পহেলা বৈশাখ ও শৈশবের আনন্দ-উচ্ছ্বাস
১৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:৩৩
পহেলা বৈশাখের যে উৎসব তার আতুড়ঘর, সৃষ্টির ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে রাজা-বাদশাহদের প্রাসাদে। নববর্ষ অর্থাৎ নতুন বছর, একেবারে নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয় নতুন বঙ্গাব্দর জন্ম মোগল বাদশাহ আকবরের দরবারে। আকবরই এই সনের প্রবর্তক। বাংলাপিডিয়ায় উল্লেখ রয়েছে, ‘কৃষিকাজের সুবিধার্থেই মুগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন এবং তা কার্যকর হয় তাঁর সিংহাসন আরোহণের সময় থেকে (৫ নভেম্বর ১৫৫৬)।’ প্রধানত কৃষকদের খাজনাপাতি দেয়ার সুবিধার্থে এই সনের প্রবর্তন করা হয়। এ কারণে এই সনের আরেক নাম ‘ফসলি সন’। প্রথমে এটিই প্রচলিত ছিল, পরে এর পরিচিতি দাঁড়ায় বঙ্গাব্দ নামে, যা আজও কার্যকর রয়েছে।
বৈশাখের এই উৎসবকে সর্বজনীন উৎসব বলা হয় এই কারণে যে এই উৎসবে সকল ধর্মের মানুষ অংশগ্রহণ করে। বাঙালি জীবনের মৌলচেতনা হল অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করা। সেই চেতনা এখানে হাজার বছর ধরে প্রবহমান। রমনার বটমূলে ১৩৭২ বঙ্গাব্দ থেকে পহেলা বৈশাখের উৎসবের আয়োজন করে আসছে ছায়ানট। গানে গানে তাদের যে আহবান, তা মূলত বাঙ্গালীর প্রার্থনা সঙ্গীত বিশেষ। এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।/ তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।।/ যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,/ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।।/ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।/ রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,/ আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।/ মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক।’ এ গানের ভেতর দিয়ে বাঙালি প্রতি বঙ্গাব্দের প্রথম দিনে নতুন করে বাঁচতে শেখার পুণ্যমন্ত্রই উচ্চারণ করে। পুরনো এই গানের রেশ ধরেই সব না পাওয়ার বেদনাকে ধুয়ে মুছে, আকাশ-বাতাস ও প্রকৃতিকে অগ্নিস্নানে সূচি করে তুলতেই আবারো সবার মাঝে ফিরে এসেছে পহেলা বৈশাখ।
বাংলা সনের ১৪৩০ বঙ্গাব্দকে বিদায় জানিয়ে সবাই ১৪৩১ বঙ্গাব্দকে স্বাগত জানিয়ে নববর্ষকে বরণ করতে ব্যস্ত। শুরু হলো নতুন বাংলা সাল ১৪৩১ বঙ্গাব্দ। শুভ নববর্ষ। নতুন বছরের প্রথম দিনটি চিরায়ত আনন্দ-উদ্দীপনা আর বর্ণাঢ্য উৎসবের মধ্য দিয়ে হাজির হলো প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। নতুন স্বপ্ন, উদ্যম আর প্রত্যাশার আবির ছড়ানো বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় উৎসব হলো পহেলা বৈশাখ। বিগত বছরগুলোতে নানা উৎসাহ-উদ্দীপনা, আনন্দ-উচ্ছাস আর বর্ণিল আয়োজনের মধ্য দিয়ে সারাদেশে একযোগে পহেলা বৈশাখ পালন করা হলেও বিগত কয়েক বছর করোনা মহামারি এবং পবিত্র মাহে রমজানে পহেলা বৈশাখের সে বর্ণিল আয়োজন হয়ে উঠেনি। তবে বাংলার ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে ঘরোয়া আয়োজন কিংবা বিভিন্ন সংগঠনের ছোটখাটো আয়োজনের মধ্য দিয়ে বছরের প্রথম দিনের সূচনা করছেন বাঙালি জাতি। কেউবা আবার বছরের প্রথম প্রহরে পাঞ্জাবি-শাড়ি পরে স্বজনদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছেন বৈশাখীমেলা বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। অনেকে আবার মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তায় পরিচিতজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মীকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারে মেসেজের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন কেউ কেউ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের ভাষায় এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।
এমন অনুভূতিতে গ্রীষ্মের দাবদাহ এড়িয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মাঠ-ঘাট, পথে-প্রান্তরে বৈশাখের প্রহরে ঢল নামবে লাখো উচ্ছসিত জনতার। তবে আমাদের শৈশবে বৈশাখের যে আনন্দ উচ্ছাস ছিল। সে আনন্দ এখন আর নেই। কালের বিবর্তনে বাংলার সংস্কৃতির অনেক ঐতিহ্যই হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। বদলে যাওয়া আবহাওয়া তৈরি করেছে প্রচন্ড খরতাপ। প্রতিনিয়ত অনুভব হচ্ছে ভ্যাপসা গরম। বিচিত্র আবহাওয়ার বিচিত্র রূপ। কেউ কি আগে দেখেছি চৈত্র মাসে বর্ষাকাল? ঝড়ো হাওয়ার বৈশাখ দেখেছি চৈত্রে। বৈশাখের আগেই কালবৈশাখী। চৈত্রের শেষদিকের দিনগুলোতে আবহাওয়া অফিস প্রায় প্রতিদিনই দিয়েছে কালবৈশাখীর সতর্ক সংকেত দিয়ে যাচ্ছে।
বৈশাখ বঙ্গাব্দের প্রথম মাস। ১৪ এপ্রিল মানে পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। প্রথম দিনের উৎসব বাঙালির প্রাণের উৎসব। বৈশাখের আগমনের আগেই বসন্তের শেষবেলায় সোনাপাতি ফুলের মতো চারদিক আলোকিত করা পুষ্পরাজি সোনারঙের সৌন্দর্যের বাহার ছড়ায়। ফুলের গায়ে হলুদের মাখামাখি। হলুদের আঁচল বিছিয়ে প্রায় বিদায় নিয়েছে গাঁদা। অকাল বর্ষায় এসেছে নয়নাভিরাম সব ফুল। অনেক ফুল সবুজ পাতাগুলোকে ঢেকে দিয়ে জানান দিচ্ছে নিজের আগমনী বার্তা। এরই মধ্যে বিদায় নিল বঙ্গাব্দ ১৪৩০। চ্যানেলগুলো মুখিয়ে আছে ১৪৩১ বঙ্গাব্দকে বরণ করে নেয়ার জন্য। বাঙালির জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ পহেলা বৈশাখ। পৃথিবীর যত জায়গায় বাঙালির বসবাস, সেখানেই পালিত হয় পহেলা বৈশাখ। আকুলিত হৃদয়ে প্রথম প্রহরে গেয়ে ওঠে- ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’
শহরের বুটিক হাউস আর মার্কেটগুলোয় পাওয়া যাচ্ছে বৈশাখী রেশ। কাচের চুড়ি, তাঁতের শাড়ি আর শুভ্র পুষ্পের মেলা বসে এখানে-সেখানে। বৈশাখের প্রথম দিনে এগুলোই এনে দেয় বাঙালিয়ানা আর মনে ধরায় রঙের খেলা। আমাদের কালে তরুণীরা সাজত দুহাত ভরা লাল-নীল রঙের চুড়ি, লাল পেড়ে সাদা শাড়ি আর খোঁপায় গোঁজা বর্ণিল ফুল দিয়ে। বিবাহিত-অবিবাহিত সবাই। ঘুরে বেড়াত এবাড়ি-ওবাড়ি, মার্কেটে, ক্যাম্পাসে। বেড়াতে যেত আপনজন আর বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে। এখন তো শুধু বাধা আর বাধা। ঘুচবে কবে বাধার পাহাড়?
এ উৎসবকে ঘিরে বাঙালি-পাহাড়ির অতি প্রিয় ইলিশের গায়েও লাগে বৈশাখী ঝড়। হু হু করে বাড়তে থাকে দাম, হয়ে যায় তিন-চারগুণ। চলে যায় সাধারণ ক্রেতাদের সামর্থ্যরে বাইরে। তবুও বাঙালি হাল ছাড়ে না, কিনে নেয় যতটুকু পারে ততটুকু। কদর বাড়ে পান্তা আর বেগুনের। সঙ্গে ইজ্জত বেড়ে যায় মাটির থালা-বাসনের। অরুণোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রমনার বটতলায় বসে বাঙালির প্রিয় ছায়ানটের আসর। সবুজের মায়া হারানো ইট-পাথরের দেয়ালে বন্দি রাজধানীবাসী পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটে আসে একটু ‘আউটিং’-এর আশায়।
উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে সবখানে, গ্রামে-গঞ্জে শহরে-বন্দরে। ঐতিহ্যময় ইতিহাস বাংলা নববর্ষের। যুগের পর যুগ পার হয়ে নববর্ষের প্রথম দিনটির পালনে এসেছে অনেক ভিন্নতা, বহুমুখিতা। বিয়োগ হয়েছে বেশকিছু, যোগ হয়েছে অনেক কিছু। সময়ের বিবর্তনে বদলেছে শহুরে জীবন, অনেক কিছু পাল্টেছে গ্রামীণ জীবনে। বদলের বাঁকে বাঁকে এসছে নতুনত্ব। তবুও পহেলা বৈশাখে বসছে মেলা কোন বটতলায়, নদীর ধারে, হাটের পাশে, হাওড়-বিলের প্রান্তে, খেলার মাঠে কিংবা চারণভূমিতে।
বাঙালির রঙিন উৎসব বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে কামনা করি, হে বৈশাখ তুমি এসো স্নিগ্ধতা আর সুন্দর নিয়ে, পুরনোকে ভুলে গিয়ে, আনন্দময় হয়ে, হতাশা বিদায় দিয়ে। এসো স্নিগ্ধ সাজে বাঙালিপনা নিয়ে, লাল আর শুভ্রতার নান্দনিক চমক নিয়ে, পবিত্রতা আর উৎসবের প্রতীক হয়ে। এসো হে বৈশাখ বৈষম্য দূরের প্রত্যয় নিয়ে, আগামীর উজ্জ্বলতা নিয়ে, বৈশাখী শাড়ির আঁচলে একরাশ ভালোবাসা নিয়ে, উজ্জ্বল হৃদয়ে উজ্জ্বল আবেগ নিয়ে, বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার অঙ্গীকার নিয়ে আর সমাজের সব কুসংস্কারের আবর্জনা নিরসনের প্রত্যয় নিয়ে।
বৈশাখে যে আনন্দ-অনুভূতি ছিল। তার কিছুই এখন তেমন নেই। কালের বিবর্তনে এখন দিন দিন সবকিছুই পরিবর্তন হচ্ছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় পরিবর্তন হচ্ছে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি। হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার কৃষ্টি কালচারের পুরনো ঐতিহ্য। সেই শৈশবের পহেলা বৈশাখের আনন্দ আর বর্তমান সময়ের আনন্দ তো অনেক, অনেক তফাৎ রয়েছে। তখন বৈশাখ এলেই মনের মধ্যে অনেক আনন্দ সৃষ্টি হতো। আর এখন শত আনন্দ উল্লাস করেও মনে তেমন আনন্দের সৃষ্টি হয় না। ছোটবেলার বৈশাখের সেই আনন্দের তৃপ্তি পাওয়া যায় না। ঘরোয়া পরিবেশে পান্তা ইলিশের আয়োজন, গানের আড্ডাসহ নানা গল্প-গুজর করে অনেক আনন্দ উল্লাসের মধ্য দিয়ে পহেলা বৈশাখের দিন পার করি। তবে বৈশাখে যতই আনন্দ-উল্লাস করি না কেন সেই ছেলেবেলার মতো বৈশাখের আনন্দ কখনোই মনের আঙ্গিনা ছুঁয়ে যায়নি। সেকালের বৈশাখ আর একালের বৈশাখের মাঝে অনেক অনেক তফাৎ রয়েছে। সেই ছেলেবেলা পার করে এখন এই মধ্য বয়সে এসে জীবনের পাতা জুড়ে বারবার বৈশাখ ফিরে এলেও, ফিরে আসেনি সেই শৈশবে বৈশাখের আনন্দ-উচ্ছাস। তবুও প্রতি বছর বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে নিজেকে নতুনভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করি। নতুন পাঞ্জাবি কিংবা যে কোনো নতুন পোশাক পরে পান্তা ইলিশ ও বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ফিরে বৈশাখের আনন্দ-উল্লাসকে হৃদয়ে লালন করে সেই শৈশবের আনন্দ ফিরে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে থাকি।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই