অ্যারিস্টটল থেকে বুয়েট
৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:৫১
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাচীন পুরুষ অ্যারিস্টটল বলেছেন, মানুষ আসলে রাজনৈতিক জীব। অথচ আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া ইদানিং ভেসে যাচ্ছে বিরাজনীতিকরণের স্রোতে। বেশিরভাগ গণমাধ্যম একপেশে হয়ে আছে বিরাজনীতির দিকে। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা বেশিরভাগ চুপ। কারণ আর কিছু নয়, কথা বললে তো রাজনীতির পক্ষে বলতে হবে। কারণ যত জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন সবই রাজনীতি চর্চার পক্ষে। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে সেই পক্ষে বাতাস বইছে না। তাই বাতাসের বিপক্ষে কথা বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোল হওয়ার ঝুঁকি নিতে চান না অনেকেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে রাজনীতির নামে অপকৌশলের চর্চা চলবে সেটা মেনে নেয়াও কঠিন।
রাজনীতি-বিরাজনীতি নিয়ে অনেক কথাই হয়তো বলা যায়। কিন্তু সেটা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি আসতে চাই, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের আন্দোলনে। তার আগে আলোচনার সুবিধার জন্যে দেখে নিতে চাই রাজনীতি জিনিসটা কী। একসময় বিতর্ক উঠেছিল এটা নীতির রাজা না রাজার নীতি। রাজার নীতির পক্ষেও রাজদরবারের লোকজন ছিল। কিন্তু ‘নীতির রাজা’ নিয়ে শক্ত দর্শন এবং জনমতের কাছে টিকতে পারেনি ‘রাজার নীতি’। এরপর থেকে রাজনীতি শব্দটার অর্থ অনেকটা এরকম দাঁড়ায় যে, রাষ্ট্র বা দেশ চালানোর সুন্দর পদ্ধতি হচ্ছে রাজনীতি। আর সেই পদ্ধতিকে তখনই সুন্দর বলা হবে, যখন রাষ্ট্রের বেশিরভাগ মানুষ বলবে এটা আমাদের সুখী করেছে।
আসলে মানুষের সুখের জন্যে দেশ চালানোর যে পদ্ধতি সেটাই রাজনীতি। মানুষের সুখের জন্যে রাষ্ট্র সৃষ্টি। মানুষ না থাকলে রাষ্ট্র সৃষ্টির দরকার হতো না। তাই মানুষ যে রাজনৈতিক জীব এ নিয়ে যেমন কোনো সন্দেহ নেই, তেমনি আমাদের রাজনীতি লাগবে এর চেয়ে বড় সত্যিও নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে বুয়েটের মেধাবী ছেলে মেয়েদের একটি বড় অংশ কেন বলছে যে তারা রাজনীতি চর্চা করবে না। তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আরও অনেকেই বলছেন বুয়েটে মেধাবীদের জায়গা। বুয়েটে বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে আসে পড়াশোনা করতে। তারা রাজনীতি করতে চায় না।
খুব অবাক হলাম শুনে। খুব শ্রদ্ধেয় একজন মানুষ যখন রাজনীতির সঙ্গে পড়াশোনার কিংবা মেধার বিরোধ খুঁজে পান তখন, অবাক না হয়ে উপায় থাকে না। তত্ত্বীয়ভাবে কী এই বিরোধ থাকার কথা? নিশ্চয়ই নয়? কিন্তু বুয়েটের আন্দোলনরত ছেলে মেয়েরাও প্রায় একই রকম কথা বলছে। এর পক্ষের যুক্তি হিসেবে আবরার ফাহাদ হত্যার রেফারেন্স টানছে। সাবেকুন্নাহার সনি নামে আরেকটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হয়েছিল, সে প্রসঙ্গটি অবশ্য কেউ আনছে না। আমি আনলাম। দুটি দুর্ঘটনাই খুব দুঃখজনক। এরইমধ্যে আবরার হত্যায় ২০ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ এবং পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ হয়েছে। সনি হত্যার বিচার শেষ হয়নি।
এই দুটি হত্যাকাণ্ডের পরই বুয়েটে জোরেশোরে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি করে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। এর আগে এরকম দাবি ছিল না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বুয়েট শিক্ষার্থীদের দৃঢ় ভূমিকা ছিল। দেশের আজকের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণেও রয়েছে মেধাবী প্রকৌশলীরা। তাহলে কীভাবে এরকম ভাবছেন, আমাদের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা—বিষয়টি আমি বুঝতে পারছি না। তাই তাদের আন্দোলনের প্রতি সম্মান রেখেই প্রশ্ন করছি, মেধাবী রাজনীতিক ছাড়াই কী দেশ চলবে? বন্ধ করার বাইরে কোনো সমাধান নেই?
এবার আসতে চাই কেন বুয়েট থেকে এরকম দাবি উঠল? আবরার হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল বুয়েটে। পত্রপত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, রাত ১টায় ছাত্রলীগের সভাপতি বৃষ্টি থেকে বাঁচতে বুয়েটের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছিলেন। এর প্রতিবাদে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি একেবারে বন্ধের দাবি এসেছে। রেফারেন্স যথারীতি আবরার হত্যাকাণ্ড। ছাত্রলীগের ছেলেরা দাবি করছে, ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবির এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তহরিরের কার্যক্রম রয়েছে। তারা বড় রেফারেন্স হিসেবে সুনামগঞ্জের হাওরে গোপন বৈঠক করার সময় ৩৯ জন শিবির নেতা-কর্মীর গ্রেফতার হওয়ার খবরটি উল্লেখ করছে। যদিও আন্দোলন হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে।
এখানেই প্রশ্ন উঠছে আসলেই কী হচ্ছে বুয়েটে? ফেসবুক যতই ট্রল হোক কেউ এখনও নিশ্চিত করতে পারছে না যে, বুয়েটের ক্যাম্পাসে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম নেই। আছে শুধু ছাত্রলীগের নামে ট্রল। কিন্ত কারা এই ট্রল করছে? কেন সাবেকুন্নাহার সনির হত্যার বিচার হয়নি? এসব নিয়ে কোনো অনুসন্ধান নেই, কোনো খবরও নেই। কোনো বিবেচনা নেই। শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রল করে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার আন্দোলন। আমার তো মনে হচ্ছে, মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলার সেই মূল্যবান আপ্তবাক্যটি এখানে খুব যায়।
আসেন বিবেচনায় বসি। চলেন যার যার ক্যাম্পাসে ফিরে যাই। নিশ্চয়ই মনে আছে ছাত্রলীগ ছাত্রদলসহ প্রভাবশালী সব ছাত্র সংগঠনগুলোর কথা। প্রত্যেক দলে একটা গ্রুপ থাকে যারা শহরের মধ্যে সবচেয়ে জোরে মোটর বাইক চালায়। দোকান থেকে ফ্রি খায়। একে ওকে হুমকি দেয়। নেতাদেরও খুব একটা পাত্তা দেয় না। খুব অতিষ্ঠ হয়ে কাউকে বের করে দিলে সে যোগ দেয় বিপরীত দলে। এরা কে কখন কোন দলে যাবে, আর কে কোন দলে থাকে বোঝা মুশকিল। দলের আদর্শের কথা জিজ্ঞাসা করবেন, দেখবেন উল্টাপাল্টা বলছে। এদের আচরণ অনেকটা আজকের কিশোর গ্যাং-এর সঙ্গে মেলাতে পারেন।
এই গ্রুপের মূল লক্ষ্য ক্ষমতা বা প্রভাব। আওয়ামী লীগ সরকারি দল। তাই প্রভাব ছড়ানো যাদের লক্ষ্য তারা ছাত্রলীগেই বেশি ভিড়বে এটা জানা কথা। তবে আমার মনে হয় উদ্দেশ্যহীনভাবে যারা প্রভাব ছড়াতে দলে আসে তাদের যতটা দোষ, তাদের যারা দলে রাখে তাদের দোষ আরও বেশি। আজকে যারা আবরার হত্যায় জড়িত তাদের আচরণ সম্পর্কে যতদূর জেনেছি, তাদের আচরণও আজকের আলোচিত কিশোর গ্যাং এর মতো লাগে। যারা বিচার বিবেচনা ছাড়া একটা ছেলেকে এভাবে হত্যা করে তাদের তো দল থেকে বাদ দেওয়াই উচিত। যদিও এই অপরাধীরা এখন দল করবে কী, জীবন থেকে বাদ পড়ার শঙ্কায় পড়েছেন।
এখন তো বলাই যায় যে, গ্যাং শ্রেনীর ছেলেদের ছাড়াই সামনে এগোনো সহজ। কারণ নিশ্চয়ই কোনো সভ্য রাজনৈতিক দল এদের বোঝার মতো টানতে চাইবে না দিনের পর দিন। আবরার হত্যায় দোষীদের বিচার প্রক্রিয়াধীন। দ্রুত এগোচ্ছে বলা যায়। সেই ঘটনা ধরে একটি প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি উঠছে। বন্ধই কী সমাধান? তাহলে রাজনীতির চর্চার কী হবে? রাষ্ট্র চলবে না? মানুষ থাকবে তাই রাষ্ট্র থাকবে এবং রাজনীতিও চলবে। কোনো এক প্রলয়ে সব কিছু ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত রাজনীতি থাকবে। এর চেয়ে বড় সত্য আর নেই। রাষ্ট্র থাকলো রাজনীতিও থাকলো, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সেটা কল্যাণমূলক হবে কী না?
রাজনীতি কল্যাণমূলক হতে হলে অবশ্যই মেধাবী রাজনীতিক দরকার। মেধাবীদের রাজনীতি চর্চা বন্ধ হলে অমেধাবীদের অপচর্চা সামনে চলে আসবে। সেক্ষেত্রে বার বার বিপর্যয়ে পড়বে দেশ। তাই রাজনীতি বন্ধের আজকের দাবি মোটেও রাজনৈতিক নয়। মানুষ যেহেতু রাজনৈতিক জীব তাই এই দাবি নৈতিকও নয়। কারণ বুয়েটে পড়তে আসে দেশের সর্বোচ্চ মেধার ছেলে মেয়েরা। তারা নিজেদের ভালোমন্দ বুঝবে না, এটা হতেই পারে না। তার সমানে হাজারটা বৈধ পথ খোলা থাক। সে কোন পথে হাঁটবে নিজেই সিদ্ধান্ত নিক। আগেই যদি পথ বন্ধ করে বলা হয় হাঁটো তাহলে হাত পা বেঁধে সাঁতার কাটতে বলা মনে হয় না?
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী