বাঙালির মানস কন্যা সুচিত্রা সেন: কর্ম ও জীবন
৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৪৫
রমা দাশগুপ্ত। তৎকালীন পাবনা জেলাতেই সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানায় মাতুলালয়ে, ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল তার জন্ম। রমা ছিলেন করুণাময় দাশগুপ্তর পঞ্চম সন্তান। করুণাময় চাকরি করতেন পাবনা পৌরসভায় স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদে। আজীবন তিনি ঐ পৌরসভাতেই কর্মরত থেকে পাকিস্তান হলে দেশ ত্যাগ করেন। পাবনা শহরের বর্তমান পুরাতন পলিটেকনিকের সামনে হেমসাগর লেনের এই বাড়িতেই পরিবার নিয়ে থাকতেন তিনি। পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার এক তলা পাকা পৈতৃক বাড়িতে রমা দাস গুপ্তের (আজকের সুচিত্রা সেন) শিশু কাল, শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। তার স্কুলে ভর্তি করার সময় আরো একটি নাম রাখেন কৃষ্ণা দাশ গুপ্ত। তার সমবয়সীরা তাকে কৃষ্ণা এবং কমবয়সীরা কৃষ্ণাদি বলে ডাকতেন। শহরের মহাকালী পাঠশালায় পড়ালেখা শেষে রমা দাস গুপ্ত (সুচিত্রা সেন) স্থানীয় পাবনা বালিকা বিদ্যালয়ে (বর্তমান সরকারী) নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। পাবনায় আট থেকে দশ জন তার ঘনিষ্ঠ স্কুল-বান্ধবী ছিলেন। এদের মধ্যে মঞ্জুশ্রী ও সিরাজুন নেছা খানমের সাথে ছিল বেশী ঘনিষ্ঠতা। পড়ালেখায় খুব একটা মনোযোগী ও মেধাবী ছিলেন না সুচিত্রা সেন। তার গান, নাটক, অভিনয় প্রিয় ও পছন্দের ছিল। পাবনা শহরের নানা অনুষ্ঠানে গান গাওয়া ও নাটক থিয়েটারে তিনি অভিনয়ে দক্ষতা দেখান। বাংলার গভর্নর জন এন্ডারসন এর স্ত্রী উইলি এন্ডারসন পাবনা বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শনে আসলে তার সম্মানে কৃষ্ণার নেতৃত্বে (সুচিত্রা সেন) সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ‘ঋতুরঙ্গ’ মঞ্চস্থ হয়। সুচিত্রার পিসি (ফুফু) বাণী দাশ গুপ্ত এই বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন। তিনি নাচ গান ও অভিনয়ের শিক্ষা দিতেন। উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া রমা দাস গুপ্ত (সুচিত্রা সেনের) ওপর বাবা-মায়ের একটু বাড়তি আদর-সোহাগ-স্নেহ ছিল। আবার বাড়তি শাসনও ছিল।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ-পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা। পরিণতিস্বরূপ নিজস্ব বাড়ি ঘর ফেলে রেখে সপরিবারে করুণাময় দাস গুপ্তের দেশ ত্যাগ এবং অত্যন্ত কম বয়সেই তার সুন্দরী প্রতিভাময়ী কন্যার মার বিয়ে। মাত্র ১৬ বছর ছিল তার বয়স তৎকালীন ঢাকার বিশিষ্ট ধনাঢ্য শিল্পপতি আদিনাথ সেনের ছেলে দিবানাথ সেনের সাথে ১৯৪৭ সালে বিয়ের পর থেকেই সুচিত্রা সেন (দাস গুপ্ত শেষ হলো বিয়ের পরই) স্থায়ীভাবে কলকাতার বাসিন্দা হন। অভিনয় শিল্পের প্রতি শৈশবেই পাবনা গার্লস স্কুলে পড়ার সময় থেকেই আকৃষ্ট হয়েছিলেন সুচিত্রা-বিয়ের পরে কলকাতায় বৃহত্তর পরিসরে সুচিত্রা সেনের জীবনের তার জীবনের পরম প্রিয় আরাধ্য অভিনয় অঙ্গনে ঢুকবার অপূর্ব সুযোগ পেয়ে যান। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে তিনি একবার পাবনায় এসেছিলেন। আর বিয়ের পর স্বামীর পদবিতে রমা দাশ গুপ্ত হয়ে যান রমা সেন এবং সিনেমায় নাম পরিবর্তন হয়ে যান সুচিত্রা সেন।
আড়াই বছরের মাথায় ১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ নামের একটি বাংলা ছবিতে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। অজ্ঞাত কারণে ছবিটি মুক্তি পায়নি। এরপর ১৯৫৩ সালে নায়িকা হয়ে তার অভিনীত প্রথম ছবি ‘সাত নম্বর কয়েদি’ ছবিটি মুক্তি পায়। ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ৩৫ বছর সুচিত্রা সেন নিজেকে সিনেমার অভিনয়ে জড়িত রেখেছিলেন। স্বামী দিবানাথ সেনের প্রবল আপত্তি থাকলেও সুচিত্রা সেন মনের তাগিদে নিজেকে অভিনয়ে জড়িত রেখে ছিলেন। ‘সাত নম্বর কয়েদি’ ছবির পরিচালক ছিলেন সুকুমার দাশ গুপ্ত। তারই একজন সহকারী পরিচালক নীতিশ রায় এ ছবিতে অভিনয় করার পর ছবি মুক্তির সময় রমা নাম বদলে নাম দেন সুচিত্রা সেন। এরপর থেকেই কিশোরী বেলার বান্ধবীদের কৃষ্ণাদি বাবা-মায়ের দেয়া নাম রমা দাশ গুপ্ত থেকে স্বামীর পদবি নিয়ে রমা সেন সবশেষে স্বপ্ন সুন্দরী সুচিত্রা সেন। সাত নম্বর কয়েদি ছবির নায়ক ছিলেন সমর রায়। সুচিত্রা সেন বাংলা ৫৬টি ও ৭টি হিন্দি মিলে মোট ৬৩টি ছবিতে নায়িকা হয়ে অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে ৩২টি ছবিতেই নায়ক ছিলেন উত্তম কুমার। উত্তম কুমারের সঙ্গে ১৯৫৩ সালে প্রথম ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে সুচিত্রা সেন নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৭৫ সালে উত্তম-সুচিত্রা জুটির শেষ ছবি ‘প্রিয় বান্ধবী’ মুক্তি পায়। সুচিত্রা শেষ অভিনীত সর্বশেষ ছবি ‘প্রণয় পাশা’ মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। এ ছবির নায়ক ছিলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সুচিত্রা অভিনীত ৭টি ছবিতে বিকাশ রায় এবং ৫টিতে বসন্ত চৌধুরী নায়ক ছিলেন। একসময় পাবনা থেকে কেউ কলকাতা গিয়ে সহজেই সুচিত্রা সেন এর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারতেন। তিনি তাদের কাছে পাবনা শহর, পুরনো বান্ধবীদের চেনা-জানা ব্যক্তিদের খোঁজ খবর আগ্রহভরে জিজ্ঞাসা করে জানতেন। ১৯৭৮ সালে সিনেমায় অভিনয় বন্ধ করে দেয়ার পর থেকেই তিনি আর কারো সাক্ষাৎ দেননা।
সুচিত্রা সেন নামটিতেই যে অনিন্দ্য সুন্দর অবয়ব ভেসে ওঠে, তাঁর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে রূপকথার রাজকন্যাকে। কোনো এক পরীর জাদুতেই হয়তো সুচিত্রা জয় করে নিয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষের মন। সুচিত্রার চিবুকের তিল, সুবিন্যন্ত দাঁত, টিকালো নাকের চেয়েও দর্শক ভালোবেসেছিলেন তাঁর বাঙ্ময় চোখ আর সেই চোখের ভাষা। থ্রি কোয়ার্টার হাতার কাজ করা ব্লাউজ, শাড়িতে লেস এমনকি শুধু বেণি বাঁধা চুলকে সামনে নিয়ে আসার স্টাইলে পঞ্চাশের দশকেও সুচিত্রা পুরোপুরি আধুনিক। আটপৌরে বাঙালি নারীও যে আবেদনময়ী আর অনন্য হয়ে উঠতে পারেন, সুচিত্রা সেন যেন তাঁর প্রকৃত উদাহরণ। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জ্যাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। সুচিত্রা সেনের একমাত্র কন্যা মুনমুন সেন একজন মায়ের মত চলচ্চিত্র শিল্পিী। ২০১৪ সালে ১৭ই এপ্রিল ৮২ বছর বয়সে তিনি ইহলোক ত্যাগ করে পরলোকে গমন করেন। ৬ই এপ্রিল ছিল তার জন্মদিন এবং পাবনাবাসী তাকে এই দিনে অতি শ্রদ্ধা ভরে তাকে স্মরন করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
লেখক: গবেষক, অর্থনীতিবিদ
সারাবাংলা/এসবিডিই
ড. মিহির কুমার রায় বাঙালির মানস সুচিত্রা সেন: কর্ম ও জীবন মুক্তমত