নদী মাতৃক জীবন জীবিকা: বর্তমানে কি হারাতে বসেছে?
৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:০৭
নদীমাতৃক বাংলাদেশকে বিভিন্ন কারণে অনেকে আগের মতো আর সেভাবে সম্বোধন করতে ইচ্ছা প্রকাশ করছে না। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জনসৃষ্ট তথা প্রাকৃতিক কারণে নদ-নদীগুলোর অকাল মৃত্যু- যা আমাদের কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এক বড় হুমকি। অথচ, এক সময় শুধু প্রাকৃতিক নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবন-জীবিকা, নৌযান চলাচল তথা পরিবহনে খাল-বিল, নদী-নালার এক অপূর্ব ভূমিকা ছিল। নদী-নালাগুলো সারা দেশজুড়ে মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে থাকত যেমন পরম করুণাময়ী মায়ের মতো। বাংলাদেশের নদ-নদী কি সাহিত্যে, গানে, নাটকে ও জীবন-জীবিকায় কি অসামান্য অবদান রেখেছে, যা কবিগুররবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ বিলাসী মনের পরিচয়ে বারবার উঠে এসেছে তা সাহিত্যে যার মধ্যে কুষ্টিয়ার শিলাইদেহের কুঠিবাড়ী থাকা সত্ত্বেও পদ্মায় বজরায় রাত্রি কাটাতেন যার ফসল নৌকা ডুবির মতো উপন্যাসে বাংলাদেশের এক কবি লিখেছিলেন, ‘নদী শুধু নারী নয়, পুরুষের মতো আছে নদ। মানুষের মতো সেও হাসে-কাঁদে, ভাঙে-গড়ে, আছে তার ক্রোধ।’ এই সত্যটা প্রাচীনকাল থেকে উপমহাদেশের সমাজ-সংস্কৃতিতে স্বীকৃত। কেবল তার কোনো আইনি স্বীকৃতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। মানুষের চেয়েও নদনদীকে বেশি সম্মান দিয়েছে উপমহাদেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশের অমুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। সেই আদিকাল থেকে তারা গঙ্গা নদীকে দেবী জ্ঞানে পূজা করে। বিশ্বাস করে, গঙ্গা স্নানে সব পাপ মোচন হয়। লাখ লাখ মানুষ এখনও প্রতি বছর গঙ্গা স্নানে যায়। বিশ্বাস করে, গঙ্গা স্নানে তারা পাপমুক্ত হলো। গঙ্গাকে শুধু দেবত্ব নয়, মায়ের সম্মানও প্রদর্শন করে। কিন্তু উপমহাদেশে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এসব নদনদী দেবতা হিসেবে পূজিত হলেও কখনও তাদের সংরক্ষণ, নিরাপত্তা ও পবিত্রতা রক্ষার চেষ্টা হয়নি। অতঃপর রবীন্দ্র পরবর্তী বলয়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী গান ‘পদ্মার ঢেউরে’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, আদত্ব মল্য বর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, গোলাম মোস্তফার ‘পদ্মা নদী’, ড. নীহার রঞ্জন গুপ্তের ‘নদীর নামটির মধুমতি’ ভৌরব প্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রিক্তা নদীর বাঁধ’ আমাদের সাহিত্য অংগনকে সমৃদ্ধ করেছে। নদ-নদী প্রকৃতির দান কিন্তু আ‘মাদের নদীগুলো যেমন- চিত্রা, মধুমতি, নব গঙ্গা, আন্দার মানিক, পূর্ণভবা, ঢাকাতিয়া, বংশাই, সুবর্ণখালী, পেয়াই, আইরলক্ষ্যা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, নারদ, গড়াই, ধলেশ্বরী, বুড়ীগঙ্গা, কর্ণফুলী, মাথাভাঙ্গা, মেঘনা, পদ্মা, যমুনা, পিয়াইন, বাঙালি, মিনাই, সুবর্ণখালী, কালীগঙ্গা, ময়নাকাটা ইত্যাদি ঐতিহ্যের বাহক। কিন্তু এসব ঐতিহ্য এখন বাংলাদেশের শুধু গবেষক কবি কিংবা সাহিত্যিকের সৃষ্টিশীলতার উপাদান। কিন্তু এগুলো এখন এক শ্রেণীর মানুষের অর্থবিত্তের অর্থনৈতিক আকাক্সক্ষা কাছে হার মেনে বাসছে যার প্রাদুর্ভাব নদী দখল, নদী দূষণ ইত্যাদি যা বেশির ভাগ নদীর মৃত্যুর কারণ। দৈনিক পত্রিকা বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ অন্যান্য পত্রিকা দেশের নদ-নদীগুলোর দুর্দশার ওপর ধারাবাহিকতার প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাচ্ছে। এই সকল প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে- নদীবহুল বাংলাদেশ এখন নদীহীন দেশে পরিণত হচ্ছে, বদলে যাচ্ছে জীব বৈচিত্র, তথা মানুষের জীবন-জীবিকা। এখন অনেক নদী হয়েছে খেলার মাঠ, বসতবাড়ি, চাষের কৃষি জমি কিংবা শিল্প কারখানার স্থাপনা, আবাসন প্রকল্প, দর্লীয় স্থাপনা যা হলো সবি অবৈধ। এমন সময় এসে গেছে যে দেশের এ নদীগুলোতে সহজেই বাঁধ দিয়ে চলছে মাছের চাষ, বনায়ণ, গরুও মুরগির খামার। এতে করে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় কিংবা উত্তর-পূর্ব অঞ্চলীয় নদী অর্থনীতি কিংবা হাওর অর্থনীতি এখন বিপাকে পড়েছে। দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী সাতটি জেলার জনপদ সম্পূর্ণভাবে সমুদ্র সংযোগ নদীর উপর নির্ভরশীল যার মধ্যে আছে নৌকা, নৌজান ভিত্তিক ব্যবসা, মৎস্য জীবি শ্রেণির মাছের আহরণ ইত্যাদি। আবার সমতলে নদী হারিয়ে যাওয়া মানেই দু’পাড়ের মানুষের সভ্যতা বিপন্ন হওয়া তারমধ্যে গ্রামীণ অর্থনীতির কৃষি ব্যবস্থা, খাদ্য উৎপাদন ও কর্মসংস্থান সবচাইতে বেশি বিপন্ন। অথচ, অনেকেই বলছেন নদী হচ্ছে গ্রাম বাংলার প্রাণ, যাকে ঘিরে হয় মানুষের জীবনচক্র, ঘাঁ, বাজার, কল-কারখানা, নানা শিল্প প্রতিষ্ঠান, শহর, সভ্যতা, তাই নদী হলো জীবন কিংবা নদী হলো মরণ।
নদীর সংজ্ঞা ও সংখ্যা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে ।নদী কমিশনের ওয়েবসাইটে নদনদীর একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেখানে নদনদীর সংখ্যা প্রাথমিকভাবে ৯০৭টি নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কোন ধরনের জলাধার বা জলাভূমিকে ‘নদী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে? তার মানে, সংখ্যার আগে সংজ্ঞা নির্ধারণ জরুরি। ।‘নদী’ কী– এ প্রশ্ন আজকের নয়। খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতকের আগে ‘যাস্ক’ নামে একজন মুনি ও সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ প্রথম প্রশ্নটি তুলেছিলেন। তিনিই উত্তর দিয়েছিলেন– যা ‘নাদ্য’ অর্থাৎ নাদ বা শব্দ করে, সেটিই নদী। উনিশ শতকের ‘বাচস্পত্য অভিধান’ বলছে– ‘যে অকৃত্রিম জলপ্রবাহ ৯ মাইল ১৬০ গজ প্রবাহিত হয় নাই, তা গর্ত্ত শব্দবাচ্য।’ বাংলা একাডেমি প্রণীত অভিধানে রয়েছে নদীর সুস্পষ্ট সংজ্ঞা- ‘পাহাড় হ্রদ প্রস্রবণ প্রভৃতি থেকে উৎপন্ন ও নানা জনপদের জলস্রোত; চার ক্রোশের অধিক বাহিনী জলনালি; স্বাভাবিক জলস্রোত; স্রোতস্বিনী; তটিনী; তরঙ্গিনী; প্রবাহিণী’। পরিহাসের বিষয় বটে, নদীমাতৃক বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত নদীর আইনি সংজ্ঞা নেই।
নদী, পানি ও পরিবেশ বিষয়ে বাংলাদেশে প্রচলিত আইন ও বিধিমালার মধ্যে প্রথম প্রণীত হয়েছিল ‘দ্য ক্যানেল অ্যাক্ট, ১৮৬৪’। সর্বশেষ ২০১৩ সালে প্রণীত হয়েছে ‘বাংলাদেশ পানি আইন’। মাঝের দেড়শ বছরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নদী ও পানিসম্পদ সংক্রান্ত অন্তত ৩১টি আইন ও বিধিমালা প্রণীত হয়েছে। কোথাও নদীর সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়নি। এমনকি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইনেও নেই নদীর সংজ্ঞা।অবশ্য নদনদীর সংখ্যা নির্ধারণ করতে গিয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন একটি ‘ওয়ার্কিং ডেফিনেশন’ নির্ধারণ করেছে। ওই সংজ্ঞায় বলা হয়েছে– ‘নদ বা নদী বলিতে পাহাড়, পর্বত, হিমবাহ, হ্রদ, ঝরনা, ছড়া, অন্য কোনো জলাশয় বা অন্য কোনো জলধারা হইতে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হইয়া যে জলধারা সারা বছর বা বছরের কোনো কোনো সময় দুই তীরের মধ্য দিয়া প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত হইয়া সমুদ্র, মহাসমুদ্র, হ্রদ, অন্য কোনো জলাশয় বা অন্য কোনো জলাশয়ে পতিত হয়, তাহাকে বোঝায়।’উচ্চ আদালতের একটি রায় অনুসরণে এর সঙ্গে যোগ করা হয়েছে– ‘উপর্যুক্ত সংজ্ঞায় যাহাই থাকুক না কেন, ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে, রিভিশনাল সার্ভে ও বাংলাদেশে রিভিশনাল সার্ভে রেকর্ডে নদ বা নদী হিসেবে যাহা উল্লিখিত হইয়াছে, তাহা নদ বা নদী হিসবে গণ্য হইবে।’
নদনদীর সংখ্যা নির্ধারণে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। ২০০৫ সালে ‘পানিবিজ্ঞান’ গ্রন্থে শনাক্তকরণ নম্বরসহ যে তালিকা প্রকাশ করা হয়, সেখানে নদনদীর সংখ্যা ছিল ৩১০টি। ২০১১ সালে পরবর্তী সংস্করণে ৪০৫টি নদনদীর কথা বলা হয়। অন্যদিকে স্বায়ত্তশাসিত গবেষণা সংস্থা সিইজিআইএস বলছে, দেশে নদনদীর সংখ্যা ৪৪৫। পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক রচিত ‘বাংলাদেশের নদনদী’ গ্রন্থে (জনান্তিক/২০২০) বলা হয়েছে, দেশে নদীর সংখ্যা ১১৮২। ‘রিভারাইন পিপল’ থেকে আমরা দেশের নদনদীর তালিকা প্রণয়নের যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, সেখানে এই সংখ্যা রক্ষণশীলভাবেই ১২ শতাধিক। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তালিকায় ৯০৭টি নদী যদিও সরকারি হিসাবগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ, পূর্ণাঙ্গ তালিকা সম্ভবত নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের ৫৪টি নদী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের উপর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং এ সকল অভিন্ন নদীর ওপর উজানে বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিচেছ ভারত। ফলে শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্য কৃষিতে আর পানি পাওয়া যাচ্ছে না আবার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার সেচ পাম্পও কাজ করছে না। এখন ষড়ঋতুর দেশ বলতে যা বুঝনো হতো তাও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়, বর্ষার মৌসুমে বৃষ্টি নেই, বসন্তের আগেই বসন্তের আগমন, শীতের ব্যাপকতা থাকলেও স্থায়ীত্ব কমে গেছে, বর্ষায় নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার অল্প বৃষ্টিতেই বণ্যা ইত্যাদি এখন দেশের মানুষের নিত্য দিনের সাথী। তথ্য বলছে খুলনা বিভাগের ১০টি জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদ-নদী সমূহের প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার তলদেশ এরিমধ্যে ভরাট হয়ে গেছে। রাজশাহী জেলার মানচিত্র থেকে সাতটি নদী এরিমধ্যে হারিয়ে গেছে আর তেরটি নদীর মধ্যে এগারোটি নদী পানি শূন্য হয়ে গেছে। এই ধরনের একিচিত্র প্রায় প্রতিটি জেলাতেই রয়েছে। খুদে রাজধানী ঢাকার বুড়িগঙ্গার দূষণ ও দখল নিয়ে পরিবেশবাদী সংগঠন এবং মিডিয়া প্রায়শ সংবাদ প্রচার করে চলছে কিন্তু কাজর কাজ কিছুই হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয় না। বিষয়টি প্রশাসন তথা ভূমি মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার হলেও রাজনীতির প্রভাবের বলয় থেকে বেড়িয়ে আসা সম্ভব হয়ে উঠছে না। কারণ, এ কথা সত্য যে স্বল্পবিত্ত কোন ব্যক্তি বা সমাজ নদী, বন, জলাশয় কিংবা পাহাড় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক কর্মী, স্থানীয় সরকার সদস্য কিংবা ধর্মীয় গুরুদের প্রতিপত্তিকে সমাজে আরও বেশী প্রতিফলিত করতে এ দখল মহোৎসবে লিপ্ত রয়েছে। অর্থাৎ এই সকল কাজগুলো ধীরে ধীরে সংগঠিত হয়েছে ক্ষমতার বলয়ে অন্তরালে আর যাদের দায়িত্ব এগুলো রক্ষা করার তাদের সর্ব সময়ই নিশ্চুপ থাকতে দেখা যায় যা সার্বিক অর্থে দুর্ভাগ্যজনক তথা লজ্জাকর।
এই ধরনের একটা পরিস্থিতিতে ‘মরছে নদী, ধুঁকছে মানুষ’ নামে স্লোগান প্রায়শই শোনা যায় পরিবেশ বাদীদের কাছ থেকে। কিন্তু তাদের শক্তি কতটুকু আছে এক বিশাল দখলদারদের বিরুদ্ধে লড়তে। প্রাকৃতিক কারণে নদী বা শাখা নদীগুলো তার নাব্য হারিয়েছে বিশেষ করে দীর্ঘদিনের পানি কিংবা বর্জ্য জমানোর কারণে এবং আমাদের দেশের মানুষ এখন প্রকৃতির খুব একটা শক্তিশালী প্রতিযোগী হয়ে দাড়িয়েছে কি নদী দখলে বা বন দখলে যার ফলে প্রাণীকূল একেবারেই বিপন্ন প্রায় যা আমরা চ্যানেল আই এর “প্রকৃতি ও জীবন” অনুষ্ঠান থেকে জানতে পারি। কিন্তু এতে প্রকৃতি নিধন হয় না যদি সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকে।
গবেষকরা বলছেন, এই প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনায় যে অনিয়ম অনাচার চলছে তা যদি নিয়ন্ত্রণে না আনা হয় তবে বাড়তি জনসংখ্যার চাপে প্রকৃতি বির্পয় অনিবার্য। এমন একটা সময়ে সেগুলো ঘটছে যেখানে দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে পা রেখেছে এবং একে টেকসই বেগবান রাখতেই এই সকল বিষয়গুলোতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ জরুরি বিধায় প্রথমত: ছোট বা বড়, শাখা কিংবা প্রশাখা যে কোন ধরনের নদীই হউক না কেন তার নাব্যতা ফেরাতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং এর কোনো বিকল্প নেই যার মাধ্যমে মূল নদীর সংগে শাখা নদীগুলোর সংযোগ মুখ প্রশস্ত হবে এবং নৌযান চলাচলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বেগবান হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে কিছু সংখ্যক অসাদু প্রকৌশলী, ঠিকাদার, কনট্রাক্টর এর কারসাজিতে সরকারি অর্থের সঠিক ব্যবহর নিশ্চিত হয় না। কিংবা বরাদ্দের টাকার অর্ধেকও যদি ব্যয়িত হতো তাহলেও অনেক কাজ সম্পন্ন হতো যা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, নদ-নদীগুলো দূষণসহ মৃত হওয়ার প্রধান কারণ শিল্পের বর্জ্য নদীতে প্রেরণ- যা আইন বিরোধী এবং একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু শিল্পের কারখানার মালিকরা তা কোনভাবেই প্রতিপালন করছে না কেবল পরিবেশ দফতরের উদাসীনতার কারণে। অথচ, শিল্প কারখানার অনুমোদনের সময় পরিবেশের দিকটি বিবেচনায় রেখেই প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয় অথচ পরবর্তীতে তা আর মানা হচ্ছে না। আবার মানুষের কি এতটুকু বিবেচনা নেই যে, তাদের শিল্পের বর্জ্যগুলো ফেলিয়ে নদীর এত বড় ক্ষতি করছে নদীর পানির ব্যবহারে জীবন-জীবকায় ও প্রাণিজ বসতিতে স্বাস্থ্য সংকট সৃষ্টি করছে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় একটি নদী গবেষণা ইনষ্টিউিট রয়েছে সত্যি কিন্তু তাদের গবেষণার ফলাফল নদ-নদীর রক্ষার কি কাজে লাগছে তার কোন আলামত পাওয়া দুষ্কর। কারণ বিষয়গুলো এতই টেকনিক্যাল যে সাধারণ কেন অনেক বিষেজ্ঞই বুঝতে বা প্রয়োগিক বিষয় জানতে অপারক হয়। তাই প্রশাসনিক সংস্থা পানি উন্নয়ন বোর্ড কিংবা উদ্যোগী মন্ত্রণালয় যেমন পানি সম্পদ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয় তাদের গবেষণার ফলাফলের সফল প্রয়োগ করে দেশের নদীগুলোকে কিভাবে রক্ষা করবে তা ভাবনায় সময় এসেছে। চতুর্থত, নদী-নালা, খাল-বিল জলাধার ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদ যা সারাদেশ জুড়েই ছড়িয়ে আছে এবং সেগুলোর গুণগত প্রাকৃতিক মান ধরে রাখার দায়িত্ব জনগণের যা থেকে সমাজ উপকৃত হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে সমাজ কাঠামোতে নিঃস্বার্থ লোক একেবারেই কমে গেছে এবং আর যারা আছে তারা ভোগ দখল নিয়েই ব্যস্ত রয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়। এখন প্রশ্ন আসে- দেশের রাজনীতি কি সমাজ উন্নয়নের জন্য নাকি ব্যক্তি উন্নয়নের জন্য? পঞ্চমত: নদীসহ সকল প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় জনগণের সম্পৃক্তকরণ কিংবা অংশীদারিত্ব যদি নিশ্চিত করা যায় তাহলে জনগণই এগুলোর পাহাড়াদার হিসাবে কাজ করবে। কিন্তু সেই ধরনের উদ্যোগ সৃষ্টিতে জাতীয কিংবা স্থানীয় সরকারের একটি ভূমিকা রয়েছে যা ভুলে গেলে চলবে না; ষষ্ঠত, যারা অবৈধভাবে নদী থেকে মাটি কিংবা বালু উত্তোলন করছে কিংবা লিজ গ্রহণ তথা জল মহাল দখল করে বেড়াচ্ছে প্রকৃতির ভারসাম্যের বিনিময়ে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু তাই নয় নদী রক্ষা করতে প্রতিবেশীর দেশগুলোর সাথে কুটনেতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। নদী রক্ষায় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে নদ-নদী দখল মুক্ত করে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ সৃষ্টি করতে হবে। ষষ্টত, সপ্তম ও অষ্ঠম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতে নদী ভাঙনরোধ ও ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ রয়েছে কিন্তু নদ-নদী ও কার-বিল উদ্যারের ভিশন অনুপস্থিত রযেছে।ডিজিটেল বাংলাদেশের ভিশন যখন প্রধানমন্ত্রী ২০০৮ সালে ঘোষণা করেন তখন অনেকেই তা বুঝতে পারেন নি কিন্তু আজকে তা বাস্তবায়ন হয়েছে। এখন নদী ব্যবস্তাকে চালু রাখতে হলে প্রতিবেশী ভারত থেকে আসা ৫৪টি নদীতে পানি ব্যবস্থাপনাকে চালু রাখতে হবে। এটা নির্ভর করে নদীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও ধরনের ওপর। তাই বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে ব্যাপক ড্রেজিংসহ নদী ভাঙন রোধ, নদী তীর রক্ষা ও নদীগর্ভ থেকে ভূমি পুনরুদ্ধার করতে হবে। তবে কাজটি এত সহজ হবে না। এজন্য প্রয়োজন হবে সংশ্লিষ্ট সব দফতরের সমন্বিত প্রয়াশ; অষ্টমত : বাংলাদেশে তো আবার নদনদীর বড় শত্রু মানুষই। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে নদী খনন, নদী সংস্কার না হওয়ায় তার গভীরতা ও নাব্য শঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। তার ওপর অসাধু মানুষ নদীতে বালু ফেলে নদী মজিয়ে দিয়ে বসতি স্থাপন ও দোকানপাট করার জন্য অবৈধভাবে তার দখল নিচ্ছে। এই সমস্যাটি রাজধানী ঢাকার বুড়িগঙ্গা এবং বন্দরনগর নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর জন্যও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এই অসৎ ও অসাধু কাজের সঙ্গে ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের যোগাযোগ এত প্রবল যে, নদী রক্ষার জন্য আইন হয়; সেই আইন কার্যকর হয় না। ফলে বাংলাদেশে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। আবহাওয়া প্রতিকূল হয়ে উঠছে, প্রাণিসম্পদ রক্ষা করা দুরূহ হচ্ছে। এই পরিবেশ দূষণ এবং নদী, পানি ও বনসম্পদ রক্ষায় বিশ্বময় জোরালো আন্দোলন চলছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বময় এই পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের একজন অগ্রনায়ক। বাংলাদেশে নদনদী, বনসম্পদ রক্ষা (সুন্দরবন রক্ষাসহ) ও পরিবেশ দূষণ বন্ধ করার জন্য বহুদিন ধরে আন্দোলন চলছে। সম্প্রতি দেশের হাইকোর্টের রায়ে দেশবাসীর এই দাবি পূরিত হতে চলেছে মনে হয়।নদনদী রক্ষা সম্পর্কে এক ব্যক্তির করা রিট সম্পর্কে রায় দিতে গিয়ে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ তুরাগ নদকে লিগ্যাল পারসন বা ‘জীবিত ব্যক্তি’ বলে ঘোষণা করেন। তার পরই পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ হলে দেখা যায়, কেবল তুরাগ নদ নয়, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সব নদীকে একই মর্যাদা দিয়ে লিগ্যাল পারসন বা আইনি ব্যক্তি ঘোষণা করা হয়েছে। এটি একটি ঐতিহাসিক রায়। হাসিনা সরকারের আমলে এই রায়টি ঘোষিত হওয়ায় পরিবেশ দূষণ থেকে বিশ্বকে মুক্ত করা এবং নদনদী, বনাঞ্চল রক্ষায় আন্তর্জাতিক মঞ্চে শেখ হাসিনার যে ভূমিকা, তার আন্তরিকতা প্রমাণিত হলো।
লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ
সারাবাংলা/এজেডএস
ড. মিহির কুমার রায় নদী মাতৃক জীবন জীবিকা: বর্তমানে কি হারাতে বসেছে?