Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি ও কিশোর গ্যাং

মারিয়া হক শৈলী
২১ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:০৯

রাজনীতি হলো এক ধরনের সামাজিক প্রকৃয়া বা কর্মকান্ড। সবসময়ই সকলের মধ্যে সংলাপ ও যুক্তিতর্কের জন্ম দিয়ে রাজনীতি তার আপন গতিতে চলে। এই রাজনীতি কেবলমাত্র রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল, শ্রমিক সংঘ কিংবা গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; পরিবার, স্কুল, কলেজ, সাংস্কৃতিক সংগঠন, ধর্মীয় সংগঠন, বহুজাতিক সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ সকল ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণ, জনসেবা ও সাধারনের প্রতিনিধিত্ব। যেসকল কর্মকান্ড মানুষের জন্য ক্ষতিকর, অন্যকে শারিরীক ও মানসিক ভাবে হয়রানি করে যে সকল কর্মকান্ড, সে সকল কর্মকান্ড কখনই রাজনৈতিক কর্মকান্ড হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে না। কিন্তু ইদানিং আমরা দেখতে পাচ্ছি রাজনীতির নামে এসকল সমাজ বিরোধী কার্যকালাপ বেশ নিশ্চিন্তেই সংগঠিত হচ্ছে এবং সেসবের নেপথ্যে আবার দেশের প্রথম সারির রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরাই।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বেশ উজ্জ্বল এবং বহু দক্ষ রাজনীতিবিদদের অবদানে মুখরিত। কিন্তু ইদানিং সেই উজ্জ্বলতা আর চোখে পড়ে না। প্রতিহিংসা ও অপসংস্কৃতি এখন দেশের রাজনীতিতে একটি নিত্যনৈমাত্তিক বিষয়। একটা সময় দেখা যেত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দলীয় মতের অমিল থাকলেও, ব্যক্তি পর্যায়ে সে বিরোধ ছিল নিষ্ক্রীয়। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেসব এখন কেবলই মরিচীকা কিংবা কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ কোন দলিল, যে দলিল ধুলোর আস্তরনে ঢাকা পড়ে আছে প্রায় বহু বছর। বর্তমান রাজনীতির এই অধ:পতন বেশ উদ্বেগজনক তো বটেই একই সাথে আশংকারও।

বিজ্ঞাপন

এই যখন পরিস্থিতি তখন বর্তমান রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির পাশাপাশি আলোচনার নতুন বিষয় কিশোর গ্যাং। বলা হচ্ছে রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে কিশোর গ্যাং একটি নয়া হাতিয়ার এবং এই হাতিয়ারটি রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ করে থাকেন স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা।

১৭৮৩ সালে আমেরিকায় স্ট্রিট গ্যাং এর মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রথম গ্যাং কালচারের সূত্রপাত ঘটে। এরপর এই সংস্কৃতি ধীরে ধীরে লাতিন আমেরিকা সহ এশিয়া মহাদেশের বেশ কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে কিশোর গ্যাং এর অস্তিত্ব পাওয়া যায় ২০১২ সালে, কিন্তু ২০১৭ সালে ১৪ বছর বয়সী আদনান কবির হত্যাকান্ডের পর এই গ্যাং কালচার বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরপর থেকে এই ধারা আজও বহমান। ২০১৭ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন মতে, ”ঢাকা ও এর আশপাশে ১২টি এবং সারা দেশে কমপক্ষে ৩৫টি কিশোর গ্যাং ছিল। ” তবে, বর্তমানে সারা দেশে কিশোর অপরাধীদের ১৭৩টি দল সক্রিয় রয়েছে। এসব দলে ২ হাজার ২৯ জন কিশোর রয়েছে। কিশোর অপরাধের ঘটনায় এখন পর্যন্ত সারা দেশে ৭৮০টি মামলা হয়েছে, এসব মামলায় আসামি ৮৯৬ জন। রাজধানীর বাইরে সাভারে প্রায় ১৫টি, টঙ্গীতে ৩০টি এবং নারায়ণগঞ্জে বেশ কয়েকটি গ্রুপ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোকে অপরাধের অভয়ারণ্য বানিয়ে রেখেছে। ফলে ঢাকায় প্রতি মাসে ১৫-২০টি খুন হচ্ছে।

কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা স্থানীয় নেতাদের বলে বলীয়ান হয়ে স্বাধীনভাবে অপরাধী কর্মকান্ডগুলো পরিচালনা করে। ফলে দেখা যায় একটি অপরাধে প্রায় ৩০-৪০ জন কিশোর জড়িয়ে পড়ে। ক্ষমতার বলে সংগঠিত হওয়া এসব অপরাধের উত্কৃষ্ট উদাহরণ ২০২০ সালে সংগঠিত হওয়া স্কুল ছাত্রী নীলা রায় হত্যাকান্ড।

এক সময় আমাদের সমাজে মূল্যবোধ চর্চার ঐতিহ্য ছিল। সেই ঐতিহ্য আজ ভেঙে পড়ছে। মুরব্বিরা ভীত, কিশোর-তরুণরা বেপরোয়া। সামাজিক সেই বন্ধন ও শৃঙ্খলা খসে পড়েছে।

মুলত পারিবারিক ভাঙন, পারস্পরিক শ্রদ্ধাহীনতা, অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে খেলার মাঠ ভরাট, অপরিনত বয়সে মোবাইল ফোনে আসক্তি, আধুনিকতার নামে ভীন দেশি সংস্কৃতির নেতিবাচক চর্চা, শিল্প ও দেশীয় সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকা, বাবা-মায়ের অসচেতনতা, খারাপ সঙ্গ-ইত্যাদি নানা কারণে আমাদের দেশের তরুনরা কিশোর গ্যাং এ লিপ্ত হয়ে নানান অপরাধে নিজেদের নাম লেখাচ্ছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও এ কিশোর গ্যাং তৈরিতে অনেকাংশে দায়ী। ”জিপিএ-৫” নির্ভর এই শিক্ষা ব্যবস্থায় নেই কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার দিকনির্দেশনা, নেই কোনো মূল্যবোধের আদর্শে নিজেকে তৈরি করার বাস্তবমুখী গাইডলাইন। ফলে কিশোর বয়সেই বিপুল অর্থ উপার্জনের লোভে পথভ্রষ্ট হচ্ছে তরুনরা।

আর এ সকল পথভ্রষ্ট তরুনরাই রাজনৈতিক অসাধু নেতাকর্মীদের টার্গেট। এলাকাভিত্তিক রাজনৈতিক কোন্দলগুলো ধরে রাখা, প্রতিপক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করা, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করা সহ আরো নানান অপকর্ম সেসকল অসাধু নেতাকর্মীদের প্রতিনিধি হিসেবে কিশোর গ্যাংই পরিচালনা করে থাকে। ‘পুলিশের তালিকায় কিশোর গ্যাংয়ের রাজনৈতিক শেল্টারদাতা বা পৃষ্ঠপোষক হিসেবে অর্ধশত ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে’ (যুগান্তর, ২০ জুন ২০২১)।

১৯২২ সালের বেঙ্গল চিলড্রেন অ্যাক্ট থেকে ১৯৭৪ সালের শিশুআইন এবং সর্বশেষ প্রণীত শিশুআইন ২০১৩ করা হয়েছে শিশুদের জন্য (প্রথম আলো, ২ নভেম্বর ২০২১)। কিন্তু এই আইনের ফাঁকফোকরে কিশোররা ‘শিশু’তে সংজ্ঞায়িত হওয়ায় কিশোর গ্যাং দমনে এটি একটি প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

সে যাই হোক, আজকের তরুন আগামীর ভবিষ্যত। এই তরুনদের যে বয়সে নিজেদের সমৃদ্ধশালী নাগরিক হিসেবে গোড়ে তোলার কথা, সে বয়সেই এরা জড়িয়ে পড়ছে রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিতে। রাজনীতির এই বিষাক্ত বলয় থেকে তরুনদের বের করে আনতে হবে, আর এটি করতে পারলেই কিশোর গ্যাং এর আধিপত্য লোপ পাবে, বিশৃঙ্খলা ও অশ্লীলতার অবসান ঘটে সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। পাশাপাশি দেশ ও জাতি এই ভয়াবহ সামাজিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা পাবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ

সারাবাংলা/এসবিডিই

মারিয়া হক শৈলী মুক্তমত রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি ও কিশোর গ্যাং

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর