ঈদের উপঢৌকন যেন মেয়ের বাবার জন্য অভিশাপ
২ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:১৪
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুটি ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা। এই ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে ঘরে-ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ঈদ উপলক্ষে কত শত রকমের কেনাকাটা, রান্নাবান্না ও আয়োজন। তবে এই ঈদ সকলের জন্য সমান আনন্দের নয় কারো ক্ষেত্রে বা কোন পরিবারের ক্ষেত্রে বিষপানের কারণ। বাংলাদেশে বিয়ের পর মেয়ের বাড়ি থেকে ঈদের বাজার, পশু দেওয়া, পোশাক দেওয়া যেন বিয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো ছাড়া যেন বিয়েকে কোন ভাবেই হালাল করা যায়না। আমাদের চট্টগ্রামেও এটিকে বিয়ের অংশ হিসেবে ভাবা হয়। কার বাবা কী পরিমাণ উপঢৌকন দিচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে তার মেয়ের সুখে থাকা নির্ভর করে। ঈদ উপলক্ষে মেয়ের বাড়ি থেকে ছেলের বাড়িতে উপহারের নাম করে যেসকল খাদ্য-দ্রব্য বা টাকা-পয়সা আদান-প্রদান করা হয় সেটাকে আমি রীতিমতো অর্থনৈতিক অত্যাচার হিসেবে বিবেচনা করি।
আসুন আপনাদের এই ঈদ উপঢৌকনের জন্য ঘটে যাওয়া কিছু বিভৎস ঘটনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন ২০২১ সালে সিলেটের ওসমানীনগরে অন্তসত্ত্বা গৃহবধূ শরিফা বেগমের লাশ উদ্ধার করেছিলো পুলিশ। তিনি উসমানপুর ইউনিয়নের তাহিরপুর গ্রামের আরজু মিয়ার স্ত্রী এবং হবিগঞ্জ জেলার নবিগঞ্জের পিঠুয়া সদরাবাদ গ্রামের সাকিন উল্লাহর মেয়ে ছিলেন। বাবার বাড়ি থেকে ঈদের উপঢৌকন না পাওয়ায় শশুর বাড়িতে সহ্য করতে হয়েছে কঠিনতম নির্যাতন। ফলাফল হিসেবে সাকিন উল্লাহ পেয়েছেন মেয়ের লাশ।
একই বছরে একই রকম ঘটনা ঘটেছিলো সিলেটের জৈন্তাপুরে। বাবার বাড়ি থেকে পাঠানো ইফতার নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে গালমন্দ করায় হেলেনা বেগম নামের এক নববধূ আত্মহত্যা করেছিলেন। এই তো কয়েকদিন আগেই আরেকটি বিভৎস ঘটনার সাক্ষী হলো সিলেট সদরের মানুষ। মেয়ের বাড়ি থেকে পাঠানো ঈদ ইফতার সামগ্রী কম হওয়ায় সকলের সামনেই মেয়ের বাবাকে করা হয়েছে অপমান। আর এই অপমান সহ্য করতে না পেরেই মেয়ে করেছেন আত্মহত্যা। আর কতো জীবন গেলে আমরা বেরিয়ে আসবো এই অপসংস্কৃতি থেকে?
আমাদের চট্টগ্রামও কিন্তু এই অপসংস্কৃতি চর্চায় কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। গতবছর ঈদুল আযহার সময় হাটহাজারী উপজেলায় সুমি আক্তার নামে এক গৃহবধূর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। ভুক্তভোগী পরিবারের দাবি, কোরবানির ঈদে যৌতুক হিসেবে গরু না দিয়ে ছাগল দেওয়ায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। পরবর্তীতে অভিযুক্তরা নিজেদের বাঁচতে আত্মহত্যা বলে প্রচার করছে। আর কতো প্রমাণ প্রয়োজন? আসুন আরো বলছি । পটুয়াখালীতে তো ঘটেছে আরেকটু বেশি বিভৎস ঘটনা। শ্বশুরবাড়ি থেকে রমজান মাসের ইফতার না দেওয়ায় ঘরের দরজা বন্ধ করে স্ত্রী ও শ্বশুর-শাশুড়িকে মারধর করেছেন মো. সফিক নামের এক ব্যক্তি।
এবার একটি করুণ বাস্তব কাহিনি শুনুন। কিছুদিন আগে দেখেছিলাম আমাদের এলাকার এক মুরুব্বি বিত্তবানদের দ্বারে দ্বারে সাহায্য চেয়ে বেড়াচ্ছেন। উদ্দেশ্য একটাই সামনে ঈদ মেয়ের বাড়ি ঈদের বাজার পাঠাতে হবে। না হয় যে তার সদ্য বিবাহ হওয়া মেয়ের নানান মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে হবে তবে অনেকের ক্ষেত্রে হয়তো সেটা শারীরিক নির্যাতনে রুপান্তরিত হয়। মুরুব্বি বলছিলেন এই বৃদ্ধ বয়সে এসে যেখানে দুইবেলা দুমুঠো ভাত খেতে, নিজের ওষুধের খরচ ও বৌয়ের ঔষধের খরচ যোগাতেই মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয় সেখানে এসব বাজারের খরচ যোগাতে মানুষের দ্বারে সহযোগিতা চাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই ।পরিবারে কোন ইনকাম নেই। ছোট একটা ছেলে আছে। ভাবতেছি আর একটু বড় হলেই কাজে দিয়ে দিবো।
অর্থাৎ তিনি বাধ্য হয়ে নিজের ছেলের জীবটাকেও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিবেন। অপসংস্কৃতি অনুসরণ করতে গিয়ে কিছু ছেলের পরিবারে মেয়ের বাড়ির উপঢৌকন ছাড়া যেন ঈদই সম্পূর্ণ হয়না। এগুলো নিয়ে রীতিমতো একটি মেয়েকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে নানান নির্যানতনের স্বীকার হতে হয়। যার শেষ পরিণতি হিসেবে বিবাহ বিচ্ছেদ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে থাকে। তাছাড়া মেয়ের পরিবারের কি করুণ অবস্থা হতে পারে তার বিবরণ আপনারা ইতোমধ্যে উপরে পেয়ে গেছেন। একবার নিজেকে প্রশ্ন করুন আমরা কোথায় আছি? কোন সমাজে বসবাস করছি? আমাদের এতো এতো শিক্ষা কোথায়? কেন আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন হচ্ছে না?
আমার দৃষ্টিতে এসবের জন্য দায়ী হচ্ছেন আমাদের বাবা-মা ও আত্নীয় স্বজন এবং আমরা নিজেই। কেন আমরা এখনো আমাদের বাবা-মা ও আত্নীয় স্বজনের মন মানসিকতার পরিবর্তন করতে পারিনি? কেন এখনো আমরা অন্যের বাড়ির উপঢৌকন পেতে এতো আগ্ৰহী? তবে কি এটি আমাদের জাতিগত কুসংস্কার অনুসরণের ফল নাকি মানুষ হিসেবেই আমরা অন্যজনকে নির্যাতন করতে পছন্দ করি। এই অপসংস্কৃতিক প্রথা বন্ধ করার জন্য সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আসতে হবে প্রত্যেক পরিবারের প্রধান সদস্যদের। আপনারা এই উপঢৌকন না অন্য পরিবারকে দিবেন না অন্য পরিবার থেকে গ্ৰহণ করবেন। এছাড়াও এই প্রথা রহিত করার জন্য আমাদের প্রশাসনের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে । তবেই আমরা এই অপসংস্কৃতি মুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে পারবো। আসুন আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ অবস্থান থেকে এই প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এজেডএস