অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্মারক উৎসব বাঙালির বর্ষবরণ
১৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:০৬
পহেলা বৈশাখ, বাংলা বর্ষবরণ বাঙালির একটি অনন্য উৎসব। ধর্মীয় অনুসঙ্গবিহীন এরকম সর্বজনীন উৎসব পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। নতুন বাংলা বর্ষবরণ ছাড়া বাঙালির অন্য সব সামাজিক উৎসবের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ধর্মীয় অনুষঙ্গ। যেমন বাঙালি মুসলমানদের ঈদ, হিন্দুদের দুর্গাপূজা, বৌদ্ধদের বৌদ্ধপূর্ণিমা ও খ্রিস্টানদের বড়দিনের উৎসবে। এই সব উৎসবে অংশ গ্রহণে সব ধর্মের মানুষের আগ্রহ গত কয়ক দশকে ক্রমাগত হারে বাড়লেও ধর্মীয় মোহরের বাইরে পহেলা বৈশাখই একমাত্র উৎসব, যা আবহমান বাংলার সব ধর্ম, জাতিসত্তা ও ভাষাভাষি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে একই মোহনায়। কালের পরিক্রমায় বাংলা নববর্ষ আজ পরিণত হয়েছে বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি বাঙালির প্রধান ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবে।
আজ সমগ্র বাঙালির কাছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্মারক উৎসবে পরিণত হয়েছে পহেলা বৈশাখ। বাংলা বর্ষবরণ বাঙালিয়ানার প্রতিচ্ছবি। এই উদযাপন আমাদের শেকড়ের সন্ধান দেয়, এর মধ্য দিয়ে বাঙালি খুঁজে পায় তার জাতিসত্তার পরিচয়।
ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি লালনের মাধ্যমে বিশ্বসমাজে বাঙালি শ্রেষ্ঠ জাতি হয়ে উঠেছে। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বতাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার ধারাবাহিকতায় ইউনেস্কো ২০১৬ সালে পহেলা বৈশাখের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। নববর্ষের-এ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সারাবিশ্বের বাঙালির জন্য নিঃসন্দেহে বিরাট অর্জন।
কবে কখন বাঙালির এই বর্ষবরণ উৎসবে পরিণত হয় তা নিয়ে ইতিহাসে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য রয়েছে। নানান তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায় আজ থেকে প্রায় দুশ বছর আগে জমিদারি প্রথা প্রবর্তনের পর এ দেশের জমিদাররা অর্থনৈতিক প্রয়োজনে বাংলা নববর্ষকে সামাজিক উৎসবে রূপান্তরিত করেন। রাজধানী ঢাকায় আজ যা পুরান ঢাকা নামে পরিচিত সেখানকার ব্যবসায়ীদের হালখাতার গণ্ডি পেরিয়ে বৈশাখের প্রথম সূর্যোদয় পরিণত হয়েছে শেকড়সন্ধানী বাঙালির মিলনমেলায়। এর সূচনা ঘটেছে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। ছায়ানটের উদ্যোগে ঢাকায় বাংলা নববর্ষ প্রথম কয়েক বছর উদযাপিত হয়েছে বলধা গার্ডেনে।
বাঙালির এই প্রাণের উৎসবে ক্রমানয়ে বাড়তে থাকে জনসমাগম। প্রয়োজনের তাগিদে ১৯৬৭ সাল থেকে মূল আয়োজন রমনার বটমূলে স্থানান্তরিত হয়। ছায়ানটের শিল্পীরা বৈশাখের প্রথম সূর্যোদয়ের মুহূর্তে রমনা পার্কের বটমূলে রবীন্দ্রনাথের বর্ষাবন্দনার মাধ্যমে সূচনা করেন উৎসবের। এরসাথে যুক্ত হয় চারুকলা ইন্সটিটিউটের ছাত্র-শিক্ষকদের মঙ্গল শোভাযাত্রা। যেখানে সর্বস্তরের মানুষের অংশ গ্রহণে সার্বজনীনতায় রুপ পায় বাঙালির এই ধর্মনিরপেক্ষ একমাত্র উৎসব। শুধু রাজধানীতেই নয় দেশের আজ এমন কোনো জনপদ নেই, যেখানে ঘটা করে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয় না। পহেলা বৈশাখ এখন এদেশের আদিবাসীদেরও উৎসবের দিনে পরিণত হয়েছে।
সংগীত, নৃত্যকলা, মঙ্গল শোভাযাত্রাকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি আখ্যা দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির চর্চাকে থামিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র ও অপচেষ্টা দীর্ঘদিনের। ষাটের দশকের শুরুতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তাদের ভাষ্যমতে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু, ভারতীয়; পাকিস্তানের আদর্শের পরিপন্থি। এমনকি তারা বাংলাকে হিন্দুদের ভাষা হিসেবে অভিহিত করে এর ইসলামিকরণের এক হাস্যকর অথচ ভয়ংকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল।
সকল ষড়যন্ত্র ও প্রতিকুলতাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়া বীর জাতির নাম বাঙালি। পঞ্চাশের দশকে বাঙালিরা বাংলা ভাষার ইসলামিকরণের চক্রান্ত প্রতিহত করেছিল দুই বাংলার খ্যাতিমান লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের মহাসম্মেলন আয়োজন করে। আর , ষাটের দশকের শুরুতে সাড়ম্বরে পালন করেছিল রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী। সাংস্কৃতিক জাগরণ আর প্রতিবাদের এমন ধারাবাহিকতায় বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করবার জন্য জন্ম হয় ‘ছায়ানট’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’, ‘সন্দীপন’সহ অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠনের। ছায়ানটই উদ্যোগ নিয়েছিল রাজধানী ঢাকায় সাড়ম্বরে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের, যে সংগঠনের মধ্যমণি ছিলেন ওয়াহিদুল হক ও সানজিদা খাতুন শিল্পী দম্পতি। সেদিনকার পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ছায়ানটের প্রতিবাদ আজ হাজারো সংগঠনের বহুমাত্রিক মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। পরিনত হয়েছে বাঙালির মহামিলনমেলার বর্ণাঢ্য উৎসবে।
বাঙালির এই রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক জাগরণ ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশে নতুন মাত্রা যেগ করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ভেতর ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্র তৈরি করেছে মূলত ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক আন্দোলন। যা মুক্তিযুদ্ধেরও ভিত নির্মাণ করেছে ৭১ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত করে পাকিস্তান সৃষ্টি করা হয়েছিল ধর্মীয় দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালি সংস্কৃতির গায়ে হিন্দুয়ানি তকমা লাগিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধচারন করে পাকিস্তান।
১৯৭১-সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতিতত্ত্বের দর্শনকে অযৌক্তিক, অসার ও অমানবিক বলে প্রমান করে বাঙালি জাতি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ কারনেই বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের সময় ধর্মনিরপেক্ষতার রক্ষাকবচ হিসেবে সাংবিধানিকভাবে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে ছিলেন।
ধর্মীয় আবরণের বাইরে গিয়ে বাঙালি তার মায়ের ভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতির জাগরণে স্বাধীনতা লাভ করেছে। যা পাকিস্তান এবং এখনো বাংলাদেশকে যারা নব্যপাকিস্তান বানানোর দিবা স্বপ্নে বিভোর তারা মেনে নিতে পারেনি। তাই ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র এখনো চলছে। ’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যই তারা ১৯৭৫-এ নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুকে। এর পর ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলের ভিতরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতীয় চারনেতাকে। যারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন ও একটি অনন্যসাধারণ সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য।
স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘ ২১ বছর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ শাসিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে চেতনা বিরোধীদের দ্বারা। আর তাদের পেছনে কলকাঠি নেড়েছে স্বাধীনতার সময়ে যে সকল দেশ আমাদের বিরুদ্ধে ছিল বিশেষ করে আমেরিকা, চীন ও মধ্য প্রাচ্যের কয়েকটি দেশ। তখন থেকেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়া হয়। তাদের বীজ ছড়িয়ে যায় সারা দেশে। এরপর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলেও এক মেয়াদে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদীদের বীজ সমূলে মূলোৎপাটন করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ২০০১ সালে বিএনপি জামায়াত আবারও ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিকে ‘পাকিস্তানিকরণ’ করার নগ্ন খেলায় মেতে উঠে পাকিস্তানি ভাবধরায় বিশ্বাসীর।
পাকিস্তান আমলে বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের সহযোগীরা হিন্দুয়ানি আখ্যা দিয়েছিল। একইভাবে স্বাধীন বাংলাদেশেও জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক দোসররা বাংলা নববর্ষ উদযাপনসহ বাঙালির সকল সাংস্কৃতিক আচার অনুষ্ঠানকে হিন্দুয়ানি বলে যখন যেখানে সুযোগ পেয়েছে তখনই এর ওপর হামলা করেছে।
বাঙালি সংস্কৃতির ওপর সবচেয়ে বড় হামলা হয় ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল। বাংলা নববর্ষের দিন রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে গ্রেনেড হামলায় ১০ জন নিহত হয়।
১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে উদীচির সম্মেলনে বোমা হামলায় শিল্পীসহ নিহত হয় ১০ জন। আহত হয় দেড়শতাধিক। এই দুটি হামলার সাথেই জড়িত হরকাতুল জিহাদ। এই দেশ হরকাতুল জিহাদ সহ সকল মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে বিএনপি ও জামাত। ধর্মের নামে এই সব জঙ্গিবাদী সংগঠন ইসলাম ও, মানবতার শত্রু। এই শত্রুদের দৃষ্টান্ত মূলক শান্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের পৃষ্ঠপোষকরদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। আর তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে প্রতিরোধ করতে গড়ে তুলতে হবে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ইস্পাত কঠিন ঐক্য।
আর সেই লড়াইয়ে আমাদের অনুপ্রেরণা অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক ও বাহক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও আদর্শের যোগ্য উত্তরসূরি রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানাতে সরকার প্রধান তাই প্রতিবছর তার শুভেচ্ছাবার্তা ও বানীতে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দেন বাঙালির সাহসীকতা ও ত্যাগ তিতিক্ষার কথা। প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাস বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখা যাবে না, বাঙালি বীরের জাতি হিসেবে তার অর্জন ও অগ্রগতি চির ভাস্বর হয়ে থাকবে যুগ যুগান্তর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসাম্প্রদায়িক, উদারনৈতিক, জাতীয়তাবাদী ও গণতন্ত্রের ভাবাদর্শে আজীবন যে সংগ্রাম করে গেছেন তারও মূলমন্ত্র জাতিগত ঐতিহ্য ও অহংকার। সেই আদর্শে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন, দেশ পুনর্গঠনে কাজ করেছে তার অভিন্ন চেতনা। একইসঙ্গে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, উগ্রবাদ তথা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ তথা সুখী-সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ তথা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বৈশাখ আমাদের জন্য বিপুল প্রেরণাদায়ী।’
প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে তার বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রেখে সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভশক্তির জাগরণ ঘটিয়ে আসুন সবই মিলে সামিল হই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের নতুন মিশন ও ভিশন বাস্তবায়নের স্বপ্ন ছোঁয়ার মিছিলে।
লেখক: ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সহ সভাপতি ও বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য
সারাবাংলা/এসবিডিই
অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্মারক উৎসব বাঙালির বর্ষবরণ মানিক লাল ঘোষ মুক্তমত