ঈদের নামাজের পূর্বেই ফিতরা আদায় করুন
৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৫৮
ঈদুল ফিতর মুসলমানদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসবের একটি। ‘ঈদ’ অর্থ উৎসব বা আনন্দ। ‘ফিতর’ অর্থ বিদীর্ণ করা, উপবাস ভঙ্গ করা, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া।
পবিত্র রমজানে মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা ও সংযম পালনের পর শাওয়াল মাসের ১ তারিখে স্বাভাবিক কর্মজীবনে ফিরে যাওয়ার দিনটিই ঈদুল ফিতর। পবিত্র রমজানের এক মাস কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য—এসব রিপুর চর্চা থেকে নিজেকে বিরত রাখার সাধনা চলে।
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের পরই ঈদুল ফিতর উৎসব পালন শুরু হয়। হজরত আনাস (রা.) বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায় যে নবী করিম (সা.) মদিনায় এসে জানলেন, মদিনাবাসী বছরের দুটি দিনে আনন্দ-উল্লাস করে থাকে। জিজ্ঞাসা করে তিনি আরও জানলেন, ইসলামপূর্ব যুগ থেকেই এই দুটি দিনকে তারা উৎসবের দিন হিসেবে পালন করে। রাসুল (সা.) তাঁদের বললেন, আল্লাহ তোমাদের এই দুইটি দিনের বদলে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন। দিন দুটি হলো ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর।পবিত্র রমজানের পুরো এক মাস রোজা এবং সংশ্লিষ্ট ইবাদত ও বিধিনিষেধ পালনের পর শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে ঈদ উৎসব পালিত হয়। এ দিনের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে জামাতে ঈদের নামাজ আদায়, গরিব-দুঃখীদের মধ্যে ফিতরা বিতরণ এবং ভালো খাওয়া–দাওয়ার আয়োজন।
ঈদুল ফিতর উৎসবের একটি তাৎপর্যময় অঙ্গ হলো ফিতরা বিতরণ। রোজার সময় সংযম সাধনায় কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি ঘটে থাকলে তা সংশোধন এবং সমাজের সর্বস্তরের লোক যাতে উৎসবে অংশগ্রহণ করতে পারে, সে জন্য গরিব-দুঃখীদের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট হারে সদকায়ে ফিতরা বিতরণ করতে হয়।
প্রত্যেক সমর্থ্য মুসলমানের জন্য ফিতরা দেওয়া ওয়াজিব। মাথাপিছু কত টাকা ফিতরা দিতে হবে, তা আগেই ইসলামিক রাষ্ট্র কিংবা সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে দেয়। নিয়ম হলো ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগেই এই ফিতরা পরিশোধ করতে হবে। তারপর ঈদগাহ কিংবা তার অভাবে বড় মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করতে হয়। ফিতরা দেওয়া ছাড়াও গরিবদের সাধ্যমতো খাদ্য ও বস্ত্র ইত্যাদি দেওয়া উত্তম।
ঈদুল ফিতরের নামাজে অতিরিক্ত ছয় তকবিরসহ দু’রাকাত ওয়াজিব নামাজ পড়তে হয়। নামাজের শেষে ইমাম সাহেব পর পর দুটি খুতবা পড়েন। নামাজ শেষে মুসলমানরা উচ্চ–নিচ, ধনী–গরিব ও বয়সনির্বিশেষে পরস্পরের সঙ্গে কোলাকুলি, সালাম ও কুশল বিনিময় করে। এ ছাড়া অনেকে এ দিন আত্মীয়স্বজন ও পুণ্যবানদের কবরও জিয়ারত করে।পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে যে সব প্রধান ধর্মীয় উৎসব উদযাপিত হয় সেগুলির মধ্যে ঈদুল ফিত্র হচ্ছে কনিষ্ঠতম৷ এ মহান পুণ্যময় দিবসের উদযাপন শুরু হয় আজ থেকে মাত্র ১৩৮০ সৌর বছর পূর্বে৷ প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মদীনাতে হিজরত-এর অব্যবহিত পরেই ঈদুল ফিত্র উৎসব পালন শুরু হয়৷ হযরত আনাস (রা.) বর্ণিত একটি হাদীস থেকে জানা যায়, নবী করিম (সা.) মদীনা আগমন করে দেখলেন মদীনাবাসীগণ দুই দিবসে আনন্দ-উল্লাস করে থাকে৷ মহানবী (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, এ দিবসদ্বয় কি? ওরা বলল, জাহেলী যুগ থেকেই এ দুটি দিবসে আনন্দ-উল্লাস করে থাকি৷ তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, “আল্লাহ তোমাদেরকে উক্ত দিবসদ্বয়ের পরিবর্তে উত্তম দুটি দিবস দান করেছেন৷ দিবসদ্বয় হলো ঈদুল আযহার দিবস ও ঈদুল ফিত্রের দিবস৷ (সুনান আবূ দাউদ, কিতাবুল ঈদায়ন)’’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পারসিক প্রভাবে শরতের পূর্ণিমার নওরোয নামে এবং বসন্তের পূর্ণিমার মিহিরজান নামে উৎসব দুটি মদীনাবাসীরা বিভিন্ন ধরনের আনন্দ-আহ্লাদ, খেলাধুলা ও কুরুচিপূর্ণ রংতামাশার মাধ্যমে উদযাপন করত৷ উৎসব দুটির রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার ছিল সম্পূর্ণরূপে ইসলামের আদর্শ পরিপন্থী৷ জরথুস্ত্র প্রবর্তিত নওরোয ছিল নববর্ষের উৎসব৷ কিন্তু এটি ছয়দিন ব্যাপী উদযাপিত হতো যার মধ্যে শুধুমাত্র একটি দিবস নওরোয-এ-আম্মা বা কুসাক ছিল সাধারণ মানুষের জন্য নির্দিষ্ট৷ অন্যান্য দিনগুলি ছিল সম্ভ্রান্ত ও উচ্চবিত্তের ব্যক্তিবর্গের জন্য সুনির্দিষ্ট৷ অনুরূপভাবে ৬ (ছয়) দিনব্যাপী মিহিরজান অনুষ্ঠানেও শুধুমাত্র একটি দিন সাধারণ, দরিদ্র মানুষেরা উপভোগ করতে পারত৷ শ্রেণি বৈষম্য, ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে কৃত্রিম পার্থক্য, ঐশ্বর্য-অহমিকা ও অশালীনতার পূর্ণ প্রকাশে কলুষিত ছিল এ দুটি উৎসব৷ ইসলামী আদর্শে উজ্জীবিত আরববাসীরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশে শুরু করল ঈদুল ফিত্র ও ঈদুল আযহা উৎসব উদযাপন৷ জন্ম নিল শ্রেণি বৈষম্য বিবর্জিত, পঙ্কিলতা ও অশালীনতামুক্ত সুনির্মল আনন্দে ভরা সুস্নিগ্ধ, প্রীতি-সঘন মিলন উৎসব ঈদুল ফিত্র৷ উল্লেখ্য যে, ইসলাম ধর্মীয় উৎসব বলে ঈদুল ফিত্র প্রধানত মুসলমানদের মধ্যেই সীমিত থাকে৷ তবে, ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম এবং ঈদের অর্থ আনন্দ বিধায় প্রকারান্তরে ঈদ সকল মানবের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে৷ মুসলিমরা ঈদুল ফিতরের দিন বেশ কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন করে থাকে৷ ঈদের দিন রোজা রাখা নিষিদ্ধ এবং এই দিনটির জন্য একটি নির্দিষ্ট নামাজও মনোনীত করা হয়েছে। দান-খয়রাতের একটি বাধ্যতামূলক কাজ হিসেবে ‘ঈদের নামাজে’ যাবার আগে গরিব ও অভাবীকে অর্থ (যাকাত উল ফিতর নামে পরিচিত) প্রদান করা হয়৷ রমযান মাসের রোজার ভুলত্রুটির দূর করার জন্যে ঈদের দিন অভাবী বা দুস্থদের কাছে অর্থ প্রদান করা হয়, যেটিকে ফিতরা বলা হয়ে থাকে৷ এটি প্রদান করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব৷ ঈদের নামাজের পূর্বেই ফিতরা আদায় করার বিধান রয়েছে৷ তবে ভুলক্রমে নামাজ পড়া হয়ে গেলেও ফিতরা আদায় করার নির্দেশ ইসলামে রয়েছে৷ ফিতরার ন্যূনতম পরিমাণ ইসলামি বিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট৷ সাধারণত ফিতরা নির্দিষ্ট পরিমাণ আটা বা অন্য শস্যের (যেমন: যব, কিসমিস) মূল্যের ভিত্তিতে হিসাব করা হয়৷ সচরাচর আড়াই সের আটার স্থানীয় মূল্যের ভিত্তিতে ন্যূনতম ফিতরার পরিমাণ নিরূপণ করা হয়৷ স্বীয় গোলামের ওপর মালিক কর্তৃক ফিতরা আদায়যোগ্য হলেও বাসার চাকর/চাকরানি অর্থাৎ কাজের লোকের ওপর ফিতরা আদায়যোগ্য নয়; বরং তাকে ফিতরা দেয়া যেতে পারে৷ ইসলামে নিয়ম অনুযায়ী, যাকাত পাওয়ার যোগ্যরাই ফিতরা লাভের যোগ্য৷
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই