প্রজন্মের জন্য দুই মহাবিপদ
১৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:১৬
চলতি মাসে দেশে আলোচিত ঘটনার একটি হলো, বাবার হাতে মাদকাসক্ত ছেলের খুনের ঘটনা। সত্যিই এটি আইনের চোখে অপরাধ। ব্যক্তি যতোই অপরাধ করুক না কেন, তাকে হত্যার অধিকার তো কারো নেই। অপরাধীর বিচারের জন্য আইন আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে। তবে কেন বাবা সন্তানকে খুন করতে গেলেন?
তাছাড়া পিতা পুত্রের সম্পর্ক তো এমন হওয়ার কথা নয়। ভালোবাসার বন্ধনের শক্তি কতোটা মজবুত তা একজন বাবাই বলতে পারবেন। কারণ তিনি তো সন্তানকে কোলে পিঠে করে, আলোর পথে নেয়ার নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়েছে। সুখে অসুখে-ভালো-মন্দে নিরবচ্ছিন্ন পাশে থেকেছেন। নিজে কষ্ট করেছেন ঠিক। কিন্তু সন্তানকে সব সময় আগলে রেখেছেন। কত বিনিদ্র রজনী এই সন্তানের জন্য বাবা-মাকে কাটাতে হয়, তা একজন সন্তান বাবা-মা না হওয়া পর্যন্ত বোঝতে পারে না। তাছাড়া সন্তান তো পিতা মাতার জন্য আশির্বাদ। অনেক প্রত্যাশার ফসল। তাকে খুন করার মতো এত নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তই বা বাবা কেন নিলেন?
ঘটনা গাজীপুরের কালীগঞ্জের। ঘুমন্ত সন্তানকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যায় কৃষক আব্দুর রশীদ বাগমারকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা আলোচনা চলছে। কেউ তার পক্ষে বলছেন। কেউবা বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরছেন। প্রশ্ন হলো কেন পিতা-পুত্রের আত্মার সম্পর্ক খুনের পর্যায়ে গেল?
সন্তান মাদকাসক্ত। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ এলাকাবাসীসহ পরিবারের লোকজন। ছেলের নেশা ও জোয়া খেলার টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে জমি-সম্পত্তি বিক্রি করে প্রায় নিঃস্ব পরিবার। যখন তখন টাকার তাগিদ। না পেলেই বাবা-মা সহ পরিবারের সদস্যদের গায়ে হাত তোলা। বাড়িতে ভাঙচুড় চালানো। যন্ত্রণা আর পারিবারিক অশান্তির মুখে বাবা যেন আর সইতে পারছিলেন না। ধৈর্যের সব বাঁধ ভেঙেছে তার। শেষ পর্যন্ত রাতে ঘুমন্ত ছেলেকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছেন তিনি। ঘটনার পর নিজ থেকেই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন আব্দুর রশীদ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অকপটে স্বীকার করেন খুনের কথা।
ঘটনার পর বাবার আর্তনাদে ভাড়ি হয়ে উঠেছিল এলাকার আকাশ বাতাস। প্রচ- অনুশোচনায় ভুগছিলেন তিনি। স্বজন হারানোর যন্ত্রণা তাকে রীতিমতো বেসামাল করে তুলেছিল। আদরের ছেলের মুখ না দেখে তিনি কিভাবে থাকবেন? সন্তানকে রেখে কিভাবে জেলে দিন কাটবে, একথা বলে বিলাপ করছিলেন এই বৃদ্ধ। মর্মান্তিক এই ঘটনার খবরে এলাকাবাসী যারা জড়ো হয়েছিলেন, সেদিন কেউ আর চোখের পানি আটকাতে পারেননি।
এই ঘটনা সমাজে কি বার্তা দিল? দেশজুড়ে এরকম ঘটনা একটিই? মোটেই না। এ ঘটনায় সমাজের দুটি বাস্তব চিত্র আবারো সামনে উঠে এসেছে। এর একটি হলো মোবাইল ফোনে জুয়ার বিস্তার। অপরটি নেশার ভয়াবহতা। বর্তমান নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে পরা মারাত্মক এই দুটি ব্যাধি এখন দেশ ছেয়েছে। প্রায় ঘরে ঘরে ভয়ঙ্কর রোগের সংক্রমণ ঘটেছে। আক্রান্ত হয়েছে দেশের সম্ভাবনাময় জনশক্তি। যা সত্যিই দুঃখজনক। চোখের সামনে একটি প্রজন্ম অন্ধকারের দিকে হারিয়ে যেতে বসেছে। অথচ সবাই কেমন নির্বিকার। কারো মুখে শব্দ নেই। প্রতিকারের চিন্তা নেই। ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে যাওয়া ক্ষতির এই উপসর্গ কাউকে পিড়া দিচ্ছে বলে মনে হয় না!
অথচ এই কারণে লাখ লাখ পরিবার অশান্তির দাবানলে জ¦লছে রাতদিন। সংসারে ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে। সম্পর্কের দূরত্ব বাড়ছে। আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে হাজারো পরিবার। কেউ কেউ মুখ বুজে তা সহ্য করছে। যেসব পরিবারে সহ্যের মাত্রা ছাড়াচ্ছে, সেখানে ঘটছে অপ্রিতীকর ঘটনা।
মাদক এবং জুয়া দুটো নেশা। দুটোই আর্থিক ক্ষতির কারণ। তেমনি একটি সম্ভাবনাময় জীবন ধ্বংসের দিকে যেতে এসবে আসক্তিই যথেষ্ট। এরকম ব্যক্তি শুধু পরিবারের বোঝাই নয়, সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্যও ক্ষতির কারণ। তার থেকে পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রের কোনকিছু পাওয়ার আশা থাকে না। আস্তে আস্তে সে সবার জন্যই বোঝায় পরিণত হয়। তখন বাবা-মা কিংবা স্বজনের নীরবে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কী করার আছে?
প্রশ্ন হলো এই মহা বিপদের কি কোন প্রতিকার নেই? প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম সংকেত পেতে বিজ্ঞানীরা এখন মহা ব্যস্ত সময় পার করছেন। চিন্তা হচ্ছে চাঁদে বসবাসের। অন্যান্য অনেক জটিল সমস্যার তো সমাধান আছেই। অসাধ্য সাধন যখন পৃথবী জুড়ে চলছে, তখন মাদক আর জুয়ার মতো সমাধানযোগ্য সংকটের দাওয়াই কঠিন কিছু? এজন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ক্ষতির বিষয়টি উপলব্দি করে পদক্ষেপ নেয়া।
পদক্ষেপ নেয়ার আগে মাদক আর জুয়া কিভাবে দেশজুড়ে ছড়িয়ে তরুণ প্রজন্মকে গ্রাস করছে এ নিয়ে কিছুটা কথা প্রয়োজন। আইনের চোখে এ দুটিই অপরাধ। সমাজের চোখে ঘৃণ্য কাজ। তাহলে কিভাবে এতে আসক্তি বাড়ছে। সমাজে একটা কথা প্রচলিত আছে-নিষিদ্ধের প্রতি আগ্রহ বেশি। আর আগ্রহ থেকেই আসক্তি। যদি তা সহজলভ্য হয়, তাহলে আসক্তি দ্রুত ছড়াবে, স্বাভাবিক। মোবাইল ফোনের কারণে জুয়া খেলার এ্যাপের অভাব নেই। ফেসবুক, ইউটিউব থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জুয়া খেলার এ্যাপগুলো প্রকাশ্যে নানা অফার দিচ্ছে। যেন প্রজন্মকে মৃত্যুর দিকে টানছে সব সময়। এখন তো গ্রাম পর্যায়ে মোবাইল ফোনের ছড়াছড়ি। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় ইন্টারনেট এখন সহজলভ্য। কিন্তু সমাজের একই অংশ ইন্টারনেটের অপব্যবহার করে বিপথে যাচ্ছে। আবার মোবাইল ফোন ছাড়াও কার্ড দিয়ে জুয়ার আসর চলে।
নেশা এখন শহর ছাপিয়ে গ্রাম পর্যায়ে একেবারেই সহজলভ্য। হাত বাড়ালেই মিলছে পছন্দের যে কোন মাদক। পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠেছে নেশার আখড়া। ইয়াবা, গাঁজা, ড্যান্ডি, ফেন্সিডিল, মদ থেকে শুরু করে সব ধরণের মাদকের বিস্তার ঘটেছে চোখের সামনে। মহল্লায় মহল্লায় গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং নয়ত মাদক, জুয়ার সিন্ডিকেট। একে একে বন্ধু বাড়ে। বাড়ে আসক্তি।
নীরবে এই বিপদ সারাদেশে ছড়িয়ে গেছে এজন্য দায়ি আসলে কে বা কারা? প্রথমে অভিভাবকরা এর দায় এড়াতে পারেন না। দ্বিতীয় পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন, সর্বোপরী রাষ্ট্র ব্যর্থতা এড়াবে কিভাবে? প্রজন্মকে বেড়ে উঠার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার দায় তো প্রত্যেকের। তা তো নিশ্চিত করা যায়নি। সামাজিক সুরক্ষার সবকিছুই এখন পড়তে পড়তে নষ্ট হয়ে গেছে। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে যখন নেশা ও জুয়া জাতির জন্য বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন প্রতিকারের চিন্তা অবশ্যই সবার আগে। এজন্য সবাই চুপ হয়ে বসে থাকব। প্রয়োজন সামাজিক জাগরণ। অন্যান্য জরুরি কাজের মতোই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মাদক-জুয়া রোধের বিষয়টি বিবেচনায় আনা সময়ের দাবি।
প্রথমেই মোবাইল ফোনে জুয়ার সকল এ্যাপ বন্ধে তৎপর হতে হবে। যে কোন মূল্যে সরকারের আইসিটি মন্ত্রালয়কে এ ব্যপারে সফল হওয়ার বিকল্প নেই। গুগল প্লে স্টোর থেকে যেন কেউ এ ধরণের এ্যাপ ব্যবহার না করতে পারে, সেজন্য সব করণীয় নিশ্চিত করা দরকার, নিজেদের স্বার্থেই। তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে জুয়ার লিংক প্রচার নিষিদ্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে ফেসবুককে চিঠি দেয়া যেতে পারে।
নেশা বন্ধে সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান বন্ধ জরুরি। চোরাই পথে ইয়াবা থেকে শুরু করে সব রকমের মাদক বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হওয়া প্রয়োজন। পেশাগত কাজে লাইসেন্সধারী ব্যক্তি ছাড়া কারো কাছে ড্যান্ডি বিক্রি করলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখা উচিত মাদক আইনে। জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের কাছে মাদক বিক্রি করা যাবে না। মাদক নির্মূলে দেশজুড়ে চালাতে হবে চিরুনী অভিযান। অবৈধভাবে যারা মাদক ব্যবসায় নিয়োজিত তাদের আনতে হবে আইনের আওতায়। এজন্য জনপ্রতিনিধিদের কাজে লাগানো দরকার। তেমনি পাড়ায় পাড়ায় মাদক জুয়া প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হলে সেই কমিটি অপরাধীদের সনাক্ত করে তালিকা থানায় দেবে। তালিকা ধরে পদক্ষেপ নেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ কাজটি সম্ভব হলো তা হবে সবচেয়ে কার্যকর। কারণ সব অভিভাবক চান সন্তান ভালো হোক। সুনাগরিক হয়ে বেড়ে উঠুক।
বেশি আসক্তদের রাষ্ট্রের উদ্যোগে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে পাঠিয়ে সুস্থ হওয়ার পর তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করা দরকার। তাহলে প্রজন্মকে বাঁচানো যাবে। অন্যথায় মাদক আর জুয়ার থাবায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অন্ধকারে পতিত হবে। তাদের থেকে জন্ম নেবে আরেকটা অস্বাভাবিক প্রজন্ম। এই দুই প্রজন্ম থেকে পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্র কী আশা করে? তা ভাববার সময় এখনই।
সর্বোপরী রাষ্ট্র সহ সব পক্ষকে ভাবতে হবে এই দুর্যোগ জাতির জন্য মহা-বিপদসংকেত। তা কাটিয়ে উঠতে হবে। এই মানসিকতাই সমাজ রুপান্তরের বড় রকমের নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই