পাহাড় রঙিন বিজু, বৈসু, সাংগ্রাইয়ে
১১ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:২৭
পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘরে ঘরে এখন বৈসুক-সাংগ্রাই-বিজু-বিহু-বিষু-সাংক্রানের উৎসবমুখর আমেজ শুরু হয়ে গিয়েছে। ইহা পার্বত্য অঞ্চলের বহু কাল ধরে চলে আসা প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সামাজিক একটি উৎসব। পুরনো বছরের সকল দুঃখ- কষ্ট- ব্যর্থতাকে পিছনে ফেলে নতুন বছরকে নতুনভাবে বরণ করে নতুন দিনের শুভসূচনার আকাঙ্ক্ষায় পাহাড়ের ঘরে ঘরে চলে ব্যাপক প্রস্তুতি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব বৈসুক-সাংগ্রাই-বিজু-বিহু-বিষু-সাংক্রান। ত্রিপুরারা এ উৎসবকে বলেন বৈসুক, মারমারা বলেন সাংগ্রাই, চাকমারা বলেন বিজু, অহমিয়ারা বলেন বিহু, তঞ্চঙ্গারা বলেন বিষু এবং খুমী, খিয়াং, ম্রোরা পালন করেন সাংক্রান নামে।
চৈত্র মাস শেষের আগের দিন, শেষ দিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন এই তিন দিন জুড়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উৎসব আয়োজন। চৈত্র মাস শেষের আগের দিনকে তারা ফুল বিজু নামে অভিহিত করেন। তাদের কিছু সুন্দর প্রথা রয়েছে যে পাহাড়ি ছেলে-নেয়েরা ভোরবেলা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফুল সংগ্রহ করে তা নদীতে ভাসিয়ে দিই। সারা বছরের সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে গিয়ে নব উদ্যমে বছর শুরু করার প্রত্যয় নিয়ে তারা প্রার্থনা করে থাকে। তারপর পরই শুরু হয় মূল বিজুর আয়োজন।
বিজুর আমেজ শুধু ছোটদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং এতে ছোট-বড় বৃদ্ধ-যোয়ান সকলেই আনন্দ উৎসব পালন করে থাকে। নদীতে ফুল ভাসানোর পর তারা ঘর সাজিয়ে থাকে হরেক রকম ফুল দিয়ে। এছাড়াও শুনেছি ফুল বিঝুর দিন ছোটরা সকলে মিলে বাড়ির বৃদ্ধদের স্নান করিয়ে দেয়। এতে করে তাদের বন্ধন দৃঢ় হয় এবং অশেষ পুণ্য সঞ্চিত হয়।পাহাড়ের এই সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য শহরাঞ্চলে পাওয়া খুবই বিরল। তাই তো প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক আসেন তাদের দেখতে জানতে। পার্বত্য অঞ্চলে থাকা প্রতিটি মানুষ এই উৎসবকে নিজের মনে করে সকলের সাথে উৎযাপন করেন।
এবার আসি মূল বিজুর পর্বে, চৈত্র মাসের শেষদিনটা হলো মূল বিজু। এদিনেই মূল উৎসব। এদিনে সর্বত্র যেন বয়ে বেড়ায় সীমাহীন আনন্দধারা। চারদিক থেকে শোনা যায় বিশেষ প্রফুল্লধ্বনি। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা মেতে ওঠে অনাবিল আনন্দে। দিনব্যাপী ঘরে ঘরে নানান পিঠা, পানীয়, খানাপিনার আয়োজন চলে। চারদিকে প্রফুল্লতার আমেজে বয়ে যায় সমুজ্জ্বল সুবাতাস। মূল বিজুর দিনে প্রধান আকর্ষণ হলো পাজন যা ৩২ রকম পদ দিয়ে রান্না করা হয়।
বন-পাহাড় থেকে সংগ্রহ করা নানা রকম পাহাড়ি বনজ সবজি দিয়ে রান্না করা হয় ‘পাজন’ নামের বিশেষ তরকারি। এই দিনে একটি বিশেষ প্রথা প্রচলিত রয়েছে যে, সবার জন্যই কমপক্ষে সাতটি ঘরের ‘পাজন’ খেতে হয়।তারা বিশ্বাস করেন এতে শরীরে কোনো রোগ-ব্যাধি সহজে বাসা বাঁধতে পারে না। ‘পাজন’ ছাড়াও প্রতিটি ঘরে পরিবেশন করা হয় নানান পিঠা, যেমন বিন্নি চাল দিয়ে বানানো ‘বড়া পিদে’, ‘বিনিহোগা’, কলাপাতা দিয়ে বানানো ‘কলাপিদে’ কিংবা আতপ চালের গুঁড়া, তালের রস এবং গুড় দিয়ে বানানো ‘সান্ন্যেপিদে’। এছাড়া বয়োজ্যেষ্ঠজন বা অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয় বিশেষ পানীয় দিয়ে।
বিজুর দিনে সকলে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সবার বাড়িতে যায়। কারণ, বিজুর দিন কেউ কাউকে নিমন্ত্রণ করে না, যদিও আজকাল নিমন্ত্রণের রীতিও চলে আসছে। একে-অপরের বাড়িতে বেড়ানোর ফলে নিজেদের মাঝে সম্পর্ক গভীর হয়। মূলত বিজু আমাদের সামাজিক হওয়ার প্রেরণা জোগায়।
এরপর দিন হলো নতুন বছরের প্রথম দিন। মানে পহেলা বৈশাখ। যাকে চাকমারা গোজ্যেপোজ্যে নামে অবিহিত করেছে। এদিনে সবাই নতুন সাজে নতুন রঙ্গে বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে সব জীবের প্রতি মৈত্রী ও মঙ্গল কামনা করে থাকে। কেউ–বা ঘরে ধর্মীয় গুরুকে ডেকে মঙ্গলসূত্র শ্রবণ করেন। এদিন নতুন চালের ভাত ও মাছ-মাংস দিয়ে ভোজন করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, এদিন যদি ভোজন ভালো হয়, তাহলে পুরো বছরের ভোজনে কোনো রকম কমতি হবে না। সন্ধ্যায় বাড়িতে বাড়িতে পৃথিবী হতে অন্ধকার দূর করণে প্রদীপ জ্বালানো হয়।
নতুন বছরকে আদিবাসীগণ ঠিক এই ভাবেই বরণ করে নেন। পুরনো দিনের সকল অপ্রাপ্তি কাটিয়ে উঠে সকল দুঃখ-কষ্ট- দুশ্চিন্তাকে পেছনে ফেলে নববর্ষে সবকিছু নতুন করে সাজিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করে। পার্বত্য অঞ্চলে থাকা প্রতিটি মানুষ এই উৎসবে অংশ নেয় । সকলে সকলের সাথে আনন্দ-কষ্ট ভাগ করেন নিয়েই নতুন বছরকে বরণ করেন।
লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট
সারাবাংলা/এসবিডিই