Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আর্থিক খাতের সুশাসন সময়ের দাবি

ড. মিহির কুমার রায়
৩১ মার্চ ২০২৪ ১৮:৪১

সাম্প্রতিককালে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসন নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রণীত বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২-তে এটিকে একটি স্বতন্ত্র স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে দেশের সার্বিক আর্থিক উন্নয়নের স্বার্থে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বিগত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে পরিচালিত নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ কী এ কথাটি সুধী মহলে বহুল আলোচিত। প্রথাগতভাবে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক খাতের অভিবাবক, ব্যাংকের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল, সরকারের আর্থিক সম্পদের রক্ষক, পরামর্শক এবং আর্থিক সম্পদ উন্নয়নের কাজে পর্থিকৃত।

বিজ্ঞাপন

অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুটি মুল কাজ: (১) বছরে দু’বার মুদ্রানীতি প্রণয়ন, (২) সংস্থা হিসাবে তফসিলী ব্যাংকের কাজের পরিদর্শন, তদারকি ও পরিবেশ মূল্যায়ণ। প্রথমটির মূখ্য উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা যাতে সঠিক সময়ে সঠিক মুদ্রা সঠিক হাতে পৌঁছে দেয়া যায়। এর দুটি হাতিয়ার আছে যেমন (১) পরিমাণগত: যার মধ্যে আছে ব্যাংক রেইট পলিসি, খোলা বাজার অপারেশন, সি.আর,আর ও এস.এল.আর এবং অন্যটি হলো (২) গুণগত: যেমন রেশনিং, নৈতিকভাবে প্ররোচিত করা, প্রচারণা ও মিটিং করা।

বিজ্ঞাপন

দেশের প্রচলিত নিয়মানুসারে তফসলি ব্যাংকগুলো তাদের আমানতের একটি অংশ সি.আর.আর হিসাবে ৬.৫ শতাংশ ও এস.এল.আর হিসাবে ১৪ শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে গচ্ছিত রাখতে হয় যার উদ্দেশ্য বাজারে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ। এই দুটি হার কম বেশি করা হয় অর্থনীতির সার্বিক বিবেচনায়। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্বান্ত স্ব স্ব পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে তাদের সার্বিক সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ করে, যা সব দেশের একই নীতি। কয়েক বছর আগে সি.আর.আর ১ শতাংশ কমানো হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয় কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন প্রকার বিচার বিশ্লেষণ ছাড়াই বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্যাংকস( বিএবি )এর দাবির মুখে। আরও বলা হয়েছে, ’আগে বাস্তবায়ন তারপর বিশ্লেষণ’। বিষয়টি এমনও হতে পারত বিএবি সদস্যবৃন্দ মন্ত্রনালয়ের সাথে আলাপ করতে পারত এবং এই আলাপের ফলাফল কেন্দ্রীয় বাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য পাঠাতে পারত। কিন্তু বিষয়টি উল্টো হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে বলে বিশ্লেষকগণ মনে করেন। একইভাবে যদি ক্ষমতার বলয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে উপেক্ষা করে মুদ্রানীতির সবছেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্বান্তগুলো নেয়া হয় তাহলে দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাখার যৌক্তিকতা কী? আর্থিকখাতের গবেষকবৃন্ধ বলছেন আমানতকারীদের স্বার্থেই সি.আর.আর/ এস.এল.আর ২০-২২ শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা হয় কারণ ব্যাংকের মোট আমানতের ৯০ শতাংশই তাদের ও বাকি ১০ শতাংশ মালিক পক্ষ বিএবি এর সদস্যদের। এই ঘটনাটিতে সংখ্যালঘু ব্যাংক মালিকদের স্বার্থ রক্ষা হল সংখ্যাগরিষ্ঠ আমানতকারীদের নয়।

এই সিদ্বান্তের ফলে বাজারে ১০ হাজার কোটি টাকা চলে এসেছে যা ব্যাংকগুলোর বর্তমান মূলধন সংকটে বিমোচনে ব্যবহৃত হবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে ব্যাংক মূলধন সংকটের কারণ কী? বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, (১). খেলাপী ঋণ বর্তমানে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে যা মোট বিতরনকৃত ঋণের ১২ শতাংশ থাকে বলা হয় মহাবিপদ সংকেত; (২). এডভান্স ডিপোসিট রেসিও (এডিআর )অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিধায় সেখানে ব্যাংক গুলোর তাদের আমানতের ৮০-৮৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ অনুমোদন ও বিতরন করতে পারে সেখানে কিছু কিছু বেসরকারি ব্যাংক নিয়ম লঙ্গন করে এডিআর রেশিও ৯০ শতাংশে এবং ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ৯২ শতাংশ উন্নত করেছে ।এ দুটি হলো তারল্য সংকটের মুল কারণ। এল ফলশ্রুতিতে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করতে তার অপারগততা প্রকাশ করছে উদ্ক্তোাদেরকে। এর জন্য দায়ী ভ্রান্ত রাজনীতি, সরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য লোক নিয়োগ, ঋণ খেলাপিরদের পৃষ্ঠপোষক করা অব্যহত রাখা এবং ব্যাংক জালিয়াতিদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেওয়া। অবস্থাটা এ রকম যে সরকার-ব্যাংক মালিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা–যদি এক হয়ে যায় তা হলে অর্থনীতির জন্য এর চেযে বড় বিপদ আর কি হতে পারে। বিএবি অর্থমন্ত্রীর কাছে আরও একটি দাবি করছে যা বাস্তবায়ন হলে তা হবে আরও একটি আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত, তা হলো সরকারি ফান্ডের অর্ধেক বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখতে হবে। এরই মধ্যে ফার্মাস ব্যাংক লি. এবং এন আর বি লি. ভীষনভাবে তারল্য সংকটের কারণে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে, শীর্ষপর্যায়ে নীতিনির্ধারকদের অব্যহতি দেয়া হয়েছে সত্য কিন্তু অগণিত আমানতকারীদের জমা রাখা অর্থের কী হবে? সরকারিখাাতের জলবায়ু তহবিলের পাঁচশত কোটি টাকার ফান্ড যা ফার্মাস ব্যাংক লি. এ জমা ছিল তার কী হবে? এনআরবি ব্যাংকে জমাকৃত আড়াইশত কোটি টাকা সরকারি ফান্ডের কী হবে? এই অবস্থায় যদি বিএবি এর দাবি সরকার মেনে নেয় তা হলে আর্থিক খাতের বিপর্যয় আর ঠেকানো যাবে না। বিএবি এর তৃতীয় দাবিটা হলো বর্তমানে মোট বিনিয়োগের শতকরা ২ ভাগ কৃষি ঋণে রয়েছে তা ১ ভাগ নিয়ে আসতে হবে। এতে অন্তর্ভুক্তি মূলক অর্থায়ন তথা অগ্রধিকার খাত বিশেষত: কৃষি, পল্লী উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, নারী উন্নয়ন, পশু সম্পদ উন্নয়নে অর্থায়ন, বনায়ন ইত্যাদি বাধাগ্রস্ত হবে। যার সূদরপ্রসারি প্রভাব পড়বে দেশে খাদ্য নিরাপত্তায় এবং বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ নিকটতম ভবিষ্যতে পরিণত হবে একটি খাদ্য ঘাটতির দেশ হিসাবে।

উপরোল্লিখিত যে তিনটি দাবি বিএবি কর্তৃল উত্তোপিত ও আদায়কৃত বাংলাদেশ ব্যাংককে পাশ কাটিয়ে তা দেশে যে সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে তার জলন্ত প্রমাণ যা অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে। কোনভাবেই আর্থিকখাতে দৈত্যশাসন থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা খর্ব হয়ে যায় এবং এরজন্য সরকারের ব্যাংকিংও আর্থিক বিভাগকে দায়ি করা হয় যারা সব সময়ই রাজনৈতিক বিবেচেনায় বৃহদাকার ঋণ পূনর্গঠন, নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স অনুমোদন, ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে পরিবারতন্ত্র কায়েম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রভাবিত করে থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের মুখোমুখি হতে দেখা যায় যা দেশের উন্নয়নের জন্য অশুভ সংকেত। কিন্তু কেন এমন হয় এটা কি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণ নাকি ব্যাংকিং খাত নিয়ে সরকারের রাজনৈতিক খেলা। প্রায়শই বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এই বলে যে এই ব্যাংকটির গভর্নর তার কাজের জন্য কোন সংস্থার কাছে দায়বদ্ধ: অর্থ মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, রাষ্টপতির কার্যালয় নাকি জাতীয় সংসদ সচিবলায়?

এই প্রশ্নটি কোন একটি জাতীয় সেমিনারে আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরকে করেছিলাম কিন্তু উত্তর পাইনি। অথচ ভারতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর তার কাজের জন্য ভারতীয় লোকসভার কাছে দায়বদ্ধ বিধায় সেই দেশটি সরকার তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ব্যাংকের উপর চাপাতে সাহস পায় না যেটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অহরহ ঘটে চলছে। এখন এ থেকে পরিক্রমণের উপায় নিয়ে ভাবতে হবে। এখন আমাদের প্রতিবেশী ভারত ও নেপালে কিভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কার্যক্রম চলছে তার কিছুটা অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে বিআইবিএম কর্তৃক আয়োজিত এক আঞ্চলিক সেমিনার থেকে। নেপাল কেন্দ্রীয় বাংকের এসএলআর/সিএরআর বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি এবং তাদের পরীবিক্ষণ নজরদারি খুবই জোরালো থাকায় খেলাপী ঋণের পরিমাণ আমাদের তুলনায় কম। দেশটির রাষ্ট্রীয় ব্যাংক সে দেশের ব্যক্তি মালিকানায়/সরকারি মালিকানায় পরিচালিত সকল ব্যাংকের মালিক ও প্রধান নির্বহীদের প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে, তাদেরকে নিয়ে সেমিনার করে থাকে যা বাংলাদেশ অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। সম্প্রতি ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের কেলেঙ্কারি সম্পর্কে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক রির্জাভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার গভর্নরের একটি ব্যক্তব্যে বলা হয়েছে ‘দ্বৈত শাসন থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধার কমে যায়’ । এই ব্যক্তব্যটি বাংলাদেশ ব্যাংকিং খাতের জন্য শতভাগ প্রযোজ্য।

কারণ দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায়শই অর্থ মন্ত্রনালয়ের ব্যাংকি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এর সাথে মতানৈক্যে জড়িত হয় যা কোনভাবেই কাম্য নয়। বিষয়টি এমন যে মন্ত্রণালয় কোন কোন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে গণনাতেই আনে না অথচ বিষটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ। আবার কোন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মন্ত্রনালয়ের চিঠি পাঠালেও তা তেমন গুরুত্ব পায় না। এতে করে অনেক সিদান্ত চলে আসছে যেমন নতুন ব্যাংক খোলার লাইসেন্স, বড় বড় ঋণ অবলোকন/ মওকুফ, সঞ্চিত বাড়ানো কমানো যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক করতে বাধ্য হচ্ছে যদিও সেগুলো দেশের সাবিক আর্থিক উন্নয়নের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এমতাবস্থায় স্বায়ত্বশাসন কিংবা সুশাসন কিংবা শৃঙ্খলা উন্নয়ন খুব জরুরি বলে প্রতিয়মান হয়। আশা করা হয় এই বিষয়গুলোর শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে এবং দেশ সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অগ্রনী ভূমিকা রাখবে।

লেখক: অর্থনীতিবিদ ও গবেষক; সাবেক ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি; জ্যাষ্ট সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবীদ সমিতি, ঢাকা

সারাবাংলা/এজেডএস

আর্থিক খাতের সুশাসন সময়ের দাবি ড. মিহির কুমার রায়

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর