দিন যায় কথা থাকে
৫ এপ্রিল ২০২৪ ২০:৫৭
আমাদের যৌবন কালে সুবীর নন্দীর কণ্ঠে, খান আতাউর রহমানের গীত ও সুরে একটা গান খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। গানটা ছিলো, “দিন যায়, কথা থাকে”। এধরণের তরল প্রাণস্পর্শী গান আজ আর শোনা যায় না। এখন আমরা গানের সুর, তাল, গায়কী আর নাচ নিয়েই মগ্ন থাকি। খুব কম সংখ্যকই গানের কথা নিয়ে মাথা ঘামাই। সেই গানে বলা হয়েছে, “সে যে কথা দিয়ে রাখল না/ ভুলে যাবার আগে ভাবল না/ সে কথা লেখা আছে বুকে। সে জ্বালা-যন্ত্রণা কাউকে বলব না/ বলব আছি কী যে সুখে। মনপাখি তুই থাক রে খাঁচায় বন্দি / আমি তো করেছি দুঃখের সঙ্গে সন্ধি। কি আছে পাওনা/ কার কাছে দেনা/ যাক সে হিসাব চুকে”।
গানটি অন্তর্গত উজ্জ্বল বিষাদের চরম বহিঃপ্রকাশ। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এরূপ নানাবিধ দু:খ-কষ্ট সুপ্ত থাকে। কখনো কখনো তা হিসেব মিলাতে গিয়ে গুমরে গুমরে মরে। আত্মস্থ জ্বালা-যন্ত্রণার কথা কাউকে বলা যায় না, বলেও ফায়দা হয় না। তাই দু:খের সাথে সন্ধি করা ভিন্ন কোন পথ থাকে না। দেনা-পাওনার হিসাব চুকে গেলে ভালো হত। কিন্তু তা হয় কি?
আমাদের শৈশব শুরু হয়েছিলো নিস্তরঙ্গ আবহাওয়ায়। কৈশোর ছিলো দুরন্তপনায় ভরপুর। যৌবনের ঊষাকাল ছিলো সপ্তরঙ্গে রাঙ্গানো একখন্ড রংধনু আকাশ। আমাদের জীবন যাপনের মূলমন্ত্র ছিলো সততা আর সাধাসিধে জীবনযাপন। শিক্ষার ভিত্তি ছিলো সরল চিন্তা আর অধ্যবসায়। দীক্ষা ছিলো ধর্মভিত্তিক নৈতিকতা আর গুরুজনে ভক্তির। বাবা ছিলেন নায়ক, হরফুন মাওলা। সকল কাজের কাজী। মা ছিলেন সব আবদার পূরণ আর ক্ষমার একমাত্র জায়গা। পারিবারিক বন্ধন ছিলো সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। অনুশাসনও ছিলো বেশ কড়া। আত্মীয়স্বজন নিয়েই ছিলো পরিবারের শক্ত বেষ্টনী। সামাজিক ক্ষেত্র ছিলো অভিভাবক সুলভ। সেখানে ইচ্ছেমত মনঘুড়ি উড়ানো যেত। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে দৌড়ানো যেত। খোলা আকাশ দেখা যেত। বুক ভরে নির্মল নি:শ্বাস নেওয়া যেত। আবার নিষেধের অলিখিত অথচ কড়া অনুশাসনও ছিলো। অভাব ছিলো, দৈন্যতা ছিলো। তবে একে অপরের সহমর্মিতা আর সহযোগিতার পরশে জীবনে সন্তুষ্টি বোধ ছিলো। তখনো উঁচু-নিচু, জাতপাত ছিলো। তবে তা ধারাপাত মেনে চলত। মানবিক ও ধর্মীয় দীক্ষা জনগোষ্ঠীর সেই অসম অবস্থাকে দুর্বিষহ হতে দিত না। তখনো স্বার্থের বীজ ছিলো, তবে তা আজকের মত এত মহীরুহ হয়ে উঠেনি। আজ পারিবারিক বন্ধন ঢিলেঢালা আর সামাজিক বন্ধন নানারূপ ব্র্যাকেটে আবদ্ধ।
তখন শিক্ষার তেমন প্রসার ছিলো না। তবে আলোকিত মানুষ ছিলো। আজ চারিদিকে শিক্ষার ছড়াছড়ি, কিন্তু আলোকিত মানুষ খুব কম। তখন খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ, বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘন ঘন হানা দিত। সমাজ একতাবদ্ধ হয়ে তা সাহসের সাথে মোকাবেলাও করত। তখনো দুবৃত্তদের দুর্বৃত্তপনা ছিলো। তবে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থা কঠোর থাকায় তা অন্ধকারের কারবার হিসেবে চিহ্নিত হত। তখনো প্রেম-ভালোবাসার বাগান ছিলো। নানারূপ ফুল আর ভ্রমরের বিচরণ ছিলো। আড়াল-আবডাল ছিলো। নিষেধের বেড়াজাল ছিলো। এর মধ্যেই চকিত চাহনির আকুতি ছিলো। পত্র চালাচালির সুযোগের অপেক্ষা ছিলো। আর দেখা-সাক্ষাতের দুর্লভ মুহুর্ত ছিলো পরম পাওয়া। আর এখন দেশ জুড়ে ভালোবাসার উন্মুক্ত কানন, কোথাও কোন রাখঢাক নেই। নিষেধের রক্তচক্ষু নেই। ভালোবাসা আজ অতিলভ্য পণ্য। যেন চাহিবা মাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য। মুহূর্তেই প্রেম, পরক্ষণেই ব্রেক আপ। রয়েছে পরকীয়ার ছড়াছড়ি। শিক্ষকদের আচরণ ছিলো কঠোর অথচ অভিভাবক সুলভ। মান্যগণ্যতা ছিলো অপরিসীম। আজ শিক্ষক ভক্ষক রূপে ভয়ানক অতিশয়। মোটকথা তখন সমাজের এক অংশের সাথে অন্য অংশের বোঝাপড়া ছিলো সুনির্দিষ্ট ও অনুসরণীয়। আজ ছাড়াছাড়া ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট।
তখনো সামাজিক অনাচার ছিলো, জোরজবরদস্তি ছিলো। জুলুম-নির্যাতন ছিলো, শোষণ আর বৈষম্য ছিলো। সামাজিক বিচার ব্যবস্থা যথাযথ ছিলো। আবার বাছবিচারও ছিলো। তবে অপরাধী মাথা নিচু করে আড়ালে আবডালে অন্ধকারে চলাফেরা করত। নিম্নকণ্ঠ থাকত। সমাজের উচ্চাসন পেতে তার আবদার-খায়েস ছিলো না বললেই চলে। আজ সর্বত্র অবিচারের খেলা। অপরাধীরা আজ মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়ায়। তাদেও ছাড়া মঞ্চের শোভা বর্ধন হয়না। তখন সামাজিক আচার অনুষ্ঠান প্রাণবন্ত ও আন্তরিক ছিলো। সমাজের সবার অংশগ্রহণে সম্পর্ক পুন:পুন: নবায়িত হতো। আন্তরিকতা ও নৈকট্য বৃদ্ধি পেতো। আজ পৃথক পৃথক বলয় তেরি হয়েছে। বলয়ের বাইরে সম্পর্ক বৈরিতার। সে অনেক কথা। নষ্টালজিক সে সময়ের কথা বলে শেষ করা যাবে না। তখনো দু:খ ছিলো, দুর্দশা ছিলো, যাতনা-বঞ্চনা ছিলো। রোগ-শোক, জরা ব্যাধির তীব্রতা ছিলো। চিকিৎসা সংকট প্রকট ছিলো। শিক্ষার সুযোগে কমতি ছিলো। সমতার বিধানে ঘাটতি ছিলো। রাস্তা-ঘাট, যাতায়াতে ভোগান্তি ছিলো। খাদ্যাভাব ছিলো। সুষম বন্টনে কমতি ছিলো। তবু সমাজে প্রেম-ভালোবাসার মাধুর্যতা ছিলো, আন্তরিকতার সুশীতল পরশ ছিলো। সন্তোষ বোধ ছিল সবার পথ চলার ‘চালিকা শক্তি’। এখন সর্বত্র নাই নাই এর রাক্ষুসে অতৃপ্তিবোধ।
আজকের প্রেক্ষাপট ভিন্ন সাজে সেজেছে। নতুন ক্যানভাসে সর্বত্র আধুনিকায়নের প্রলেপ পড়েছে। জীবন চলার গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ডামাডোলের স্পন্দনে চারিদিক মুখরিত হচ্ছে। ইতিউতি ছুটাছুটি বেড়েছে। জীবিকার অন্বেষনে মানুষজন পাগলপারা হয়ে উর্ধশ্বাসে ছুটছে। জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রচুর টাকা কামাই করা। ডলার পাউন্ড হলে মারহাবা। আজ জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রচুর টাকা কামাই করা। ডলার পাউন্ড হলে মারহাবা। অন্য কিছু হলেও ক্ষতি নাই। সর্বত্র টাকা কামানোর ধান্ধা। এই প্রতিযোগিতায় জোন নির্ধারিত ব্যাকরণ নেই। ব্যাকরণ মানলে উপার্জনের ভল্ট খা খা করবে। নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর মত ছা পোষা জীবন নিয়ে সরীসৃপের মত মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে। নিচে পিষ্ট হয়ে আহত-নিহত হওয়ার আশংকা প্রবল। আর উপরের আকাশ দেখার পরহ বন্ধ। আজকে শিক্ষার মূল্য আছে কি নেই তা নিয়ে জব্বর বিতর্ক চলতে পারে। কিছু লোক শিক্ষায় ভর করে খাচ্ছে সত্য। তবে অনেকেই বিদ্যা-শিক্ষার ঘরে তালা মেরে আজ শিরোমণি হয়ে আসন করে নিচ্ছে সহজেই। আজ প্রাত্যহিক এরূপ অসংখ্য যাতনা নিয়েও মুখে প্লাস্টিকের হাসি নিয়ে তবু বলতে হয়, ভালো আছি।
যোগ্যরা অযোগ্যদের অনুগামী হচ্ছে নয়ত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বদলে যাওয়া আকাশের রঙ দেখছে। ভালো বলে যার ইমেজ সাধারণ্যে সমাদৃত, রাষ্ট্রে তার কদর নেই। যার কোন ইমেজ নেই বা কালো ছায়া যার নিত্য সঙ্গী তার আসর তত বেশি আলোকিত ও সু উচ্চ। আজকাল শিল্প-সাহিত্যের বড় মাপের কেউ নেই। যারা ছিলেন তাদের অনেকেই এখন নিভৃতচারী অথবা অনেকে কীর্তনেই বেশুমার লাভ ভেবে বশংবদ।
সৃজনশীল কর্মে এখন আর কোন পৃষ্ঠপোষকতা নেই। আছে কনসার্টে আর ভাড়া করা বিদেশি শিল্পীদের জন্য বিশাল আয়োজন। টক শো তে আজ যারা গলা চড়িয়ে কথা বলে পাবলিক তাদেরকে চিনে না বা ভালো জানে না। আর যাদেরকে পাবলিক চিনে অথচ মনে মনে ধিক্কার দেয় তারাই দখল করে রাখে চ্যানেল গুলোর রাতের টেবিল। আর যাদেরকে পাবলিক ভালো জানে, নিজেদের কন্ঠ-প্রতিনিধি জ্ঞান করে তাদের স্থান কালো তালিকায় অথবা তাদের জন্য নির্ধারিত থাকে সঞ্চালক সমেত দলবাজদের মিলিত কোরাস-ভর্ৎসনা।
এখানে এখন সুরের চেয়ে উচ্চস্বরের কদর বেশি। মেধার চেয়ে মোসাহেবির দাম চড়া। যে যত বেশি শিক্ষিত সে তত বেশি ফন্দিবাজ, ধড়িবাজ, দলবাজ, চাপাবাজ। যে যত অর্ধ শিক্ষিত তার প্রভাব ততবেশি উল্লেখযোগ্য। তারা শোনায়, পাবলিক শুনে। তারা দেখায়, পাবলিক দেখে। বাস্তবে সার্কাস বিলুপ্ত হলেও এরা বিনোদন প্রদায়ক হিসেবে আজ খুব সফল। সিঁধ কাটতে খুব পারদর্শী। ভল্ট স্থানান্তরে অগ্রণী। আরেকদল আছে, পজিটিভ চেতনাধারী। কিছু পায়, তাই এক সুরে গান গায়। উন্নয়নের কোরাস তাদের কণ্ঠে অষ্টপ্রহর উচ্চস্বরে বাজতে থাকে। এদের চোখের পর্দা কম, গায়ের চামড়া মোটা। প্রভু যা বলে এরা বলে তার হাজার গুণ। এদের দাপটে পাবলিক আজ খামোশ। তাই আজ কোথাও কোন বিপরীত স্রোত নেই, দখিনা বাতাস ভিন্ন অন্য কোন প্রবাহ নেই। তাই, এক চিমটি দেশ প্রেমের ছবক, এক চিমটি দাসত্বের নিমক আর এক চিমটি চেতনার তবক দিয়ে ঘুটা মেরে তৈরি করা ককটেল পানীয় আজ সকল কিছুর দাওয়াই হিসেবে গলাধঃকরণের নতুন আবিষ্কৃত প্রেসক্রিপশন।
দিবসের পর দিবস আসছে। ঘটা করে তা পালনও করা হচ্ছে। মুখে মুখে শপথের বুলিও কপচানো হচ্ছে। সবাই আনুষ্ঠানিকতায় খাঁটি দেশ প্রেমিক অথচ নেপথ্যে দুরাচারী অতিশয়। খেলারাম খেলে যাচ্ছে, শোনা উল্লা শুনে যাচ্ছে। বকা বড়ুয়া বকেই যাচ্ছে। আর হাঁদারাম পাবলিক চৈতন্যে তালা মেরে বিনে পয়সার সার্কাস দেখছে। চোখের সামনে দিয়ে এমনি করেই দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে। আর দেনাপাওনার কথা থেকেই যাচ্ছে। আমাদের হুঁশ আর কবে হবে? সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
সারাবাংলা/এজেডএস