দারিদ্র্য গবেষণার গতিপ্রকৃতি: এর সুফল পাবে কে?
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৬:১০
‘করোনা মহামারি ও পরবর্তী প্রতিবন্ধকতা কীভাবে বাংলাদেশের দারিদ্র্য, আয়বৈষম্য, শিক্ষা এবং খাদ্য সুরক্ষার ওপর প্রভাব ফেলছে’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে করোনা মহামারির পর দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার কমে ২০ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। তবে পাঁচ বছরের ব্যবধানে গ্রামীণ এলাকায় দরিদ্র কমলেও শহরে বেড়েছে। ২০২৩ সালে দারিদ্র্যের হার দেশের গ্রামীণ এলাকায় ২১ দশমিক ৬ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। পাঁচ বছর আগে গ্রামীণ এলাকায় দারিদ্র্য ছিল ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ ও শহরে ছিল ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম ও যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট যৌথভাবে গবেষণাটি পরিচালনা করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সাল শেষে মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ পরিবার তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে ২৮ শতাংশ পরিবার ঋণ করেছে। দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে দেশের সাধারণ মানুষ পুষ্টিকর খাবার কম খাচ্ছে। আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চিকিৎসা ব্যয় ও ওষুধের দাম ব্যাপক হারে বাড়ায় দেশের স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বেড়েছে তিন গুণ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শহরের দরিদ্ররা গ্রামের তুলনায় বেশি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। গ্রামের ২৯ শতাংশ ও শহরের ৩২ শতাংশ দরিদ্র পরিবার মাঝারিভাবে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) নির্দেশিকা অনুযায়ী এ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা পরিমাপ করা হয়েছে। ২০১৮ সালে দেশের সামগ্রিক দারিদ্র্যের হার ছিল ২১ দশমিক ৬ শতাংশ, যা এখন ২০ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। যৌথ গবেষণায় বলা হচ্ছে, বর্তমানে দেশে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ। এ হার গ্রামীণ এলাকায় বেশি। গ্রামীণ এলাকায় চরম দারিদ্র্যে রয়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ। বিভাগীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ দারিদ্র্যের হার রংপুরে, দ্বিতীয় অবস্থানে বরিশাল। দারিদ্র্যের হার রংপুর ও বরিশালে যথাক্রমে ৪২ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ। উল্লেখযোগ্যভাবে বাংলাদেশে গ্রামীণ দারিদ্র্যের হার ২০১৮ সালে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে ২১ দশমিক ৬ শতাংশে কমে এলেও শহুরে দারিদ্র্যের হার ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে গবেষণায় । প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সরকার প্রদত্ত সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় এসেছে ৩৭ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠী। এর মধ্যে টিসিবি ফ্যামিলি কার্ড সেবা সর্বোচ্চসংখ্যক তথা ১৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ পরিবারের কাছে পৌঁছেছে। এ ছাড়া বার্ধক্য ভাতা ৮ দশমিক ৯ শতাংশ, বিধবা, স্বামী নিগৃহীত, দুস্থ মহিলা ভাতা ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ, আর্থিকভাবে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা ৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ভাতা ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছেছে। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই অর্থাৎ ৪৭ শতাংশ সেবা খাতে নিযুক্ত, ৩৬ কৃষি ও ১৮ শতাংশ শিল্প খাতে কর্মরত। জাতীয় পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। গ্রামীণ এলাকায় এ হার ৩ দশমিক ৬ এবং শহরাঞ্চলেম দারিদ্র্যের হার কমলেও বেড়েছে শহর এলাকায়।
দারিদ্র্য নিয়ে কাজ করে যে তিন মহান বাঙালি নোবেল জয়ের অনন্য গৌরব অর্জন করেছেন তারা হলেন ড. অমর্ত্য সেন (১৯৯৮)যিনি পেয়েছেন দারিদ্র্য বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান তৈরির জন্য, ড. মুহাম্মদ ইউনূস (২০০৬) যিনি পেয়েছেন দারিদ্র্য দূরীকরণে গরিবদের উপযোগী ব্যাংক তৈরির জন্য আর ড. অভিজিৎ ব্যানার্জি (২০১৯) পেয়েছেন দারিদ্র্য দূরীকরণে পরীক্ষাগার পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য। তারপরও দারিদ্র্য জয় পুরোপুরি হয়নি । বাংলাদেশের সার্বিক দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির মৌলিক ভিত্তি হচ্ছে ড. আখতার হামিদ খানের কুমিল্লা মডেলের চার স্থর যথাক্রমে পল্লী পূর্ত কর্মসূচী, টিটিডিসি,থানা সেচ কর্মসূচী ও দ্বি-স্তর বিশিষ্ঠ সমবায়। দারিদ্র্য বিমোচন বাংলাদেশের বিগত ৫৩ বছরের অন্যতম বড় কার্যক্রম যার কিছু মডেল বিশ্বে প্রশংসা পেয়েছে তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশে জাতীয় কর্মসূচী হিসাবে। সত্য হলো, বাংলাদেশে দারিদ্র্য, আর্থিক অসচ্ছলতা, ঊর্ধ্বমুখী অসমতা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা সত্ত্বেও বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক রূপান্তর অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে এবং আজকের নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হিসেবে কাজ করতে পারে। । দেশটির সাফল্যের বড় অংশের পেছনে ফজলে হাসান আবেদের ব্র্যাক এবং মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান গুলো অবদান রয়েছে। সুনির্দিষ্টভাবে একটি হস্তক্ষেপ প্রত্যাশার চেয়ে বড় অবদান রেখেছিল। আর তা হলো, পরিবারের জ্যেষ্ঠ নারী সদস্যদের কাছে ক্ষুদ্রঋণ দেয়ার গ্রামীণ ব্যাংকের প্রথমদিককার সিদ্ধান্ত। এটি ঘরে নারীদের কথা বলার অধিকার সংহত করেছিল, পালাক্রমে শিশুকল্যাণে পারিবারিক ব্যয় প্রবাহিত করায় ভূমিকা রেখেছিল। এটি অন্যতম প্রধান কারণ গড় আয়ু, সাক্ষরতা ও অপুষ্টি মোকাবেলায় বাংলাদেশ কেন এত উন্নতি করেছে। বাংলাদেশে বিশ্বের অন্যতম বড় ক্ষুদ্রঋণ খাত আছে, যা ঋণ ফাঁদ থেকে পরিবারগুলোকে বেরিয়ে আনতে এবং নিজস্ব ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করতে সাহায্য করেছে। একটি কম্পিউটেবল জেনারেল ইকুলিব্রিয়াম মডেল ব্যবহার করে দেখিয়েছেন ক্ষুদ্রঋণ নিছকই অর্থগ্রহণের চেয়ে বেশি মাত্রায় পরিবারগুলোকে সাহায্য করেছে। আর্থিক-রাজস্ব ও মুদ্রানীতিতে পৃষ্ঠপোষকতা জুগিয়ে এটি দেশটির জিডিপি ৯-১২ শতাংশ চাঙ্গা করেছে। তবে ভাগ্যগুণেও বাংলাদেশের অনেকটা সাফল্য এসেছে।
কিন্তু বিশ্বব্যাংক বলেছে,গত দেড় দশকে দ্রুত দারিদ্র্য কমানোর প্রতিযোগিতায় শীর্ষ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নেই অর্থাৎ সেই সকল দেশ যে গতিতে দারিদ্র্য কমেছে(৩.২শতাংশ হারেতানজানিয়), বাংলাদেশে কমেছে এর চেয়ে কম (১.৩৭ শতাংশ হারে)। প্রশ্ন হচ্ছে, দারিদ্র্য জয়ের প্রমাণিত এবং প্রতিষ্ঠিত নিজস্ব মডেল থাকার পরও বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্তির হারে অন্য দেশের চেয়ে পিছিয়ে কেন? বিশ্বব্যাংক সময় সময় বাংলাদেশের দারিদ্র্য নিয়ে মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়ন অগ্রগতির উদ্দীপক গল্প হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে ২০০০ সালের পর থেকে দারিদ্র্য অর্ধেকে নেমে এসেছে। দেড় দশকের এ সময়ে বাংলাদেশে আড়াই কোটির বেশি লোক দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও অর্থনীতি শক্তিশালী ও প্রাণবন্ত রয়েছে। সব খাত দারিদ্র্য বিমোচনে কম বেশি ভূমিকা রেখেছে। দারিদ্র্য নিরসনের সঙ্গে সঙ্গে মানব পুঁজির উন্নয়ন ঘটেছে, জন্ম হার কমেছে ও প্রত্যাশিত গড় আয়ু এবং শিক্ষার হার বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও ব্যক্তিত্বের বাইরে রাষ্ট্রনায়করাও বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রশংসা প্রকাশ করেছেন। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মতে, বাংলাদেশের মানুষ পরিশ্রমী ও আত্মনির্ভরশীল। ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিগত পাঁচ দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটেছে এবং বৈশ্বিক দারিদ্র্যের ভাগ কমাতে সাহায্য করেছে। একই সুর পাওয়া যায় জার্মানির প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক ওয়াল্টার স্টেইনমেইয়ারের ভাষায়ও। বর্তমান বাংলাদেশ হলো উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও গতিশীল গণতন্ত্রের দেশ। বাংলাদেশ উদ্ভাবনী উন্নয়ন নীতির মাধ্যমে দারিদ্র্য কমাতে সক্ষম হয়েছে। আমেরিকার অন্যতম বৃহত্তম ব্যবস্থাপনা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বোস্টন কনসাল্টেটিভ গ্রুপের বাংলাদেশের ওপর বিশেষ প্রতিবেদন ‘দ্য ট্রিলিয়ন ডলার প্রাইজ’ ওপর আলোকপাত করে শেষ করতে চাই। ২০১৬-২১ এ সময়ে বাংলাদেশের গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ, যা তার তুলনীয় দেশ ভিয়েতনাম, ভারত, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে অনেক বেশি ভালো করেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে ভোক্তাদের আশাবাদ, ভোগ বৃদ্ধি (বিশ্বের নবম ভোগ বাজার), তরুণ শ্রমশক্তি (জনসংখ্যার মধ্যমা বয়স ২৮), উচ্চ অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা, ডিজিটাল গতিবেগ (১৭৭ মিলিয়ন মোবাইল ব্যবহারকারী), সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি (বিগত দশকে তিন গুণ বেড়েছে), ব্যক্তি খাতে দ্রুত বৃদ্ধি, দ্রুত বর্ধনশীল গিগ অর্থনীতি (বিশ্বের মোট ফ্রিল্যান্সারের ১৫ শতাংশ)। বাংলাদেশের অর্থনীতি যদি ১০ শতাংশ হারে বাড়ে তাহলে ২০৩০ সালে, ৫ শতাংশ হারে বাড়লে ২০৪০ সালে ট্রিলিয়ন ডলারের বড় ইকোনমিতে পরিণত হবে।
প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১ অনুযায়ী অর্থনীতিকে আগামী দুই দশকে গড়ে ৯ শতাংশ হারে বাড়তে হবে। কভিড-১৯-এর পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ না হলে হয়তো এখন প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশ বা তার কাছাকাছি থাকত। সে হিসেবে আমরা যদি বাস্তবিক প্রক্ষেপণ করি তাহলে ২০৩৪-৩৫ সালের মধ্যে আমরা ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হব নিশ্চিত। ২০০৯-এর পর থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক গতি ২০৪০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। এ কথা বাহুল্য নয় কারণ চীন তিন দশক পর্যন্ত দুই অংকের প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। স্টিফান ডারকনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তাই বলতে হয়, ‘বাংলাদেশ ক্রমাগত বিশ্বকে অবাক করে দিতে থাকবে।’ কবি সুকান্তের ভাষায়, ‘সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়।’
তাই দারিদ্র্য বিমোচন পরিকল্পন প্রক্রিয়ার বড় স্থম্ভ হবে কর্মসংস্থানের বিস্তৃতি। ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই লক্ষ্যে ১১.৩৩ মিলিয়ন কর্ম সৃষ্টি হবে বলে প্রক্ষেপিত হয়েছে এবং এই সময়ে শ্রমিক সংখ্যা ৭.৮৫ মিলিয়ন বাড়বে বলে প্রাক্কলিত হয়েছে ফলত এই পাঁচ বছরে ৩.৫২ মিলিয়ন উদ্বৃত্ত কর্ম সৃষ্টি হয়ে আগ থেকে অস্তিত্বমান বেকারত্ব (২০২০ সালে ৫.২ মিলিয়নে প্রাক্কলিত) অনেকাংশে দূর করতে সমর্থ হবে বলে পরিকল্পনাবিদরা প্রক্ষেপণ করেছেন। অষ্ঠমম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে কৃষি উৎপাদন বাড়বে ২০২১ সালের ৩.৪৭শতাংশ থেকে ২০২৫ সালে ৩.৯ শতাংশ হারে, শিল্প উৎপাদন বাড়বে ২০২১ সালের ১০.২৯ শতাংশ থেকে ২০২৫ সালে ১১.৯ শতাংশ হারে, আর সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি হবে ২০২১ সালের ৬.৭৪ শতাংশ থেকে ২০২৫ সালে ৭.৩৫ শতাংশ হারে। একই সঙ্গে উৎপাদনশীলতা বার্ষিক ৫.৬ শতাংশ হারে বাড়বে যার এক বড় অংশ বাড়বে রফতানির অবয়বে যা বার্ষিক জিডিপির ১২.৬৪ শতাংশ হারে বাড়বে বলে পরিকল্পিত হয়েছে। ্এই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কৃষি, পশুসম্পদ ও মৎস্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ৩৬০ বিলিয়ন টাকা প্রযুক্ত করা হবে। এই বিনিয়োগ এসব খাতে উৎপাদন বাড়িয়ে এবং বর্ধিত উৎপাদন সাধারণ জনগণের ব্যবহার ও ভোগসীমার ওপরে উঠিয়ে নেয়ার জন্য কর্মসংস্থানের ব্যাপ্তি বাড়াবে। উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা সুসংহত করা হবে, উপকরণ সরবরাহ, প্রয়োজনীয় মূল্য সমর্থন, পানি সরবরাহ, কৃষি ঋণ ও বিপণন সহায়তা এবং পশু ও মৎস্য সম্পদ বাড়ানোয় কর্মসংস্থান বাড়বে। এর সঙ্গে ক্ষুদ্র উদ্যোগ ও কুটির শিল্পের বিকাশ প্রথাগত কৃষির বাইরে কর্মসংস্থান বিস্তৃত করবে। এর সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে ক্ষুদ্র ঋণ প্রবাহ, যা ২০১৯ এর ১৪০৩ বিলিয়ন টাকা থেকে প্রতিবছর ১০ শতাংশ করে বাড়ানো হবে। দারিদ্র্য বিমোচন প্রক্রিয়ায় এই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতকে ইপ্সিত মাত্রায় প্রসারিত করা হবে। স্বাস্থ্য খাতে ২০১৯ সালে জিডিপির ০.৭ শতাংশ প্রযুক্ত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে ২০২৫ সালে জিডিপির ২% উন্নীত করা হবে।
কিন্তু করোনা বাংলাদেশকে আক্রান্ত করেছে যা দরিদ্র অবস্থার গতি প্রকৃতি পরিবর্তন করে দিয়েছে এবং চলতি স্বাস্থ্য-দুর্যোগ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের পেশাগত জীবনে যেভাবে আঘাত হেনেছে, ধনীদের সম্পদ সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় তেমন আঘাত হেনেছে বলে ব্যাংকিং সাক্ষ্য মিলছে না। অর্থনীতির স্বীকৃত ও প্রকাশ্য প্রক্রিয়ায় যদি এসব সম্পদ সংগ্রহ হয়ে থাকে, তাহলে করোনাকালে তার এ রকম অক্ষত থাকা কথার কথি ছাড়া আর কিছুই নয় যদিও এর উত্তর অনুমান করা কঠিন নয়। তবে যে কারণেই সম্পদের পুঞ্জীভবন ও দারিদ্র্য বাড়ুক,সেটা দেশের জন্য স্বস্তির খবনর নয় । স্পেন সরকার আয়োজিত ‘বহুপাক্ষিকতা জোরদারে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান’ শীর্ষক উচ্চ পর্যায়ের এক অনুষ্ঠানে প্রচারিত পূর্বে ধারণকৃত ভিডিও বক্তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ভার্চ্রয়েল বক্তৃত্য় বলেছেন বৈষম্য হ্রাস, দারিদ্র্য নির্মূল ও ধরিত্রী রক্ষায় একযোগে বহুমুখী প্রচেষ্টা চালানোর জন্য বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারী স্মরণ করিয়ে দেয়, প্রত্যেকে নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত কেউই নিরাপদ নয়। এজন্য বৈষম্য হ্রাস, দারিদ্র্য বিমোচন এবং কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করে আমাদের গ্রহকে সুরক্ষিত করতে হবে এবং আমাদের বহুমুখী প্রয়াসকে আরও জোরদার করতে হবে। আজকের গে¬াবালাইজড বিশ্বে গঠনমূলক বহুমুখীতার কোন বিকল্প নেই, মানবজাতির অভিন্ন অগ্রগতি এবং আইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক নির্দেশনার এটিই একমাত্র পথ। বিগত কোভিড-১৯ মহামারী এই শিক্ষা দিয়েছে যে, সম্মিলিত কার্যক্রম, একতা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপরই বৈশ্বিক সমৃদ্ধি নির্ভর করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ইতিহাস প্রমাণ করে যে সম্মিলিত প্রচেষ্টা থেকে যে কোন বিচ্যূতি মানবজাতির জন্য বিপর্যয় নিয়ে আসবে। বিগত মহামারী সংকটের মোকাবেল্্ায় দেশের জনগণের জীবিকার সুরক্ষায় ১৪. ১৪ বিলিয়ন অর্থ বরাদ্দ ছিল যা দেশের জিডিপির ৪. ৩ শতাংশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে (ইউএনজিএ) তার ভাষণে সম্মিলিত প্রচেষ্টার গুরুত্ব এবং জাতিসংঘের ভূমিকার কথাও তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘জাতিসংঘ দুঃখ, দুর্দশা এবং সংঘাতের এই পৃথিবীতে ভবিষ্যৎ মানুষের আশার কেন্দ্র হয়ে থাকবে। তবে দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রগতি হলেও সারা বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে ধনিক শ্রেণির সংখ্যা দ্রুত বাড়ার ফলে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে, সামাজিক খাতে উন্নয়ন সত্ত্বেও বাংলাদেশে আয়বৈষম্য প্রকট যেমন দেশের গরিব ৪০ শতাংশের আয় মোট আয়ের মাত্র ২১ শতাংশ, প্রথম ১০ শতাংশ শীর্ষ ধনীর কাছে ২৭ শতাংশ আয় চলে যায়, শেষ ১০ শতাংশ মানুষের কাছে পৌঁছায় ৩ .৮ শতাংশ আয়। অর্থাৎ শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনী শেষ ১০ শতাংশের তুলনায় প্রায় ৮ গুণ বেশি আয় করে যার ফলে মোট দেশজ উৎপাদন/আয় বৃদ্ধি পেলে তার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে কম পৌঁছায়। ইউএনডিপির ২০২০ সালের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের গিনি সূচকের পয়েন্ট ০. ৪৭৮ এবং কোনো দেশের এই স্কোর ০ .৫০ এর ঘর পেরোলেই উচ্চ বৈষম্যের দেশ হিসেবে ধরা হয় যা কোন ভাবেই বাংলাদেশের জন্য সু খবর নয়।
স্বাধীনতার ৫৩ বছরে অর্থনীতির অনেক পরিবর্তন হলেও সমাজের মৌলিক সমস্যা যেমন নারীর প্রতি বৈষম্য,যৌতুক প্রথা, মানবিক মূল্যবোধ,গনতন্ত্রিক আচরন, ভোগের প্রবণতা বৃদ্ধি,পরিবার প্রথায় অনীহা,কাল টকার প্রভাব মুক্ত সমাজ অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, হতাশাজনক রাজনীতি, নির্বাচনের প্রতি অনীহা,সরকার-বিরোধী দল দ্বান্দ ইত্যাদি বিষয় গুলোর তেমন গুনগত পরিবর্তন হয় নি যা নিয়ে সমাজ বিশ্লেষক গন চিন্তিত া গ্রামীণ থেকে শহুরে, স্থানীয় থেকে জাতীয় / আঞ্চলিক স্তরের সকল পর্যায়ে যে পরিবর্তন হয়েছে তার সঙ্গে দেশের আদি সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থায় রয়েছে যা কাম্য নয় া সরকার ভ’মিহীন পরিবারের মধ্যে বাড়ী তৈরী করে বিতরনের কাজ শুরু করেছে যা প্রশংসনীয় া উন্নয়নের সঙ্গে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের র্ভাগ্য পরিবর্ত’ন জরুরি যাতে অতীত ও বর্তমানের মানুষের চেয়ে তারা অর্থনৈতিকভাবে/ সামাজিকভাবে আরও সচ্ছল, নিরাপদ এবং সাংস্কৃতিকভাবে আরও সমৃদ্ধ হতে পারেএবং স্বাধীনতার পাঁচ দশক পড়েও সেটাই হতে হবে আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক: গবেষক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ
সারাবাংলা/এসবিডিই
ড. মিহির কুমার রায় দারিদ্র্য গবেষণার গতিপ্রকৃতি: এর সুফল পাবে কে? মুক্তমত