূর্ণাঙ্গরূপে গড়ে উঠেনি। তাই বাংলার নাট্যচর্চা পেশাদারি রূপরেখা তো পায়নি-ই; এমনকি স্বাধীনতা পূর্বকালে দর্শনীর বিনিময়ে নাটক দেখার রেওয়াজও গড়ে উঠেনি।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি পেল সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত প্রেক্ষাপট, মুক্ত সংস্কৃতি চর্চার একটি অনুকুল পরিবেশ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের নাট্যকর্মীরা এগিয়ে এলো সর্বাগ্রে। মৌসুমি নাট্যচর্চার আবর্তন ছেড়ে নাট্যকর্মীরা এবার নিয়মিত নাট্যচর্চায় এগিয়ে এলেন। নাট্যচর্চার এই আন্দোলনে যুক্ত হতে লাগল সচেতন তরুণ ছাত্রসমাজ। মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা অর্জনের অভিজ্ঞতায় নাট্যরচনা এবং মঞ্চায়ন সুস্পষ্ট বক্তব্যের দিকে মোড় নিল। নাটক হয়ে উঠল সমাজের প্রতিচ্ছবি, তরুণ নাট্যকর্মীরাও নাটকের প্রতি অনেকবেশি দায়বদ্ধ হয়ে উঠল। নতুন দেশের, নতুন কালের এই নাট্য জোয়ারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করল ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, নাটোর, চাপাইনবাবগঞ্জ, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, বগুড়া, কুমিল্লা, ফেনীসহ বিভিন্ন জেলার স্থানীয় নাট্যদলগুলো নিজ নিজ শহরে স্বাধীনতা পরবর্তী নাট্যচর্চায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।

শুরু হল দর্শনীর বিনিময়ে নাটক মঞ্চায়ন। ১৯৭৩ সালে দর্শনী বিনিময়ে নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় বাংলাদেশে দর্শনীর বিনি য়ে নিয়মিত নাট্যচর্চার সূচনা করে। তাদের প্রথম মঞ্চস্থ নাটকটি ছিলো বাদল সরকার রচিত ‘বাকী ইতিহাস’। ১৯৭৪ সালে আব্দুল্লাহ আল মামুনের ‘সুবচন নির্বাসনে’ মঞ্চস্থ হয় নাট্যদল থিয়েটারে প্রযোজনায়। সত্তরের দশকে ঢাকা থিয়েটার মঞ্চস্থ করে সেলিম আল দীনের সংবাদ কার্টুন, মুনতাসীর ফ্যান্টাসী, শকুন্তলা প্রভৃতি নাটক। এই দশকেই আরণ্যক নাট্যদল থেকে মঞ্চস্থ হয় মামুনুর রশীদের ‘ওরা কদম আলী’।

১৯৮০ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকার উল্লেখযোগ্য নাট্যদলগুলো আলোচনায় মিলিত হয় এবং তাদের মিলিত সিদ্ধান্তেই বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন গঠনের পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৮১ সালের আগস্ট মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ফেডারেশনের প্রথম জাতীয় সম্মেলন। এ সম্মেলনে প্রথম নির্বাহী পরিষদ নির্বাচন করা হয়। এসময় সভাপতিম-লীর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন রামেন্দু মজুমদার এবং সেক্রেটারি জেনারেল হন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। ১৯৮২ সাল থেকে বাংলাদেশে বিশেষ মর্যাদায় এই দিনটি উদ্যাপিত হয়ে আসছে। ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট (বাংলাদেশ কেন্দ্র), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ সম্মিলিতভাবে এ দিবসটি পালন করেন।

এদেশে নাট্য চর্চা আশির দশকে পদার্পন করলে অনেক নতুন নতুন নাট্য দল গড়ে উঠে। যারা পরবর্তীতে নাটক চর্চায় অনেক অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। নাটক বিষয়ক শিক্ষা গ্রহণকারীদের পেশাদারী কাজের দ্বারা এদেশে নাট্য আন্দোলনে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়। সে সময় ভারতের দিল্লী ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে দেশে ফিরে এলেন একদল তরুণ নাট্যকর্মী। এদের নিরলস পরিশ্রম ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রভাব পড়তে লাগলো বাংলাদেশের নাট্যচর্চায়। তখন থেকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নাটক স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।

আশির দশকে আরও উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, বাংলাদেশের মঞ্চনাটক প্রসেনিয়ামের ঘেরাটোপ ভেঙে রাজপথে ঠাঁই করে নিল। পথনাটক বাংলাদেশের নাট্যচর্চা রাজপথ থেকে শহীদ মিনার, পার্ক, ময়দানে ঠাঁই করে নিল। বাংলাদেশের পথনাটকের সূত্রপাত ঘটে ঢাকা থিয়েটারের চর কাকড়ার ডকুমেন্টরি নাটকটির মাধ্যমে। সেলিম আল দীন রচিত ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ নির্দেশিত এই নাটক মঞ্চস্থ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্রের সড়ক দ্বীপে। নাটকটির ওপর তৎকালীন স্বৈর-সরকারের পুলিশ বাহিনী হামলা চালায়। এরপর খায়রুল বাশার রচিত জনৈক ঈমান আলী, জীবন এখানে কোরাস গান প্রভৃতি পখ নাটকগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সড়ক দ্বীপে এবং বটতলায় মঞ্চায়িত হতে থাকে। এর মধ্য দিয়েই আশির দশকের শুরু থেকে নব্বই দশকের প্রান্তে এসে পথ নাটক বাংলাদেশের নাট্য জগতে নতুন মাত্রা সংযোজন করে। নব্বইয়ের স্বৈরশাসকের পতন ও গণআন্দোলনে পথ নাটক বিশেষ ভূমিকা রাখে।

নব্বইয়ের স্বৈরশাসকের পতনে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন বিশেষ উল্লেখের দাবিদার। তৎকালের নাট্যচর্চায় বিশেষত নাটক রচনায় স্বৈরশাসকের রূপ এবং তার বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মমতাজ উদ্দিন আহমেদের সাত ঘাটের কানাকড়ি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বাংলা নাটক রচনার উৎকৃষ্ট দলিল। এছাড়াও সেলিম আল দীনের চাকা ও সৈয়দ শামসুল হকের গণনায়কের মতো মানসম্পন্ন নাটকেও স্বৈরশাসনের দিনকালের প্রভাব পড়ে।

নব্বই দশকের আরেকটি নাট্য অর্জন বলা যায়, ঢাকা থিয়েটারের শিকড় সন্ধানী প্রযোজনাসমূহকে। দলের নাট্যকার সেলিম আল দীন ও নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফের প্রচেষ্টায় বাংলা নাটকের হাজার বছরের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার ও বাংলার নিজস্ব নাট্যরীতির সন্ধানের প্রক্রিয়া হিসেবে এ দল থেকে মঞ্চস্থ হতে থাকব যৈবতী কন্যার মন, হাতহদাই, বনপাংশুল প্রভৃতি নাটক। উল্লেখ্য এই মঞ্চনাটকসমূহের মাধ্যমেই ঢাকা থিয়েটার বাংলা নাটকের নিজস্ব নন্দনতত্ত্ব সূত্রানুসন্ধান এবং বর্ণনাত্মক নাট্যরীতি, পাঁচালির রীতির নাটক ইত্যাদির প্রতিষ্ঠা করে। এ সময়ের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নাটক হিসেবে সৈয়দ শামসুল হকের এখানে এখন, ঈর্ষা, আব্দুল্লাহ আল মামুনের তিনটি পথ নাটক, কোকিলারা, নাসির উদ্দিন ইউসুফের একাত্তরের পালা, মান্নান হীরার মৃগনাভি, শেকল, আদাব, ঘুমের মানুষ, ময়ুর সিংহাসন, মামুনুর রশীদের লেবেদেফ, পাথর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

নতুন সহ¯্রাব্দে এসে বাংলাদেশের নাটক আন্তর্জাতিক নাট্যধারা সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে থাকে। নব্বইয়ের শেষ প্রান্তেরই বাংলাদেশের একাধিক নাট্যদল তাদের প্রযোজনা নিয়ে যেমন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নাটক মঞ্চস্থ করতে যায় তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন নাট্যদলও এ দেশে আসে। বাংলা নাটক ও বাংলাদেশী নাট্যকর্মীদের সঙ্গে বিশ্বনাটকের আদান-প্রদান প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এরমধ্যে আমেরিকায় সেলিম আল দীনের চাকা, জার্মানিতে মামুনুর রশীদের ওরা কদম আলী, কোরিয়ায় সৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় মঞ্চায়ন উল্লেখযোগ্য ঘটনা। একবিংশ শতকের দ্বারপ্রান্তে ঢাকায় প্রফেশনাল থিয়েটার হিসেবে সিএটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ দল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নির্দেশক, ডিজাইনার দিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করে। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনার মধ্যে ঢাকা থিয়েটারের হরগজ, আরণ্যকের সংক্রান্তি, নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের রক্তকরবী, নাট্যকেন্দ্রে আরজ চরিতামৃত, সিএটির রাজা আলোড়ন সৃষ্টি করে।

ঢাকার মঞ্চে গ্রুপ থিয়েটার চর্চার এই ইতিহাসে বিদেশি নাটকের অনুবাদ ও রূপান্তর নাটক এক বিশাল অধ্যায় জুড়ে রয়েছে। ১৯৭১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত স্যামুয়েল বেকেট, ইউজিন আয়ানেস্কা, ব্রেটল্ট ব্রেখট, জ্যঁ পল সার্ত, এলবেয়ার ক্যামু, অ্যাডওয়ার্ড এলবি, মলিয়ের, মোলনার, শেকস্পিয়র, হেনরিক ইবসেন প্রমুখের নাটক অনূদীত ও রূপান্তরিত হয়েছে। এরমধ্যে শেকস্পিয়র, মলিয়ের, ব্রেখট ও ইবসেনের নাটকের মঞ্চায়নই বেশি হযয়েছে। ফরাসী নাট্যকার মলিয়েরের কমেডিসমূহ বাংলাদেশে প্রবলভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। লোকনাট্য দলের কঞ্জুস, কুশীলবের গিট্টু, নাট্যকেন্দ্রের বিচ্ছু বাংলাদেশে মঞ্চস্থ মলিয়েরের অন্যতম জনপ্রিয় নাটক। মলিয়েরের মতোই বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন জার্মান নাট্যকার ব্রেটল্ট ব্রেখট। নাগরিক নাট্যসম্প্রদাযয়ের গ্যালিলিও, সৎ মানুষের খোঁজে, দেওয়ান গাজীর কিসসা, নাগরিক নাট্যাঙ্গনের জনতার রঙ্গশালা ব্রেখট মঞ্চায়নের আদর্শ উদাহরণ। শেকসপিয়রের ট্রাজেডি এবং কমেডি উভয়ই বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে একাধিকবার মঞ্চস্থ হয়েছে। ঢাকা থিয়েটারের মার্চেন্ট অব ভ্যানিস, নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের দর্পণ, থিয়েটারের ম্যাকবেথ, নাগরিক ও থিয়েটারের যৌথ প্রযোজনা ওথেলো উল্লেখযোগ্য শেকসপিয়র প্রযোজনা। বিদেশি নাটক মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মঞ্চে যেমন স্যামুয়েল বেকেটের ওয়েটিং ফর গডোর মতো নিরীক্ষামূলক নাটক ঠাঁই পেয়েছে তেমনি সফোক্লিসের রাজা ইডিপাসের মতো ধ্রুপদী নাটকও ঠাঁই পেয়েছে।

দেশের সমস্ত পর্যায়ে মঞ্চ, থিয়েটার এসবের মাধ্যমে নাটকের যেটুকু চর্চা নিয়মিত-অনিয়মিত হয়ে থাকে; তা শুধুমাত্র নাটকপ্রাণ নাট্যযোদ্ধাদের নিজস্ব উদ্যোগ ও চেষ্টাতেই কেবল সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার চর্চা যেমন ক্রমশ ত্বরান্বিত হচ্ছে তেমনি গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের কার্যক্রমও বাড়ছে। নাট্যচর্চার সূচনা লগ্নে হাতেগোনা কয়েকটি দল নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও মাত্র তিরিশ বছরে গ্রুপসহ থিয়েটার ফেডারশনভুক্ত নাট্যদলের সংখ্যা বর্তমানে দুই শতাধিক।

সারা বছর যেসব নাট্যকর্মীরা শুধুমাত্র মনের খোরাকে সংস্কৃতির প্রতি কমিটমেন্ট থেকে স্বঅর্থায়নে নাট্যচর্চা চালিয়ে যায়। মাসের পর মাস নাটক প্রস্তুত করে মঞ্চায়নের খরচ যোগাতে নিজেদের টিকেট বিক্রি করতেও দেখা যায়। তারপরও নতুন সহ¯্রাব্দের সূচনায় সমস্ত নাট্যকর্মী, নাটকপ্রাণ মানুষের প্রত্যাশা, দেশের নাট্য আন্দোলন, গ্রুপ থিয়েটার চর্চা আরও বিকশিত হবে, বিস্তৃতি লাভ করবে। এদেশের মঞ্চনাটক বিশ্বমঞ্চে নিজেদের আরও সমৃদ্ধ করবে, অপসংস্কৃতির রাহুমুক্ত হবে সংস্কৃতি প্রাণ মানুষের মুক্তবুদ্ধির চর্চায়।

লেখক: সংস্কৃতি কর্মী

সারাবাংলা/এসবিডিই

অজয় মিত্র বিশ্ব নাট্য দিবস: নাটকের ইতিহাস ঐতিহ্যের পটভূমি ও চর্চা মুক্তমত


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর