Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী; হাওরবাসীর ভাগ্যোন্নয়নে সহায় হোন

রফিকুল ইসলাম
২৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:৩৫

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
তসলিমবাদ সমাচার এই যে, গত ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয় এক সফরে হাওরের কেন্দ্রবিন্দু কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলা সদরে গিয়েছিলেন। এলাকাটি দু’বারের নির্বাচিত সাবেক সফল রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের জন্মভূমি।

২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি একই সাথে একই উপজেলায় রাষ্ট্রপ্রধান মো. আবদুল হামিদ এবং সরকারপ্রধান হিসেবে আপনার সফর ছিল তাৎপর্যপূর্ণ ও নজিরবিহীন।

বিজ্ঞাপন

ওই সময় আমি বাংলাদেশের মূলধারার প্রথম শ্রেণির অনলাইন নিউজ পোর্টাল সারাবাংলা’য় ‘রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের হাওর সফর এবং ৪৫টি উন্নয়ন প্রস্তাবনা’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। যা ১৭শ’রও অধিক শেয়ার হয়ে পাঠকমহলে তুমুল আলোড়ন তুললেও সরকারের নীতিনির্ধারক মহল বিশেষ করে আপনার নজর কাড়েনি।

যার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরাসরি আপনার সদয় দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গণমাধ্যমে এই খোলা চিঠি লেখার অবতারণা।

ভৌগোলিক এবং ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে হাওর অঞ্চল একটি নিচু, জলমগ্ন, ভয়ঙ্কর দুর্গম ও দুর্যোগপ্রবণ এলাকা।

ইতিহাসের দৃষ্টিতে সম্ভবত ষষ্ঠ শতাব্দীতে সাগরের বুক থেকে হাওর অঞ্চলের উৎপত্তি। চীনের বিখ্যাত পর্যটক হিউয়েং সাঙ সম্ভবত ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে এবং উত্তর আফ্রিকার মরক্কোয় জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ১৩৩৩ ও ১৩৩৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ভ্রমণ কাহিনি ‘কিতাবুল রেহালায়’ হাওরাঞ্চলের প্রকৃতির নান্দনিকতায় মুগ্ধ হলেও বিরূপতায় অতিশয় কুপিত ও রুষ্টতা প্রকাশ করেছিলেন।

এমনিভাবে হাওর বা ভাটির লোকগীতির প্রবাদপুরুষ একুশে পদকপ্রাপ্ত বাউল সম্রাট শাহ্ আব্দুল করিমের লোকগীতির চরণে হাওরের অপরূপকতাকে ছাপিয়ে হাওরপাড়ের জনজীবনের বাস্তুসঙ্কটাপন্ন কঠিন বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন ভয়ালরূপে। তিনি লিখেছেন- ‘যোগক্ষেমে আফাল আসে যখন হিংস্রবাণে, / ত্রিবেণীতে বসত ভিটাবাড়ি ভেসে যায় সমানে… ।’

বিজ্ঞাপন

এছাড়া হাওরের প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলের চমৎকার বাস্তবিক বর্ণনা মিলে শাহ্ আব্দুল করিমের ভাটির চিঠিতেও। তিনি লিখেছেন – ‘আকাশ থেকে পাহাড়েতে নামত যখন ঢল, / পলিমাটি সঙ্গে নিয়ে নিচে নামে জল। / পাহাড়ী পলিমাটি নিচে এসে পড়ে, / সাগরের তলদেশ ধীরে ধীরে ভরে। … উঁচু জায়গাগুলোতে হল গ্রাম ঘর, / নীচু জায়গাগুলোর নাম হল হাওর। / গ্রামের কাছে নীচু জায়গাগুলোর নাম হল ঝিল, / গভীর জলাশয়গুলোর নাম হল বিল।’

প্রিয় নেত্রী,
‘মাটির উপরে জলের বসতি জলের উপরে ঢেউ, / তরঙ্গের সাথে পবনের পিরিতি নগরের জানে না কেউ।’

নৈসর্গিক হাওরের রূপবৈচিত্রের বিপরীতে রুদ্রতার উপাখ্যানই বিমূর্তভাবে চিত্রায়িত হয়েছে লোকগীতির এই চরণখানিতে। কিন্তু পর্যটনে ও বিনোদনের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমের বদৌলতে বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্ত্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে হাওরাঞ্চল স্বপ্নিল রূপে। বিশেষ করে কিশোরগঞ্জের হাওর।

হাওর অঞ্চলে মৌসুম দুটি – বর্ষা ও শুকনা। বর্ষার ছয়মাস হাওরবাসী থাকে পানিবন্দি। জলবায়ুর রয়েছে দুটি রূপ – স্বপ্নিল ও ভয়াল। আর আবহাওয়ারও রয়েছে দুটি ধরন – নিরাগ (শান্ত) ও আফাল (তুফান)। যা একেক সময় একেক রূপে আবির্ভূত হয়।

দেশের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত ৭টি জেলা কিশোরগঞ্জসহ সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মতান্তরে ৪৮টি উপজেলার সমন্বয়ে গঠিত মোট ভূখণ্ডের এক-পঞ্চমাংশ এলাকাজুড়ে বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চল। এখানে প্রায় দু’কোটি লোকের বসবাস। যা জনসংখ্যার দিক দিয়ে দেশের এক-দশমাংশ প্রায়।

প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হাওরাঞ্চলকে সোনালি ধানের দেশ, রূপালি মাছের দেশ, গ্যাসের দেশ এবং পর্যটনে ‘রূপের দেশ’ বলা হলেও মোট ৩৭৩টি হাওরের মধ্যে ৩৯টি হাওর হারিয়ে হাওর নিজেই অস্তিত্বের সংকটে বিপন্ন। ফলে হাওরপাড়ের জনবসতি টিকে থাকাটাই অসম্ভব হয়ে উঠেছে।

হাওরের রূপের সম্মোহনীর আড়ালে না দেখে কেউ হাওরের মেহনতি মানুষের দুর্বিষহ জীবন-জীবিকা, না দেখে শুকনা মৌসুমে নদী ভাঙন ও বর্ষা মৌসুমে সাগরসম হাওরের ভাঙযজ্ঞে বাস্তুচ্যুত কিংবা দেশান্তরীত হওয়ার আহাজারি, না দেখে অকাল বন্যায় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে একমাত্র রবিশস্য ও বোরো ফসলহানির হাহাকার, না দেখে মহোৎসবে পরিণত হওয়া হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের দুর্নীতি, না দেখে অপ্রতিরোধ্য ওয়াটার লর্ড বা ফিশারী ইজারাদারদের জুলুমে নিষ্পেষিত জেলেদের অসহায়ত্বতা।

পানির দেশ হাওরাঞ্চল, যা সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ক্ষেত্রবিশেষে মাত্র ২.০০-৪.০০ মিটার উঁচু। ভারত হতে ৫৪টি নদী দিয়ে পানি ডুকে সারাবাংলায়। এর মধ্যে ২৪টি নদীনালা দিয়ে হাওরে প্রবেশ করে মোট পানির শতকরা ৬৭ ভাগ। এছাড়া বর্ষাকালে পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা ভারতের চেরাপুঞ্জিসহ মেঘালয়, মিজোরো, মণিপুর ও ত্রিপুরার বৃষ্টির পানি পাহাড় বেয়ে ঝর্ণা ও নদীনালা দিয়ে হাওরে প্রবেশ করে। এতে অসংখ্য হাওর-বাঁওড়, বিল-ঝিল, কোড়, ডোবা-নালা ও নদীর পানি একাকার হয়ে বর্ষা মৌসুমে একটি হাওরে পরিণত হয়ে রূপ নেয় সাগরে।

পানিই হাওরের সবচেয়ে বড় সম্পদ এবং সবচেয়ে বড় আপদের নাম। অতিরিক্ত এবং অতি কম পানি দু-ই হাওরবাসীর জীবন বিপর্যস্ত করে তুলছে। সেসাথে নদীনালা, হাওর-বাঁওড়, খালবিল, কোড় তথা জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়ায় অকাল বন্যায় ফসলহানি, নৌযোগাযোগ চরম বিঘ্নিত ও জনজীবন বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে।

পরিবেশ ও ভৌগোলিকগত কারণে হাওরে বর্ষা মৌসুম মানেই বন্যা, প্রচণ্ড ঢেউ আর ভাঙনযজ্ঞের ধ্বংসলীলা। এই সময় কবি-সাহিত্যিক, প্রকৃতিপ্রেমি ও পর্যটকদের কাছে নৈসর্গিক রূপ লাভ করলেও তখন হাওরবাসীর দুঃখ-কষ্টের সীমা থাকে না। বসত ভিটাবাড়ি, রাস্তাঘাট, হাটবাজার, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-স্থাপনা, গবাদিপশুসহ জানমালের ব্যাপক ক্ষতিসাধন ছাড়াও গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে যায় রাক্ষসী হাওরজলে। এতে ব্যতিক্রম বাদে প্রতিবছরই বাস্তুচ্যুত হয়ে হাওর ছাড়ছে হাজারো মানুষ। তাদের কেউ কেউ আবার জিরাতি হয়ে বোরো ধান আবাদ করতে হাওরে আসে। হাওরাঞ্চলের বোরো ধান দেশের প্রায় ২০ ভাগ জোগান দিয়ে থাকলেও পলি পড়ে প্রতিবছর কৃষিজমি কমছে ০.৩৩%।

ব্লু-ইকোনমিক অর্থাৎ সুনীল অর্থনীতির উর্বরক্ষেত্র এবং ৮ হাজার ৫শ ৯০ বর্গকিলোমিটার পরিধির বিশ্বের সর্ববৃহৎ মিঠাপানির একক ‘ওয়াটার বডি’ বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চল। কৃষিজ ও প্রাণিজ সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চল এটি। প্রায় ১২ হাজার বর্গমাইল ভূ-খণ্ডের প্রায় ৩০ লাখ একর আবাদযোগ্য জমি, নদী, জলমহাল, জলাশয় ও হাওর-বাঁওড়ের বিশাল জলরাশি এবং দু’কোটি মানুষ এখানকার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। হাওরের মাটি, পানি এবং মানবসম্পদ – এই তিন সম্পদের সমন্বিত ব্যবহারের ওপরই নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যৎ। অর্থাৎ, আর্থ-সামাজিক উন্নতি ও সমৃদ্ধি।

হাওর অঞ্চল কৃষিজ উৎপাদনে ও কৃষিজ দ্রব্যাদির শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদনের পাশাপাশি মৎস্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাসহ অতিরিক্ত মৎস্য ও মৎস্যজাত সামগ্রী রফতানি এবং বিভিন্ন খামার, উপযোগী শিল্প-প্রতিষ্ঠানসহ ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটন শিল্পের ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় এলাকা।

তাতে সরকারের দক্ষ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার সঙ্গে লাগসই প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং কৃষি ও মৎস্য বিষয়ক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথাপ্রযুক্তিকে কাজে লাগানো গেলে শুধু ধান ও মৎস্য খাত থেকেই দেশের মোট খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ মেটানো সম্ভব হতে পারে। গবাদিপশুর উন্নয়নসহ কৃষিজ ও প্রাণিজ সম্পদের ব্যাপক পরিধির দৃশ্য ও অদৃশ্যমান সমস্ত খাত থেকেই জাতীয় সার্বিক উন্নয়নে সরকারি যেকোনো ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে ব্যয়ের তুলনায় আয়ের বিস্তর সুযোগ রয়েছে এখানে।

কিন্তু হাওর জনপদটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ন্যায় এখনও পশ্চাৎপদ ও তুলনামূলক সুবিধাবঞ্চিত।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

আপনার সমীপে হাওর অঞ্চল রক্ষা ও হাওরবাসীর সার্বিক উন্নয়নে বেশকিছু প্রস্তাবনা নিচে তুলে ধরা হলো:

১. দুর্যোগ মোকাবেলা, হাওর রক্ষা ও হাওরের মানুষের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে জাতীয় পর্যায়ে ‘হাওর উন্নয়ন বোর্ড’ পুনরুজ্জীবিত করে হাওরবাসীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় বিশেষ বিবেচনায় এনে বিশেষ কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করতে পৃথক ‘হাওর মন্ত্রণালয়’ গঠন করা অতীব জরুরি।

২. সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের জ্যেষ্ঠপুত্র চারবারের নির্বাচিত এমপি, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং বাংলাদেশ কৃষক লীগের উপদেষ্টা রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিককে মন্ত্রীত্ব দেওয়া।

৩. একটি জাতীয় সুবিন্যস্ত হাওর উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা। এর মাধ্যমে হাওরের মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নকে এগিয়ে নেওয়া যাবে।

৪. নদীর নাব্যতা ও গতিশীলতা আনতে এবং অকাল বন্যা নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরিকল্পনা নিয়ে সরকারি শতবর্ষ মেয়াদি ডেল্টা পরিকল্পনায় আওতায় এনে মিঠাপানির উৎস ভরাট নদী, ডোবানালা, খাল-বিল-ঝিল, হাওর-বাঁওড়, কোড়, পুকুর, দীঘি, জলাশয় ও জলমহাল পুনঃখনন করা।

৫. বাঁধ-বেড়িবাঁধ, জলাধার, স্লুইসগেট, রেগুলেটর ব্যারেজ ইত্যাদি নির্মাণ করা।

৬. নদী সোজাকরণ (লুপকাট) অপরিহার্য। এক্ষেত্রে ড্রেজিং এর মাটি দিয়ে বর্ষার ভাঙনে বিলীন হয়ে যাওয়া বা বিধ্বস্ত গ্রামগুলো ভরাট ও গৃহনির্মাণ করে পুনর্বাসনের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।

৭. হাওরাঞ্চলে প্রাকৃতিক বিভিন্ন দুর্যোগ তথা আফালের ফলে সৃষ্ট ভূমিক্ষয়রোধ ও ভূমি পুনরুদ্ধারের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।

৮. সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে হাওরের ভূমিক্ষয় ও ভাঙনরোধে তথা নদীর তীরবর্তী গ্রাম, নদী ভাঙন ও বর্ষার উত্তাল ঢেউ-বাণ বা আফাল থেকে স্থায়ী সুরক্ষার জন্য ক্ষেত্রবিশেষে রিটেইনিং ওয়াল ও পাইলিং রিটেইনিং ওয়াল দেওয়া।

৯. হাওরের প্রতিটি গ্রাম ও পাড়ায় ড্রেজারের মাটি ফেলে প্রশস্ত করে পাকা প্রতিরক্ষা দেয়াল তৈরি করা। এতে বারো মাসই বাণিজ্যিক ও পারিবারিক উদ্যান ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

১০. পরিকল্পিত উদ্যোগের মাধ্যমে শহরের সঙ্গে হাওরের ‘অদিন-সুদিন’ বারো মাসই নৌ ও সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করা। এতে বিভিন্ন খামার, কুটির শিল্প ও শিল্পকারখানা স্থাপন, কৃষি উন্নয়ন, শিল্প উন্নয়ন, কৃষি ও শিল্পজাত পণ্যসামগ্রী বাজারজাতকরণ, যাতায়াত ও পরিবহন, বনজ সম্পদের সংগ্রহ ইত্যাদি ত্বরান্বিত হবে এবং নতুন নতুন ব্যবসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠাসহ ভারত ও ভুটানের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু অধিক বেগবান হবে।

১১. হাওরাঞ্চলে দুটি কৃষি পরিবেশ অঞ্চল নির্ধারণ করা এবং সমবায় আন্দোলন গড়ে তোলা। এ সমবায়ের মাধ্যমে কৃষি-উন্নয়ন, কুটির শিল্প স্থাপন, ব্যবসা-বাণিজ্যের নানা সুযোগ সৃষ্টি করা।

১২. কৃষি ও মৎস্য ক্ষেত্রের আধুনিকায়নে হাওরাঞ্চলের ভূমিব্যবস্থাপনা এবং কৃষি ও মৎস্যনীতি ঘোষণা করা। তাছাড়া আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তি-যন্ত্রপাতির ব্যবহার সুলভ ও সম্প্রসারিত করা।

১৩. কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা।

১৪. ব্যাপক পরিমাণে হাওরে সরকারি খাদ্যগুদামে প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে বোরো ধান সংগ্রহ করা।

১৫. ‘কৃষিবীমা’ চাল করা এবং বর্ষাশেষে কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে কিংবা স্বল্পমূল্যে কৃষি উপকরণ ও পর্যাপ্ত কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করা।

১৬. মৎস্য উৎপাদন টেকসই করতে নতুন উদ্যোক্তাদের কমসুদে ঋণ দেওয়া।

১৭. অধিক উৎপাদনের লক্ষ্যে হাওরসহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল ধানবীজ ও শস্যের এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন করা।

১৮. প্রতিটি গ্রামে ও পাড়ায় এবং সেচ প্রকল্পে শতভাগ বিদ্যুতায়ন করা। এতে সেচ খরচ কমবে এবং হাওরবাসী আধুনিক জীবন পাবে।

১৯. হাওর ও ফসলি মাঠ থেকে পানি নিষ্কাশন এবং জলাবদ্ধতা দূরীকরণে পর্যাপ্ত স্লুইসগেট ও কালভার্ট নির্মাণ করা।

২০. কৃষকের কাটা ধান ও শস্য-পণ্যসামগ্রী পরিবহনকল্পে ফসলি মাঠাভ্যন্তর দিয়ে পাকা রাস্তা তৈরি করা।

২১. বন্যাকবলিত ধানের পচনরোধে হাওরের বিভিন্ন উঁচুস্থানে পাকা মাড়াইকেন্দ্র তৈরি করা এবং ধান শুকানো ও উড়ানোর স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি স্থাপন করা- যাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মুহুর্তে অনায়াসে ধান তোলা যায়।

২২. আবাদী জমির পাশাপাশি সমস্ত অনাবাদী জমিকে আবাদের আওতায় আনা এবং সবজি ফসলে গুরুত্ব দিয়ে এক ফসলি হাওরাঞ্চলকে বহুমুখী উৎপাদনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। এতে দেশের মোট খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ মেটানো সম্ভব হতে পারে।

২৩. হাওরাঞ্চলের জলমহালগুলোর লীজব্যবস্থা বাতিল করে প্রভাবশালী ওয়াটার-লর্ডদের বা ইজারাদারদের কব্জামুক্ত করে প্রকৃত জেলে ও সাধারণদের মাঝে উম্মুক্তভাবে ছেড়ে দেওয়া। এক্ষেত্রে উপজেলাগুলোর মৎস্য বিভাগ নদী, জলমহাল ও জলাশয়গুলো এবং বর্ষাকালে হাওরের বিশাল জলরাশিতে মাছের পোনা ছাড়ার পদক্ষেপ নেওয়া। এতে মৎস্য মজুদ ও উৎপাদন বাড়াতে ফলদায়ক হবে।

২৪. ব্যক্তি উদ্যোগে হাওর, পুকুর, দীঘি, বিল-ঝিল, কোড় তথা জলাশয়ে মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করা। এতে দেশের আমিষ চাহিদা মিটিয়ে রফতানি করার দ্বার অবারিত হবে। ফলে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে।

২৫. বিশ্বব্যাংকের আইডিএ ঋণ সহায়তায় উপকূলীয় অঞ্চলে গৃহীত ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরীন ফিশারীজ প্রজেক্ট’ – এর ন্যায় ব্লু-ইকোনমির সুফল পেতে হাওরাঞ্চলেও একটি পৃথক মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা।

২৬. আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে কার্যকরী ব্যাপক ‘ওয়ার্কস প্রোগ্রাম’ চালু করা।

২৭. শক্তিশালী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হাওরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতীয় আয় বণ্টনের ব্যবস্থা করা।

২৮. আন্তঃযোগাযোগের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে হাওরবাসীদের অংশীদার করা। তাছাড়া অধিক ফসল ফলানোর লক্ষ্যে লাগসই প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং কৃষি বিষয়ক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলার কৌশলের সঙ্গে কৃষকদের পরিচিত করার প্রয়াস নেওয়া।

২৯. বেসরকারি ছাড়াও চাষীদের মাধ্যমে সমন্বিত ধান খেতে মাছ চাষ প্রযুক্তি জনপ্রিয় করে তোলার উদ্যোগ নেওয়া।

৩০. কৃষি বনায়ন ও সামাজিক বনায়নসহ হাওরে বনায়নের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে তা কার্যকর করা।

৩১. এরিয়াল সার্ভেভিত্তিক কৃষি ফসল উৎপাদনে শস্যক্রম ও শস্য আবর্তন এবং ফলদ বৃক্ষরোপণ এলাকা নির্ধারণ করে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।

৩২. ওয়ার্ড শুধু নয়, গ্রাম পর্যায়ে বন্যাশ্রয় কেন্দ্র এবং অডুবন্ত কবরস্থান নির্মাণ করা।

৩৩. হাওরাঞ্চলে তেল, গ্যাস, কয়লা, পাথর, শামুক-ঝিনুকের মুক্তোসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের সন্ধানপূর্বক এর যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করা।

৩৪. হাওরে পানি দূষণরোধে ও জ্বালানি সংকট নিরসনে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করা।

৩৫. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ন্যায় হাওরাঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান, পরিবেশ ও জলবায়ু, শিক্ষা, কৃষি, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, জীবন-জীবিকা, সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি বর্ণনা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা।

৩৬. কয়েকবছর মেয়াদি বিশেষ ‘কৃষি সারচার্য’ চালু করা। যা কৃষিতে বিভিন্ন স্থায়ী উন্নয়নমুখী কার্যক্রমে ব্যয় করতে হবে।

৩৭. কৃষি অফিস উপজেলা সদর থেকে সম্প্রসারণপূর্বক প্রতি উপজেলাকে বেশ কয়েকটি অঞ্চল ও উপ-অঞ্চলে বিভক্ত করা। দুর্বল উৎপাদনশীল এলাকাগুলো উপ-অঞ্চল হবে। প্রতিটি অঞ্চলে গরু-ছাগল ও পোল্ট্রির সরকারি খামার গড়ে তোলা। যা খাদ্যের নিরাপত্তার অংশ বাড়াবে এবং জৈব কৃষিকে এগিয়ে নেবে।

৩৮. হাওরাঞ্চলে কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ করা।

৩৯. হাওরাঞ্চলের সমাজ কাঠামোর সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় করে উৎপাদনমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা। বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিসহ কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার পথ উম্মুক্ত করে পর্যাপ্ত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা।

৪০. হাওরাঞ্চলে বিদ্যমান ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংরক্ষণ ও পর্যটন শিল্প হিসেবে গড়ে তোলা। এতে পর্যটকেরা শুধু সমুদ্র সৈকতে নয়, রূপসী হাওরবাংলার নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করতে এ অঞ্চলেও ছুটে আসবে। আসছেও। ফলে সৃষ্টি হবে রাজস্ব আয়ের নতুন খাত।

৪১. হাওরাঞ্চল রক্ষা এবং হাওরের মানুষের জীবনমান ও ভাগ্যোন্নয়নে ‘ন্যাশনাল হাওর অ্যালায়েন্স’ নামীয় একটি জাতীয় প্লাটফর্ম গড়ে তোলা। এতে সমমনা উন্নয়ন সহযোগী আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ের উন্নয়ন সংগঠন, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, গবেষক, সাংবাদিক, উদ্যোক্তা, নারী ও কৃষক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত হবে এই জোট।

৪২. প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহার দেশের হাওরাঞ্চল রক্ষা ও অধিকার বঞ্চিত হাওরবাসীর ভাগ্যোন্নয়নে সঠিক দিক নির্দেশনা থাকা আবশ্যক।

৪৩. হাওরে জলবায়ু সহিষ্ণু জীবিকার সহায়তা ও বিপণন ব্যবস্থা উন্নয়নের মাধ্যমে অভিযোজন সক্ষমতা গড়ে তোলার সরকারি উদ্যোগ নেওয়া।

৪৪. উপকূলীয় অঞ্চলে নদী-শাসনের মাধ্যমে বন্যা প্রতিরোধের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ‘ফ্যাপ’ (ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান) প্রকল্পের ন্যায় হাওরাঞ্চলেও গ্রহণ করা।

৪৫. চাকরিতে হাওরকোটা বরাদ্দ এবং হাওরভাতা ও ঝুঁকিভাতা চালু করা। এক্ষেত্রে ইতোমধ্যে ১৬টি উপজেলায় হাওরভাতা সরকারিভাবে চালু করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধুবাদপ্রাপ্য। কিন্তু এতে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকেরা বঞ্চিত রয়ে গেছেন। তাদেরকেও এর আওতায় আনা।

৪৬. হাওরাঞ্চল দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল বলে সরকার কর্তৃক জাতিসংঘের মানবিক বিষয়সংক্রান্ত বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

৪৭. হাওরাঞ্চলের সমস্যা, রক্ষা ও উন্নয়নে বহুল প্রচারে গণমাধ্যম ও গৌণ গণমাধ্যমের এগিয়ে আসা খুব জরুরি। এক্ষেত্রে বিশেষ প্রতিবেদন ও নিবন্ধ প্রকাশসহ টিভিতে ‘হাওর রক্ষা ও উন্নয়নে গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা যেতে পারে।

৪৮. হাওরাঞ্চলকে তার নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়েই বাঁচতে দেওয়া অত্যাবশ্যক।

উল্লেখ্য, প্রতিবছর শুধু লাখ লাখ মেট্রিক টন বিনষ্ট হয়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ ও ফসলহানি এবং নদী আর হাওরের প্রলয়ঙ্করী ঢেউয়ে গ্রামের পর গ্রাম ভাঙন কেবল নয়; যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থানের ক্ষেত্রেও হাওরবাসী পিছিয়ে ও উপেক্ষিত।

দেশ আজ অবস্থান করছে তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগ ও উন্নয়নের মহাসড়কে। দৃশ্যমান এই উন্নয়নের ঢেউ হাওরাঞ্চলেও বইছে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট, সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়

সারাবাংলা/এসবিডিই

প্রধানমন্ত্রীর প্রতি খোলা চিঠি: হাওরবাসীর ভাগ্যোন্নয়নে সহায় হোন মত-দ্বিমত রফিকুল ইসলাম

বিজ্ঞাপন

বিদেশ বিভুঁই। ছবিনামা-১
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:০০

আরো

সম্পর্কিত খবর