এডিপি বাস্তবায়নে কতিপয় চ্যালেঞ্জ
২২ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:০৪
‘২০২২-২৩ অর্থবছরের এডিপির অগ্রগতি পর্যালোচনা’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। উক্ত আইএমইডি’র প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায় ২৮ চ্যালেঞ্জে ঘুরপাক খাচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন। এর মধ্যে প্রকল্প তৈরি অনুমোদন পর্যায়ে ১১টি, বাস্তবায়ন পর্যায়ে ১১টি এবং প্রকল্পের শেষে ৬টি চালেঞ্জ রয়েছে। এ কারণে উন্নয়ন প্রকল্পের কাঙ্ক্ষিত বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বছরের পর বছর ঝুলে থাকছে প্রকল্পের কাজ। বাড়ছে মেয়াদ ও ব্যয়। আইএমইডি’র প্রতিবেদন বিশ্লেষন করে দেখা যায়, প্রকল্প তৈরি ও অনুমোদন পর্যায়ে ১১টি চ্যালেঞ্জ হলো— প্রকল্প তৈরিতে দুর্বলতা, দক্ষতার অভাবে অন্য প্রকল্পের ছক অনুসরণ করে নতুন প্রকল্প তৈরি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রকল্প প্রস্তাবে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা লক্ষ্য অর্জনের তথ্যে অপর্যাপ্ততা এবং প্রকল্প গ্রহণে সুবিধাভোগীদের মতামত না নেওয়া। এছাড়া প্রকল্প তৈরির সময় রেজাল্ট ফ্রেমওয়ার্ক ও লগ ফ্রেমওয়ার্ক ঠিকভাবে না করা, প্রকল্প নেওয়ার আগে সম্ভাব্য ভূমি চিহ্নিত না করা, এমটিবিএফ’র আর্থিক সীমা অনুসরণ না করা এবং প্রকল্পের ফলাফল টেকসই করতে পরিকল্পনা সঠিকভাবে তৈরি না করা। আরও আছে ভৌত কাজের ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়, বৈদেশিক অর্থায়ন নিশ্চিত না করেই প্রকল্প অনুমোদন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রকল্পের দ্বৈততা থাকে। প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ের ১১টি চ্যালেঞ্জ হলো প্রকল্প প্রস্তাবে দেওয়া কর্ম পরিকল্পনা ও ক্রয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করা, প্রকল্পের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য সঠিক ও কার্যকর পরিকল্পনা এবং তা পরিবীক্ষণের কার্যকর ব্যবস্থা না থাকা এবং মাঠ পর্যায়ে প্রকল্প তৈরি ও বাস্তবায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা। এছাড়া কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, নিয়মিত পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) ও পিএসসি (প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটি) সভা না করা এবং কার্যাদেশ প্রাপ্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্যাকেজের কাজ শেষ না করে বার বার সময় বৃদ্ধির আবেদন করা। আরও আছে ইউটিলিটি স্থানান্তরে দীর্ঘসূত্রতা ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে জটিলতা, পিইসি ও পিএসসি সভা ছাড়াই প্রকল্প সংশোধনের প্রস্তাব এবং প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে বিলম্ব ও একজন কর্মকর্তা একাধিক প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা। প্রকল্প এলাকায় পরিচালকের অবস্থান না করা এবং আইএমইডির সুপারিশ বাস্তবায়ন বা ফলোআপ না করা।
প্রকল্প বাস্তবায়ন পরবর্তী পর্যায়ের ৬টি চ্যালেঞ্জ হলো— প্রকল্প শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে পিসিআর (প্রকল্প সমাপ্ত প্রতিবেদন) না দেওয়া, তুলনামূলক আর্থিক বা অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ না করা এবং পিসিআর মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ফিডব্যাক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আইএমইডি’কে অবহিত না করা। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়িত কার্যক্রম প্রকল্প শেষে পরিচালনা করার জন্য রাজস্ব বাজেটের অপ্রতুলতা, প্রকল্প শেষ হওয়ার পর এর থেকে প্রাপ্ত ফলাফল স্থায়ী করতে কোনো ব্যবস্থা না করা এবং প্রকল্প শেষে এর যানবাহন নির্ধারিত সময়ে সরকারি পরিবহন পুলে জমা না দেওয়া। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন নির্দেশিকার হালনাগাদ সংস্করণ ২০২২ সালের জুনে প্রকাশ করা হয়েছে। ওই নির্দেশিকায় প্রকল্প তৈরির সময় বিবেচনার জন্য বিভিন্ন বিষয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণে দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা থেকে আইএমইডি প্রকল্পের বাস্তবায়ন, দীর্ঘ সময় লাগা এবং প্রাক্কলিত ব্যয় অতিক্রান্ত হওয়ার কারণসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে। এ বিষয়ে আইএমইডি’র সচিব বলেন, আমরা শুধু চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেই দায়িত্ব শেষ করিনি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কি কি ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেসব বিষয়ও তুলে ধরেছি প্রতিবেদনে। ইতোমধ্যেই প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নিয়োগ সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আশা করছি আগামীতে এটি আর চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকবে না। একইসঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নে আর একটি অন্যতম বাধা হলো ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা। এটিও সমাধানের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। এভাবে পর্যায়ক্রমে বাকি সমস্যাগুলোরও সমাধান করা সম্ভব হবে।
আইএমইডি বাজেট বাস্তবায়নের যে বক্তব্য দিয়েছে তা গতানুগতিক ধারার বাহক বলে প্রতিয়মান হয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদগন। এটা সত্যি যে বাজেট বাস্তবায়নে চাই একাগ্রতা ও দক্ষতা যা নতুন করে বলার কিছুই নেই। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নির্বাচনকালীন বাজেট বাস্তবায়নের অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের মধ্যে ছিল কেন্দ্রীক রাজস্ব আহরন, অবকাঠামোগত ঘাটতি, অগ্রাধিকারভিত্তিক সরকারি ব্যয় নির্ধারন, ঘাটতি বাজেটের আর্থিক ব্যবস্থাপনা, বৈদেশিক ঋন প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা, ব্যাক্তি ঋনের প্রতিবন্ধকতা, রফতানী আমদানী বানিজ্যে সমতা আনয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সঞ্চয় বিনিয়োগের ভারসাম্য রক্ষা ইত্যাদি যা একেবারেই দৃশ্যমান। এখন বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা রোডম্যাপ তৈরি, রাজস্ব আদায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, প্রকল্পের গুনগত বাস্তবায়ন ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করলে অনেক চ্যালেঞ্জই মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।
এখন প্রশ্নটি হলো তা কিভাবে সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী তার বাজেট সমাপনী বক্তৃতায় মহান জাতীয় সংসদে বলেছেন সকল বৈশ্বিক সঙ্কট মোকাবেলা করে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হবে এবং অর্থমন্ত্রী বলেছেন অর্থের কোন রকম অভাব হবে না। এখন বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা মানেই এর সাথে সংযুক্ত জনশক্তি তথা প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোর সক্ষমতা যা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে যা সরকার অবগত আছে॥ কিন্তু এর উন্নয়নের গতিধারায় কবে নাগাদ এই সক্ষমতা একটি গ্রহনযোগ্য পর্যায়ে পৌছাবে তা বলা দুস্কর কিন্তু দেশ উন্নয়নের দিকে যাচ্ছে যে গতিতে তার চেয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধির গতি আরও বাড়ানো প্রয়োজন। এর জন্য প্রশিক্ষন ও তদারকির কোন বিকল্প নেই সত্যি কিন্তু একটি রোডম্যাপ ধরে আগাতে হবে। প্রায়শই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এন,বি,আর,) এর সক্ষমতা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীভূক্ত প্রকল্পগুলোর ব্যয় দক্ষতা/ব্যয়ের মান নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন শোনা যায় বিশেষত; অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে যার ভিত্তিগুলো সরকারকে আমলে নেয়া উচিত। কারণ রাজস্ব আয়ের আহরণের একটি বড় প্রতিষ্ঠান হলো এন,বি,আর যার সাথে সরকারের স্থায়ীত্বশিলতার প্রশ্নটি জড়িত। সে ক্ষেত্রে উক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নৈতিক ভিত্তি তথা প্রশাসনিক কাঠামো আরো জোরদার করতে হবে, নতুন নতুন করদাতা সংগ্রহে উপজেলায় আরও অফিস স্থানান্তর করতে হবে এবং বেশী বেশী কর মেলার আয়োজন নতুন অঞ্চলগুলোতে করতে হবে। আবার উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন দক্ষতা বৃদ্ধি, ব্যয়ের মান উন্নয়ন ও অব্যাহত দুর্নীতি প্রতিরোধে উদ্যোগী মন্ত্রনালয়, বাস্তবায়নকারী সংস্থা, পরিকল্পনা কমিশন, অর্থ মন্ত্রনালয়ের অর্থ অনুবিভাগকে উন্নয়নের সহযাত্রী হিসাবে কাজ করতে হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাবেক জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি, ঢাকা
সারাবাংলা/এসবিডিই