স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ধর্মীয় আগ্রাসন রোধ জরুরি
২১ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:১৩
প্রতিটি সম্প্রদায়ের গুণগতভাবে উল্লেখযোগ্য মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারে ধর্মগুরুরা। এই দক্ষিণ এশিয়ার কিছু সংখ্যক দেশে ধর্মগুরুরা যেভাবে খুব সহজ পদ্ধতিতে বিস্তার লাভ করেছে তা আবার ইউরোপের পাশ্চাত্য দেশগুলোতে তেমনটি দেখা মেলেনা। তবে একথা ঠিক যে, আধুনিক বিজ্ঞান যেখানে প্রতিনিয়ত বিশ্বব্যাপী আলোছড়াচ্ছে সেখানে ধর্মের নামে চলছে হত্যা, খুনের মতো অমানবিক বিধ্বংসীমূলক ঘটনা। এসব লৌকিক ধর্মের কারণে প্রতিনিয়ত অঘটনের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিহিংসামুলক ঘটনা থেকে মুক্ত হতে না পারলে পৃথিবীর বেশকিছু দেশ আগামী এক যুগের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যা ধর্ম বিশ্লেষকরা একবাক্যে স্বীকার করছেন। ধর্মবিদ্বেষের কারণে ইতিমধ্যে দেশে দেশে যেভাবে যুদ্ধের ভয়াবহতা বাড়তে শুরু করেছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ এখন এক চরম উদ্বেগের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করছে। কোনো দেশই আজ নমনীয়তার মধ্যে নেই। ইউক্রেন-রাশিয়ার ভয়াবহ যুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এখন যুদ্ধের দামামা ছড়িয়ে পড়েছে। ইসরাইলের ভয়াবহ হামলায় ফিলিস্তিনির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এক রকম ভেঙে পড়েছে। এরপর ইসরাইল একে একে লেবানন, ইরানসহ আরো কয়েকটি দেশে হামলার বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানরা ব্যবসায়িক আধিপত্যবাদের কথা বললেও এর মূলে রয়েছে ধর্মীয় আগ্রাসন।
প্রত্যেকটি দেশ ধর্মীয় আগ্রাসনকে নিজ নিজ দেশের কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে। ধর্মীয় উগ্রতার কারণে পরস্পর পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষমুলক আচরণের ক্রমশঃ বিস্তার ঘটছে। হিংসা-বিক্ষুব্দ, লোভ-লালসা থেকে মুক্ত হয়ে অনন্ত অনন্ত ত্যাগের মহিমায় জীবনকে স্মরণীয় করার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে শান্তিময় পরিবার ও দেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্মজীবনে ফিরে এসেছিলেন ধর্মগুরুরা আজ সে পথে কতটুকু নিজেদেরকে তুলে ধরতে পেরেছেন তা অনেকের কাছে আজ প্রশ্নবিদ্ধ? এই অবক্ষয়ের শেষ কোথায়। ধর্মীয় উগ্রবাদ সৃষ্টিতে ধর্মগুরুরা প্রতিনিয়ত তৎপর! তারা যতটুকু না মানবিকতার কথা বলে তার চেয়ে বেশি প্রচার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি ও ধর্মীয় বিভাজনের কথা। মানুষ-মানুষের মধ্যে বিভেদের কথা। ধর্মীয় আগ্রাসনের প্রভাববলয় থেকে বের হয়ে মানুষরা যদি মানবিক মুল্যবোধকে প্রাধান্য দিতেন তাহলে বিশ্বে আজ এত অশান্তির দেখা মিলতো না। তাই বিজ্ঞানের এই সময়ে এখন সবাইকে আবার নতুন করে প্রকৃত মানুষ হওয়ার পাঠ গ্রহণ করতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষা যত না মানুষকে শান্ত সুশৃঙ্খল হওয়ার কথা বলে কিন্তু তাদের হাতে ঘটছে বরাবরই বিপরীত কর্ম। ধর্মীয় উগ্রবাদ দিনদিন মাথাছাড়া দিয়ে উঠছে। তাই বর্তমান সময়ে মৌলিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য দেশের প্রথিতযশা বরেণ্য শিক্ষাবিদগণের এগিয়ে আসা জরুরি মনে করছি। শিক্ষাবিদগণদের দেশ রক্ষার সংগ্রামে হাত বাড়াতে হবে। সাধারণ শিক্ষায় বড়রকমের পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হলে আগামীর ভবিষ্যত অন্ধকারে পতিত হবে এবং যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় আমাদেরকে প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হয়ে বড়ো রকমের শংকার মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হবে।
বাংলাদেশে ৪টি ধর্ম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্র মানুষদেরকে ধর্মীয় চিন্তাধারায় পরিগণিত না করে যদি মানুষদেরকে মানুষ হিসেবে দেখলে তাহলে আমার মনে হয় দেশ আরো বেশি দ্রুত এগিয়ে যেত এবং উন্নত সমৃদ্ধ হতো। দেশের জনগণকে ধর্ম, গোত্র হিসেবে মূল্যায়িত করতে গিয়ে আজ সর্বক্ষেত্রে ভয়াবহতা নেমে আসছে। একথা লিখছি বলে আমি যে ধর্মকে অশ্রদ্ধা-অসম্মান করি তা কিন্তু নয়! আমি আবার কোনোরকম ধর্ম বিদ্বেষীও নই। ধর্ম করতে হবে অন্তর দিয়ে। ধর্ম স্বচ্ছ-নির্মল, নির্লোভ-নিরাহংকার, নিয়ম-শৃঙ্খলা, বিনয়শীল হওয়ার পূর্বশর্ত। ধর্ম প্রচারকারীদের হতে হবে সাম্য, শান্তি ও মৈত্রীর প্রতীক। প্রত্যেক ধর্মের ধর্মীয়বেত্তাদের এজন্য প্রকৃতজ্ঞানে পারদর্শী হওয়ার পাঠ নিতে হবে। দেখাতে হবে সহনশীলতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কোনো ধর্মই উগ্রতার শিক্ষা দেয় না। রাষ্ট্র থেকে পৃষ্টপোষকতা পাওয়া স্বত্তেও ধর্ম একে অপরের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে তেমন একটা জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছেনা। যেভাবে দেশে দেশে উগ্র ধর্মের উত্থান ঘটছে মাননীয় সরকার প্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ২০৪১ সালে ভিশন স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ধর্মীয় উগ্রবাদ একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ধর্মীয় আগ্রাসন কীভাবে রোধ করা যায় সে বিষয়ে সরকারের নীতি নির্ধারণী মহলকে এখন থেকে ভাবতে হবে।
উগ্রতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ যারা ধর্মশিক্ষা দিতে আসে তারা পারিবারিকভাবে নৈতিক শিক্ষা সম্পর্কে শতকরা ৯৮ ভাগই অবগত নন। আপনার আশেপাশে একটু গভীরভাবে চোখবুলালে ঠিকই টের পাবেন। ধর্মীয় শিক্ষায় বেশির ভাগ অভাব অনটন পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠির থেকে পদার্পন ঘটার কারণে সেই ধর্মীয় গুরুরা লোভ-লালসা যে ধর্মীয় জীবনযাপনের সাথে সম্পূর্ণ অনৈতিক-বেমানান তারা বুঝে উঠতে পারছে না। সে জ্ঞান তাদের মধ্যে অর্জিত হয়নি, আর সে কারণে সাধারণ মানুষের সাথে ধর্মীয়গুরুদের জীবনযাপন ক্রমশঃ সাংঘর্ষিকপূর্ণ হয়ে উঠছে। আর ছাড় নয়, এবার সরকারকে এবিষয়ের ব্যাপারে নজরদারী বাড়ানো উচিত বলে অনেকে মনে করেন।
মুসলমানদের ইমাম/মাওলানা/ হুজুর, হিন্দুদের মধ্যে ব্রাম্মন /পুরোহিত, ক্রিষ্টানদের মধ্যে ফাদার/পাদ্রী আর বৌদ্ধদের ভিক্ষু। তারা ধর্মীয় উপাসনালয় মসজিদ, মন্দির, বিহার, গীর্জায় সার্বক্ষনিক উপস্থিত থেকে নিজ নিজ ধর্মের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে ধর্মীয় ভাবধারায় এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে। জানামতে, শুধুমাত্র ক্রিষ্টান ও বৌদ্ধ ধর্মীয়গুরুরা সংসার জীবন থেকে দুরে থাকে। আবার ক্রিষ্টান পাদ্রীরা একটি সময় পরিবারের সদস্যদের মেলামেশা করার প্রবণতা আছে সেদিক থেকে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় গুরুরা যখন ধর্মীয় জীবনে ফিরে যান তখন পরিবারের সদস্য বা পরিবারে রাত্রীযাপন করা বৌদ্ধ বিনয় বিধানে আইনসিদ্ধ নয়। সেই কারণে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দেখতে শুনতে অন্য ধর্মের গুরুদের চাইতে স্বতন্ত্র বিদ্যমান। এমনকি লোভ থাকতেই পারবে না, তা ছাড়া টাকাকড়ি পর্যন্ত ছুঁতে পারেনা। কিন্তু এখন সে ধারা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের ভিক্ষুরা মানতে রাজি নন। আর তাই দিনদিন অঘটনের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এখানেও সেই অভাব অনটন থেকে উঠে আসা লেখাপড়া না জানা বেশিরভাগ পরিবারের সন্তানেরা বড়জোর ২/৩ বছর ধর্মীয় জীবনযাপন করার পর তারা অর্থের লিপ্সায় নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলে। অনেকে আছেন নামেমাত্র লাল কাপড় ধারণ করে দেদারছে জায়গা-জমি, ব্যবসাবাণিজ্য করছে এবং অনেকে পরিবারকে লক্ষ লক্ষ টাকা সহায়তা করে সম্পদের পাহাড় গড়ে দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ সীমাহীন অনৈতিক কর্মে জড়িত হয়ে সম্প্রদায়কে সংকটের মুখে ফেলে দিচ্ছে। তারা লক্ষ টাকা দামের মোবাইলসহ আলিশান জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তাদের নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্চ্য কথা বললে ফেইক আইডি খুলে লেখক ও সামাজিক বিশিষ্টজনদের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করে তাদের সম্মানহানীতে উঠে পরে লাগে। সময়ে সময়ে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে একেকটি গোষ্ঠি হঠাৎ মাথা ছাড়া দিয়ে উঠে সমাজ-দেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও সম্প্রীতিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করার অপতৎপরতায় লিপ্ত থাকে- যা একটি শান্তিময় গণতান্ত্রিক দেশের জন্য চরম হুমকি। ভিশন ২০৪১ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখন থেকে ধর্মীয় আগ্রাসন রোধে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
সারাবাংলা/এসবিডিই
বিপ্লব বড়ুয়া মুক্তমত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ধর্মীয় আগ্রাসন রোধ জরুরি