সড়কে শৃঙ্খলা: অন্যরা পারলে আমরা কেন পারবো না?
২১ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৩৪
সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা উন্নত বিশ্বের দেশগুলিতেও ঘটে। তবে আমাদের দেশে যেভাবে প্রতিদিন ঘটে এবং নিহত হয় ঠিক এত বেশি শোনা যায় না। তাছাড়া সেসব দেশে সড়ক দুর্ঘটনার কথা বলতে ব্যক্তিগত গাড়ির কথাই বেশি শোনা যায়। আমাদের দেশে বাস, ট্রাক, সিএনজি, নসিমন ইত্যাদি যানগুলো প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনার কবলে পরছে। ঈদ বা বড় কোনো উৎসবে ছুটির সময় সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা বেড়ে যায় উল্লেখযোগ্য হারে। এবং অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় সেই চালকের ত্রুটি রয়েছে। ওভার স্পীড, ওভারটেকিং প্রবণতা, এক টানা দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চালিয়ে ক্লান্তির কারণে ইত্যাদি আরও নানা কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এর ফলে নিরীহ যাত্রীদের প্রতিনিয়ত সড়কে প্রাণ হারাতে হচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য ডিজিটাল দেশ গড়ে তোলার পাশাপাশি একটি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম শর্ত হলো স্মার্ট যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। স্মার্ট যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার শর্ত হলো সড়ক দুর্ঘটনা উল্লেখযোগ্যহারে হ্রাস করা। বর্তমান সরকারের সময়ে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিক করে গড়ে তোলা হচ্ছে। সড়ক মহাসড়ক প্রশস্ত হচ্ছে। গড়ে উঠছে এক্সপ্রেসওয়ে। এতকিছুর পরেও যদি দুর্ঘটনা একই হারে চলতে থাকে তাহলে তা হবে দুঃখজনক। গত মার্চ মাসে দেশে ৫৫২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৬৫ জন নিহত, ১২২৮ জন আহত হয়েছেন বলে গতকাল জানিয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন র্কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ১ হাজার ৪৬৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৩৬৭ জন নিহত ও ১ হাজার ৭৭৮ জন আহত হয়েছে। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১৫ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর এবার ঈদুল ফিতরের আগের সাত দিন থেকে গতকাল পর্যন্ত ১২ দিনে সড়কে ৩৫০টি দুর্ঘটনায় অন্তত ২৬০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বিআরটিএর হিসাবে, গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় চলতি বছর দুর্ঘটনা বেড়েছে ৪৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ এবং মৃত্যু বেড়েছে ৩০শতাংশ। গত বছরের প্রথম তিন মাসে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১৭টি এবং এতে ১ হাজার ৫১ জন নিহত ও ১ হাজার ৪৪০ জন আহত হয়। এ ছাড়া আরও অন্তত ৫৪৪ জন আহত হয়েছে। অর্থাৎ ঈদযাত্রা ঘিরে সড়কে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২১ জন মানুষ নিহত হয়েছে। অতি সম্প্রতি ঝালকাঠির গাবখান সেতুর টোল প্লাজায় সিমেন্টবাহী একটি ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারালে দুর্ঘটনায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়।
গণমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০২২ সালে সড়কে ৪ হাজার ৬৩৮ জন নিহত হয়েছেন। এতে জিডিপির ৩ শতাংশের সমপরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির এক সংলাপে এসব তথ্য দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, শুধু ৫ শতাংশ গতি নিয়ন্ত্রণ ও পরিবীক্ষণের মাধ্যমে ৩০ শতাংশ মৃত্যুঝুঁকি কমানো সম্ভব। সিটবেল্ট বাঁধলে মৃত্যুঝুঁকি কমে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ। শিশুদের জন্য বিশেষায়িত সিটের ব্যবস্থা করলে ৫৪ থেকে ৮০ শতাংশ ঝুঁকি কমে। সঠিক মানের হেলমেট ব্যবহারে মৃত্যুঝুঁকি ৪০ শতাংশ এবং গুরুতর আঘাতের ঝুঁকি ৭০ শতাংশ কমে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে বছরে সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা ২৩ হাজারের বেশি বলা হয়েছে। ২০১২-২০২২ সাল পর্যন্ত সারা দেশে মোট ৩৭ হাজার ৮৪৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৭ হাজার ৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া, আহত হয়েছেন ৮৭ হাজার ৬৬৭ জন।নিসচার তথ্য বলছে, ৫ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু বাড়ছে। ২০১৮ সালে যেখানে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৬০, সেখানে ২০২২ সালে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৬১৮। পাঁচ বছরে দুর্ঘটনায় ২১৬ জন বাসের চালক ও শ্রমিক মারা গেছেন। আবার বাসের চেয়ে ট্রাকে চালকের মৃত্যু বেশি। এ সময় ৩৯২ জন ট্রাকচালক ও শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। মোটরসাইকেলে মৃত্যুর দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশ শীর্ষে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০২১ সালে মোটরসাইকেল বেশি চলাচল করে, এমন ১৬টি দেশের (বাংলাদেশসহ) ওপর সড়ক নিরাপত্তাসংক্রান্ত একটি গবেষণা করে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)।
প্রতিদিন এক থেকে একাধিক সড়ক দুর্ঘটনার খবর পড়তে হয়। এর ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বেড়েই চলেছে। সেসব দুর্ঘটনায় একই পরিবারের একাধিক সদস্য মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। কোনোভাবেই যেন এই মৃত্যুর মিছিল রোধ করা যাচ্ছে না। সে হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনাও এক ধরনের মহামারী যা চাইলেও রোধ করা যাচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত ‘গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি-২০১৮’-এর তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ ৩৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় সড়ক দুর্ঘটনায়। এছাড়া ২০-৫০ লাখ মানুষ বিভিন্ন মাত্রায় আহত হয় বা প্রতিবন্ধী হন। সব বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর অষ্টম প্রধান কারণ হলো সড়ক দুর্ঘটনা। ৫-২৯ বছর এবং আরো কম বয়সি শিশুদের জন্য এটি মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছে। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয় যে, বিশ্বব্যাপী শতকরা ৯০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে যার সংখ্যা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় তিন গুণ বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের চিত্র অনেকটা একই রকম। প্রতিবেদনের তথ্য মতে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার, পাকিস্তানে প্রায় ২৭ হাজার এবং ভারতে প্রায় ৩ লাখ। সড়কে বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুসারে, পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই এটা কমে আসছে। ২০১০ সালের তুলনায় মৃত্যুর হার কমেছে অন্তত ১০৮টি দেশে। যার মধ্যে রয়েছে শ্রীলঙ্কাও। বেলারুশ, ব্রুনাই দারুসসালাম, ডেনমার্ক, জাপান, লিথুয়ানিয়া, নরওয়ে, রাশিয়া, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ভেনেজুয়েলার মতো ১০টি দেশ তো মৃত্যুর হার অর্ধেকের বেশি কমিয়ে এনেছে। অন্যান্য দেশগুলো পরিকল্পিতভাবে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে পারলেও বাংলাদেশ কেন তা পারছে না সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। অথচ সড়কে গাড়ির চাপ কমাতে প্রচুর কাজ হচ্ছে। এসব উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান। তাহলে সমস্যা কোথায় থেকে যাচ্ছে?
আমাদের দেশে যারা মহাসড়কে বা অন্যান্য সড়কে যানবাহন চালায় তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অশিক্ষিত। গাড়ি চালানোর সঠিক সাইড, গতি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়গুলো জানে না বললেই চলে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা প্রণীত পাঁচটি আচরণগত ঝুঁকি, গতি কমানো, সিটবেল্ট ব্যবহার, সঠিক হেলমেট ব্যবহার, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি না চালানো ও শিশুদের জন্য বিশেষ সিটের ব্যবস্থায় নজর দেওয়া প্রয়োজন।
প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বাস, ট্রাক, নসিমন-করিমন বা মটরসাইকেল বা কোন না কোন যানবাহন দুর্ঘটনায় পরবে। ইদানিং আবার মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে ব্যাপকহারে। কখনো আলাদা আলাদা পরিবারের সদস্যের মৃত্যুর খবর আসে আবার কখনো আসে একই পরিবারের সদস্যের মারা যাওয়ার খবর। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা সচরাচর যে কারণগুলো দেখি এসব কারণের মধ্যে রয়েছে ক্রটিপূর্ণ যানবাহন, চালকের অদক্ষতা (অনেক সময়ই দেখা যায় কয়েকনি চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করার পরপরই গাড়ি চালানোর মত ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব তুলে নেয়), ঝুঁকিপূর্ণ গাড়ি চালনা করা (আমাদের দেশে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কোন রাস্তায় কত গতিতে গাড়ি চালানো উচিত সেসব নিয়ম কানুন মেনে চলার কোন বালাই নেই। যদিও সড়কের ধারেই সর্বোচ্চ গতির বিষয়টি লেখা থাকে), মহাসড়কগুলোতে আগে চালানোর প্রবণতা (সামনের গাড়ির চেয়ে আগে না গেলে যাত্রী পাওয়া যাবে না অথবা নিজেকে দক্ষ প্রমাণ করার চেষ্টা অথবা অভ্যাসবশত অনেক চালকই এটা করে থাকে। জবাবদিহিতার অভাব, অনেক সড়কে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক বেশী থাকে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়া অর্থ্যাৎ আইন জানা সত্তেও দেখা যায় তা মেনে চলার কোনই প্রয়োজন মনে করে না অনেকে, ড্রাইভিং পেশার অনুৎকর্ষতা, ক্রটিপূর্ণ ট্রাফিক সিগনাল ব্যবস্থা, বিকল্প যানবাহনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা। গাড়ির চাকায় পিষ্ট হচ্ছে মানুষ। এক্ষেত্রেও যে দোষ কেবল চালকের এমন নয়। আমরা যারা পথচারী তাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। রাজধানীতে নিয়ম না মেনে চলার প্রবণতাই বেশি। নানাভাবে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। এতকিছুর পরে সড়কে মড়ক থামছে না। একটি নিরাপদ সড়ক গড়ে তোলা স্মার্ট বাংলাদেশের অন্যতম শর্ত। সড়ক দুর্ঘটনা চলতে থাকলে তা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অন্তরায় হিসেবে কাজ করবে।
লেখক: কলামিষ্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
অলোক আচার্য মুক্তমত সড়কে শৃঙ্খলা: অন্যরা পারলে আমরা কেন পারবো না?