সাংস্কৃতিক সংকটে সুযোগ নেয় সাম্প্রদায়িক অপশক্তি
১৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:০২
মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি— এমনটা দাবি কেউ করেনা। বরং বলা হয়ে থাকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতিকে চিত্রিত করা হয় শিল্প ও কারুকার্যের মাধ্যমে। অর্থাৎ হাজার বছরের সংস্কৃতি মঙ্গল শোভাযাত্রা নয়, হাজার বছরের সংস্কৃতিকে ধারণ করে মঙ্গল শোভাযাত্রা, বিষয়টি এমনই হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা দেখছি বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচারণ করা সুবেহ-বাংলার পরাজিত সৈনিকেরা উল্টোটা প্রচার চালিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।
শোভাযাত্রায় যে-সকল উপকরণ চিত্রিত করা হয়, প্রত্যেকটি আলাদা-আলাদা অর্থবহন করে, যার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। কেউ-কেউ সে-সবকে মূর্তিপূজা বা উপসনার সাথে তুলনা করে একধরণের সাম্প্রদায়িক সুখানুভব করে। অথচ আমরা দেখিনি শোভাযাত্রায় কোনো সন্তান প্রত্যাশী নারীকে ছাগল মানত করতে, পরীক্ষায় ভালো ফলপ্রত্যাশী কোনো শিক্ষার্থীকে নগদ অর্থ দান করতে, কিংবা দীর্ঘায়ু লাভের আশায় কোনো অশীতিপর বৃদ্ধকে মাথা ঠুকতে! তবুও একদল বুদ্ধু আসবে পূজা-অর্চনার অভিযোগ নিয়ে। তারা অর্গাজমের সুখ নিয়ে এসব বলতে থাকবে, অব্যাহতভাবে বলেই যাবে, একবার নয় বারবার বলবে।
সবকিছু নির্ভর করে নিয়ত বা উদ্দেশ্যের উপর। আপনি ছাগলটি বধ করছেন ঈশ্বরের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কুরবানির জন্য না-কি তার মাংস খাওয়ার জন্য— তা নির্ভর করবে একান্তই আপনার নিয়তের উপর। মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়াটা যদি হয়ে থাকে আপনার বাঙালি সংস্কৃতিকে উৎসবের আমেজে ধারণ করা— তবে তা কখনোই মূর্তিপূজা বা ঈশ্বরের আরাধনার শামিল নয়। কিন্তু আমরা দেখছি মরুভূমির সংস্কৃতির ধারক-বাহকেরা দীর্ঘদিন যাবৎ সুকৌশলে বাঙালি সংস্কৃতিকে ধর্মীয় মোড়কে আবদ্ধ করে নিজেদের রাজনৈতিক হাতিয়ারে রূপদান করেছে। পহেলা বৈশাখ হারাম, পান্তা-ইলিশ হারাম, মঙ্গল শোভাযাত্রা হারাম, শহিদমিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন হারাম, জাতীয় সংগীত হারাম, নারীনেতৃত্ব হারাম, টিপ হারাম, কবিতা লেখা হারাম, ভাস্কর্য হারাম, এটা হারাম-সেটা হারাম, বলতে গেলে তাদের কাছে সৃষ্টিশীল ও চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত সবকিছুই হারাম। হারাম-হালালের রাজনৈতিক খেলা খেলতে গিয়ে এরা ধর্মীয় বিষবাষ্প ছড়িয়ে অন্যদেরকেও মানবমাথাখেকো দলে ভিড়াচ্ছে, সাধারণ সংস্কৃতিপ্রিয় মানুষের স্বাভাবিক জীবনপ্রক্রিয়াকে এরা ধারাবাহিকভাবে অতিষ্ঠ করে তুলছে।
পহেলা বৈশাখ হারাম, পান্তা-ইলিশ খাওয়া হারাম, মঙ্গল শোভাযাত্রা হারাম! হয়তো অচিরে নতুন করে জানতে হবে ইলিশের আসল নাম ‘ইবলিশ’। ইবলিশ একটি মুরতাদ মাছ। অতএব, ইলিশ ওরফে ইবলিশ ভক্ষণ করা হারাম। ঘুরেফিরে দেখবেন এই গোষ্ঠীটি শুধুমাত্র বাঙালি জাতিসত্তাকে অস্বীকৃতি জানিয়ে নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের অপচেষ্টা অব্যাহতভাবে চলমান রেখেছে, এখানে তারা ট্রামকার্ড হিশেবে ব্যবহার করছে ধর্মকে।
নির্মোহচিত্তে যদি আমার পরিচয়ের কথা বলি, প্রথমত আমি একজন মানুষ, দ্বিতীয়ত আমি বাঙালি কিংবা বাংলাদেশি। এখানে ধর্মীয় পরিচয়টা আসছে অনেক পরে। আমি কোন ধর্মের, আমার বংশপরিচয় কী, আমার গোত্র কোনটি, লিঙ্গ কী— তা গৌণ পরিচয়। কেননা এগুলো পরিবর্তনশীল। বিয়ের পর জয়া মাসউদ থেকে জয়া আহসান হয়ে যেতে পারে, ধর্ম পাল্টে হিন্দু কায়েত পরিবারের ছেলে মধুসূদন দত্ত থেকে মাইকেল মধুসূদন হয়ে যেতে পারে, লৈঙ্গিকপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শরিফ থেকে শরিফা হয়ে যেতে পারে— কিন্তু চাইলেই কেউ তার মানব ও জাতিসত্তা পরিবর্তন করতে পারবেনা। আপনি একবার বাঙালি ঘরে জন্ম নিয়েছেন মানে আপনাকে বাঙালি হয়েই মরতে হবে, এমনকি জন্মসনদ-পাসপোর্টে তো লিখবেনই ‘জন্মসূত্রে বাংলাদেশি’। এই সহজবোধ্য ব্যাপারগুলো ভুলে গেলে তো চলবেনা।
প্রতিটা জাতির নিজস্ব কিছু সংস্কৃতি আছে, যা তাদের সার্বিক পরিচয় বহন করে। বাঙালির নিজস্ব পোশাক-পরিচ্ছদ, ভাষা, চিরায়ত সংস্কৃতি রয়েছে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ধর্মে যা বলেনি কর্মে তা করে দেখাতে সদা-প্রস্তুত। একটা সময় তারা বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকেও হিন্দুয়ানী ভাষা আখ্যা দিয়ে হারামের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে গিয়ে ব্যার্থ হয়েছে। আমার ধারণা, এরা বৈশাখ বরণ উৎসবেও পরাজয় স্বীকার করবে, আজ-হোক কাল-হোক করবেই। কেননা আমরা দেখেছি ভাস্কর্যকে হারাম ঘোষণা দেওয়া নিয়াজীপুত্ররা ফেনিতে ইসলামি ভাস্কর্য নির্মাণের খবরে আনন্দে-আটখানা হয়ে একঢোকে হারামকে গিলে খেয়েছে, ছবি তোলাকে হারাম আখ্যায়িত করা মোল্লারা এখন প্রতিনিয়ত ইউটিউবে-ফেইসবুকে ভিডিয়ো দিচ্ছে, টেলিভিশনে টকশোতে আসছে। একসময় ইংরেজিকে খ্রিষ্টানদের ভাষা বলে দূরে সরিয়ে রাখা লোকগুলোই ইংরেজিতে পারদর্শী বক্তাকে ওয়াজে প্রধান বক্তা বানাতে লাইন দিয়ে পড়ে থাকে, নারীনেতৃত্ব হারাম ঘোষণা দিয়ে তাদেরই একাংশ এইটপাশ নেত্রীকে সমর্থন জুগিয়ে রাজনীতি করছে, এভাবে প্রতিনিয়ত তারা নিজেদের ফতোয়ায় নিজেরাই আটকা পড়ছে সেদিকে তাদের একটুও খেয়াল নেই। এ-সকল ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তাদের হারামবাজি বেশিদিন ধর্মীয়-রাজনীতির বাজারে টিকে থাকতে পারেনি, তা ছিলো নিছক মৌসুমিউস্কানি। অর্থাৎ, আলো আসবে। শুধুমাত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিশেবে ব্যবহার করে তারা এতদূর এসেছে, যুগে-যুগে বহুবার তারা সাময়িক সফল হয়েছে, কিন্তু চিরস্থায়ী নয়।
এ-মুহূর্তে যেটা দরকার, তা হলো সাংস্কৃতিক বিপ্লব। আমি আগেও বলেছি, সাংস্কৃতিক সংকটে সুযোগ নেয় সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। সহজলভ্য ইন্টারনেটের বদৌলতে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীটি প্রত্যন্ত অঞ্চল অবধি দ্রুত পৌঁছে গিয়েছে, যার ইতিবাচক দিকের চাইতে নেতিবাচক দিকটিই বেশি। সহজ-সরল মানুষগুলোর মাঝে ভয় দেখিয়ে, কৌশলে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে মরুভূমির সংস্কৃতি, বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতি থেকে ছিটকে আমরা ক্রমাগত মরুভূমির সংস্কৃতিকে লালন করছি, ধারণ করছি ভিনদেশী জাতীয়তাবাদ। আমার দেশে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব দরকার, যা ছড়িয়ে যাবে প্রতিটা বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বাঙালি সংস্কৃতি জাগ্রত হোক সতত-বাঙালির হৃদয়ে। আমার চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতির উপর যারা আঘাত হানে, তারা বহিঃশত্রু। এই বহিঃশত্রুর উত্থানের পতন ঘটাতে হবে, নতুবা বাইরের জিনিস বাইরেই বিতাড়িত করতে হবে।
এই দেশটা মানুষের হোক, এই দেশটা বাঙালির হোক।
লেখক : শিক্ষার্থী, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই
মুক্তমত শিশির ওয়াহিদ সাংস্কৃতিক সংকটে সুযোগ নেয় সাম্প্রদায়িক অপশক্তি